তারপরও, মূর্খের মতো আশাবাদী হয়ে বলে যাই, "জয় বাংলা।"]
নিওশা বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। একটু পরেই মহাধ্যক্ষ মিরিড-এর সাথে তাদের তিনজনের দেখা করার কথা। দমকা বাতাস এসে তার মুখে, চুলে খেলা করে যায়। একটু উদাস হয়ে যায় সে। আজই থেকেই এখানে তার শেষ দিন গোনা শুরু। চারটা নাক্ষত্রিক বর্ষ কাটিয়েছে সে এখানে। চোখ বন্ধ করেই সে বলে দিতে পারে নাক্ষত্রিক উদ্ভিদবিদ্যার ইভফ (ইনভিট্রোফার্টিলাইজেশন) গবেষণাগারটা কোথায়, কিংবা কোন দিকে কয় পা গেলে অণুযন্ত্রমানববিদ্যা বিভাগের সারাই কারখানাটা পড়ে, অথবা, তাদের অনপ-র (আন্তঃনক্ষত্রীয় প্রত্মতত্ত্ব) কততম শ্রেণিকক্ষে তুহিল স্যার ক্লাস নিচ্ছেন।
এখানে, অকারণেই, তার গালে একটু গোলাপি ছোপ ধরে। এরপর হাল্কা একটা দীর্ঘশ্বাসও পড়ে। হবে না তার কোন দিনও, কখনোই বলা হবে না।
কাঁধে তার একটা ভার অনুভব করেই চমকে ওঠে সে। তার দলের বাকি দুজনও হাজির। ওয়াম আর অরপ। ওয়াম ছটফটে, প্রাণচঞ্চল আর অরপ একটু চাপা, সাহসী। অরপ যে-একটু কবি স্বভাবের আর বন্ধুর জন্যে জীবনও দিয়ে দিতে পারে, সেটা তার সাথে খুব কাছাকাছি না মিশলে কেউ টেরটিও পাবে না। ওয়াম সবার সাথেই মিশে যেতে পারে খুব সহজেই, সরল তার জীবনদর্শন।
"তুই কি ভাবছিলি রে?" ওয়াম আক্রমণ করে।
"কিছু না। দেরি করলি কেন?" নিওশার পাল্টা প্রশ্ন।
"আরে, আজ স্পেসার রেসার-এর প্রোমো রেস না?" ওয়াম চোখ টেপে। নিওশা ভাবে তাহলে আজ সে যে আসলে এসেছে, তা-ই বেশি। রেসিং ওর নেশা না বলে শ্বাস নেয়ার মতো একটা ব্যাপার বললেই বোধহয় আরো সহজে ব্যাপারটা বোঝা যায়।
অরপ এখানে ব্যাপারটা হাতে নেয়। "আসলে আমারই একটু দেরি হয়েছিল হাওয়াই গাড়িটা নিয়ে।" কাঁধ ঝাঁকিয়ে সে পরিস্থিতি একটু হালকা করতে চায়।
নিওশা জানে অরপ সবসময় নিজের কাঁধেই দোষটা রাখবে। তাই কথা না বাড়িয়ে সে হাঁটতে থাকে মহাধ্যক্ষের ঘরটার দিকে।
মিরিড-এর মুখে হাসি দেখা যায় নাকি গ্যালাক্টিক বছরে একবার। যে দেখতে পায়, তার সব ইচ্ছা পূর্ণ করা হবে, এরকম নিয়ম আছে এখানে। গত বছর সেটা দেখেছিল এরশ। ক্যাম্পাসের সবচে সুদর্শন তিনজন মেয়ে আর দুজন ছেলের সাথে সে কাটিয়েছে এরপর তিনটে দিন আর চার রাত।
সবাই দাঁড়ায় পুরু ধাতুকাচের চক্ষুপরীক্ষকের সামনে। রেটিনার ওপর দিয়ে সরে যায় অদৃশ্য গারিনরশ্মি। তাদের জিনোম থেকে শুরু করে কেন তারা এখানে এলো, সব চলে গেছে ভেতরে মহাপরিচালকের ডেস্কে, এমনকি তাদের চাপা উদ্বেগ আর উত্তেজনাও।
