• Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_clear_votes_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).
  • Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_electoral_list_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).
  • Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_results_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).
  • Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_votes_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).
  • Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_writeins_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).

গণহত্যার ছবি - ড. নূরুল উলা

এম. এম. আর. জালাল এর ছবি
লিখেছেন এম. এম. আর. জালাল (তারিখ: রবি, ২৮/১০/২০০৭ - ১২:৫৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১৯৭১ এর গণহত্যার এই ভিডিওটির চিত্রগ্রাহক ড. নূরুল উলা। তার জীবদ্দশায় তিনি লিখে গেছেন এর পেছনের কাহিনী। হাসিবকে অশেষ ধন্যবাদ লেখাটিকে ইউনিকোডে রূপান্তরিত করার জন্য..

গণহত্যার ছবি


নূরুল উলা

একাত্তরের পঁচিশে মার্চ রাতে একটু তাড়াতাড়ি ঘুমাতে গিয়েছিলাম । সেদিন খবরের কাগজে পড়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের সমঝোতা আসন্ন । তাই সবাই একটু নিশ্চিন্ত ছিলাম । মাঝরাতে প্রচন্ড এক বিস্ফোরণে ঘুম ভেঙ্গে গেল।

একটু বিরতির পরই শুরু হলো অবিরাম গোলাগুলি আর মর্টারের আওয়াজ । আমরা সবাই শোবার ঘর আর বাথরুমের মাঝামাঝি প্যাসেজে আশ্রয় নিলাম ছিটকে-আসা কোনো বুলেট থেকে রক্ষা পাবার আশায় । একটু পরে কৌতূহল সংবরণ করতে না পেরে হামাগুড়ি দিয়ে জানালার কাছে গিয়ে বাইরে কি হচ্ছে তার একটা আভাস নেবার চেষ্টা করলাম ।

আমি তখন থাকতাম ফুলার রোডে পুরাতন এ্যাসেম্বলি হলের উল্টোদিকে, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের তৈরী চারতলার ফ্লাটে । আমার জানালা থেকে জগন্নাথ হল ছাত্রাবাস আর তার বিরাট মাঠ সরাসরি চোখে পড়ে । সে রাত ছিলো নিশ্ছিদ্র অন্ধকার, কিন্তু তার মাঝেও বুঝলাম জগন্নাথ হল ছাত্রাবাস আর তার চারপাশের রাস্তাগুলো মিলিটারি ছেয়ে গেছে । কিছু পরে দেখলাম হলের কতকগুলো ঘরে আগুন ধরে গেল । সেই আলোয় আবার দেখলাম কিছুসংখ্যক সৈন্য টর্চ হাতে প্রতিটি ঘরে তল্লাশি চালাচ্ছে । বেশিক্ষণ তাকাবার ভরসা পেলাম না । করিডোরে ফিরে এসে গোলাগুলির শব্দের মধ্যেই জেগে সারারাত কাটিয়ে দিলাম ।

ভোর হতেই আবার উঁকি মেরে দেখলাম – - কোথাও কাউকে চোখে পড়লো না”; কেবল রাস্তায় পড়ে আছে অনেক ইটের টুকরো আর মাঠের ওপর বিছানো দুটো বড় বড় সাদা চাদর । কিছুটা আশ্বস্ত হলাম এই ভেবে যে তেমন বেশি খুন-জখম হয়তো হয়নি ।

কিন্তু এরপরই যে দৃশ্যের অবতারনা হলো - কোনদিন কল্পনা করিনি সে দৃশ্য আমাকে জীবনে কখনো দেখতে হবে; আর কামনা করি, এ-রকম ভয়াবহ ঘটনা যেন কাউকে স্বচক্ষে দেখতে না হয় ।

