নগরের পথে হাঁটছে মতি মিয়া। আহ ! নগরের পথ ! কালো পিচ, কালো রাতের মতই ঝিকমিকে স্বপ্নে বোনা, কালো রাতের মতই বিস্ময়করভাবে দুর্বোধ্য এবং পরিশেষে ভীতিপ্রদ। তারপরও নরম সাদা মাটি নয় কালো পিচের প্রতিই মানুষের দুর্নিবার আকর্ষণ। তাই তো ধর্মগ্রন্থে লেখা আছে যাবতীয় হুমকি-ধামকি ও হুঁশিয়ারির পরও অধিকতর মানুষ নরকবাসী হইবে।
বাংলাদেশে প্রকৃত অর্থে কোনো নগর নাই। শিল্পায়নের তোড়ে যে সকল সমাজে রাত আর দিনের ফারাক বোঝা যায়না তারা আমাদের ভাগের কার্বন নির্গমন অধিকার কিনে নেন নগদ টাকায়। আমরা নরম মাটির দেশের সাঁঝের বাতি জ্বালিয়ে বসে বসে ঝিমুই আর বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হওয়ার অপেক্ষা করি। এই যা, আবারও প্রসঙ্গ থেকে দূরে সরে গেলাম, কথা হচ্ছিল মতি মিয়াকে নিয়ে যে হাঁটছে নগরের পথে। তো যাই হোক আমাদের দেশে শিল্পায়ন না হলেও বিকৃত শহরায়ন হয়েছে। কারণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা নগরকেন্দ্রিক। তো আমাদের নরম মাটির গ্রামগুলোকে কালো পিচ দিয়ে ঢেকে নিদেনপক্ষে শহরে বদলে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, সেখানে বিদেশী গাড়ি, বাহারী পণ্যে ঠাঁসা বিপনী বিতান, বহুজাতিক কোম্পানি, হালের অ্যাপার্টমেন্টের প্রাচুর্য। কিন্তু আজও পালা-পার্বনে খাঁ খাঁ করা শহর অট্টহাসি হেসে বলে - নগরের পত্তন ঘঁটায় শ্রমিকেরা, তোরা তো সব চাষার ব্যাটা–বেটি, তোরা চাকর হতে এলি কেন?
মতি মিয়ার আসার কারণ অবশ্য ভিন্ন। সিরাজগঞ্জ থেকে তাকে কালো পিচে ছুড়ে দিয়েছে নদী। আরো তিন দেশী ভাইয়ের সঙ্গে একটি ঘুপচি ঘরে কোনোমতে ঠাঁই মিলেছে বটে তবে ভাড়াটা নেহাৎ কম নয়। চাষ-বাস ছাড়া জীবনে আর কোনো কাজ করেনি। তবে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান জুটে যাওয়াই যার কাছে স্বর্গপ্রাপ্তি তার জন্য কাজ জোটানোটা শিক্ষিত বেকারদের মত দুঃসাধ্য হয়না। নগরের পথে মৌসুমি ফল বিক্রির কাজটা আয়ত্ব করে নেয় দ্রুত। পথেরও আছে পথপতি। এরাও প্রশ্নাতীত আনুগত্যে বিশ্বাসী। সেই সঙ্গে আছে নানা পর্যায়ে করপ্রদান প্রথা।পথের ধর্মে দীক্ষিত হতেও সময় লাগেনা মতি মিয়ার। “বাঙালীরা বলে - আমরা সিংহাসনের প্রতি বিশ্বস্ত । যে সিংহাসন অধিকার করে, তাকেই আমরা অনুগতভাবে ভক্তি করি” সম্রাট বাবর আত্মকাহিনীতে বলে গেছেন এই কথা। মতি মিয়াও বাঙালীই বটে। শাসন মানতে জানে বিলক্ষণ।
কস্তুরি পথের মেয়ে। বয়স বারো, তেরো বা এর কিছু বেশীও হতে পারে।মা, বাপ, ভাই, বোন কি জানেনা। তবে খেতে হয় এটা জানে। আর আজকাল আরেকটা ব্যপার জেনেছে – সে মেয়ে।