ওপরে নিচে খুলে যায় দরজাটা। চারপাশের আলোগুলো তাদের হাঁটার সাথে সাথে উজ্জ্বল হয়ে উঠতে থাকে। মিরিড তীব্র আলো পছন্দ করেন শুধু অন্যদের সাথে কথা বলার সময়। তখনও তাঁর মাথার ওপর থাকে মোলায়েম অরিন আলো, তিনি থাকবেন আবছায়াতে।
রুপোলি সংকর ধাতুর তৈরি অভ্রধূসর ডেস্কে তিনি বসে আছেন আঙুলগুলো দিয়ে পিরামিড বানিয়ে। তাদের বসার কোন জায়গা নেই সামনে। তিনি বলেন মসৃণ কণ্ঠে, "বসো।"
তারা বসার ভঙ্গি করে। সাথে সাথেই মেঝে থেকে বেরুনো তিনটে রশ্মিম্যাট্রিক্স তাদের শরীরের ভর নিয়ে নেয়, যেভাবে তাদের সর্বোচ্চ আরাম হবে, তেমনিভাবে তাদের বসিয়ে রাখে।
বলাটা শুরু করলেন মিরিড-ই। "তোমরা এবার শিক্ষার শেষ পর্যায়ে। এই শিক্ষাভ্রমণ শেষে তোমাদের ফলাফলই জানাবে তোমরা শেখাটা কাজে লাগানোর মতো উপযোগী হয়েছো কি-না। তোমাদের এই সফরটা মোট ষোল নক্ষত্র দিনের। এর মধ্যে যাত্রাপথের জন্যে চারদিনের হিসেবটা থাকবে না। সফরে কী করবে সেটার বিবরণ তোমরা জানো। নতুন কিছু আবিষ্কার করতে পারলে কৃতিত্ব বিবেচনায় আনা হবে। কোন প্রশ্ন?"
কোন প্রশ্ন নেই, তারা জানে।
কোন প্রশ্নের প্রয়োজন নেই, তারা জানে।
নিওশা তারপরও বলে, "আমাদের সাথে আর কি কি যাচ্ছে?"
"মহাকাশ নিয়ন্ত্রক সংস্থার শিক্ষাসফর সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ, গ্যালাক্টিক এরা ৩৩৭৮, ধারা ৩৫, উপধারা ৭(ক)(৪) আর (৫) অনুযায়ী তোমরা সর্বোচ্চ তিনটে যন্ত্রমানব পাবে। তোমাদের আত্মরক্ষার জন্যে সর্বোচ্চ দুটো অস্ত্র বহনের অনুমতি আছে। তোমাদের রসদ আর কাপড় বা অন্য পরিধেয়ের, যেমন: মহাকাশ বর্ম, শ্বাসনল, এজাতীয় যা কিছু আছে সবকিছু আমরাই দিচ্ছি। এখন তোমাদের প্রস্তুতির পালা।"
ওয়ামের কেমন যেন লাগে। একটা উত্তেজনা, একটা পবিত্র দায়বদ্ধতা যেন তার কাঁধে। সে এর আগে কখনো এরকম অনুভূতির সাথে পরিচিত হয় নি। হয়তো, তার আবার শমক-কক্ষে যাওয়ার সময় এসে গেছে।
অরপ নিশ্চুপ, শ্বাস ফেলছে কিনাও সন্দেহ। কিন্তু, তার হরমোন প্রবাহ খরতর নয়। নিওশা তার দিকে না তাকিয়েও জানে, এই ভ্রমণে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্যে অরপের অবচেতন প্রস্তুতি নিয়েই ফেলেছে, এবং তারা অনেক নিশ্চিন্ত থাকতে পারবে বাকি সময়টা জুড়ে।
তারা উঠে দাঁড়ায়।
মিরাড একটু কোমল চোখেই বোধহয় (বোঝা মুশকিল, তাঁর ওপর আলো এতোই কম পড়েছে) নিওশার দিকে তাকালেন।
বললেন, "নিওশা, মুক্তজ কেমন আছে?"
"তেমন ভালো না।"
"তুমি ওকে শুধু এটা জানিও যে, তুমি তোমাদের পুরনো মাটিতে ক'দিনের জন্যে ফেরত যাচ্ছো।"
"পুরনো মাটি?"