তখন বেশ সকাল হয়ে গেছে । মাঠের পশ্চিমদিকে অর্থাৎ যেদিকে জগন্নাথ হলের প্রধান ছাত্রাবাস, সেদিক থেকে হঠাৎ আবির্ভূত হলো জনাবিশেক পাকিস্তানী সৈন্য, সঙ্গে দু'জন আহত ছাত্র । ছেলে দুটোকে সৈন্যরা বেশ যত্ন করেই কাঁধে ভর দিয়ে এনে চাদর দুটোর পাশে বসাল –-মনে হলো হাসপাতালে নিয়ে যাবে । একটু পরই চাদর দুটো টেনে সরিয়ে ফেলল – দেখলাম চাদর দিয়ে ঢাকা ছিলো বেশ কয়েকটি মৃতদেহ ।

আহত ছেলে দুটো বসেছিলো পূর্ব দিকে মুখ করে, লাশগুলো তাদের পেছনে । দুজন সৈন্য আরেকটু পূর্বে সরে গিয়ে তাদের মুখোমুখি দাড়িয়ে তাদের দিকে উচিয়ে ধরলো হাতের রাইফেল – কয়েক মুহূর্তের জন্য দেখলাম ছেলে দুটো হাত বাড়িয়ে কাকুতি-মিনতি করছে । তার পরই চললো গুলি ।

কোন সৈন্য দুটো কিংবা তিনটার বেশী গুলি খরচ করেনি । শেষের গুলিটা করলো শুয়ে-থাকা লাশের ওপর মৃত্যু সুনিশ্চিত করার জন্য । ওদের হাতে যে আগ্নেয়াস্ত্র ছিলো সেটা মাঝারি ধরনের আর তা থেকে যে গুলি বেরিয়েছে তার শব্দ তেমন প্রচন্ড নয় ।

জীবনে এই প্রথম স্বচক্ষে মানুষ মারা দেখলাম, আর সেটাও আহত লোককে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে । মানসিক শক পূর্নভাবে উপলদ্ধি করার আগেই নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবতে হলো - কারন তখন রাস্তা দিয়ে সামরিক গাড়ী মাইকে কারফিউ-এর ঘোষণা প্রচার করতে করতে গেল আর সেই সঙ্গে জানিয়েও গেল কেউ যেন জানালা দিয়ে বাইরে না তাকায় । কিন্তু তাকানো বন্ধ করলাম না, কারন আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো যে, যদি জানালার কাচ বন্ধ রাখি আর ঘরে কোন আলো জ্বালানো না থাকে তাহলে বাইরে থেকে কিছু দেখা যাবে না । কেবল আশা করছিলাম সবচাইতে খারাপ যা হবার তা হয়ে গেছে, আর কিছু ঘটবে না, আর কিছু দেখতে হবে না । তখনও জানতাম না এ কেবল আরম্ভ ।

অল্পক্ষণ পরে, কিছু সৈন্য আরো কয়েকজন আহত লোক নিয়ে এলো, এবারও পশ্চিম দিকের ছাত্রাবাস থেকে । তাদের ঠিক আগের মতন অর্থাৎ লোকগুলোর কাছে নিয়ে এসে আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে ধরল । তারপর শুরু হলো গুলি, অনেকটা এলোপাথাড়ি । কেউ বসে ছিল, কেউ দাঁড়িয়ে, তাদের ওপর সামনে, বেশ কাছাকাছি থেকে গুলি চালাচ্ছে । আর পেছন থেকে উঠছে ধূলি । বুঝলাম কিছু গুলি দেহ ভেদ করে মাটিতে ঠেকছে । মাঠের ওপর পড়ে থাকা লোকের সংখ্যা বাড়তে থাকল ।

পরবর্তীকালে বিদেশী টেশিভিশনের সাংবাদিকরা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, সেই সময় আমার মানসিক অবস্থা কেমন ছিল, আর কি করে আমার মাথায় এই হত্যাকান্ডের ছবি তোলার চিন্তা মাথায় এল । আসলে ছবি তোলার আইডিয়া আমার নয় । পর পর দু”বার এভাবে আহত আর নিরস্ত্র মানুষদের ঠান্ডা মাথায় খুন করা দেখে বুঝলাম আরো খুন হবে, আজ একটা সামগ্রিক গণহত্যা হবে । তখন বোকার মত বলে উঠলাম-আমাদের হাতেও যদি অস্ত্র থাকতো । তখন পাশ থেকে আমার চাচাতো ভাই নসীম বলে উঠলো - ভাইজান, ছবি তোলেন ।

