[ল্যু স্যুন (সেপ্টেম্বর ২৫, ১৮৮১-অক্টোবর ১৯, ১৯৩৬)-এর আসল নাম ঝৌ শুরেন এবং তাঁকে বিংশ শতাব্দীর চিনে লেখকদের মধ্যে অন্যতম পুরোধা হিসেবে পৃথিবী জানে। 'ডায়েরি অব আ ম্যাড ম্যান' বা 'আ ম্যাড ম্যানজ ডায়েরি' গল্পটি প্রকাশিত হয় ১৯১৮-এর এপ্রিলে এবং প্রকাশের পরপরই তিনি খ্যাত হয়ে ওঠেন। তাঁর সেরা রচনাগুলোর একটা হিসেবে ধরা হয় এটি। পড়ুন, উপভোগ করুন। সাথে ল্যু স্যুনের ওপর লেখা একটি ব্লগ, বাংলায়। ল্যু স্যুনের একটা বাণী দিয়েই ভূমিকা এখানে শেষ করি:
বিচক্ষণ, পরাক্রান্ত মানুষজন অতীতকে মৃত আর ফেলে-আসা সময় হিসেবেই বিবেচনা করে। ক্ষমতাসীনরা চায় এখনকার অবস্থানেই থেকে যেতে। যারা এখনো ক্ষমতার স্বাদ পায়নি তারা চায় সবকিছুকে ঢেলে সাজাতে।
এটাই সাধারণ নিয়ম।]
দু'ভাইয়ের সাথে হাই স্কুলে থাকার সময় আমার বেশ দোস্তি ছিলো, তাদের নামগুলো এখানটায় বলছি না; কিন্তু বহু বছরের বিচ্ছেদের পর ধীরে ধীরে আমাদের সম্পর্ক ফিকে হয়ে যায়। কিছু দিন আগে খবর পাই যে তাদের একজন বড্ড অসুস্থ, আর যেহেতু আমি ফিরে যাচ্ছি আমার পুরনো বাড়িতে, তাই যাত্রার মাঝপথে তাদের সাথে দেখা করতে গেলাম। অবশ্য দেখা হলো আমার সাথে স্রেফ একজনেরই, জানলাম তার কাছ থেকে যে অসুস্থজন তার ছোট ভাই।
"আমাদের দেখতে এদ্দূর এসেছিস জেনে ভালোই লাগছে," বলে সে, "কিন্তু কিছু দিন আগে ও সেরে উঠে অফিসের কাজে বাইরে গেছে।" তারপর হেসে উঠে সে তার ভাইয়ের ডাইরির দুটো খণ্ড আমায় আমার হাতে তুলে দেয়। তার ভাষ্যমতে এগুলো থেকে তার ভাইয়ের অসুখের রকম নিয়ে জানা যাবে আর পুরনো কোন বন্ধুকে এগুলো দেখাতে তেমন দোষ নেই। ডায়েরিগুলো নিয়ে আমি পুরোটা পড়ি আর দেখি যে সে হত্যার ভয়ের কোন একটা রকমফেরে ভুগছিলো। লেখাটা বড্ড খাপছাড়া আর বিভ্রান্ত, আর নানারকমের উদ্ভুট্টি কথাবার্তায় ভর্তি; তার ওপর তারিখের কোন বালাই নেই, কালির রং আর লেখার ভিন্নতায় বোঝা যায় যে আলাদা আলাদা সময়ে ওসব লেখা হয়েছে। কিছু কিছু অংশ অবশ্য একেবারে অসঙ্গতিপূর্ণ নয়। আমি ওখান থেকে চিকিৎসাসম্বন্ধীয় গবেষণার জন্যে বেশ কিছু জায়গা লিখে রেখেছি। ডায়েরির একটিও অযৌক্তিক কথাবার্তা আমি পাল্টাই নি, শুধু নামগুলো বদলে দিয়েছি। অবশ্য যাদের নাম লেখা ছিলো তারা গ্রামের লোক, দুনিয়ার কাছে অচেনা আর নাম না পাল্টালেও বিশেষ কিছু যেতো-আসতো না। শিরোনামটা লেখকেরই, সেরে-ওঠার পর সে নিজেই বেছে নিয়েছিলো নামটা, ওটা আর বদলাই নি আমি।
১
আজ রাতের চাঁদটা খুব ঝলমলে।
ত্রিশ বছরের ওপর হয় ওটা দেখি নি আমি, তাই আজ যখন ওটা দেখলাম তখন দারুণ লাগছিলো। বুঝতে পারলাম যে গত প্রায় ত্রিশ বছরের ওপরে আমি ছিলাম অন্ধকারে; কিন্তু এখন আমায় অসম্ভব সতর্ক হতে হবে। নইলে চাওদের বাড়ির কুকুরটা আমার দিকে দু'দু'বার করে তাকাবে কেনো?