"আমাদের তথ্যকেন্দ্র বলছে, যেখানে তোমরা যাচ্ছো, আগে ওখানেই তোমার পূর্বপুরুষেরা বাস করতেন।"
নিওশার গলায় কি একটা আটকে গেলো। শুধু তার মৃত্যুপথযাত্রী পিতামহ মুক্তজ-এর অনুভূতি কল্পনা করে নয়, তার নিজেরও স্বপ্নগুলোর কথা ভেবে। ছোটবেলা থেকে সে ওখানকার কথা এতো শুনে এসেছে, আজ ওখানেই যাওয়া! সে উদ্বেল হয়ে ওঠে, স্বপ্নালুও।
বেরিয়ে পড়ে তারা তিনজন আর ছিটকে যায় তিনদিকে।
----------------------------------------------------------------------------------------
নিওশা এসেছে মূল চিকিৎসাকেন্দ্রে তার পিতামহ মুক্তজ-এর সাথে দেখা করতে। যাদের অবস্থা খুব খারাপ শুধু তাদেরই এখানে রাখা হয়, পাশাপাশি এটা একটা গবেষণাগারও বটে। দুরারোগ্য আর বিরল রোগাক্রান্ত রোগীদের নানান তথ্য সংগ্রহ এবং সেসংক্রান্ত আরোগ্যকৌশল আবিষ্কারের চেষ্টা চলে এখানে।
মুক্তজের বয়েস অনেক। চুলে বরফ পড়েছে অনেক আগেই। লড়াই করার অদম্য আগ্রহই বোধহয় তাঁকে টিকিয়ে রেখেছে এতদিন। তিনি প্রায়ই হেসে বলতেন, "আমরা যোদ্ধার বংশধর।" সে-যুদ্ধ প্রাচীন এক সময়ের গৌরবের কাহিনি, যা অনেকেরই, এমনকি নিওশার বন্ধুদেরও অজানা।
মুক্তজ শ্বাস নেন কষ্টে। কিন্তু নাতনিকে দেখে তাঁর হাসিটা অমলিন, যদিও মুখে একাধিক নল।
নিওশা তাঁর হাত তুলে নেয় নিজের হাতে। রক্ত কি কথা বলে রক্তের সাথে? মনে হচ্ছে তার ত্বক তথ্যবিনিময় করছে, ভালোবাসা জানাচ্ছে, স্নেহ অনুভব করছে নীরবে।
মুক্তজের কানের কাছে সে ফিসফিস করে বলে, "আমি তোমার মাটিতে যাচ্ছি দা, আমি আমাদের মাটিতে যাচ্ছি।"
মুক্তজ তার দিকে তাকান অবিশ্বাস আর বিশ্বাসের লড়াই করতে-থাকা চোখে। শেষমেষ তাঁর চোখে প্রচণ্ড উত্তেজনা যেন ফেটে পড়তে থাকে।
জিজ্ঞেস করেন তিনি, "এটা কোন বছর নি?"
নিওশার মন খারাপ হয়। এই ছোটখাট জিনিসগুলো ভোলার লোক তার দা কখনোই ছিলো না। সে হতাশা চেপে বলে, "কেন, দা ভুলে গেলে এটা ৩৯৪২? তারিখটা বলতে হবে?"
"বল তো?"
"১১ ২৯!"
"কিছু বুঝতে পারছিস না?"
বিমূঢ় নিওশা তাল রাখতে পারছে না এই মৃত্যুপথযাত্রীর বোধির সাথে।
"না।"
"তোরা কখন রওনা হচ্ছিস, ক'দিন থাকবি?"
"দুদিন পর।"
"আর ফিরবি?"
"১২ ১৬।"
এবার বৃদ্ধ উঠে পড়তে চান যেন তার সাথে সংযুক্ত সব চিকিৎসোপকরণ ছিঁড়ে। অদ্ভুত এক প্রেরণায় আর আন্তর শক্তিতে জ্বলজ্বল করছে তাঁর ধূসর চোখজোড়া।
নিওশা প্রায় চিৎকার করে ওঠে, "কী হলো দা?"
"তুই সব ভুলে গেছিস নি, যা বলেছিলাম তোর, আমাদের পুরনো মাটির কথা, সব?"
"নিওশা", এবার একটু শান্ত স্বরে বলছেন তিনি, "আমার বইয়ের তাকের পেছনে একটা লুকনো দেরাজ আছে। ওটার খোলসংকেত হচ্ছে মব৫২৬৬৬৯। ওখানে একটা লাল স্ফটিক চাকতি পাবি। পড়ে দেখিস।"
তিনি ক্লান্ত হয়ে চোখ বোজেন।
নিওশা তাঁকে ওখানকার যান্ত্রিক সেবকের হাতে রেখে অন্যরকম একটা আশঙ্কা আর আকুলতা নিয়ে রাস্তায় তার হালকা সি-১২৪-টায় চাপে।
ঠিক তখনই এই দ্ব্যর্কক গ্রহের অন্য কোন প্রান্তে কথা বলছে একজন নতমুখ, নতজানু তরুণ এবং একজন সৌম্য প্রৌঢ়।
"প্রথমেই চেষ্টা করবে যেন কোনভাবেই ওই জায়গার খোঁজ না পায়, আর তা না হলেই শেষ কাজ।"
"হুঁ। কিন্তু, বন্ধু তো সবাই...। কিভাবে যে...!"