তখন মনে পড়লো আমার বাসায় ভিডিও ক্যামেরাসহ এইটা ভিসিআর আছে । জাপানে তৈরী প্রাথমিক যুগের এই পোর্টেবল ভিসিআর ছিল বেশ ভারি আর আমার জানামতে দেশে প্রথম । যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ক্যামেরা সেট করে একটা কালো কাগজ ফুটো করে ক্যামেরার লেন্সটা তার মাঝে গলিয়ে দিয়ে জানালার কাচের ওপর রাখলাম । ঠিক যতটুকু ক্যামেরার লেন্স, বাদবাকী পর্দা দিয়ে ঢাকা থাকল আর জানালা সামান্য ফাঁক করে সরু মাইক্রোফোনটা একটু বের করে রাখলাম । ইতোমধ্যে আরো-দুটো ব্যাচকে ধরে এনে হত্যা করা হয়েছে । ছবির রেকর্ডিং-এ ধরা পড়েছে বাদবাকী তিনটি গণহত্যা । এর মধ্য সবচাইতে ভয়াবহ ছিল শেষেরটি ।

তখন বন্দী আনা শুরু হয়েছে মাঠের পূর্বদিক থেকে । যাদের নিয়ে আসা হচ্ছে তাদের পরনে লুংগী, গেঞ্জি অথবা খালি গা । বুঝলাম সব ঘুমন্ত অবস্থায় ধরা পড়েছে । আগের লাশগুলোর কাছে নিয়ে এসে ওদের ওপর গুলি করা হচ্ছে ।

এরপর মাঠ হঠাৎ করে ফাঁকা হয়ে গেল । ইতোমধ্যে মাঠে বেশ কিছু লাশ জমে উঠেছে । ভাবলাম এবার বুঝি এই হত্যাযজ্ঞের শেষ । কিন্তু না, একটু পরে দেখলাম প্রায় জনা চল্লিশেক অস্ত্রধারী সৈন্য মাঠের উত্তরদিকে লাইন করে দাঁড়াল । এরা ছিলো লম্বা আর ফরসা, মনে হলো পাঞ্জাবী সৈন্য । এরা কিন্তু কখনই প্রত্যক্ষভাবে হত্যাকান্ডে অংশগ্রহণ করেনি । যারা গুলি চালিয়েছিলো তারা ছিল অপেক্ষাকৃত বেঁটে আর কালো । এবার এমনি ধরনের জনা-দশেক সৈন্য মাঠের পূর্বদিক থেকে আবির্ভূত হল, সঙ্গে প্রায় পঁচিশ-ছাব্বিশজন মানুষ । ভাবলাম বোধ হয় লাশ সরাবার জন্য এনেছে ।

কিন্তু মানুষগুলো পড়ে থাকা লাশগুলোর কাছে আসার সাথে সাথে ওদের সঙ্গের সৈন্যরা আবার একটু পূর্বদিকে সরে গিয়ে রাইফেল তাক করল । কিছুক্ষণের জন্য চারদিক স্তব্ধ । এর মধ্যে দেখলাম একজন লোক, মুখে তার দাড়ি, হাঁটু গেড়ে বসে করজোরে প্রাণভিক্ষা চাইছে । তারপরই শুরু হলো গুলি । গুলির পর গুলির বর্ষণ হচ্ছে আর মানুষগুলো মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে আর তাদের দেহ-ভেদ-করা গুলির আঘাতে মাঠ থেকে উঠছে ধূলা ।

গুলি যখন থামলো দেখলাম একমাত্র দাড়িওলা লোকটা তখনো বেঁচে আছে । মনে হলো ওর দিকে সরাসরি কেউ গুলা চালায়নি । লোকটা আবার হাতজোড় করে প্রাণভিক্ষা চাইতে শুরু করল । একজন সৈন্য তার বুকে লাথি মেরে তাকে মাটিতে শুইয়ে দেবার চেষ্টা করল । কিন্তু লোকটা তবু হাঁটু গেড়ে রইল । তখন তার ওপর চালালো গুলি । তার মৃতদেহ আর সবার সাথে একাকার হয়ে গেল ।

