ভাড়াটে

Sohel Lehos এর ছবি
লিখেছেন Sohel Lehos [অতিথি] (তারিখ: রবি, ১৩/০৫/২০১৮ - ৪:১০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

খোসা ফেলে দেয়া সেদ্ধ ডিমের মত সাদা চাঁদ ঝুলে ছিল দক্ষিণ-পশ্চিমের আকাশে। পূর্ণিমা বোধ হয় দিন দুয়েক আগে হয়ে গেছে। আলোয় তেমন জোর নেই। পিচিত করে রাস্তার ধারে পিক ফেলে জিবে চুন লাগায় বাতেন চেয়ারম্যান। রাতের খানা শেষে তার কিঞ্চিত হাঁটাহাঁটি করার অভ্যাস আছে। অন্য সময় হলে বন্দুক হাতে জয়নাল সাথে থাকত। আজ নেই। ছোট মেয়েকে নিয়ে সদর হাসপাতালে গেছে জয়নাল।

বাতেন চেয়ারম্যানের মন আজ বেশ অস্থির। হোসেনকে একটা কাজে পাঠিয়েছিলেন সিংহরাগী গ্রামে। সন্ধ্যার দিকে কাজটা হয়ে যাবার কথা। তার কোন খবর নেই। বোতাম টিপে মোবাইল ফোনে সময় দেখল সে। এগারোটা বেজে তিন মিনিট। হোসেনের মোবাইল বন্ধ। অপারেশনের সময় তার ফোন বন্ধ থাকে। তারপরও বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছে বাতেন। হোসেন ধরেনি।

“চুদিরপো……" বিড়বিড় করে কি যেন একটা গালি দিল বাতেন। ঠিক বোঝা গেল না।

হাটতে হাটতে হালটের ধারে চলে এসেছে বাতেন। হালটের পশ্চিম দিকে গোরস্থান। সেদিক থেকে শেয়ালের চেঁচামেচি ভেসে আসছিল। বছরের এসময়টাতে হালটে তেমন পানি থাকে না। পায়ের গোড়ালিও ডুববে কিনা সন্দেহ। পারাপারের জন্য বাশের সাঁকো আছে। হালট পার হয়ে অপর পারে আসতেই হাতের বাম দিকে বেশ ঘন বাঁশ ঝাড় পরে। শব্দ পেয়ে বাঁশ ঝাড়ের পাশে থেমে দাঁড়াল বাতেন।

“ঝাড়ের মধ্যে ক্যারা?” প্রশ্ন করে বাতেন। কোন উত্তর আসে না। তবে শব্দ বন্ধ হয়ে গেল।

“কথা কয় না ক্যান?” শেয়াল-টেয়াল হতে পারে। তারপরও নিজেকে সান্ত্বনা দেবার জন্য প্রশ্ন করে বাতেন।

“আমি হোসেন চেয়ারম্যান সাব।” হোসেনের ফ্যাসফ্যাসে গলা শোনা যায়।

“বাঁশ ঝাড়ে কি করস? কাম হইছে?”

হোসেন চুপ করে থাকে।

“কথা কস না ক্যান? কাম হইছে?” অধৈর্য হয়ে খেঁকিয়ে উঠে বাতেন।

সামাদ মাতবরকে খুন করার জন্য হোসেনের সাথে কন্ট্রাক্ট তার। ষাট হাজার টাকার বায়না। কাজ শেষে আরও চল্লিশ হাজার। এক লাখ টাকার কারবার।

ভাঙ্গা গলায় হোসেন বলে,"কাম হয় নাই চেয়ারম্যান সাব।”

“কাম হয় নাই? ফাইজালামি করস?”

আশেপাশের পাঁচ জেলার সবাই তাকে এক নামে চেনে। অমাবস্যার মত কালো গায়ের রং বলে তার নাম হয়েছে কাইল্লা হোসেন। খুনকে সে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। যারা এসব ব্যাপারে খবর রাখে তারা জানে হোসেন কথা দিয়ে কাজ করতে পারেনি এমন উদাহরণ বিরল।

“আমি ফাইজলামি করিনা চেয়ারম্যান সাব।”

“তাইলে?"