ভয় পাওয়ার কারণ আছে।
২
আজ রাতে চাঁদ দেখলামই না, আমি জানি এটা অশুভ সংকেত। আজ সকালে যখন আমি বেরুচ্ছি সাবধানে, দেখি কি মিঃ চাওয়ের চোখে অদ্ভুত একটা ভাব, যেন লোকটা আমায় ভয় পাচ্ছে, যেন সে আমায় খুন করতে চায়। আরো সাত-আটজন ছিলো, ওরাও আমায় নিয়ে কানাকানি করতে লাগলো। আর আমায় দেখে তারা ভয় পেয়ে গেলো। যতগুলো লোকের পাশ দিয়ে চলে গেছি সবাই প্রায় একই কাণ্ড করলো। ওদের ভেতর সবচে' হিংস্র দেখতে লোকটা দাঁত খিঁচালো আমায় দেখে। শিউরে উঠলাম আমি আপাদমস্তক, আমি জেনে গেছি এখন তাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।
আমি অবশ্য ভয় পাই নি, হেঁটে চলেছি আপন মনেই। একদল বাচ্চাকাচ্চা আমায় নিয়ে কিসব কথাবার্তা বলছিলো। তাদের চোখের দৃষ্টি হুবহু মিঃ চাওয়ের মতো, মুখ ভয়ংকর ফ্যাকাশে। ঠিক বুঝলাম না আমার বিরুদ্ধে ওদের এতো কিসের আক্রোশ যে এরকমটা করছে! থাকতে না পেরে চিৎকার করে উঠলাম: "বল তো দেখি!" কিন্তু তখন তারা পালিয়ে গেলো।
ভেবে পাচ্ছিলাম না মিঃ চাওয়েরই বা আমার ওপর এতো আক্রোশ কিসের, রাস্তার লোকগুলোই বা আমার ওপর এতো খ্যাপা কেনো। মনে পড়লো শুধু একটা ঘটনাই। বছর কুড়িক আগে, আমি মিঃ কু চিওর (১) হিসেবের কাগজপত্তর অনেক দিন ধরে পায়ে মাড়িয়েছি, আর তাতে মিঃ কু খুব অসন্তুষ্ট হন। যদিও মিঃ চাওয়ের সাথে তাঁর কোন সম্পর্ক ছিলো না, তিনি নিশ্চয় এ-ঘটনা শুনেছেন আর আমার ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার কথা ভেবেছেন, আর তাতে রাস্তার লোকগুলোকেও জড়িয়ে নিয়েছেন। কিন্তু, তাতে বাচ্চাদের কী সম্পর্ক? সেসময় তো তাদের জন্মই হয় নি। তাহলে ওরা আমার দিকে এমন আজব ভাবে চাইছেই বা কেন, যেন তারা আময় ভয় পাচ্ছে, যেন তারা আমায় খুন করতে চায়? বড় ভয় পেয়ে গেলাম, পুরোটাই কেমন যেন মাথা-গুলিয়ে দেয় আর মনটা ভার করে দেয়।
বুঝেছি। নির্ঘাৎ তাদের মা-বাবার কাছ থেকে ওরা জেনেছে!
৩
রাতে আমি ঘুমুতে পারি না। সব কিছু বুঝতে চাইলে খুব মাথা ঠান্ডা করে এগুতে হবে।
গত কাল সেসব লোকগুলো, যাদের কাউকে ম্যাজিস্ট্রেট গলায় তক্তা বেঁধে শাস্তি দিয়েছে, কাউকে এলাকার উঁচুতলার কেউ চড় মেরেছে কষে, অভিযোগ করে কারোর বউ নিয়ে গেছে বাদিরা কিংবা পাওনাদারদের তাড়ায় যাদের মা-বাবা আত্মহত্যা করেছে, তাদের সবাইকে এমন ভয়-পাওয়া আর হিংস্র দেখাচ্ছিলো যেমনটা আগে কখনো দেখি নি।
সবচাইতে অস্বাভাবিক ব্যাপারটা ছিলো গতকাল রাস্তার সেই মহিলাটা যে তার ছেলেটাকে মারতে মারতে বলছিলো, "খুদে শয়তান! তোর গা থেকে কয়েক কামড় খেলে তবে আমার মাথা ঠান্ডা হবে!" তারপরও সে দেখি সারাটা সময় তাকিয়ে ছিলো আমার দিকেই। নিজেকে সামলাতে পারি নি আমি, হাঁটা শুরু করেছি; তখনই দেখি সবুজমুখো লম্বা দাঁতের লোকগুলো পাগলের মতো হাসি শুরু করেছে। বুড়ো চেন তাড়াহুড়ো করে এসে আমায় ঘরে টেনে নিয়ে গেলো।
সে আমায় ঘরে টেনে নিয়ে এলো। ঘরের লোকগুলোও যেন আমায় চিনতে পারছে না; অন্যদের মতো তাদের চোখেও একই দৃষ্টি। পড়ার ঘরে যখন গেছি, তারা যেমনি করে ঘরে হাঁস বা মুরগির বাচ্চা বন্দি করে রাখে, তেমনি করে আটকে রাখলো আমায়। এতে আমার মাথা আরও গুলিয়ে গেলো।