মাঠের উত্তরদিকে যে সৈন্যরা এতক্ষণ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েছিল তারা এখন সংঘবদ্ধভাবে চলে গেল । আর হত্যাকান্ডে অংশগ্রহণকারী সৈন্যদের কেউ কেউ পড়ে থাকা দেহগুলোর চারপাশে ঘুরে ঘুরে মনোযোগের সঙ্গে দেখল আর মাঝে মাঝে শেষবারের মতো গুলি করল মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য ।

কিছুক্ষণ পর সব সৈন্য চলে গেল । চারদিক নিস্তব্ধ আর ফাঁকা, কেবল জগন্নাথ হলের মাঠের ওপর পগে আছে অসংখ্য লাশ । দেখলাম রাস্তার ওপর দিয়ে একটা ভ্যান চলে গেল, তার ওপরে একটা গোল এন্টেনা ঘুরছে । বুঝলাম মাইক্রোওয়েভ ডিটেক্টর, কেউ কোন কিছু ব্রডকাস্ট করছে কিনা ধরার জন্য । আমি জানি আমার ভিডিও ক্যামেরা থেকে সামান্য কিছু তরঙ্গ ছড়াতে পারে, তাই তাড়াতাড়ি সেটা অফ করলাম ।

ভিডিও টেপ রিওয়াইন্ড করে চেক করে যখন দেখলাম সব ছবি ঠিকমতো উঠেছে তখন সেটা খুলে ভিতর থেকে যন্ত্রাংশ সরিয়ে নিয়ে সেটাকে অকেজো করে দিলাম । বেলা তখন দশটার বেশী হবে না । যেকোনো সময় আমাদের ওপর হামলা হতে পারে আশঙ্কায় ওখানে বেশিক্ষণ থাকা সমীচীন মনে করলাম না । কারফিউ সত্ত্বেও আমরা আত্মীয়-স্বজন ও পরিবার নিয়ে এলাম পুরনো ঢাকায় । আসার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে অর্থাৎ বেলা একটার দিকে একটা বুলডজার দিয়ে মাটি খুড়তে দেখেছি । কিন্তু তারপর সেখানে কি হয়েছে বলতে পারব না । অনুমান করি, লাশগুলো পুঁতে ফেলার উদ্দেশ্যেই মাটি খোঁড়া হচ্ছে । স্বাধীনতা লাভের পর জেনেছি, আমার অনুমান ছিলো সত্যি ।

PDF ডাউনলোড করুন এখান থেকে


মন্তব্য

সৌরভ এর ছবি

একটু সময় নিয়ে নিজেকে কল্পনা করলাম, সেই আহত নীরিহ ছাত্রদের সারিতে, কিছুক্ষণ পরে যাদের শ্যুট করা হবে।
কেঁদে ফেললাম।

নুরুলউল্লার প্রতি আমাদের এ ঋণ আমরা শোধ করতে পারবোনা।


আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

সৌরভ এর ছবি

যারা দেশে থেকে কম ব্যান্ডউইডথ এর জন্যে সরাসরি য়্যুটিউব দেখতে পান না, তাদের জন্যে FLV ফাইল এখানে।

ডাউনলোড করে দেখতে হলে VLC প্লেয়ার ব্যবহার করুন।


আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

তারেক এর ছবি

কৃতজ্ঞতা জানাই।
ভিডিওটা আগের পোস্টে দেখেছিলাম। আজ পিডিএফ টাও পড়া হল।
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

হাসিব এর ছবি

ইউনিকোডিত ভার্সন দেয়া হলো ।

গণহত্যার ছবি
নূরুল উলা

একাত্তরের পঁচিশে মার্চ রাতে একটু তাড়াতাড়ি ঘুমাতে গিয়েছিলাম । সেদিন খবরের কাগজে পড়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের সমঝোতা আসন্ন । তাই সবাই একটু নিশ্চিন্ত ছিলাম । মাঝরাতে প্রচন্ড এক বিস্ফোরণে ঘুম ভেঙ্গে গেল।