হোসেন স্বভাবমত চুপ করে থাকে। তাকে তাড়া দিয়ে লাভ নেই জানে বাতেন। দাঁত খিঁচে অপেক্ষা করে সে।

দীর্ঘ নীরবতার পর হোসেন ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে,” সামাদ মাতবর আমারে দুই লাখ দিছে।”

ঘাড়ের পেছন দিকটা অবশ হয়ে আসে বাতেনের। মুখে তেঁতো স্বাদ। জয়নালের মেয়ে অসুস্থ হবার আর দিন পেল না! হোসেন কি বলতে চায় সেটা বুঝে গেছে বাতেন। তারপরও ভয়টাকে পাত্তা না দিয়ে বাজখাই গলায় চেঁচিয়ে উঠে সে,”দুই লাখ দিছে মানে? কি কইতে চাস?”

হোসেন কথা বলে না। বাতেন অনুভব করল ঘামের একটা চিকন ধারা তার পিঠ বেয়ে নিচের দিকে নামা শুরু করেছে। এতক্ষণ বেশ আরামের ঝিরঝিরি একটা বাতাস হচ্ছিল। এখন সে বাতাস লাপাত্তা। বাতেনের মনে হল একটানে পৃথিবী থেকে সব বাতাস কেউ শুষে নিয়েছে।

“আমি কি কইতে চাই সেইটা আপনে ভাল কইরাই জানেন। বেয়াদপি নিয়েন না চেয়ারম্যান সাব। আমি ব্যাবসায়ী মানুষ।”

বাতেন কাঁপা গলায় বলে,”হোসেনরে আমি তোরে পাঁচ লাখ দিমু।”

“আমি একবারের বেশি দরদাম করি না চেয়ারম্যান সাব। সব ব্যাবসার নিয়ম কানুন থাকে। এইডা আমার নিয়ম।”

“বিশ লাখ হোসেন। বিশ লাখ। কাইল দুপুরের মইদ্দে পুরা ক্যাশ পাবি।”

বাঁশ ঝাড় থেকে বেরিয়ে এসেছে হোসেন। তার গায়ে কালো চাদর প্যাঁচানো ছিল। একটু নাড়া দিতেই চাদর খসে গেল। ভেতরে খালি গায়ে লুঙ্গি কাছা দেয়া ছিল তার। ডান হাতে ধরা তিন হাতের মত লম্বা পাতলা দাঁ। চাঁদের মৃদু আলোয় দাঁয়ের ধারালো অংশটা ঝিলিক দিয়ে উঠল।

বাতেন জানে দৌড় দিয়ে লাভ নেই। চিৎকার করতে গেলেও কোন ফায়দা হবেনা। মুহুর্তের মধ্যে তাকে ফালিফালি করে ফেলবে হোসেন। হতাশ গলায় বাতেন বলল,”বেশি সময় নিস না।”

“ওইডা নিয়া টেনশন কইরেন না চেয়ারম্যান সাব। এক মিনিটের খেল।”

ক্ষিপ্র গতিতে চেয়ারম্যানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল হোসেন। গোরস্থান থেকে চিৎকার করতে লাগলো অস্থির শেয়ালের দল।


মন্তব্য

সোহেল ইমাম এর ছবি

আমারে দুই লাখ দিছে।

এখানেইতো গল্পটার শেষ হয়ে যাবার কথা, অন্তত আপনি সাধারণত যেভাবে গল্প শেষ করেন। কিন্তু এটাও খারাপ লাগেনি। চলুক

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

Sohel Lehos এর ছবি

দেঁতো হাসি গল্প ওখানেই শেষ করা যেত কিন্তু কেন যে টেনেটুনে বড় করলাম নিজেও জানি না খাইছে

সোহেল লেহস
-------------------------------------------------------
এইটা কি লেখলেন ভাই! গল্পের ট্যুইস্ট দেইখা পেটে কেমন জানি একটু মোচড় দিল হাসি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

১। 'হালট' মানে খাল বা নালা নয়, হালট হচ্ছে মাটি দিয়ে উঁচু করা পায়েচলা পথ। হালটের পাশে হাঁটু সমান গভীরতার নালা থাকতে পারে, নাও পারে। হালটের উপরে সাঁকো বা সেতু থাকার কোন প্রশ্নই নেই। হালটকে কোথাও কোথাও 'গোপাট'ও বলা হয়ে থাকে।

২। যার চলাফেরা করার জন্য বন্দুকধারী দেহরক্ষী লাগে সে কোন অবস্থাতে একা একা কৃষ্ণপক্ষের রাতে অন্ধকার বাঁশঝাড় বা গোরস্থানের কাছে যাবার কথা না। এখানে কার্যকারণ নির্মাণ বিশ্বাসযোগ্য হয়নি।

