এই হলুদ আলোটার মধ্যে এক ধরনের গা ঘিনঘিনে ব্যাপার আছে। কেমন যেন চুইয়ে চুইয়ে পড়ে ঘাড়ে, মাথায়, হাতের তালুতে , তারপর চ্যাটচ্যাট করে। চোখ বন্ধ থাকলেও চোখের পাতার কিনারা বেয়ে ঢুকে যায় একেবারে মাথার ভেতরে। তারপর … তারপর চোখ খুলতে বাধ্য হয় সোহাগ।
লাঠির গুঁতো।হঠাৎ মনে পড়ে ফুটপাতে নয় থানার এক কোনায় পড়ে আছে সে। স্থান, কাল , পাত্র – সব গুলিয়ে যাচ্ছে মাঝেই মাঝেই। কি যেন জিজ্ঞেস করছে ওরা। তবে ওর কাছ থেকে জবাব আশা করছে বলে মনে হচ্ছেনা। তাই ও খুব একটা তাড়া অনুভব করছেনা। আর তাছাড়া থানার ভেতরটা গরম। এখানে থাকা গেলে খারাপ হয়না। প্লাস্টিকের শীটের ফাঁক গলে দুষ্টু ছেলের মত ঢুকে পড়া শীতের বাতাস বড়ই উৎপাত করে। আবার লাঠির গুঁতো।ধুর শালা!
“নাক টিপলে তো দুধ বাইর হইবো। এই বয়েসেই কাম কইরা লাইছস? ওই কথা কস না ক্যান? হালার তো নিশা অহনো ছাড়ে নাই”
উফ! ক্ষিদা! আবার! এরা কিছু খেতে দেবে না ? এত ক্ষিদা লাগে ক্যান? ভাঙ্গারির কাজ – মানে মানুষের উচ্ছিষ্ট কুড়িয়ে বেড়ানো। ও নিজেও তো মানুষের উচ্ছিষ্ট। সমস্যা হচ্ছে ওর পেট আছে। যে পেটের ক্ষিদা কখোনো মেটেনা।
তারপর পথের উত্তরাধিকার হিসেবে মিললো আসক্তি। সবাই বললো “মাত্র ২০ টাকা। এক কৌটায় অনেকদিন চলবো। টান মারবি ক্ষুদা-টুদা কই চইলা যাইবো! ট্যারও পাবিনা। অনেক আরাম পাইবি”। প্রথম প্রথম সত্যিই বেহেশত মনে হতো। পরের দিকে মেজাজ খারাপ হওয়া শুরু করলো। কেমন যেন খিচ ধরে যেত। উল্টা-পাল্টা দেখাও শুরু হলো। চোখের সামনে অদৃশ্য দৃশ্যের পর্দা ঝুলতো, ধরতে গেলেই ছিড়ে খান খান। মারতে ইচ্ছা করতো সবাইকে।
“বয়স কত হবে ওর। এরকম একটা কাজ করলো কিভাবে?”
“বারো-টারো হইবো স্যার্। ডান্ডি খায়। রাস্তার পুলাপানগুলা সব এইরকম। আরে ঐযে জুতার আঠা শুকে। তখন নিশা হয়”।
“এত কম বয়সে নেশা! এত বড় ঘটনা কিভাবে ঘটালো তার একটা সুত্র পাওয়া যাচ্ছে”
“কিন্তু অ্যারে কি করবেন স্যার”
“কি আর? কোর্টে চালান দেবে।”
“কিছু তো কয়না। ঝিম মাইরা পইড়া আসে।”
“কিন্তু ঘটনা তো ঘটিয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শী আছে।”
রমিজ কিভাবে যেন একটা মোবাইল জোগাড় করেছে। আসল না, খেলনা। খুব দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে। একটু হাতে ধরে দেখতে চেয়েছিল। কিছুতেই দিলনা। মেজাজটা গেল চড়ে। হাতের লাঠিটা দিয়ে এক বাড়ি। তারপর অনেক হইচই। তারপর এরা নিয়ে আসলো।
মারধোর না করলে আর দুটো খেতে দিলে জায়গাটা খারাপ না।
---
ছবি : অতিথি সচল অনিন্দ্য
মন্তব্য
এই কাহিনী ভালো লাগলো কেমন করে বলি? তবে লেখা খুব ভালো লাগলো, এটুকু লেখার মধ্যে পুরো ব্যাপারটাকে দারুণ শক্তিশালীভাবে তুলে ধরলেন।
-----------------------------------------------------
আর কিছু না চাই
যেন আকাশখানা পাই
আর পালিয়ে যাবার মাঠ।
-----------------------------------------------------
আর কিছু না চাই
যেন আকাশখানা পাই
আর পালিয়ে যাবার মাঠ।
অসামান্য বর্ণনা। ভালো লাগলো লেখাটা।
সেদিন পথশিশুদের এই নেশা নিয়ে একজনের কাছে শুনতেছিলাম। খুব খারাপ লাগছিলো।
.............................................................................
আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;
আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
পৌঁছে অনেকক্ষণ ব'সে অপেক্ষা করার সময় আছে।
প্রধানত ক্ষুধা তাড়ানোর জন্য এই নেশা ধরে পথশিশুরা। সস্তা ও সহজলভ্য এই নেশা স্নায়ুতন্ত্রকে দ্রুত প্রভাবিত করে। পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় পথশিশুদের শতকরা আশি ভাগ এই নেশায় আক্রান্ত বলে একটি প্রতিবেদনে পেলাম। সেই সঙ্গে চাক্ষুষ প্রমাণ মিলে যাবে ঢাকার রাস্তায়, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়, নিমতলী ও পুরান ঢাকায়। আপনারা যারা লেখাটি পড়েছেন তাদের অসংখ্য ধন্যবাদ।
দেখি, দেখা যায় এসব পথশিশুদের, ঢাকার রাস্তায়। অসহায় লাগে মাঝে মাঝে ।
লেখা ভালো লেগেছে।
সেই অসহায়ত্ব থেকেই এ লেখার জন্ম। হয়তো এমন দিন আসবে যখন রাষ্ট্র সবার দায়িত্ব নেবে।
সুন্দর...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
...
নতুন মন্তব্য করুন