কিছু দিন আগে নেকড়েশাবক গ্রাম থেকে আমাদের এক ভাড়াটে শস্যের ক্ষতির কথা জানাতে এসেছিলো। বড়দাকে সে জানায় যে গ্রামের একটা বদমাশকে সবাই দল বেঁধে পিটিয়ে মেরেছে; তারপর লোকেদের কেউ কেউ তার হৃৎপিণ্ড আর কলজেটা বের করে নিয়ে তেলে ভেজে খেয়ে ফেলেছে, তাতে করে নাকি তাদের সাহস বাড়বে। আমি যখন মাঝখানে কথা বলে উঠলাম, ভাড়াটেটা আর বড়দা দুজনেই আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আজই বুঝলাম যে তাদের দৃষ্টিটাও ঠিক বাইরের লোকগুলোর মতোই ছিলো।
ভাবনাটা মাথায় আসতে মাথার ব্রহ্মতালু থেকে পায়ের তলা পর্যন্ত শিউরে উঠলো আমার।
ওরা মানুষ খায়, তাই আমায়ও তারা খেয়ে ফেলতে পারে।
বুঝতে পারলাম যে মহিলাটার "তোর গা থেকে কয়েক গ্রাস খেয়ে-নেওয়া", সবুজমুখো লম্বা দাঁতের লোকগুলো আর ওই দিন ভাড়াটেটার গল্পগুলো নিঃসন্দেহে গোপন সংকেত। বুঝলাম তাদের কথায় লুকোনো আছে বিষ, তাদের হাসিতে লুকিয়ে আছো ছুরি। তাদের দাঁতগুলো সাদা আর ঝকঝকে সবাই তারা আদমখোর।
যদিও লোকটা আমি অতোটা খারাপ নই, তারপরও মনে হলো যেদিন থেকে মিঃ কু-এর হিসেবের খাতা মাড়িয়েছি, সেদিন থেকেই সব কিছু নির্ধারিত হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে তাদের এমন কিছু রহস্য আছে যা আমি ধরতে পারছি না, আর একবার ক্ষেপে উঠলে তারা যে-কাউকে খারাপ লোক হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে। মনে পড়ে গেলো যখন বড়দা আমায় রচনা লেখা শেখাতো, তখন আমি যদি বিরুদ্ধে কোন যুক্তি দিতাম, তখন ভালো মানুষ হওয়ার পরেও জায়গাগুলো দাগ দিয়ে রাখতো ওর অনুমোদন বোঝাতে; যদি আমি খারাপ লোকেদের মাফ করার কথা বলতাম, সে বলতো, "ভালোই হলো, মৌলিকত্ব দেখা যাচ্ছে।" ওদের গোপন কথা আমি কিভাবে বুঝবো-বিশেষত যখন তারা মানুষকে খাওয়ার কথা ভাবছে?
সব কিছু বুঝতে চাইলে খুব মাথা ঠান্ডা করে এগুতে হবে। অনেক আগে লোকেরা মানুষ খেতো বটে, কিন্তু ঠিক স্পষ্ট মনে পড়ছে না। খুঁজে দেখতে চাইলাম সেসব, কিন্তু ইতিহাসের ঠিক সময়ের হদিশ নেই আমার, আর প্রতিটা পাতাতেই দেখলাম হিজিবিজি করে লেখা: "ন্যায়পরায়ণতা আর নৈতিকতা"। যেহেতু আমার ঘুম আসে না, প্রায় অর্ধেক রাত অবধি মন দিয়ে পড়লাম, শেষমেষ দেখি লাইনগুলোর ভেতরে ভেতরে দেখতে পাচ্ছি শব্দ, দুটো শব্দই ভরে রেখেছে পুরো বইটা-"মানুষ খাও"।
বইটার যতো শব্দ, আমাদের ভাড়াটের বলা যতো কথা, সবই অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে রহস্যময় এক হাসি দিয়ে।
আমিও একটা মানুষ, আর তারা আমায় খেতে চায়!
সকালে কিছু ক্ষণ বসে রইলাম চুপচাপ। বুড়ো চেন খাবার নিয়ে এলো: এক বাটি সবজি, এক বাটি ভাপানো মাছ। মাছের চোখগুলো সাদা আর শক্ত, আর ওটার মুখ সেসব লোকেদের মতো হাঁ-করা যারা মানুষ খেতে চায়। কয়েক গ্রাস খাওয়ার পর আর বুঝতে পারছিলাম না পিচ্ছিল টুকরোগুলো মাছ না মানুষের মাংস, তাই সব বমি করে ফেললাম।
আমি বললাম, "চেন বুড়ো. দাদাকে বলো যে আমার খুব দম আটকে আসছে। আমি বাগানে একটু হেঁটে আসতে চাই।" বুড়ো চেন কিছু না বলে বেরিয়ে গেলো। কিছু সময় পরে ফিরে এসে সে দরজাটা খুলে দিলো।
আমি নড়ি নি, দেখছিলাম তারা কিভাবে আমায় নেয়। খুব ভালো করেই জানি যে ওরা আমায় বেরুতে দেবে না। একদম পাক্কা! দাদা ধীরে ধীরে একটা বুড়ো লোককে নিয়ে বেরিয়ে এলো। তার চোখে খুনিয়া দৃষ্টি। আমি ওটা দেখবো বুঝে সে মাথা নামিয়ে নিলো, চুরি করে চশমার ফাঁক দিয়ে দেখছিলো আমায়।
"দেখে মনে হচ্ছে তুই আজ বেশ ভালো আছিস," দাদা বললো।
"হ্যাঁ," আমি বলি।
"মিঃ হো-কে নিয়ে এলাম আজ," দাদা বলে, "তোকে দেখানোর জন্যে।"
"ঠিক আছে," বলি আমি।