"আহ্, যদি আজ আমার তারুণ্য থাকতো তবে দরকার হতো তোমার মতো এই ছাগ...? মনে রাখবে, কেউ তোমার বন্ধু না। কেউ না। তোমার দায়িত্বের কাছে কোন বন্ধু নেই। সময়টা খারাপ। সাবধানে থাকবে। সুযোগ পেলে ওরাই তোমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। ওদের পূর্বপুরুষদের হত্যা করা হয়েছিলো যেখানেই পাওয়া যাক, এমনকি পবিত্র মাসেও। তুমিও ভুলো না ওরা কত ঘৃণা করে তোমাদের, আমাদের, এখনও। এখন যাও।"
নতজানু যুবক কৃতার্থ হয়ে পিছিয়ে আসে নতশিরেই।
----------------------------------------------------------------------
আজ তাদের যাত্রা হলো শুরু।
সব ঠিকঠাক। তারা উঠেছে একটা বাণিজ্যযানে। আধুনিক এই যন্ত্রযানটি তাদের তিনদিনের রাস্তা পৌঁছে দিচ্ছে মাত্র ছয় ঘণ্টায়, হস (হাইপারস্পেশিয়াল) ঝাঁপ দিয়ে। অবশ্য এজন্যে খরচও নিচ্ছে তারা, ব্যয়ভার দিচ্ছে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়।
এই বাণিজ্যতরীর প্রধান ক. উলহ তাদের সাথে স্বাভাবিকভাবেই কথা বলছে। তার ঠিক বিশ্বাসই হচ্ছে না কেন এই মৃত গ্রহে তারা শিক্ষা নিতে যাচ্ছে। তার কথার নিচে একটা হালকা অবজ্ঞার সুর টের পাওয়া যায়। তারা অবশ্য আসন্ন অভিযানের উত্তেজনায় এতোটাই মশগুল যে, ওসব ঠিক গায়ে মাখছে না।
ক. বলে, "আপনারা জানেন এই জায়গাটা কেমন ছিল আগে?"
"জানি।"নিওশা বলে।
"কিভাবে?"
"এটা আমাদের পুরনো মাটি ছিল।"
"তাই?"কিছু একটা বলতে গিয়ে থমকে যায় ক.।
নিওশা মৃদু হাসে।"আপনি কিছু একটা বলতে চাইছিলেন।"
"না, আসলে পুরো জায়গাটা কিভাবে যে ডুবে গেল! খুব দুঃখজনক।"
"হুঁ, তবে পুরো গ্রহটাই তো নষ্ট হয়ে গেল। আমাদের মাটিটা একটু আগেভাগেই পানির তলায় চলে গেল আর কি।"
"প্রযুক্তিতে তেমন উন্নতও তো ছিল না।"
এবার একটু উত্তেজিত হয়ে ওঠে নিও, "ওটা মোটেও কারণ ছিল না। যাদের প্রযুক্তি উন্নত ছিল,তারাই বা কী করল? ওরা কেন টিকতে পারলো না? নিজেরাই ধ্বংস করলো নিজেদের। ভাগ্যিস, বেরিয়ে আসার প্রযুক্তি প্রায় অনেকেরই হাতে ছিল তখন।"
"তা ঠিক।" আর কথা বাড়ায় না ক., সম্ভবত তার মনে পড়ে যায় এদের প্রতিষ্ঠান তাকে বেশ কিছু বাড়তি সুবিধে দিচ্ছে।
"আপনারা ঠিক কী কাজ করবেন ওখানে?" কথা ঘোরায় সে।
"নানান জায়গা থেকে তথ্য, উপাদান নেবো, নানারকমের। মাটি খুঁড়বো। পুরনো জিনিস খুঁজে বের করবো। সম্ভব হলে ইতিহাসের পাতার সাথে মিলিয়ে কিছু তুলে আনার চেষ্টা করবো। ভাগ্য ভালো থাকলে হয়তো দারুণ কিছু আবিষ্কারও করে ফেলতে পারি।"
"করুন। শুভেচ্ছা থাকলো। তবে জানেন তো, পুরোটাই মাটির নিচে চাপা পড়ে গেছে।" এবার তার চাপা পরিহাস বিদ্রূপ হয়ে তার সারা মুখে ফুটে ওঠে।
নেমেছে তারা।
