শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় - বন্ধুত্বের দিনগুলো : পর্ব ৩

জহিরুল সিদ্দিকী এর ছবি
লিখেছেন জহিরুল সিদ্দিকী [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ০৩/১২/২০০৮ - ৭:০৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(আগের পর্বগুলো: শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়-বন্ধুত্বের দিনগুলো:পর্ব ১/বন্ধুত্বের দিনগুলো:পর্ব ২)

এক
কিছু কিছু জিনিশ আছে বারবার দেখার পরেও দেখার সাধ পূরণ হয় না। নাম শুনলেই কেমন জানি একটা মন-উতালপাতাল ভাব শুরু হয়। নস্টালজিয়ায় ঘিরে ধরে। আবার দেখতে ইচ্ছে হয়। চাবাগানের সৌন্দর্য্য কারণে-অকারণে আমাকে বারবার টানে। মুগ্ধ করে। আনন্দ দেয়। আন্দোলিত করে। এই সখ্যতা আমার অনেক ছোটবেলা থেকেই। যখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি, স্কুল পালিয়ে পাড়ার লাইব্রেরীতে সমরেশ শীর্যেন্দু পড়তাম সেই সময় থেকে। এমদাদ প্লেন করলো এবার সবাইকে নিয়ে শমসেরনগর যাবে। তার বাবা শমসেরনগর চাবাগানে চাকরি করেন। মা-বাবা-বোন ওখানেই থাকেন। গত একমাসে পত্রিকা নিয়ে থাকায় যাওয়া হয়নি। তাকে না দেখে তার মা বেশীদিন থাকতে পরেন না। ইউনির প্রথম দিকে এই অতিভালোবাসায় শিকার হয়ে বেচারা এমদাদকে প্রতি সপ্তাহে একবার সিলেট-শমসেরনগর করতে হতো। তাও এখন ১৫ দিনে বা মাসে একবার করতে হয়। তবে এইবার মা-ছেলের সাক্ষাতের চেয়ে টাকার প্রয়োজনটাই বেশী । তার হাতে কোনো টাকা নেই।

শমসেরনগর যাওয়াটা অবশ্য তেমন কোন কষ্টকর ট্রাভেল না। ঢাকাগামী পারাবত, জয়ন্তিকা, উপবনে উঠে বসলেই মাইজগাঁও স্টেশান। বিনাটিকিটে জার্নি। টিটি ধরলে উল্টো ভাব ধরে বলা, টিকিট করিনি সাস্টে পড়ি। তেমন কোনো ঝামেলা হয় না। টিটি আইকার মতো পেছনে লাগার আগেই মাইজগাঁও স্টেশান এসে যায়। সিলেট হতে মাত্র ৩০ মিনিটের দুরত্ব। সেখান থেকে মুড়িরটিন বাস ধরে শমসেরনগর। লক্কর ঝক্কর বাস। হেলেদুলে চলে। ধুলো উড়িয়ে, মাইলে ৪/৫ বার থেমে থেমে, নামকরণের সার্থকতা সফল করে। ভাবটা যেন, বাবা তোমাদের যদি এতোই তাড়া থাকে তাইলে আমায় উঠেছো ক্যান? অন্যপথে যাইতা। আমি তো তোমাদের জোড় করে তুলিনি। উঠেছো যখন তখন আমার মাতলামিতো সহ্য করে রয়ে সয়েই যেতে হবে। অবশ্য পারাবত অথবা জয়ন্তিকা অথবা উপবনে আর মুড়িরটিন মাতলামিপর্ব ছাড়াও সিলেট-শমসনগর করার আরেকটি সহজ অপশন আছে। সিলেট থেকে লোকাল ট্রেনে সরাসরি শমসেরনগর স্টেশান যাওয়া যায়।