কস্তুরিকে মতি মিয়া স্নেহ করে। বিশেষ কোনো কারণ নেই। শিশুরা স্বাভাবিকভাবেই স্নেহের উদ্রেককারী। তবে পথের শিশুদের প্রতি স্নেহপ্রবন না হওয়াই মঙ্গল কারণ তারা দ্রুত বাড়ে বোধে না হলেও চাতুরিতে এবং তারা হয় সকলের সম্পত্তি।
ভ্যানের আশেপাশে ঘুরঘুর করতে থাকা কুকুরের মতই লোভাতুর কস্তুরির দিকে মাঝে মাঝে দুই এক টুকরো ফল ছুড়ে দেয়া পর্যন্তই ঠিক ছিল। সাত সদস্যের পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে পথের উচ্ছিষ্টদের প্রতি মায়া দেখালে চলেনা। মতি মিয়াও এই বিষয়ে একদমই একমত ছিল। আর তাছাড়া পথের “মেয়ে”র ভাগ্য তো এমনই হয়। মেয়ে হয়ে ওঠা বোঝার আগেই পুরুষ কী – সেটা বোঝা হয়ে যায়। পথ তো জঙ্গলের মতই – সবলরা দুর্বলের ওপর চড়াও হবে এটাই স্বাভাবিক।
অযথাই এই স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহের মধ্যে ছেদ ঘটিয়ে দিল মতি মিয়া।পাখির ছানার মত কস্তুরির ওপর যখন নরপশুর হাত পড়লো তখন মা – পাখির মতো তেড়ে এল সে। ঐদিনের মত রক্ষা পেল কস্তুরি।
কালো পিচের ওপর গড়িয়ে পড়লো ফল, ভাঙ্গা ভ্যানের টুকরো, লাল রক্ত। নগরের পথের ধারা যারা মানেনা তাদেরকে সহ্য করার কোনো কারণ নেই। ভারসাম্য রক্ষা করা বড়ই জরুরী।
মতি মিয়াকে মনে রাখাটা যুক্তিসঙ্গত নয়। কিন্তু আমি মনে রেখেছি। কারণ একজন মানুষ প্রতিবাদ করেছিল।
ছবির সূত্র : http://www.virtualtourist.com/
মন্তব্য
ভালো লাগলো লেখাটা
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
থ্যাংকু
লেখাটি দারুণ। বিশেষত ভাষাবিন্যাস খুব ভালো লাগলো।
-----------------------------------------------------------
জানতে হলে পথেই এসো, গৃহী হয়ে কে কবে কি পেয়েছে বলো....
-----------------------------------------------------------------------------------------------------
" ছেলেবেলা থেকেই আমি নিজেকে শুধু নষ্ট হতে দিয়েছি, ভেসে যেতে দিয়েছি, উড়িয়ে-পুড়িয়ে দিতে চেয়েছি নিজেকে। দ্বিধা আর শঙ্কা, এই নিয়েই আমি এক বিতিকিচ্ছিরি
অনেক ধন্যবাদ। ভাষা নিয়ে সবসময় সংশয়ে থাকি। আপনার মন্তব্যে শান্তি পেলাম।
ভালো লাগল।
মতি মিয়াদের কে কবে লিখে রাখে স্মৃতিপটে!
.....................................................................................
আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;
আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
পৌঁছে অনেকক্ষণ ব'সে অপেক্ষা করার সময় আছে।
মতি মিয়াদের মনে রাখলে তো আমাদের বিপদ!! আমরা তো পরিবর্তনে বিশ্বাসী না। নিরাপত্তাই আমাদের আরাধ্য।
দারুন!
---------------------------------------------
ফুল ফোটে? তাই বল! আমি ভাবি পটকা।
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
নতুন মন্তব্য করুন