এখন অনেক কাজ তাদের। প্রথম কাজ তাদের বিভাগের সাথে যোগাযোগ করা। কাজটা বেশ শক্ত হতো এমনকি পঞ্চাশ বছর আগেও। কিন্তু, এখন অগুনতি শক্তিশালী কৃত্র্রিম উপগ্রহ আর বেতার তরঙ্গধারক তাদের কাজ অনেকটাই সহজ করে দিল। তার ওপর কাছাকাছির মধ্যে একটা তথ্য সংগ্রহের গবেষণাগার ছিলোই। ওতেই কাজটা আরো সহজ হয়ে গেল।
পুরো মাটিটাই বহু আগে চলে গেছে পানির নিচে, সমুদ্রের পানি। উপকূলের কাছাকাছি জায়গা বলে পলিমাটি বেশি হওয়ায় এখন যেদিকেই তাকানো যায় শুধু সামান্য উচ্চাবচ প্রায়-ধূসর প্রায়-একরঙা স্তরীভূত শিলা ছাড়া আর কিছু চোখেই পড়ে না।
কতটুকু জায়গা খুঁড়ে দেখবে তারা, কি কি সংগ্রহ করা হবে বা করার চেষ্টা করা হবে, কতটুকু সময় লাগবে, সংগৃহীত জিনিসগুলো কিভাবে রাখা হবে, সবই আগে-থেকে ছকে-রাখা। যন্ত্রমানবদেরও নির্দেশ দেওয়াই আছে। কিন্তু, সব দেওয়া নেই।
এখানেই তাদের শিক্ষা কাজে লাগানোর কথা আসে। যা সংগ্রহ করা হলো, সেগুলোর শ্রেণিকরণ, সেগুলোর উপযোগিতা নির্ধারণ, পুরনো ইতিহাসের সাথে মিলিয়ে সেগুলো সঠিক মাত্রায় চিহ্নিতকরণ-এমনি সব কাজেই তাদের দক্ষতা প্রকাশিত হবে। এরপর সেগুলো অন্য গ্রহের সভ্যতার বা এর অবশেষের সাথে মিলিয়ে তাদের তুলনামূলক প্রত্মতত্ত্বীয় আলোচনায় নামতে হবে। যন্ত্রমানবগুলো না থাকলে যে কী হতো, তা আসলে এখন কেউ ভাবেই না। তাদের কাজ সুচারু আর সুনিয়ন্ত্রিত। অল্পক্ষণের মধ্যেই তারা থাকার, খাওয়ার আর কাজ-করার চমৎকার অস্থায়ী আবাস বানিয়ে দেয়।
"এটার নাম দিলাম 'আমাদের বাড়ি'।" ওয়াম উচ্ছ্বসিত হয়।
"ইশ, রেসিঙের ফাইনালটা দেখা হবে না আর", কৃত্রিম দুঃখপ্রকাশ করে নিওশা।
"নি, আমার কাটা ঘায়ে হাইড্রোসায়ানিক এসিডটা না ঢাললে তোর চলছিলো না?" কৃত্রিম ক্রোধপ্রদর্শন করে ওয়াম।
তিনজনই তারা ভেতরে গিয়ে বসে।
নিওশা শুরু করে।
"জানিস তো মুক্তজ, আমার দা, অসুস্থ।"
"জানি। এখন ঠিক আছেন তো?"
"এখনো পর্যন্ত মোটামুটি। আসার আগে উনি আমায় একটা চাকতি দিয়েছেন। ওখানে এই মাটির কোন একটা জায়গার কিছু তথ্য রাখা আছে। আমায় বলা হয়েছে আমি যেন সেই জায়গাটা খুঁজে বের করি, যেকোনভাবে। ওটা আমার পূর্বপুরুষেরা অনেক খুঁজেছেন। কিন্তু, আমাদের মাটিটা পানির নিচে চলে যাওয়ায় তাঁরা শেষপর্যন্ত সুবিধে করে উঠতে পারেন নি।"
"তো, ওখানে আছেটা কী?"
"চাকতিতে বলা আছে ওখানে এমন কিছু আছে যেটা দেখলেই আমি বুঝে যাবো আমায় কী করতে হবে। আমিও নিশ্চিত না ব্যাপারটা কী। কয়েকটা আন্দাজ আছে বটে। আমি শুধু চাই তোরা আমার সাথে থাকবি। আশা করছি সফল হবো। দা অবশ্য নিশ্চিত আমার সাফল্য নিয়ে। কারণ ওর একটা কুসংস্কার। এই বছরটা।"
"বছরটা? বছরে কী হলো?"