আমরা দলবেধে শমসেরনগর রওয়ানা দিলাম। ইউনি বন্ধ। নামকরণ আন্দোলন চলছে। বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ বিশিষ্ট বাঙালীদের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ভবনের নামকরণ করেছেন। সিন্ডিকেটে সেটা পাশ হয়েও এসেছে। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জি সি দেব এমনসব মহান ব্যক্তিদের নামে নামকরণ হয়েছে। আমরা সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা খুশী হলাম। কিন্তু ইসলামী মৌলবাদী এবং তাদের বাচ্চারা সেটা সহ্য করতে পারেনি। তারা শহীদ রুমির মাকে সিলেটে চায় না। কিছু স্বার্থান্বেষী পলিটিশিয়ান তাদের সাথে যোগ দিলো। নামকরণের প্রতিবাদ করলো। বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষও নামকরণ করেই ছাড়বে। শেষমেষ বিএনপিও মৌলবাদী এবং তাদের বাচ্চাদের সাথে জড়ো হলো। দ্বন্ধ আরো জটিল হতে থাকলো। সেই দ্বন্ধে আমাদের মতো হাজার হাজার সাধারণ ছেলে মেয়ে তখন আট মাস বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে ছিলাম।

আমার কোচিং এবং টিউশানী অবশ্য সেমসয়টায় বন্ধ না। কিন্তু ব্যাপার না। সবাই যাচ্ছে আর আমি যাবো না, তাতো হয় না। একটা উৎসব উৎসব ভাব নিয়ে বের হলাম। পারাবতে যথারীতি মাইজগাঁও নামলাম এবং মুড়িরটিন ধরলাম। সালামটা পারেও বটে। কিভাবে যেন বাসের হেল্পারকে পটিয়ে কয়েকটা পাতার বিড়ি জোগাড় করে ফেলল। নাসিরুদ্দিন বিড়ি। ব্লেকে পাওয়া যায়। ২৫ টার প্যাকেট ৫ টাকায়। এই জিনিশ খাওয়াটা কিন্তু জটিল একটা কাজ। অনেক উস্তাদি লাগে। মিনিটে অন্তত একবার টানতে হয়। বিশ্রি গন্ধ বেড়োয়। অবশ্য গন্ধওয়ালা এই বিড়ি দিয়েই ক্লাস এইটে পড়ার সময় বিড়ি খাওয়ার তালিম নিয়েছিলাম। আমার এক তালতোভাই এর কাছ থেকে। কৃষক মানুষ। ওদের কাছে এই বিড়ি অমৃতের মতো। তো আমারা মনের আনন্দে বিড়ি খেয়ে যাচ্ছি। বাসভর্তি মানুষ দেখছে। দিনমজুর টাইপের কিছু মানুষ বাক্স-ঝোলা সহ কোথাও যাচ্ছিলো। সাথে বোরখা পরিহিত রমণীরাও ছিলো। বাস থেকে নেমেই খেয়াল করলাম মুখ আর কাপড়-চোপড় থেকে বিড়ির গন্ধ ছড়াচ্ছে। একেকজন যেন নাসিরুদ্দিন বিড়ির একেকটা জীবন্ত ফ্যাক্টরী । চাবাগানের টিউবওয়েলে অনেকক্ষণ ধরে হাত-মুখ ধুলাম। ওয়াক ওয়াক করলাম। গন্ধ যেন আরো বাড়ছিলো। মনে হচ্ছিলো, বিড়িরগন্ধওয়ালা সাবান দিয়ে এইমাত্র যেন আমরা গোসল করে এসেছি। মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। এমদাদ সালামকে বকতে থাকলো। দূর মিয়া তুমি আর মানুষ হইলা না, কই থাইক্যা যে এইসব জোগাড় করো। তোমারে মিয়া পিএল দেওয়া উচিত। সালাম সাথে সাথে মাথাটা মাটির দিকে নিচু করে পাছাটা আকাশের দিকে তোলে বলল, জ্বি দেন। আফটার অল আপনার বাড়ি যাচ্ছি। আপনাকে খুশী রাখতে হবে, নইলে নাখাইয়ে রাখার সম্ভাবনা আছে।