একটু বিরতির পরই শুরু হলো অবিরাম গোলাগুলি আর মর্টারের আওয়াজ । আমরা সবাই শোবার ঘর আর বাথরুমের মাঝামাঝি প্যাসেজে আশ্রয় নিলাম ছিটকে-আসা কোনো বুলেট থেকে রক্ষা পাবার আশায় । একটু পরে কৌতূহল সংবরণ করতে না পেরে হামাগুড়ি দিয়ে জানালার কাছে গিয়ে বাইরে কি হচ্ছে তার একটা আভাস নেবার চেষ্টা করলাম ।

আমি তখন থাকতাম ফুলার রোডে পুরাতন এ্যাসেম্বলি হলের উল্টোদিকে, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের তৈরী চারতলার ফ্লাটে । আমার জানালা থেকে জগন্নাথ হল ছাত্রাবাস আর তার বিরাট মাঠ সরাসরি চোখে পড়ে । সে রাত ছিলো নিশ্ছিদ্র অন্ধকার, কিন্তু তার মাঝেও বুঝলাম জগন্নাথ হল ছাত্রাবাস আর তার চারপাশের রাস্তাগুলো মিলিটারি ছেয়ে গেছে । কিছু পরে দেখলাম হলের কতকগুলো ঘরে আগুন ধরে গেল । সেই আলোয় আবার দেখলাম কিছুসংখ্যক সৈন্য টর্চ হাতে প্রতিটি ঘরে তল্লাশি চালাচ্ছে । বেশিক্ষণ তাকাবার ভরসা পেলাম না । করিডোরে ফিরে এসে গোলাগুলির শব্দের মধ্যেই জেগে সারারাত কাটিয়ে দিলাম ।

ভোর হতেই আবার উঁকি মেরে দেখলাম – - কোথাও কাউকে চোখে পড়লো না”; কেবল রাস্তায় পড়ে আছে অনেক ইটের টুকরো আর মাঠের ওপর বিছানো দুটো বড় বড় সাদা চাদর । কিছুটা আশ্বস্ত হলাম এই ভেবে যে তেমন বেশি খুন-জখম হয়তো হয়নি ।

কিন্তু এরপরই যে দৃশ্যের অবতারনা হলো - কোনদিন কল্পনা করিনি সে দৃশ্য আমাকে জীবনে কখনো দেখতে হবে; আর কামনা করি, এ-রকম ভয়াবহ ঘটনা যেন কাউকে স্বচক্ষে দেখতে না হয় ।

তখন বেশ সকাল হয়ে গেছে । মাঠের পশ্চিমদিকে অর্থাৎ যেদিকে জগন্নাথ হলের প্রধান ছাত্রাবাস, সেদিক থেকে হঠাৎ আবির্ভূত হলো জনাবিশেক পাকিস্তানী সৈন্য, সঙ্গে দু'জন আহত ছাত্র । ছেলে দুটোকে সৈন্যরা বেশ যত্ন করেই কাঁধে ভর দিয়ে এনে চাদর দুটোর পাশে বসাল –-মনে হলো হাসপাতালে নিয়ে যাবে । একটু পরই চাদর দুটো টেনে সরিয়ে ফেলল – দেখলাম চাদর দিয়ে ঢাকা ছিলো বেশ কয়েকটি মৃতদেহ ।

আহত ছেলে দুটো বসেছিলো পূর্ব দিকে মুখ করে, লাশগুলো তাদের পেছনে । দুজন সৈন্য আরেকটু পূর্বে সরে গিয়ে তাদের মুখোমুখি দাড়িয়ে তাদের দিকে উচিয়ে ধরলো হাতের রাইফেল – কয়েক মুহূর্তের জন্য দেখলাম ছেলে দুটো হাত বাড়িয়ে কাকুতি-মিনতি করছে । তার পরই চললো গুলি ।