মুখ টিপে হাসে নিওশা। "দা বলে, সমস্যা হলে ওটাকে অর্ধেক করার চেষ্টা করলে সমস্যাটা সহজ হয়ে আসে। তা তোরা আমার সাথে আছিস তো?"
"হ্যাঁ, হ্যাঁ রে বাবা, আমরা সবাই আছি।" ওয়াম ফিকে হাসে।
জায়গাটার মোটাদাগে সূত্র রাখাই ছিলো। অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশ নামে একটা পুরনো হিসেব ব্যবহার করা হতো। সেটা ধরেই প্রায় পৌঁছে গেলো তারা সেখানটায়।
শুরু হলো খোঁড়াখুঁড়ি। যন্ত্রমানবেরাই দায়িত্ব নিলো।
প্রায় দুদিনের প্রচণ্ড পরিশ্রম আর মাথা-ঘামানো শেষ হওয়ার পালা। নিওশা পুরো সত্যিটা বলে নি তার বন্ধুদের। সে জানে কী খুঁজছে সে। সে জানে না তার বন্ধুরা কিরকম আচরণ করবে তার সাথে যদি জানে ওগুলো আসলেই কী। হয়তো তার খ্যাপামিতে রাগ করবে, হয়তো হাসাহাসি, হয়তো...।
"এটা কী রে?" যন্ত্রমানবদের খোঁড়াখুঁড়িতে উঠে-আসা একটা স্থাপনার দিকে তাকিয়ে ক্লান্তভাবে বলে অরপ।
"ওটা একটা চিরন্তন আগুনের উৎস ছিলো। ওটা সবসময় জ্বালানো থাকতো এই মাটির লোকেদের লড়াই আর স্বাধীনতার স্মৃতি মনে পড়িয়ে দিতে।" নিওশা যন্ত্রের মতো একঘেয়ে গলায় বলে। সে তার সন্ধানের খুব কাছাকাছি এই সত্যটা টের পেয়েছে তার অবচেতন।
নিওশা খুঁজে পাচ্ছে জায়গাটা। সূত্রগুলো সব গুছিয়ে আনছে সে। ছোট হয়ে আসছে তার সন্ধানের পরিধি। সে অবাক হয় সেসব পুরনো লোকেদের ঔদ্ধত্যে আর ক্রূর বুদ্ধিতে। এটা ছিল তখনকার সেনানিবাস, আর এখানেই কি না লুকনো আছে...! যাক, শেষ দেখেই ছাড়বে সে। ব্যয (ব্যক্তিগত যোগাযোগকারক)-তে মুক্তজ-এর সাথে কথা বলা যাবে না, অসুস্থতার জন্যে। কিন্তু সে খবর পাচ্ছে তার অবস্থা দিন দিন যাচ্ছে খারাপেরই দিকে। সে খুব করে কামনা করে যেন তার খোঁজাখুঁজির পালা শেষ হলে সে একটা ভালো খবর তুলে দিতে পারে তার দা-এর কানে। আগের দিনে নাকি লোকেরা ঈশ্বর নামে এক অতিলৌকিক সত্তায় বিশ্বাস রেখে তার কাছেই সব চাইতো আর ভরসা করতো। উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠার মধ্যেও তার হাসি পেয়ে যায়। আহা, সেও যদি পারতো সব দায়িত্ব কারুর ঘাড়ে তুলে দিয়ে নির্ভার হতে! আবারো একজনের মুখ আবছা হয়ে ভেসে ওঠে তার মনের ঘরে।
শেষ সূত্রটাও সমাধান করেছে নিওশা। এখন তারা দাঁড়িয়ে আছে একটা মাটির নিচের দরজার সামনে। গোপন গুহার মতো ঘরটা। তারা ঢুকলো দল বেঁধে।
এঘর ওঘর ঘুরে তারা এসে দাঁড়ালো একটা বড় দরজার সামনে। এখানেই, নি জানে, তার, তার পূর্বপুরুষদের এতোদিনের খোঁজার শেষ।
যন্ত্রমানবদের সাহায্য নিয়েও অনেক কষ্ট হয় দরজাটা খুলতে।
"ভেতরে কী আছে রে?" ওয়ামের কৌতূহলী গলা।
"ক'টা লাশ।"
"লাশ? এগুলো খোঁজার জন্যে আমরা এতোদিন ধরে এতো কষ্ট করলাম?"