এখানকার চাবাগান গুলো অন্যরকম সুন্দর। পাহাড়ের গায়ে স্তরে স্তরে সাজানো। নতুন কুঁড়ি এসেছিলো তখন। চারদিকে সবুজ আর সবুজ। বড়ো বড়ো ছায়াগাছ। ঠিক মাঝদিয়ে চাবাগানকে দুইফালি করে চলেছে ঢাকা-সিলেট রেলেররাস্তা। রাস্তার ওপাড়ে চাকুলিদের বস্তি। কুলিবস্তি থেকে অনেকটা দূরে, রেলের এপাড়ে এমদাদের বাড়ি। ওখানে অনেকগুলো পরিবার থাকে। সবাই চাবাগানের কমর্চারী। কেউবা ফ্যাক্টরির কেউবা বাগানের। ছোট একটি হাসপাতাল। একটি এম্বুলেন্সও আছে ।

প্রতিটা বাড়ির সামনে একটা মোটা লাইলনের রশি। শাড়ি লুঙ্গি পেটিকোট গামছা হাফপেন্ট শার্ট ঝুলছে। ঝটকা হাওয়ায় পতপত করছে। বাচ্চাদের অনেকগুলো তেনাকাপড়ও আছে। কেউ হয়ত কদিন আগেই মা হয়েছেন। এমদাদের মা-বাবা-বোনের সাথে আমাদের পরিচয় হলো। খুব সহজ সরল সাধারণ একটা পরিবার। সরলতা আর নিমর্লতায় একেকজন অনন্য। এমদাদের ঠিক ফটোকপি।

পলাশ বলল কি শামিম ভাই, চাবাগান দ্যাখতে এসে এখানে ঝিমানোর মানেটা কি? পলাশকে ক্ষেপানোর জন্য ইমদাদ আস্তে আস্তে বলল পলাশদা, ঝিমধরে তো আপনিই বসে আছেন। আমরাতো কবে থেকেই বেরুবো বেরুবো করছি। পলাশ বলল ফাজলামু করোনা, আমি রেডি। চলো, বাগানে চলো। সালামকে পাওয়া যাচ্ছে না। লাপাত্তা । এমদাদ বললো আসার পর থেকেই নাকি ওকে সে দেখতেছে না। আমরা যা বুঝার বুঝলাম, ফুয়েল সংগ্রহে বেরিয়েছে। সিগারেট ছাড়া ও বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। তখনও বিকেল হয়নি। মাথাধরা রোদ পড়ছিলো। ঝিমধরা দুপুর । প্রচন্ড গরম। ঘন্টাখানেকের মাঝেই সালামের দেখা মিলল। কয়েকটা কোকের বোতল হাতে চাবাগান ফুঁড়ে যেন হঠাৎ উদয় হলো। চা বাগানজুড়ে ছোট ছোট পথ। জালের মতো। পথধরে হাটলে বুঝা যায় চাগাছগুলো মাথাউচ্চতার সমান। সেইসব পথধরে অনেক্ষণ হাটলাম। এমদাদের বাবা সাপের উৎপাতের কথা আমাদের বলে দিয়েছিলেন। আমরা খুব সাবধাণে একটা টিলার চুড়ায় দিকে এগুচ্ছিলাম। সবার হাতে আবার একটি করে লাঠিও ছিলো। গাছের ডালের। ভাবটা এমন যেন হিলারী তেনজিং এর মতো পৃথিবীর আরেকটি চুড়া জয় করতে চলেছি। কোনো সাপের দেখা আমরা পাইনি। তবে মনে ভয়টা ছিলো। এমদাদ বলল সাপ হুদাই কেন আপনাকে ছোবল দিতে আসবে। জান বাচাঁতেই সাপ ছোবল দেয়। টিলার ঐ পাশটা থেকে রেলরাস্তারটাকে একটা জলনালার শরীরের মতো লাগছিলো। মরীচিকা। তেজী সূর্যের আলো স্লিপারের উপর প্রতিবিম্বিত হয়ে এমনটা হয়েছিলো। চারদিকে সবুজ আর সবুজ। মনমাতানো সৌন্দর্য্য । অনেক দূরে চাশ্রমিকেরা চাপাতা তুলছে। পলাশ কবিতার কথা, কবির কথা বললো। কবিতার কথা বলতে বসলেই পলাশের চোখ ঝিকমিক করে উঠে। সেদিনো হলো। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওর কথা শুনছিলাম। এমদাদ কি জানি একটা গল্প পড়েলো। শাহাদুজ্জামানের একটা গল্প। ইমদাদ কয়েকটা কবিতা পড়লো। সম্ভবত জীবনানন্দ দাশ এর কবিতা থেকে। তার নিজের কবিতাও পড়লো কয়েকটা। কবিতা গল্প আর চাবাগানের ঝিমধরা সৌন্দর্য্যে মাতাল হয়ে সিগারেটের শেষফিল্টারটি পালাক্রমে টানতে টানতে আমরা চুড়া থেকে নামলাম।