আসলে আমি খুব ভালো করেই জানি যে বুড়োটা ছদ্মবেশী খুনি। আমার নাড়ি দেখার ছলে সে দেখা নেয় আমি কতোটা মোটা হয়েছি; কারণ ওটা করলে সে আমার মাংসের ভাগ পাবে। তারপরও আমি ভয় পাই নি। যদিও আমি মানুষ খাই না, তারপরও ওদের চাইতে আমার সাহস অনেক বেশি। আমি দুটো হাত মুঠো করে বাড়িয়ে দেই, দেখি ওটা নিয়ে সে কী করে। বুড়োটা বসে, চোখ বন্ধ করে, কিছু ক্ষণ হাতড়ায়, তারপর কিছু ক্ষণ চুপ করে থাকে; তারপর তার চুলবুলে চোখগুলো খোলে আর বলে, "কল্পনাকে হারিয়ে যেতে দিও না। কয়েক দিন চুপচাপ বিশ্রাম নাও, তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে।"
কল্পনা হারিয়ে যেতে দিও না! কয়েক দিন চুপচাপ বিশ্রাম নাও! যখন আমি মোটা হয়ে উঠবো, স্বাভাবিকভাবেই তাদের খাবার বেশি হবে; কিন্তু তাতে আমার লাভ কী, আর ওতে করে 'সব ঠিক'ই বা হয়ে যাবে কিভাবে? যেসব লোকগুলো মানুষের মাংস খেতে চায় আর একই সাথে চুপচাপ লুকিয়ে কাজ করে, দ্রুত কাজ করতে সাহস পায় না, ওদের দেখেশুনে হাসতে হাসতে আমার প্রাণ যায় আর কি। চেঁচিয়ে না হেসে উঠে পারি না, খুবই আমোদ হচ্ছিলো আমার। আমি জানি যে এই হাসিতে লুকিয়ে আছে সাহস আর সততা। বুড়ো লোক আর বড়দা দুজনেই আমার সাহস আর সততায় থ হয়ে ফ্যাকাশে বনে যায়।
কিন্তু আমি সাহসী বলেই তারা আমায় আরো বেশি করে খেতে চায়, যাতে করে আমার সাহসের ভাগ পায় তারা। বুড়োটা দরজার বাইরে বেরিয়ে যায়, কিন্তু খুব বেশি দূর যাওয়ার আগেই দাদাকে সে নিচু গলায় তাকে বলে, "এখনই খেতে হবে!" আর দাদা মাথা নাড়ে। তুমিও তাহলে এখানে জড়িয়ে আছো! এই হতবুদ্ধিকর আবিষ্কার যদিও দারুণ নাড়া দিলো আমায়, আশাতীত কিছুই ঘটে নি আসলে: আমায় মেরে যারা খেতে চায় তাদের সাহায্য করছে আমারই বড় ভাই!
নরমাংসখাদক আমারই বড় ভাই!
নরখাদকের ছোট ভাই আমি!
অন্যেরা খাবে আমায়, কিন্তু তারপরও আমি এক নরখাদকের ছোট ভাই!
৫
সেসব দিনগুলোয় আমি আবারো ভাবা শুরু করলাম: লোকটা যদি ছদ্মবেশী খুনি না-ও হয়, একজন আসল ডাক্তারই হয়, তারপরও সে নরখাদক ছাড়া আর কিছু নয়। ওর পূর্বসূরী লি শি-চেনের (২) ভেষজ গুল্ম নিয়ে লেখা বইটায় স্পষ্ট ভাষায় লেখা আছে যে মানুষের মাংস সেদ্ধ করে খাওয়া যায়। এখনো কি ও বলবে যে ও মানুষ খায় না?
দাদাকে সন্দেহ করারও স্পষ্ট কারণ আছে। যখন সে আমায় পড়াতো, তখন নিজের মুখেই সে একবার বলেছিলো, "লোকেরা খিদের জ্বালায় খাদ্যের বিনিময়ে নিজেদের বাচ্চাদের বিক্রি করতো।" একবার একটা খারাপ লোকের কথা বলতে গিয়ে সে বলছিলো যে ওকে শুধু মেরে-ফেলাই উচিত না, বরং "ওর মাংস খেয়ে ওর চামড়া পেতে ঘুমুনো উচিত...।" (৩) আমি তখনো বেশ ছোটো, আর আমার বুকটা বেশ কিছু ক্ষণ জোরে জোরে ধুকপুক করেছিলো। সেদিন যখন নেকড়েশাবক গ্রাম থেকে একটা লোকের হৃৎপিণ্ড আর কলজে খেয়ে-ফেলার খবর এলো, বড়দা মোটেও আশ্চর্য হয় নি, বরং মাথা নেড়েই যাচ্ছিলো সে। ও আগের মতোই নিষ্ঠুর আছে। যেহেতু "বাচ্চাদের খাবারের জন্যে বেচে-দেওয়া" সম্ভব, তাহলে যেকোনো কিছুই এভাবে বদলে নেওয়া যায়, খাওয়া যায় যেকোনো কিছুই। আগে ওর ব্যাখ্যাগুলো আমি শুধু শুনেই যেতাম চুপচাপ। এখন টের পাচ্ছি যে কথাগুলো যখন সে আমায় বোঝাতো, তখন ওর ঠোঁটের কোণায় শুধু মানুষের চর্বিই যে লেগে ছিলো তা নয়, বরং মানুষ খাওয়ার জন্যে পুরোপুরি উন্মুখ ছিলো ওর মন।
৬
নিকষ আঁধার। জানি না এখন দিন না রাত। চাও-দের বাড়ির কুকুরটা আবারো ডাকা শুরু করেছে।
সিংহের হিংস্রতা, খরগোশের ভয়, শেয়ালের চাতুরি...