"ওগুলো এখানে আর থাকবে না।"
আর কাউকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সে ভেতরে অন্ধকারে ঢুকে পড়ে। অন্যেরা আসে তার পেছন পেছন।
অনাড়ম্বর, কিন্তু সাজানো সমাধিস্থলটা। সবার নিচে চারটা বাক্স, তার ওপর তিনটা, তার ওপর দুটো, তার ওপর একটা।
সবার ওপরের বাক্সটার ওপর কী যেন লেখা ধুলোয় ঢাকা পড়েছে। ভাষাটা নি-এর পরিচিত নয়। সে ওটার ছবি নিয়ে সরাসরি পাঠায় মূল তথ্যকেন্দ্রে। একটু পরেই জানা যাবে ওখানে কী লেখা আছে।
"নি," ওয়াম বাধা দেয়, "এরা যদি মৃত মানুষ হয়, এদের শান্তিতে থাকতে দেয়াটা ভালো না? এতো পুরনো মরা মানুষগুলো তো তোর পূর্বপুরুষই, না?"
"খবরদার!" নি চিৎকার করে ওঠে পাগলের মতো। "এই বেজন্মা হারামিগুলো আমার কেউ না। আমাদের কেউ না। এই হিংস্র, ধূর্ত শয়তানগুলো বরাবরই আমাদের দেশের মাটির বিরুদ্ধে, মানুষের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে। যারা এই মাটির স্বাধীনতা চেয়েছিলো, তাদের তুলে দিয়েছে ভিনদেশি হায়েনাদের হাতে, তাদের মা-বোনদের ছুঁড়ে দিয়েছে নরকের কুকুরদের মুখে। শেষমেষ তাদের বিচার হয়, মৃত্যুদণ্ড। মানুষ তাদের ওপর এতো খ্যাপা ছিলো যে কেউ তাদের মৃতদেহ এই মাটিতে রাখতে চায় নি। শেষপর্যন্ত তাদের সাথের লোকেরা কোথায় যে তাদের লাশ লুকিয়ে ফেললো, আর খুঁজে পাওয়া যায় নি। আমার পূর্বপুরুষেরা অনেক খুঁজেছে কিন্তু পারে নি শেষমেষ। আজ আমি পেলাম। আর এই মাটিতে তাদের থাকার সুযোগ দেওয়া হবে না। ওই বাক্সগুলোর ওপরের লেখাটা কিন্তু এই মাটির লেখা না। ওগুলো অন্য মাটির লোকেদের বর্ণমালায় লেখা। মরার পরেও তাদের ওই দেশের জন্যে ভালোবাসা যায় নি। তবে, এ-ই শেষ।"
"হ্যাঁ, এই শেষ।" অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা গলায় বলে ওয়াম। তার হাতে ছোট একটা মারণাস্ত্র উঠে এসেছে কখন।
জমে গেছে নি তার নিজের জায়গায়।
"তোর পূর্বপুরুষদের কাজ তুই শেষ করছিস, আমার পূর্বপুরুষদের সম্মানও আমায় রাখতে দে।"
"তুই...? মানে...?"
"হ্যাঁ। ওই যে সবার ওপরের বাক্সটা, ওটায় আমার পূর্বপুরুষ শুয়ে আছেন। তাঁকে বিরক্ত করা চলবে না। তোর সাথে মিশেছি, কারণ জানতাম তোদের কাছেই আছে এখানে আসার রহস্য। জানতাম, এবার তোরা চেষ্টা করবিই। কিন্তু, আফসোস! পারবি না। উনি আর উনার সঙ্গীরা এখানেই ছিলেন, আছেন, থাকবেন। আহ্হ্হ্হ..." তার কথা শেষ হয় না। অরপের হাতের প্রায়-অদৃশ্য অস্ত্রটা থেকে মারণরশ্মি বেরিয়ে ওয়ামের বুকে প্রায় আধা মিটার ব্যাসের একটা গর্ত তৈরি করেছে।
নি ঘটনার ঘনঘটায় বিমূঢ় হয়ে বসে পড়েছে। তার ব্যয-টা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সে ওটা হাতে নিয়ে দেখে। কেন্দ্রীয় তথ্যকেন্দ্রে তার পাঠানো ছবিটার ভাষা অনুবাদ করা হয়েছে। সে দেখে ওখানে লেখা আছে:
"এখানে চিরশান্তির দেশে যাত্রার উদ্দেশে শায়িত বীর সেনাধ্যক্ষ মহান নেতা গুলফাম আজমল। ঈশ্বর তাঁর চিরসহায় ছিলেন, আছেন সুনিশ্চিতভাবেই। নিশ্চয় ঈশ্বর চিরকল্যাণদাতা, চিরপ্রশংসনীয়।"
নি ওঠে। খোলে বাক্সটা। শরীরটা মমি-করা। কাপড়জড়ানো। চোখে বহুরশ্মক চশমা পরে পরীক্ষা করতে থাকে মৃতদেহটা। চশমাটা রঞ্জন-রশ্মিময় করে তোলে সে। কী যেন দেখে তার উত্তেজনা বেড়ে যায়। সে হাতছানি দিয়ে ডাকে অরপকে।
"দেখ, দেখ।"
অরপ দেখে। উত্তেজিত গলায় সে-ও বলে, "এ তো অসম্ভব।"
"হ্যাঁ, তাই তো। এরা তো মানুষ না! দেখ হাতের আঙ্গুলের হাড়ের ডগাগুলো কেমন ছুঁচলো। পায়ের আঙ্গুলও তাই। পুচ্ছদেশীয় কশেরুকাগুলোর শেষটুকু দেখ। লেজ প্রায় বেরিয়েই আসছে। মুখে দেখ। ছেদক-দাঁতগুলোও বেশ ধারালো। এরা যখন বেঁচে ছিলো, লোকেরা টের পেতো না এরা যে আসলে মানুষ না?"