এই ছোট্ট টিলাপাড়াটিতে আশ্চর্যরকম সুন্দর একটা পুকুর আছে। পলাশ আবার সাঁতার জানতো না। সে কি ভয়! পুকুরের পানিতে পা লাগিয়েই আগুণে ছেঁকা খাওয়ার মতো ছিটকে দূরে সরে গেলো। এখন আর সালামকে কে থামায়? এতোদিন পর পলাশকে কাবু করার একটা (কুট !) কৌশল পেয়েছে। জোরকরে এনে পানিতে নামালো। সাঁতার শেখাবে বলে। আমরা মেতে উঠলাম পলাশকে নিয়ে। বেশীদূর করতে পারলাম না। বেচারার ভয়ার্থ চোখমুখ দেখে আমাদেরই ভয় লেগে গেলো। ঐ পুকুরে আবার জোঁকের ভয়ও ছিলো। আমি আবার জোঁক ভয় পাই। ছোটবেলায় আমরা দলবেধে খালের উপরের বাঁশের সাঁকো থেকে বা ওয়াবদার অর্ধনির্মিত ব্রিজের উপর থেকে যেরকম লাফিয়ে পড়তাম, লাই খেলতাম, ডুব সাঁতারে প্রতিযোগিতা করতাম সেরকম মজা করলাম। চোখলালকরা গোসল করলাম।

সন্ধ্যার হতে না হতেই কুলিবস্তি হতে ঢাকঢোলের বেতাল শব্দ আসতে থাকলো। আমদের স্থির করলাম হাসপাতালের রোগীদের বেডে ঘুমাবো। সিগারেট আর আড্ডাবাজির সুবিধার্থে এই ব্যবস্থা করা হলো। সালামকে আবার খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না । কোথায় গেল কোথায় গেল করতে করতে জানা গেলো কুলিবস্তিতে সস্তা মদ আর গানের উৎসব দ্যাখতে গিয়েছে । ওখানে নাকি সন্ধ্যার পরেই ফ্রিতে ড্রামভর্তি বাংলা মদ দেওয়া হয়। গ্লাসভর্তি করে যতপার খাও। বড়ো গ্লাস, একগ্লাস খেলেই নাকি কাইত। কুলিরা খায়। বোধবুদ্ধি হারায়। নাচে। গায়। বুঝলাম এটা শোষণের উদার কৌশল। কুলিদের কুলিকরে রাখার সনাতন এবং বিশ্বস্ত একটা পদ্ধতি। পদ্ধতিটি এই যুগেও এখানে চলছে! বাবুরা এঁদের বোধবুদ্ধিহীনই রাখতে চায়। আধুনিক পৃথিবীর দূরে রাখতে চায়। এঁদের ভেতরে যে বেশামাল আগুণ। দপকরে জ্বলে উঠলেই উনাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে। ব্যবসায় লালবাত্তি জ্বলবে। কে চায় রিস্ক নিতে? ফ্রিতে মদ দাও। যত চায় তত দাও। খাক, টাল হোক। পরদিন সকালে টিলাবাবুরা লাঠিতে গুতিয়ে গুতিয়ে ঘুম ভাঙাক, হুইসেলের রুটিনে কাজে নিক, আবার সারাদিন খাটুক, সন্ধ্যায় খাক, টাল হোক। আমাদের মন খারাপ হলো।