৭
ওদের মতলব জানি; সঙ্গে সঙ্গে কাউকে ওরা খুন করবে না, সাহসও নেই তাদের, পরিণামের ভয় পায় ওরা। তার বদলে ওরা দল বেঁধে সবখানে পাতবে ফাঁদ, নিজেকে খুন করতে বাধ্য করবে আমায়। কিছু দিন আগে রাস্তায় পুরুষ আর নারীদের ব্যবহার আর গত কদিন ধরে আমার বড় ভাইয়ের ব্যবহার দেখে এটা স্পষ্ট বুঝেছি। বেল্ট খুলে কড়িকাঠ থেকে ঝুলে পড়লে তাদের সবচাইতে পছন্দ হবে। তাতে করে খুনের দায় আর তাদের ঘাড়ে পড়বে না আর তাদের মনোবাসনাও পূর্ণ হবে। তাহলেই তারা প্রাণখোলা আনন্দের হাসিতে ফেটে পড়বে। অন্যদিকে, সে যদি ভয় পেয়ে বা উদ্বেগে মারা যায়, তাতে করে সে পাতলা হয়ে গেলেও তাদের চলবে।
ওরা শুধু লাশের মাংস খায়! মনে পড়লো কোথায় যেন একটা ভয়ংকর পশুর কথা পড়েছিলাম, 'হায়েনা' ওটার নাম, চোখে তার কুৎসিত একটা দৃষ্টি। সে মাংস খায় শুধু মৃত্যুর পর। এমনকি সবচাইতে বড় হাড়গুলোও ওরা চিবিয়ে ছাতু করে দেয় আর গিলে ফেলে: ভাবলেই ভয়ে প্রাণ খাঁচাছাড়া হয়। হায়েনারা নেকড়ের জাতভাই, আর নেকড়ে কুকুর প্রজাতির। ওদিন আবার চাওদের বাড়ির কুকুরটা আমায় বেশ ক'বার দেখেছে; নির্ঘাৎ ওই ব্যাটাও আছে এই ষড়যন্ত্রে ওদের সাথে। বুড়োটা চোখ নামিয়ে রেখেছিলো, কিন্তু ওসব করে আমায় ফাঁকি দেওয়া সম্ভব না!
সব চাইতে নোংরা ব্যাপার হলো আমার বড় ভাই। সেও তো এক জন মানুষ, তাহলে সে ভয় পাচ্ছে না কেন, কেন সে অন্যদের সাথে মিলে আমায় খেতে চাইছে? মানুষ এসবে কতোটা অভ্যস্ত হলে এগুলো অপরাধ না ভেবে পার পায়? নাকি কাজটা ভুল জেনেও সে মন শক্ত করে ফেলেছে?
নরখাদকদের অভিশাপ দিতে হলে শুরু করবো বড়দাকে দিয়েই, আর নরখাদকদের দূর করতেও ওকেই রাখবো পয়লা নম্বরে।
৮
আসলে, ওসব কথা ঢুকলে তাদের মাথায় অনেক আগেই ঢুকতো...
হঠাৎ কে যেন ঘরে ঢুকলো। ওর বয়েস বছর বিশেকের বেশি হবে না আর ওর চেহারা ঠিক ভালো করে আমি বুঝতে পারছিলাম না। তার মুখ হাসিতে কুঁচকে গেছে, কিন্তু যখন সে হেসে আমার উদ্দেশে মাথা নোয়ালো ওর হাসিটা খুব আন্তরিক লাগলো না।
ওকে প্রশ্ন করলাম, "মানুষ খাওয়া কি ভালো?"
তখনো হাসছিলো সে, বললো, "দুর্ভিক্ষ না হলে মানুষ খাওয়ার চিন্তা মাথায় আসবে কিভাবে?"
এক লহমাতেই বুঝে গেলাম, সেও ওদেরই দলে; কিন্তু তারপরও সাহস সঞ্চয় করে পরের প্রশ্নটা করলাম:
"কাজটা কি ঠিক?"
"এরকম ভাবছেন কেন? আপনি আসলে...বেশ কৌতুক পছন্দ করেন...আজকের দিনটা বেশ ভালো।"
"তা ভালো, চাঁদটাও বেশ উজ্জ্বল। কিন্তু আপনাকে যেটা জিজ্ঞেস করছিলাম: কাজটা কি ঠিক?"
ওকে কেমন কাবু দেখালো, বিড়বিড় করলো সে: "না..."
"না? তাহলে ওরা তারপরও কাজটা কেন করে?"
"কিসের কথা বলছেন?"
"কিসের কথা বলছি? ওরা নেকড়েশাবক গ্রামে আজকাল মানুষ খাচ্ছে, আর বইগুলোতেও জ্বলজ্বলে লাল কালিতে ওসব লেখা আছে।"
তার চেহারা পাল্টে গেলো, ভূত দেখার মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেলো সে। "হতে পারে," আমার দিকে তাকিয়ে বলে সে।
"ওরকমটাই হয়ে এসেছে..."
"ওরকম হয়ে এসেছে বলেই কি ব্যাপারটা ঠিক হয়ে গেলো?"
"আপনার সাথে ওসব নিয়ে আর কথা বলতে চাইছি না। যাহোক, ওসব নিয়ে মাথা ঘামাবেন না তো। যারাই ওসব নিয়ে কথা বলে তারা ভুলে ডুবে আছে।"
৯
নিজেরা এদিকে মানুষ খাবে, আবার একই সাথে নিজেদের অন্য কেউ খেয়ে নেবে সেই ভয়ে আছে, একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছে গভীর সন্দেহ নিয়ে...
