আলম বিশিষ্ট লেখক। তার কারবার অণুগল্প নিয়ে। হাজার তিনেক গল্পের জন্ম সে ইতিমধ্যে দিয়েছে। ফেসবুকের দেয়ালে এগুলো নিয়মিত পোষ্ট হয়। লাইক তেমন একটা পড়ে না। বরঞ্চ উল্টো ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে তার বন্ধুর সংখ্যা কমে যায়। ফ্রেন্ডলিস্টে আগে ছিল বত্রিশ জন। আজকে দেখা গেল উনত্রিশ। তিনজন সম্ভবত বিরক্ত হয়ে আনফ্রেন্ড করেছে। আলম দমে যাবার পাত্র নয়। তার সাধনা নিরলস।
কোন ব্লগেই তার লেখা ছাপা হয় না। ব্লগের সঞ্চালকদের মেসেজ পাঠাতে পাঠাতে তার আঙ্গুলের ছাল উঠে গেছে। সেখানে জ্বালা পোড়া করে। ভেসলিন লাগিয়ে রাখতে হয়। আলম বুঝে না তার “আলোকিত বিভীষিকা” কিংবা “দানবের ভালবাসা” এর মত তুখোড় অণুগল্প কি করে সাহিত্য ব্লগ গুলতে স্থান পায় না। জীবদ্দশায় সত্যিকারের জিনিয়াসরা কখনই মূল্য পান না। আলমের আফসোস।
তবে তার অণুগল্প সাধনায় কোন ভাটা পড়েনি। সে বিরামহীন দিস্তা দিস্তা গল্প লিখে যায়। কম্পিউটারে টাইপ করে গল্প লিখে আরাম নেই। তাকে কাগজ কলম ব্যাবহার করতে হয়। পরে সেখান থেকে কম্পিউটারে উঠাতে হয়। আলাদা কষ্ট। কিন্তু কথায় বলে কষ্ট না করলে কেষ্ট নেই। আলমের ইকনো বলপেনের কালি ফুরাতে থাকে।
যাহোক সোমবার দুপুরে ঘুম থেকে উঠে তার ছোটখাট হার্ট এট্যাকের মত হয়ে গেল। অণুগল্প বলে এক ফেসবুক গ্রুপে তার “চরম বিষাদ” গল্পটি পাবলিশ হয়েছে। এখনো কোন লাইক পড়েনি। তাতে কি আসে যায়! সস্তা লাইকের জন্য আলম লিখে না।
গল্প প্রকাশের চরম আনন্দে আলমের প্রসব বেদনা উঠে গেল। নাস্তা মুখ না করেই সে খাতা-কলম নিয়ে বসে গেল। হালিখানেক অণুগল্প ভূমিষ্ট হবার পর তার মন কিঞ্চিত শান্ত হল। এক কাপ চা নিয়ে ল্যাপটপে বসল সে। সদ্য ভূমিষ্ট লেখাগুলো তুলতে হবে।
অণুগল্প গ্রুপ থেকে জনৈক বিলাল নামের একলোক ইনবক্সে মেসেজ পাঠিয়েছেন। গল্প বিষয়ক আলোচনার জন্য সময় চেয়েছেন। আলম উত্তর পাঠাল। তার আধামিনিটের মধ্যেই রিপ্লাই এল। আলমকে নিয়ে সামনা সামনি বসতে চাচ্ছেন উনি। আলোচনা ফলপ্রসূ হলে গ্রুপের নিয়মিত একজন লেখক হিসাবে মনোয়ন করবেন। “চরম বিষাদ” গল্পটি নাকি প্রমাণ করেছে আলম একজন জাত লেখক।
অভিমানে আলমের বুক ফেটে কান্না এল। এই প্রথম কেউ একজন তার কদর বুঝল। চোখ মুছে রিপ্লাই পাঠাল সে। সমস্যা হল আলম থাকে টাংগাইলে। বিলাল থাকেন ঢাকায়। সামনা সামনি বসার উপায় কি?
বিলাল বলল,”সামনের সপ্তাহে এক কাজে আমাকে পঞ্চগড় যেতে হবে। যাত্রা পথে টাঙ্গাইলে ব্রেক নেব।”
আলম খুশি হয়ে রিপ্লাই দিল,”তাহলে এই গরিবের গৃহে দুপুরের খানাটা খেয়ে যাবেন।”
বিলাল সম্মতি দিলেন। পরের সপ্তাহে খোচাখোচা কাঁচা-পাকা দাড়ির ষণ্ডা মতন এক লোক কাঁধে কাপড়ের ঝোলা নিয়ে আলমের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে।
আলমঃ আপনাকেতো চিনলাম না।
আগুন্তকঃ আমি বিলাল হোসেন। অণুগল্পের লোক।
খুশিতে বিলালকে জড়িয়ে ধরল আলম। ছাড়তেই চায়না। দুপুরে খেতে বসে ভাতে মুরগির ঝোল মাখাতে মাখাতে বিলাল হোসেন মুখ বেজার করে বলল,”আমি ডায়বেটিসের রোগী।”
আলমের মা বুঝতে না পেরে এক চামচ আলু-মাংসের ঝোল এগিয়ে দিয়ে বললেন,”বাবা আরেকটু তরকারি দেই?”
প্লেট সরিয়ে নিতে নিতে বিলাল বলল,” খালাম্মা আলু যে মিষ্টি খেলে হাসপাতালে দৌড়াতে হবে।”
আলমের মা বিব্রত হয়ে বললেন,” বাজারের আলু। এমন মিষ্টি কেমনে হইল?”