দুই
মনু নদীর ভাঙন ফিবছর আমাদের প্লাবিত করে। পত্রিকার পাতা জুড়ে আকমল হোসেন নিপু লিখে চলেন মনুর ভাঙনের বর্ণনা, প্লাবণের বৃতান্ত। আমরা পড়ি। মন খারাপ করি। প্লাবিত হই। এই মনু তীরেই ইমদাদ বেড়ে উঠেছে। আমাদের এইবারের জার্নি বাই ট্রেন টু মনুতীর। ইমদাদের ফুফাতো ভাইয়ের বিয়ে, মনুর গতি প্লাবণ ভাঙন দেখতে এমন সুযোগ আমি, সালাম, পালাশ এমদাদ ছাড়লাম না।

একদুপুরে পারাবত ধরতে এসে, না পেয়ে, লোকাল ট্রেনে রওয়ানা দিলাম মনুতীরে। আমি ইমদাদ আবশ্য পারাবতে ঠিকই চলে যেতে পারতাম। যথাসময়েই আমরা স্টেশনে এসেছিলাম। পালাশ, সালাম আর এমদাদ গেলো সিগারেট কিনতে। আমাদের করো কাছে সিগারেট ছিলো না। পালাশ বলল ফুয়েল ছাড়া এতোগুলো মানুষ চলবো কিভাবে? আমি আর ইমদাদ ট্রেনের শেষ কামরার দরজাধরে ওদের অপেক্ষায় আছি। ইতিমধ্যে ট্রেন চলতে শুরু করলো। দেখলাম ওরাও চলে এসেছে। একদম কাছাকাছি। সেকেন্ড তিনেক দুরত্ব। তিন জনেই দৌড়াচ্ছে। ট্রেনও চলছে। গতি বাড়ছে। ওরাও দৌড়াচ্ছে। ট্রেন আর ওদের মাঝে দূরত্ব বাড়তে থাকলো। বুঝলাম ওদের পক্ষে ট্রেনে উঠা সম্ভব না। কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখি ইমদাদ লাফিয়ে প্লাটফর্মে নেমে পড়লো। শেষমেষ নিলাম রিস্ক। চোখবুঝে দিলাম বেঙলাফ। ঠেংঠুং সে যাত্রায় অবশ্য ভাঙেনি।

লোকাল ট্রেন। হ-য-ব-র-ল অবস্থা। নারী পুরুষ শিশু বাচ্চাশিশু চাওয়ালা পানওয়ালা চানাচুরওয়ালা সব একাকার। কেউ ঝুলছে। কেউ দুলছে। একটি শিশু প্রশ্রাব করে দিয়েছে। অনবরত এ্যাঁ এ্যাঁ করে যাচ্ছে আর সেই প্রশ্রাবে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বাবা মা পাশেই। বাপটা নির্বিকার। দ্বিতীয় বাচ্চাশিশুটিকে কোলে নিয়ে আয়েশে বিড়িটেনে যাচ্ছে। আমরা ঐপাশটার দখলনিলাম। আমাদেরকে অনেকেই আবার বেশসমীহের চোখেই দেখছে। জায়গা টায়গা দিচ্ছে। সালাম শুরু করলো সুরে বেসুরে ভুপেনের গান। ট্রেন শম্ভুকগতিতে একেকটা স্টেশনে যাচ্ছে আর আধঘন্টা থামছে। মাঝে মাঝে আবার ইন্টারসিটিকেও পাশ দিচ্ছে। যত স্টেশন সামনে আসছে ততই লোক বাড়ছে। কেউই নামছে না। শুধু উঠছে আর উঠছেই। পিনপিন মানুষ। দাড়ানোর জায়গা পযর্ন্ত নেই। চারপাশে মানুষ ঝুলে আছে। ট্রেনটি বাইরে থেকে দেখতে আমার ভীযণ ইচ্ছে হচ্ছিলো। নিশ্চয় এটি তখন আখেরী মোনাজাত শেষে তাবলীগজামাত ফেরৎ মানুষ বোঝাই ট্রেনের মতোই দেখাচ্ছিলো । একজন আবার কয়েকটা ছাগল নিয়েও উঠে বসেছিলো। যাক বাবা এক স্টেশান পরেই ছাগলবাহিনীর যাত্রাসমাপ্তি হয়েছিলো। ছাগল যেভাবে হাগামুতা শুরু করেছিলো, আরকিছুক্ষণ থাকলেই খবর ছিলো। ছাগলের ফেলে যাওয়া গন্ধ। মানুযের গন্ধ-ঘা । হাউখাও । বিড়ির ধোঁয় । বাচ্চাদের চিল্লাচিল্লি। বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা।