যদি এসব দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেতো তারা, তাহলে জীবনটা তাদের জন্যে কী আরামের-ই না হতো। কাজে যেতে, হাঁটতে, খেতে আর ঘুমুতে পারতো তারা আরামে। শুধু একটা কাজই করতে হবে তাদের। তারপরও বাবারা আর ছেলেরা, স্বামীরা আর স্ত্রীরা, ভাই, বন্ধুরা, শিক্ষকেরা আর ছাত্রেরা, জাতশত্রু আর এমনকি অপরিচিতেরাও সবাই মিলেছে এই ষড়যন্ত্রে, নিরুৎসাহিত করছে অন্যদের আর দিচ্ছে বাধা যাতে ওই পদক্ষেপটা নেওয়া না হয়।
১০
আজ ভোরে ভোরে বড়দার খোঁজে বেরুলাম। ও হলঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিলো। আমি ওর পেছনে হেঁটে গেলাম, গিয়ে দাঁড়ালাম দরজা আর ওর মাঝখানে। খুব ভাব নিয়ে দারুণ বিনীত গলায় বললাম:
"দাদা, তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো।"
"বেশ, বলে ফ্যাল।" হুট করে আমার দিকে ফিরে মাথা নুইয়ে বললো সে।
"কথাটা ছোট, কিন্তু কিভাবে বলবো ঠিক বুঝছি না। দাদা, সব আদিম মানুষেরাই কিন্তু অল্পবিস্তর মানুষের মাংস খেতো। পরে তাদের চেহারা পাল্টে যায় বলে কেউ খাওয়া ছেড়ে দেয়। তারা ভালো থাকতে চেয়েছিলো বলে মানুষ হয়ে উঠেছিলো, আসল মানুষ। কিন্তু কেউ কেউ এখনো খেয়ে যাচ্ছে-সরীসৃপদের মতো।
"কেউ কেউ মাছ, পাখি, বানর আর শেষে মানুষ হয়ে উঠেছে; কিন্তু কেউ কেউ ভালো থাকতে চায় নি আর এখনো সরীসৃপই থেকে গেছে। যখন নরখাদক মানুষগুলো নরমাংস না-খাওয়া মানুষের সাথে তাদের তুলনা করে, ঘোরতর লজ্জায় ডুবে যায় তারা। সরীসৃপেরা বানরের সামনে যেমনটা হয় তার চাইতেও বেশি।
"আগের দিনে ইই ইয়া তার ছেলেকে সেদ্ধ করে চিয়েহ আর চৌকে খাইয়েছিল; ওটা পুরাণকাহিনি (৪)। কিন্তু যখন থেকে পান কু স্বর্গ-নরক তৈরি করেছেন ততদিন থেকেই মানুষ একে অন্যকে খেয়ে যাচ্ছে। ইই ইয়ার ছেলের আমল থেকে হ্সু হ্সি-লিনের (৫) আমল অবধি, হ্সু হ্সি-লিনের সময় থেকে নেকড়েশাবক গ্রামে মানুষ খাওয়া পর্যন্ত। গত বছর তারা একটা অপরাধীকে শহরে প্রাণদণ্ড দেয়, আর এক জন অভিযোগকারী মরা লোকটার রক্তে রুটি ভিজিয়ে শুষে নেয়।
"ওরা আমায় খেতে চায়, আর একা তুমি ওদের বিরুদ্ধে কিচ্ছু করতে পারবে না; কিন্তু তুমি ওদের দলে গিয়ে ভিড়লে কেন? নরখাদকেরা যেকোন কিছু করতে পারে। ওরা আমায় খেতে পারলে, তোমায়ও খেয়ে নেবে। একই দলের লোকেরাও একে অন্যকে খেতে পারে। কিন্তু তোমরা যদি তোমাদের রাস্তাটা এক্ষুণি শুধু একটু পালটে নিতে, তাহলে সবাই শান্তি পেতো। যদিও কাজটা অনাদিকাল থেকে চলে আসছে, তারপরও ভালো হওয়ার একটা বিশেষ ব্যবস্থা তো আমরা নিতে পারি, বলতে পারি যে কাজটা করা ঠিক না! দাদা আমি নিশ্চিত তুমি কথাটা বলতে পারো। ওই দিন যখন ভাড়াটেটা ভাড়া কমানোর কথা বলছিলো, তুমি বললে সেটা সম্ভব না।"
প্রথম দিকে সে শুধু অবিশ্বাসের হাসি হাসছিলো, তারপর একটা খুনে দৃষ্টি খেলে গেলো ওর চোখে। যখন ওদের গোপন কথাটা বলা শুরু করলাম তখন তার মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেলো। দরজার বাইরে বেশ কিছু লোক ঘাড় বাড়িয়ে কথাগুলো শুনছিলো, ওর ভেতরে মিঃ চাও আর তাঁর কুকুরটাও ছিলো। তাদের সবাইকে দেখতে পাচ্ছিলাম না, কারণ দেখে মনে হচ্ছিলো যেন কাপড় দিয়ে তারা মুখোশ পরে আছে। কাউকে দেখাচ্ছিলো ফ্যাকাশে আর ভূতের মতো স্থির, হাসি চাপছিলো তারা। আমি জানি ওরা সব একই দলের, সবাই মানুষের মাংস খায়। কিন্তু এটাও জানি যে ওরা সবাই মোটেও একই রকমের নয়। কেউ কেউ ভাবে যেরকম চলছে চলুক, মানুষ খাওয়া জায়েজ। কেউ কেউ ভাবে মানুষ খাওয়া অনুচিত, কিন্তু তারপরও খেতে চায়; ভয়ে থাকে তারা পাছে কেউ তাদের গুপ্তকথা জেনে যায়। তাই তাদের কথা জেনে ফেলেছি শুনে তারা রেগে উঠলো, কিন্তু তারপরও তাদের অবিশ্বাসের ঠোঁটচাপা হাসি হেসে যাচ্ছিলো।
হঠাৎ করে দাদা খেপে উঠে উঁচু গলায় চিৎকার করে উঠলো:
"সবাই বেরোও এখান থেকে! পাগলের দিকে এভাবে তাকানোর মানে কী?"