"বোধহয়, নিজেদের লুকিয়ে রাখতো কৌশলে। কৌশল নিশ্চয় জানতো ভালোই।"
"হুঁ, শুনেছি নীতিকথার আড়ালেই নিজেদের ঢাকতো ওরা।"
"বাকিরাও এরকমই হবে বোধহয়।"
"আর বলতে!"
"এখন?"
"আর কি! সবার সব শরীর পরমাণু করে মহাশূন্যে ভাসিয়ে দেবো। ওয়ামেরটা তো সঙ্গে নিতেই হবে। কী আর করা! কিন্তু, এই মাটিতে এদের আর ঠাঁই নেই।"
নি বের করলো পরমাণুক অস্ত্রটা।
১৯৭১ সালের ঠিক ১৯৭১ বছর পর আরেক ১৬ ডিসেম্বরে বাংলার মাটিতে স্বাধীনতাবিরোধীদের শেষ চিহ্নটাও মুছে যায়।
মন্তব্য
এটা কি হল ঠিক বুঝলাম না! প্রায় ৩০০০ শব্দের পুরো লেখাটাই প্রিভিউ?!
****************************************
ইন্টারেস্টিনং!
****
অফটপিক্ঃ
অসীম বুদ্ধিদীপ্ত ও হাস্য়োজ্জল আমার প্রিয়বন্ধু হুমায়ুন হত্য়ার সুবিচার চাই। আসিফ ভাই আপিল করবেন, বলে শুনেছি। অবাক হই, একই মামলা ধামাচাপা দিতে ঘুষ খাওয়ার অভিযোগে বাবর জেলে আছে, কিন্তু সেই আসল খুনের মামলার অভিযুক্তর যারা বাবরকে ঘুষ দিল, তারা খালাস পেল। সেলুকাস।
হুমায়ুনের সাথে আপনার কি স্কুলে যোগাযোগ ছিলো, না কলেজে? আমি সাব্বির হত্যার কথা অনেকবার শুনেছি, কিন্তু সে যে আমাদের হুমায়ুন, সেটা জেনেছি অনেক পরে এবং জেনে ক্ষোভে-দুঃখে-আঘাতে বোবা হয়েছিলাম অনেকক্ষণ। এই আমাদের দেশ, এই আমাদের পরিণতি। কী মেধাবী একটা ছেলের কী নির্মম ভবিষ্যৎ! এই দেশ কী দিলো তাকে, কোন উত্তর আছে কি এই প্রশ্নের?
_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!
(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)
হুমায়ূনের সাথে আমার পরিচয় ঢাকা বিশ্ববিদ্য়ালয়ে।
ঠিক একই কথাটা আমারও মনে হয়েছে
খুবই ভালো লাগল। আর বিনির্মাণ করেছেন ব্যাপক। কাহিনীর যোগসুত্রটা খুব টানটান । পাঁচতারা
[ অটঃ একটা ভালো চিত্রনাট্য হয়ে যায় কিন্তু। ভেবে দেখবেন। মঞ্চে কিংবা সেলুলয়েডে ]
ডাকঘর | ছবিঘর
ভালো লিখেছেন। গুরুর লেখনীর প্রতি শ্রদ্ধা বাড়লো আরও।
_____________________________________________________________________
বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।
মহাস্থবির জাতক - আপনারা কি চিটাগং-এর কোন স্কুলে একসাথে পড়তেন?
নতুন মন্তব্য করুন