এক ইন্টারসিটিকে পাশদিতে গিয়ে বসেআছি, লোকজন তখন কিছুটা কেমেছে। কুলাউড়া ছাড়িয়ে এসেছি। সন্ধ্যা হবে হবে করছে। পলাশের মাথায় একটা কিছু খেলার আইডিয়া এলো, সিগারেট-সিগারেট খেলা। যদিও তা নতুন কোনো খেলা না। আমরা ক্যাম্পাসে অনেকবার এই খেলা খেলেছি। তবুও আমাদের আবার খেলতে ইচ্ছে হলো। আমরা পালাক্রমে একএককরে একটা সিগারেট টানবো,যার কাছে এসে সিগারেটের সোহাগা পরে যাবে সে নেক্সট স্টেশানে ১০টি গোল্ডলীফ কিনবে। শুরু হলো টানা পর্ব। একপাক শেষকরে সোহাগার আধিকত্যায় সিগারেট তার দ্বিতীয়পাক শুরু করলো। তখন তামাকের অজ্বালা অংশ সিগারেটের তলানিতে চলে এসেছে। সালামের কৌশলেই এমনটা হয়েছে। এমন লম্বা একটান দিয়েছে, এক টানেই প্রায় সিগারেটেই ৩০% সাবার করে সবাইকে রিস্কে ফেলে দিয়েছে। এখন একেকজনের হাতে যায় আর কম্পন বাড়তে থাকে। ইমদাদের হাতে গিয়েই সোহাগা পড়ে গেলো। আমরা একসাথে চিৎকার করে উঠলাম। আবার নতুন কিস্তি শুরু হলো। দেখলাম ট্রেনের অবশিষ্ট লোকেরাও বেশমজা পাচ্ছে। নড়েচড়ে বসেছে অনেকেই । হাসহাসি মুখকরে খেলায় মেতে উঠেছে। কেউ কেউ আমাদের সাথে সাথে এই পড়লো এই পড়লো করছে। প্রথমপাক ভালো মটই ঘুরলো। দ্বিতীয়পাক চলার সময় পলাশের হাত থেকে এমদাদের হাতে ট্রান্সপারের মুহূর্তে সোহাগা পড়ে গ্যালো। খেলা পরিত্যক্ত হলো। তৃতীয় কিস্তি শুরু করলাম। টানা চলছে; একপাক হয়েছে। দ্বিতীয়পাক হচ্ছে। এইবার আমার পালায় আসার মুহূর্তে বুঝলাম আবার ইমদাদের কপালেই পড়বে। কারণ আমি আস্তে করে কৌশলে একটান পার করে দিতে পারবো। কিন্তু ইমদাদ। আমার পরের তার পালা। আমি শিওর ছিলাম তার এখানে গিয়ে পড়বেই পড়বে। তাকে ২০টি সিগারেটের বোঝা দিতে ইচ্ছে হলো না। একটু জোড়েই টান দিলাম। সোহাগা পড়ে গ্যালো। আমি হারলাম।