তারপর তাদের শঠতা টের পেলাম। তাদের মত তারা পাল্টাবে না, তাদের মতলবও ঠিক-করা। আমায় ওরা পাগল বলে বদনাম দেবে। ভবিষ্যতে যখন আমায় ওরা খেয়ে নেবে, তখন শুধু যে ঝামেলা হবে না তাই নয় বরং লোকেরা হয়তো ওদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। যখন আমাদের ভাড়াটেটা গ্রামের শয়তান লোকটাকে খেয়ে ফেলার কথা বলছিলো, তখন আসলে একই কাজ করেছিলো ওরা। ওসব তাদের পুরনো চাল।
বুড়ো চেন সবাইকে তাড়িয়ে দিলো। বড়দা কোথাও যেন উধাও হয়ে গেছে। বুড়ো চেন আমায় নিজের ঘরে ফিরে যেতে বললো। ঘরটা ঘোর কালো। আমার মাথার ওপর কড়িকাঠ আর বর্গাগুলো দুলছে। কিছু ক্ষণ দোলার পরে ওগুলো বড় হয়ে গেলো। আমার ওপরে ওগুলো হুড়মুড় করে পড়লো।
ওগুলোর ওজন এতো ভারি, নড়তেই পারছিলাম না আমি। ওরা আমাকে মেরে ফেলতে চাইছিলো। আমি জানতাম যে ওজনগুলো ভুয়ো, তাই ঘামে ভিজে আমি ছটফট করছিলাম। কিন্তু আমায় বলতেই হলো:
"তোমাদের এক্ষুণি বদলে যেতে হবে, বুকের ভেতর থেকে পাল্টে যাও! তোমাদের বুঝতে হবে আগামীতে দুনিয়ায় নরখাদকদের কোন ঠাঁই হবে না..."
১১
সূর্য ওঠে না, খোলে না দরজা, প্রতি দিন দু'বেলা খাওয়া।
চপস্টিকগুলো হাতে তুলে নেই, তারপর ভাবি বড়দার কথা। এখন বুঝেছি কিভাবে আমার ছোট বোনটা মারা গেছে: সব ওরই কারণে। সেসময় ওর বয়েস ছিলো মাত্র পাঁচ। এখনো মনে আছে সেসময় কেমন আদুরে আর দুর্বল লাগছিলো ওকে। মা কান্না করেই যাচ্ছিলো কিন্তু বড়দা তাকে না কাঁদতে অনুরোধ করছিলো, কারণ সে-ই ওকে খেয়েছে, আর তাই কান্নাটা ওকে লজ্জা দিচ্ছিলো। একটুও যদি ওর লজ্জা থাকতো...
দাদাই আমার বোনটাকে খেলো, জানি না মা কিছু বুঝেছিলো কি না।
মা মনে হয় বুঝতে পেরেছিলো, কিন্তু কান্নার সময় সে সরাসরি কথাটা বলে নি, কারণ সে হয়তো ওটাই তখন ঠিক বলে ভেবেছিলো। মনে পড়ছে যখন আমার চার-পাঁচ বছর বয়স তখন ঠান্ডা হলঘরে বসে দাদা একবার আমায় বলেছিলো যে যদি কারোর মা-বাবার অসুখ হয়, তাহলে ভালো ছেলে হতে চাইলে নিজের শরীর থেকে এক টুকরো কেটে সেদ্ধ করে ওদের খাওয়াতে হয়। মা সেসময় তার বিরোধিতা করে নি। এক টুকরো খাওয়া গেলে পুরোটা খেতে সমস্যা কী? আর সেসময়ের বিলাপের কথা ভাবলেও আমার বুক ফেটে যায়; এটাই সবচেয়ে আজব ঘটনা!
১১
ওসব ভাবার সাহসই পাচ্ছি না।
এক্ষুণি বুঝতে পারলাম যেখানে আমি আছি সেখানে ওরা গত চার হাজার বছর ধরে নরমাংস খেয়ে আসছে। বোনটা মারা যাওয়ার পর থেকেই দাদা সংসারের ভার নিয়েছে আর হয়তো অজ্ঞাতসারেই আমাদের ভাত আর তরকারিতে বোনের মাংস মিশিয়ে খাইয়ে দিয়েছে।
না জেনেই হয়তো বোনের মাংসের দু'চার টুকরো খেয়েছি আমি, আর এবার আমার পালা...
চার হাজার বছর ধরে মানুষকে খাওয়ার ইতিহাস থাকার পরও আমার মতো কেউ-যদিও প্রথমটায় সে জানতো না কিছুই-কোন সাহসে আসল মানুষের মুখোমুখি হওয়ার আর আশা করে?
১২
হয়তো এখনো এমন বাচ্চা আছে মানুষের মাংসের স্বাদ যারা পায় নি? শিশুদের বাঁচাও..
এপ্রিল, ১৯১৮
টীকা:
১. কু চিউ মানে 'প্রাচীন যুগ'। লু স্যুনের মনে চিনের সামন্তবাদী শোষণের দীর্ঘ ইতিহাস জাগরূক ছিলো।
২. বিখ্যাত এক জন চিকিৎসক (১৫১৮-১৫৯৩)। বেন-কাও-গাঙ্গ-মু-এর লেখক, ওটা মেটিরিয়া মেডিকা বলা যায়।
৩. পুরনো ধ্রুপদী লেখা জুও ঝুয়ান থেকে নেওয়া।
৪. পুরনো নথি অনুযায়ী, ইই ইয়া তাঁর ছেলেকে রান্না করে চি-এর ডিউক হুয়ানকে উপহার দেন যিনি ৬৮৫ থেকে ৬৪৩ খ্রি.