কোন সৈন্য দুটো কিংবা তিনটার বেশী গুলি খরচ করেনি । শেষের গুলিটা করলো শুয়ে-থাকা লাশের ওপর মৃত্যু সুনিশ্চিত করার জন্য । ওদের হাতে যে আগ্নেয়াস্ত্র ছিলো সেটা মাঝারি ধরনের আর তা থেকে যে গুলি বেরিয়েছে তার শব্দ তেমন প্রচন্ড নয় ।

ওদের হাতে যে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল সেটা মাঝারি ধরনের আর তা থেকে যে গুলি বেরিয়েছে তার শব্দ তেমন প্রচন্ড নয় ।

জীবনে এই প্রথম স্বচক্ষে মানুষ মারা দেখলাম, আর সেটাও আহত লোককে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে । মানসিক শক পূর্নভাবে উপলদ্ধি করার আগেই নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবতে হলো - কারন তখন রাস্তা দিয়ে সামরিক গাড়ী মাইকে কারফিউ-এর ঘোষণা প্রচার করতে করতে গেল আর সেই সঙ্গে জানিয়েও গেল কেউ যেন জানালা দিয়ে বাইরে না তাকায় । কিন্তু তাকানো বন্ধ করলাম না, কারন আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো যে, যদি জানালার কাচ বন্ধ রাখি আর ঘরে কোন আলো জ্বালানো না থাকে তাহলে বাইরে থেকে কিছু দেখা যাবে না । কেবল আশা করছিলাম সবচাইতে খারাপ যা হবার তা হয়ে গেছে, আর কিছু ঘটবে না, আর কিছু দেখতে হবে না । তখনও জানতাম না এ কেবল আরম্ভ ।

অল্পক্ষণ পরে, কিছু সৈন্য আরো কয়েকজন আহত লোক নিয়ে এলো, এবারও পশ্চিম দিকের ছাত্রাবাস থেকে । তাদের ঠিক আগের মতন অর্থাৎ লোকগুলোর কাছে নিয়ে এসে আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে ধরল । তারপর শুরু হলো গুলি, অনেকটা এলোপাথাড়ি । কেউ বসে ছিল, কেউ দাঁড়িয়ে, তাদের ওপর সামনে, বেশ কাছাকাছি থেকে গুলি চালাচ্ছে । আর পেছন থেকে উঠছে ধূলি । বুঝলাম কিছু গুলি দেহ ভেদ করে মাটিতে ঠেকছে । মাঠের ওপর পড়ে থাকা লোকের সংখ্যা বাড়তে থাকল ।

পরবর্তীকালে বিদেশী টেশিভিশনের সাংবাদিকরা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, সেই সময় আমার মানসিক অবস্থা কেমন ছিল, আর কি করে আমার মাথায় এই হত্যাকান্ডের ছবি তোলার চিন্তা মাথায় এল । আসলে ছবি তোলার আইডিয়া আমার নয় । পর পর দু”বার এভাবে আহত আর নিরস্ত্র মানুষদের ঠান্ডা মাথায় খুন করা দেখে বুঝলাম আরো খুন হবে, আজ একটা সামগ্রিক গণহত্যা হবে । তখন বোকার মত বলে উঠলাম-আমাদের হাতেও যদি অস্ত্র থাকতো । তখন পাশ থেকে আমার চাচাতো ভাই নসীম বলে উঠলো - ভাইজান, ছবি তোলেন ।

তখন মনে পড়লো আমার বাসায় ভিডিও ক্যামেরাসহ এইটা ভিসিআর আছে । জাপানে তৈরী প্রাথমিক যুগের এই পোর্টেবল ভিসিআর ছিল বেশ ভারি আর আমার জানামতে দেশে প্রথম । যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ক্যামেরা সেট করে একটা কালো কাগজ ফুটো করে ক্যামেরার লেন্সটা তার মাঝে গলিয়ে দিয়ে জানালার কাচের ওপর রাখলাম । ঠিক যতটুকু ক্যামেরার লেন্স, বাদবাকী পর্দা দিয়ে ঢাকা থাকল আর জানালা সামান্য ফাঁক করে সরু মাইক্রোফোনটা একটু বের করে রাখলাম । ইতোমধ্যে আরো-দুটো ব্যাচকে ধরে এনে হত্যা করা হয়েছে । ছবির রেকর্ডিং-এ ধরা পড়েছে বাদবাকী তিনটি গণহত্যা । এর মধ্য সবচাইতে ভয়াবহ ছিল শেষেরটি ।