মনু স্টেশানে পৌছলাম রাত ১২টারও কিছু পরে ভয়াবহ বিরক্তি ক্ষুধা আর ঘুটঘুটে অন্ধকার মাথায় নিয়ে। ইমদাদের বাবা আমাদের জন্য টর্চ হাতে অপেক্ষা করেছিলেন। তিনি মনু বাজারে ছোট একটা ব্যাবসা করেন। একটু বাউলা টাইপের মানুষ। ইমদাদের সাথে বন্ধুর মতো সম্পর্ক। ঘুটঘুটে অন্ধকার ছিড়ে বেড়িয়ে আসা আমাদের দিকে টর্চ মেরে বললেন, কিথা বেঠা ইমদাদ, এথো রাইত ওইলো খেনরে বা? আমি হেই নয়ডা থাইখ্যা ওফেখ্যা খরথাচি।

আমরা হাটছি মনুতীর ধরে। পানির তোড়ের শব্দকে যাপন করে করে। দূরে বাজারের একটা বিজলিবাতির প্রতিবিম্ব এসে পড়ছে চলমান স্রোতে। আতঁকে উঠার মতো তোড়।

প্রতুলের গান শুনতে শুনতে সেই গভীররাতে সবচেয়ে সুস্বাদু খাবার খেয়েছিলাম আমরা। দেশী মোরগ । সদ্যতোলা লাললাল আলুতে রেধেঁছিলেন ইমাদাদের মা। অনেক ঝাল হয়েছিলো। আমরা খাচ্ছিলাম। ইমদাদের বাবা আমাদেরকে বাতাস করতেছিলেন। কথা বলছিলেন সরল মনে। নিজের স্বপ্ন। খুব স্বপ্নবিলাসী মানুষ। এলাকার ভবিয্যৎ । সংসদ ইলেকশান। সুলতান মনসুর- এম এস শাহীন কিছুই বাদ যায়নি। কিছু কিছু দৃশ্য যেমন কখনোই হারাবার নয়, আমারা কাছে সেটা তেমনিই একটা দৃশ্য । এই দৃশ্যটা মাঝে মাঝেই আমাকে আনন্দ দেয়। গভীর রাতে এক কবিরবাবা তার ছেলের বন্ধুদের পরম যত্নে খাওয়াচ্ছেন। কথা বলছেন। স্বপ্ন বলছেন।

প্রলয়ঙ্কারী শব্দটার সাথে পরিচয় আমার জন্মসূত্রে। সুনামগঞ্জের ভাটির মানুষ আমি। ঝড় আর পানির সাথে লড়াই দেখতে দেখতেই বড়ো হয়েছি। মনুর স্রোত আর ভাঙনের এমনরূপ আমি আগে কখনোই দ্যাখেনি। বাজার বরাবর একটা বাঁশের পুল। খুটিগুলোর সাথে স্রোতের বিদ্রোহী ঘর্ষণে পুলটা থরথর করে কাঁপছে। আমরা সাকোঁর উপর দাঁড়িয়ে মনুর কীর্তিকলাপ দেখছি। চোখের সামনে যুবতী ধানক্ষেতের বিশাল বিশাল খন্ডাংশ ধপাস ধপাস করে মনুতে পড়ে যেতে দেখছি। অসম্ভব স্রোত। একটা নৌকা উজানথেকে স্রোতের অনুকূলে নামছে। মাঝি শুধু হাল ধরে বসে আছে। এতেই দ্যাখলাম সাই করে নৌকাটা আমাদের নীচ দিয়ে চলে গেলো।

জহিরুল সিদ্দিকী (শামিম)
২রা ডিসেম্ভর ২০০৮
মনাশ ইউনির (মেলবোর্ন, ভিক্টোরিয়া) রসারন বিভাগে ইলেকট্টোকেমেস্ট্রিতে গবেষণারত।

(পরের পর্ব: শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় - বন্ধুত্বের দিনগুলো: পর্ব ৪)


মন্তব্য

সন্দেশ এর ছবি

আপনার পর্ব ৪ একইসাথে অন্যত্র প্রকাশিত হয়েছে বলে প্রকাশ করা সম্ভব হল না [১]। এব্যাপারে আপনার সহযোগীতা কামনা করছি। ধন্যবাদ।

[১] নীতিমালা: http://www.sachalayatan.com/sachalayatan/17756

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।