পূ.-তে রাজত্ব করেন। চিয়েহ আর চৌ আগেকার দিনের স্বৈরশাসক। মানসিক ভাবে অসুস্থ লোকটা এখানটায় ভুল করেছে।
৫. ১৯০৭ সালে এক জন চিং কর্মকর্তাকে হত্যা করার জন্যে হ্সু হ্সি-লিনের প্রাণদণ্ড হয় চেং রাজত্বের (১৬৪৪-১৯১১ খ্রি.) শেষ দিকে। তার হৃৎপিণ্ড আর কলজে খেয়ে ফেলা হয়।
মন্তব্য
প্রতিযোগিতাভিত্তিক পুঁজিতন্ত্র আর তার নিজস্ব সংজ্ঞায়িত/অর্থায়িত/পরিবেশিত ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার প্রেক্ষপাটে - এই বাক্যটা হয়ত ভিন্নভাবে জ্বলে উঠল।
অনুবাদের জন্য ধন্যবাদ জাতক।
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
আপনার রম্যরচনার হাত কিন্তু দারুণ। নিয়মিত লিখুন না। আমরা "উত্তরাধুনিক লেখালেখির সহজ কৌশল" টাইপের আরও কিছু মাস্টারপিস পাবো তাহলে।
হাতি পোস্ট দেখে একটু দূরে দূরে ছিলাম। কিছুক্ষণ পর আবারো এলাম।
অনুবাদ চমৎকার লাগলো
এই অংশটা একটু দেখবেন কি? 'খুদে শয়তান' শুনতে একটু কেমন কেমন লাগছে। এই জায়গায় 'বিচ্ছুর দল' বা অন্য কিছু কি ব্যবহার করা যায়?
-------------------------------------------------
ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
অনুবাদে পাঁচতারা
..................................................................
#Banshibir.
বেশ ভাল লেগেছে।
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
প্রথমেই ধন্যবাদ অনুবাদ কর্মের জন্য। বাংলা ভাষায় ল্যু স্যুনকে আরো বিস্তৃতভাবে পরিচয় করানোর দরকার আছে। তবে আমার কাছে এই অনুবাদটির ভাষা বেশ আড়ষ্ট লেগেছে। আপনার নিজের লেখা যারা পড়েছেন তারা ভাষার এই ভিন্নতাটা সহজে ধরতে পারবেন।
কতিপয় সংশোধনীঃ
১. ঝৌ শুরেন = চউ শু-জেন
২. কু চিও = গু জিউ
৩. বুড়ো চেন = বুড়ো ছেন
৪. "ন্যায়পরায়ণতা আর নৈতিকতা" = “কনফুসিয়ান গুণাবলী আর নৈতিকতা”
৫. মিঃ হো = মিঃ হি
৬. লি শি-চেন তাঁর মেটেরিয়া মেডিকাতে উল্লেখ করেছিলেন যে ঔষধ প্রস্তুতে নরমাংস প্রয়োজনীয় হতে পারে। তিনি সম্ভবত মৃতের মাংস ব্যবহারের কথা নির্দেশ করেছিলেন। নরমাংস সিদ্ধ করে খাবার ব্যপারটা উন্মাদ লোকটির কল্পনা।
৭. জুও ঝুয়ান = চুও চুয়ান। ইতিহাস সংক্রান্ত তাঁর এক ভাষ্যে তিনি বলেছেন খ্রীষ্টপূর্ব ৪৮৮ সালে চীনে অবরোধের কারণে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে নরমাংস খেয়ে বাঁচার জন্য লোকে নিজেদের মধ্যে সন্তান বিনিময় করেছিল।
৮. ইই ইয়া = ঈ য়া। চিয়েহ আর চৌ = যিয়ে আর চউ
৯. পান কু = পান গু। একটি পৌরাণিক চরিত্র। বিশ্বাস করা হত সে স্বর্গ-নরক সৃষ্টি করেছে।
১০. হ্সু হ্সি-লিন = শু শি-লিন্ । চিং = চিঙ
আমি কোন এককালে “বুনো ঘাস”-এর কিয়দংশ অনুবাদ করে পিঠটান দিয়েছিলাম। এখন আর ইচ্ছে করে না। আপনার সময় হলে বইটা একবার দেখতে পারেন।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ভালো লাগল।
ডাকঘর | ছবিঘর
কিছু কিছু সময়ে আপনার ভাবগম্ভীর কাঠিন্য ধারাময়তাকে কিছুটা বাধাপ্রাপ্ত করেছে। তারপরেও, অনুবাদে আপনার উৎকর্ষ প্রশ্নাতীত। অধম বেবুঝ শিষ্যদের কথা মাথায় রেখে যদি কিছুটা সহজ পথে হাঁটেন, তাতে অনেক ফায়দা হয়, বেবুঝদের দিক থেকে বলছি।
লেখাটা খুবই আকর্ষক লাগলো, এবং কিছুটা চিন্তায়ও ঘুরপাক খেতে শুরু করলাম। কথা বলতে হবে এটা নিয়ে।
_____________________________________________________________________
বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।
নতুন মন্তব্য করুন