তখন বন্দী আনা শুরু হয়েছে মাঠের পূর্বদিক থেকে । যাদের নিয়ে আসা হচ্ছে তাদের পরনে লুংগী, গেঞ্জি অথবা খালি গা । বুঝলাম সব ঘুমন্ত অবস্থায় ধরা পড়েছে । আগের লাশগুলোর কাছে নিয়ে এসে ওদের ওপর গুলি করা হচ্ছে ।

এরপর মাঠ হঠাৎ করে ফাঁকা হয়ে গেল । ইতোমধ্যে মাঠে বেশ কিছু লাশ জমে উঠেছে । ভাবলাম এবার বুঝি এই হত্যাযজ্ঞের শেষ । কিন্তু না, একটু পরে দেখলাম প্রায় জনা চল্লিশেক অস্ত্রধারী সৈন্য মাঠের উত্তরদিকে লাইন করে দাঁড়াল । এরা ছিলো লম্বা আর ফরসা, মনে হলো পাঞ্জাবী সৈন্য । এরা কিন্তু কখনই প্রত্যক্ষভাবে হত্যাকান্ডে অংশগ্রহণ করেনি । যারা গুলি চালিয়েছিলো তারা ছিল অপেক্ষাকৃত বেঁটে আর কালো । এবার এমনি ধরনের জনা-দশেক সৈন্য মাঠের পূর্বদিক থেকে আবির্ভূত হল, সঙ্গে প্রায় পঁচিশ-ছাব্বিশজন মানুষ । ভাবলাম বোধ হয় লাশ সরাবার জন্য এনেছে ।

কিন্তু মানুষগুলো পড়ে থাকা লাশগুলোর কাছে আসার সাথে সাথে ওদের সঙ্গের সৈন্যরা আবার একটু পূর্বদিকে সরে গিয়ে রাইফেল তাক করল । কিছুক্ষণের জন্য চারদিক স্তব্ধ । এর মধ্যে দেখলাম একজন লোক, মুখে তার দাড়ি, হাঁটু গেড়ে বসে করজোরে প্রাণভিক্ষা চাইছে । তারপরই শুরু হলো গুলি । গুলির পর গুলির বর্ষণ হচ্ছে আর মানুষগুলো মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে আর তাদের দেহ-ভেদ-করা গুলির আঘাতে মাঠ থেকে উঠছে ধূলা ।

গুলি যখন থামলো দেখলাম একমাত্র দাড়িওলা লোকটা তখনো বেঁচে আছে । মনে হলো ওর দিকে সরাসরি কেউ গুলা চালায়নি । লোকটা আবার হাতজোড় করে প্রাণভিক্ষা চাইতে শুরু করল । একজন সৈন্য তার বুকে লাথি মেরে তাকে মাটিতে শুইয়ে দেবার চেষ্টা করল । কিন্তু লোকটা তবু হাঁটু গেড়ে রইল । তখন তার ওপর চালালো গুলি । তার মৃতদেহ আর সবার সাথে একাকার হয়ে গেল ।

মাঠের উত্তরদিকে যে সৈন্যরা এতক্ষণ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েছিল তারা এখন সংঘবদ্ধভাবে চলে গেল । আর হত্যাকান্ডে অংশগ্রহণকারী সৈন্যদের কেউ কেউ পড়ে থাকা দেহগুলোর চারপাশে ঘুরে ঘুরে মনোযোগের সঙ্গে দেখল আর মাঝে মাঝে শেষবারের মতো গুলি করল মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য ।