৩। ভাড়াটে খুনী কাইল্লা হোসেন সামাদ মাতবরকে খুন করার জন্য বাতেন চেয়ারম্যানের কাছ থেকে ষাট হাজার টাকা আগাম নিয়েও সামাদের সাথে রফা করে দুই লাখ টাকা নিয়েছে। অর্থাৎ হোসেন 'লক্ষ্য ব্যক্তি'র সাথে দরাদরি করতে অভ্যস্থ এবং এটা তার 'নিয়ম'। সুতরাং বাতেনের পালটা পাঁচ/বিশ লাখের প্রস্তাবে তার রাজী হবারই কথা, কারণ এটা তার 'নিয়ম'-এর মধ্যে পড়ছে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

Sohel Lehos এর ছবি

১) আমার গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইল। সেখানে গভীর নালাকে হালট বলতে শুনেছি। বাড়ির পাশেই নদী থেকে মানুষে কাটা মাইল খানেকের মত দীর্ঘ একটা খাল আছে। সবাই তাকে হালট বলে। অবশ্য গল্পে আঞ্চলিক ভাষা ব্যাবহার না করলেই বোধহয় ভাল হত।

২। চেয়ারম্যানের বাড়ির পাশেই বাঁশঝাড়। গোরস্থানও তার সামনেই। বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে রাস্তা গেছে। রাস্তার ওপাশে ফসলের ক্ষেত। তার একপাশেই গোরস্থান। আমার গ্রামের বাড়ির সামনের দৃশ্য। সেটাই বর্ণনা করেছি। সেখানে রাতে হাটাহাটি করা যেতে পারে। কারণ মূল বাড়ি থেকে তা খুব বেশি দূরে নয়। তাছাড়া চেয়ারম্যান সামাদ মাতঁবরকে খুন করার জন্য কাইল্লা হোসেনকে পাঠিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই সে উত্তেজিত। হাটাহাটি করে উত্তেজনা কমানোর জন্য বাড়ির সামনের রাস্তায় এসেছিল সে।

৩। গল্পে সে বলেছে দরদাম সে একবারই করে। দ্বিতীয়বার করে না। কাইল্লা হোসেনের যে কি খেয়াল সেই জানে।

আপনার পাঠ প্রতিক্রিয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ হাসি

সোহেল লেহস
-------------------------------------------------------
এইটা কি লেখলেন ভাই! গল্পের ট্যুইস্ট দেইখা পেটে কেমন জানি একটু মোচড় দিল হাসি

সোহেল ইমাম এর ছবি

খুন করে পরদিন দুপুরে এলে এমন হতেই পারে বাতেন চেয়ারম্যান তাকে পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দিতে পারে অথবা নিজের লোক দিয়ে খুনিকে খুন করাতেও পারে। এই ঝুঁকিটা খুব বেশি ঝুকি হয়ে যায়,বিশলাখের লোভের চেয়েও এখানে ঝুঁকি বেশি। অভিজ্ঞ খুনি এই প্রস্তাব স্বভাবতই নেবেনা। এই জন্যই কাইল্লা হোসেন দু’বারই তাই দরাদরি করে। সম্ভবত কাইল্লা হোসেন এর আগে এরকম তৃতীয় প্রস্তাবে অন্য খুনিদের বিপদে পড়তে দেখেছে অথবা নিজেও লোভে পড়ে তৃতীয় প্রস্তাব নিতে গিয়ে বিপদে পড়েছিলো কোন সময় তাই সে এটা এড়াতেই নীতিটা নিয়েছে এবং এটাই খুনি হিসেবে কাইল্লা হোসেনের খ্যাতির কারণ। কারণ আমরা দেখছি গল্পের মধ্যেই বলা হচ্ছে,

খুনকে সে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। যারা এসব ব্যাপারে খবর রাখে তারা জানে হোসেন কথা দিয়ে কাজ করতে পারেনি এমন উদাহরণ বিরল।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

অতিথি লেখক এর ছবি

কতগুলো অনুগল্প জমলো আপনার? মানে জানতে চাইছি কয় ফর্মা হতে যাচ্ছে?

---মোখলেস হোসেন

Sohel Lehos এর ছবি

হা হা হা, অণুগল্প এগুলো অনেক আগে লেখা। এখন শুধু একে একে দিচ্ছি এই আর কি। বই বের হতে অনেক দেরি। ভালো ভালো অণুগল্প যখন লেখতে পারব তখন আর কি হাসি

সোহেল লেহস
-------------------------------------------------------
এইটা কি লেখলেন ভাই! গল্পের ট্যুইস্ট দেইখা পেটে কেমন জানি একটু মোচড় দিল হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।