খানা দানার পর অণুগল্প নিয়ে বিস্তর আলাপ হল। বিলালের কথাবার্তা শুনে আলম মুগ্ধ। তিনি এই ব্যাপারে বোদ্ধা লোক সন্দেহ নেই। কথা বলতে বলতে বিকেল গড়িয়ে গেল। পঞ্চগড় অনেক দূরের পথ। ঠিক হল আজ রাতটা বিলাল এখানেই কাটিয়ে দেবে। ভোর সকালে পঞ্চগড়ের বাসে উঠে যাবে সে।
রাতে শুতে গিয়ে বিলাল মুখ ভারি করে বলল,” আমার পিঠে সমস্যা আছে।”
ব্যস্ত হয়ে আলম বলে "ভাইয়ের কি পিঠ ব্যাথা? প্যারা সিটামল এনে দেই?”
নাক থেকে হেঁচকা টানে একটি চুল ছিঁড়ে এনে গভীর পর্যবেক্ষণ করতে করতে বিলাল বলল,"আরে না। খাট অনেক শক্ত। এত শক্ত খাটে আমার ঘুম হয় না।”
লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি আরও মোটা তোষকের ব্যাবস্থা করল আলম। খাটে উঠে বিলালের মুখ কালো হয়ে গেল।
“খাটেরতো পায়া ভাঙ্গা। ভাঙ্গা খাটে আমি নিন্দ্রা যাই না ভাই। ভেরি সরি।” খাট থেকে নেমে গেল বিলাল।
লজ্জায় আলমের মাথা কাটা যায়। এমন গুনীমান্যি লোকের আদর আপ্যায়ন হল না। গেস্ট রুম থেকে বিলালকে নিজের ঘরে এনে শুতে দিল আলম।
শোবার সময় বিলাল বলল,"শেষ রাতে আমার বেজায় ক্ষুধা পায়। কিছু ফলফলাদি আর পাউরুটি-বিস্কুটের ব্যবস্থা থাকলে ভাল হয়।"
বাড়িতে পাউরুটি বিস্কুট ছিলনা। একটা আম কেটে প্লেটে করে এনে দিল আলম।
আলমের বাবা গজগজ করতে করতে বললেন,” এই ব্যাটার মতলব খারাপ। কই থেইক্কা আইছে?”
তারপরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বিলালকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। কখন উঠে সে কোথায় গেছে তার খবর কেউ জানে না। টেবিলে রাখা আলমের নাদুস নুদুস গল্পের খাতাটিও লাপাত্তা। সকাল ৮টা নাগাদও যখন বিলালকে দেখা গেল না তখন সবাই ধারণা করে নিল ঠিকমত আপ্যায়ন না পেয়ে মন খারাপ করে নীরবে বাড়ি ত্যাগ করেছে বিলাল। যাবার সময় সাথে করে আলমের গল্পের খাতাখানাও নিয়ে গেছে।
নিজের লেখা আলমের কাছে সন্তানসম। তার কাছে চাইলেই গল্পের কপি অনলাইনে দিয়ে দিতে পারত। না বলে মূল কপি নিয়ে যাওয়াটা মেনে নিতে পারল না আলম। ভুলে বিলালের ফোন নাম্বার নেয়া হয়নি যে কল দেবে। ফেসবুকে মেসেজ পাঠাবে ভাবল আলম। কিন্তু কোথায় ল্যাপটপ? আলমের ঘরে পড়ার টেবিলেইতো ছিল।
তন্নতন্ন করে খুঁজেও ল্যাপটপের হদীস পাওয়া গেল না। গল্পের খাতার সাথে ল্যাপটপখানাও বেমালুম গায়েব।
টেনশনে আলমের পেটে মোচড় দিয়ে উঠল। দৌড়ে এসে ল্যাট্রিনে সবে মাত্র পা মেলে দিয়ে বসবে ওমনি সে দেখতে পেল তার অণুগল্পের খাতা দুমড়ানো মোচড়ানো অবস্থায় পাশেই পড়ে আছে। বেশ কিছু পাতা ছেঁড়া। ছেঁড়া পাতাগুলোয় ভেজা হলুদ-বাদামি জাতীয় পদার্থ লেগে আছে। এক বিজাতীয় গন্ধ এসে তার গা গুলিয়ে দিয়ে গেল।
রাতে কারেন্ট ছিল না। পাম্প দিয়ে টাঙ্কিতে পানি উঠানো হয়নি। আলম কল ছাড়ল। সেখান থেকে এক ফোটা পানিও বের হল না।
মন্তব্য
আর এভাবেই যুগে যুগে মেধাবীরা হারিয়ে যায়.....
লেখা বরাবরের মতই ভালো লাগলো
-বৃদ্ধ কিশোর
লেখা ভাল লেগেছে জেনে আমারও ভাল লাগল। ধন্যবাদ!
সোহেল লেহস
-------------------------------------------------------
এইটা কি লেখলেন ভাই! গল্পের ট্যুইস্ট দেইখা পেটে কেমন জানি একটু মোচড় দিল
হা হা হা। মজা লাগল পড়ে!
ধন্যবাদ
সোহেল লেহস
-------------------------------------------------------
এইটা কি লেখলেন ভাই! গল্পের ট্যুইস্ট দেইখা পেটে কেমন জানি একটু মোচড় দিল
মজারু
ধন্যবাদ
সোহেল লেহস
-------------------------------------------------------
এইটা কি লেখলেন ভাই! গল্পের ট্যুইস্ট দেইখা পেটে কেমন জানি একটু মোচড় দিল
অসাধারণ
নতুন মন্তব্য করুন