কিছুক্ষণ পর সব সৈন্য চলে গেল । চারদিক নিস্তব্ধ আর ফাঁকা, কেবল জগন্নাথ হলের মাঠের ওপর পগে আছে অসংখ্য লাশ । দেখলাম রাস্তার ওপর দিয়ে একটা ভ্যান চলে গেল, তার ওপরে একটা গোল এন্টেনা ঘুরছে । বুঝলাম মাইক্রোওয়েভ ডিটেক্টর, কেউ কোন কিছু ব্রডকাস্ট করছে কিনা ধরার জন্য । আমি জানি আমার ভিডিও ক্যামেরা থেকে সামান্য কিছু তরঙ্গ ছড়াতে পারে, তাই তাড়াতাড়ি সেটা অফ করলাম ।

ভিডিও টেপ রিওয়াইন্ড করে চেক করে যখন দেখলাম সব ছবি ঠিকমতো উঠেছে তখন সেটা খুলে ভিতর থেকে যন্ত্রাংশ সরিয়ে নিয়ে সেটাকে অকেজো করে দিলাম । বেলা তখন দশটার বেশী হবে না । যেকোনো সময় আমাদের ওপর হামলা হতে পারে আশঙ্কায় ওখানে বেশিক্ষণ থাকা সমীচীন মনে করলাম না । কারফিউ সত্ত্বেও আমরা আত্মীয়-স্বজন ও পরিবার নিয়ে এলাম পুরনো ঢাকায় । আসার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে অর্থাৎ বেলা একটার দিকে একটা বুলডজার দিয়ে মাটি খুড়তে দেখেছি । কিন্তু তারপর সেখানে কি হয়েছে বলতে পারব না । অনুমান করি, লাশগুলো পুঁতে ফেলার উদ্দেশ্যেই মাটি খোঁড়া হচ্ছে । স্বাধীনতা লাভের পর জেনেছি, আমার অনুমান ছিলো সত্যি ।

সৌরভ এর ছবি

সব সচল দের প্রতি অনুরোধ, এই লেখাটি ইন্টারনেটে ছড়ানো হোক। ভিডিওলিংক সহ।

নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে যাক এ তথ্যচিত্র।
চিরতরে মুছে যাক বেজন্মা রাজাকারদের আস্ফালন।


আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

বিপ্লব রহমান এর ছবি

এই মৃত্যূ উপত্যাকাই আমার দেশ!


আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

আড্ডাবাজ এর ছবি

অতি জরুরী লেখা। এসব প্রামাণ্য লেখাগুলোর প্রচারের খুব দরকার। ধন্যবাদ।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

আহারে
-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- ছোট বেলায় একটা বইয়ে পড়েছিলাম, "জগন্নাথ হলের হত্যাযজ্ঞঃ সাক্ষী একটি টিভি ক্যামেরা"। একজন প্রফেসর ফুটেজ সংগ্রহ করেছিলেন। তখন ফুটেজটা দেখতে পাইনি, কেবল পড়েছি।
আজ, এতোগুলো বছর পর যখন ফুটেজটা দেখলাম তখন মনেহয় এই কি সেই ফুটেজ নাকি আরও আছে, অন্যকারো কাছে।
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

ভিডিও এবং লিখিত বয়ান - দুইয়ে মিলে ইতিহাসের কী এক অসাধারণ দলিল! হোক বিলম্বিত, তবু অভিবাদন ড. নুরউল্লাহকে। আচ্ছা, এই ভদ্রলোক সম্পর্কে আর কোনো তথ্য কারো কাছে থাকলে দয়া করে শেয়ার করবেন?

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

পড়তে গিয়ে গলার ভেতরে ভীষণ কষ্টের অনুভূতি হতে থাকে। আমি পড়ি আর ভাবি বাঙালি নামধারী কিছু কুত্তার বাচ্চার (দুঃখের বিষয়, তাদের সংখ্যা খুব নগণ্য নয়) পাকিস্তানপ্রেম, পাকিস্তানতোষণ আর পাকিস্তানপ্রীতির কথা। তাদের হাবভাব দেখে মনে হয়, পাকিস্তানীদের ব্লো-জব সার্ভিস দিতে পারলে তাদের জীবনটা সার্থক হয়ে যাবে।

অনেক কষ্টে গালিগালাজ কন্ট্রোল করলাম।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? :-?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।