খাজা আহমেদ আব্বাসের গল্প সম্পর্কে দু-চার কথা

মনামী এর ছবি
লিখেছেন মনামী (তারিখ: বুধ, ০৯/১২/২০০৯ - ১০:২৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মনুষ্য-সন্তান হয়েও সূর্য ছুঁয়ে দেবত্বপ্রাপ্তির আকাঙ্খায় উড়েছিল সে।

রেনেসাঁ শিল্পি পিটার ব্রুগেল একেছিলেন ইকারাসের পতন। পৃথিবীর নিস্পৃহ জীবন প্রবাহে এতটুকু ব্যাঘাত না ঘটিয়ে গলে যায় তার মোমের পাখা। প্রাত্যহিক কাজে ব্যস্ত মানুষের অগোচরে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয় স্বপ্ন ও আকাঙ্খা।

ক্ষমতাযন্ত্রের নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘনের ইচ্ছার উচিত শিক্ষাই পেয়েছিল সে।
সমাজের পরতে পরতে প্রতিদিন পাখা মেলে ওড়ার চেষ্টা করে নতুন স্বপ্ন, অস্তিত্ব রক্ষার নতুন সংগ্রাম; বাস্তবের পাথরে হোঁচট খেয়ে হারিয়েও যায়। কিন্তু এক মহান নিস্পৃহতার আলোক শিখায় মোহাবিষ্ট পোকার মত মানুষ তা দেখতে পায়না। কেবল সৃষ্টিশীলতাই দেয় সেই আপাত অদৃশ্যকে দেখা ও দৃশ্যমান করার ক্ষমতা। তাই যেকোনো গদ্যে আমি খুঁজি মুছে যাওয়া পায়ের ছাপ, দৈনন্দিনতার নুনহীন সত্য যা আদপে অভিশপ্ত মায়াময় রূপকথা। খাজা আহমেদ আব্বাস সেই অল্পকিছু মানুষের মধ্যে একজন যারা ইকারাসের পতন দেখতে পান।

পুরোনো হিন্দি সিনেমার সঙ্গে অল্প বিস্তর পরিচয় থেকে থাকলে আওয়ারা, শ্রী ৪২০ কিংবা জাগতে রাহো’র মত ধ্রুপদী সিনেমার নাম কানে আসবার কথা। এই সিনেমাগুলোর মত বহু সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন খাজা আহমেদ আব্বাস। পরিচালনার জন্য পেয়েছেন কান চলচ্চিত্র উৎসবের শ্রেষ্ঠ সম্মাননা। কিন্তু চলচ্চিত্রে তার অর্জনকে ছাড়িয়ে যায় তার সাহিত্য।
ব্রিটিশ শাসিত ভারতের পাঞ্জাবে ১৯১৪ সালে জন্ম। পেশা হিসেবে প্রথমে সাংবাদিকতাকে গ্রহণ করলেও যুগপৎ চালিয়ে গেছেন সাহিত্য রচনা। লিখেছেন উর্দু, হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায়।

কাঠামোর রেকাবে পরিপাটি সাজিয়ে মুখরোচক কাহিনী পরিবেশন করেন না আব্বাস। ইয়ারের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেন অনুভূতিগুলো। যা কারও চোখে পড়েনা তা দেখে ফেলার গুরুতর অপরাধে অপরাধী আব্বাস যেন দ্রুত প্রায়শ্চিত্ত করতে চান। উত্তম পুরুষের জবানীতে তাই রূপ পায় আব্বাসের অভিব্যাক্তি। কখোনো খোদ আব্বাস হয়েই কথা বলেন, কখোনো কোনো চরিত্রের আশ্রয় নেন, কখোনো কেবল কথক হয়েই গল্প শোনান। আর সহজ সেই গল্পগুলো মষ্তিষ্কের গোপন তন্ত্রীতে নাড়া দিয়ে জটিল সব প্রশ্ন জাগিয়ে যায়।

রাস্তার ভিক্ষাজীবি মানুষের প্রতি সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার বিবরণেই শুরু হয় ‘হাতের ময়লা’ গল্পটি। কিন্তু আর দশটা মানুষের মতোই আব্বাসের কেরানী যুবকটির হঠাৎ কি যেন হয়ে যায়। ভিখারিনীর সব ধান্দাবাজি ফাঁস করে দিতে, নাকি নিজের সত্যের অনুসন্ধানেই পিছু নেয়। অসুস্থ পিতার কয়েক দন্ডের ব্যাথামুক্তি কিনে নিতে দেড় টাকা ভিক্ষা চেয়েছিল যুবতী ভিখারিনী। অবশেষে পাঁচ টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দেহ। যদিও পরিশেষে কেরানী যুবকের অনুমানকে সত্য করেই নাই হয়ে যায় যুবতীর পিতা। আর কেরানী যুবক হাতে নিয়ে ফিরে আসে খুচরো পয়সায় দেড় টাকার দাগ। লেডি ম্যাকবেথের মতই শত প্রয়াসেও যে দাগ ধুয়ে যায়না।
এক চীনা সেনার অন্তিম উপলব্ধির কথা বলে ‘রক্তের দাগ’ গল্পটি। ক্ষমতার লোভে মত্ত রাষ্ট্র নায়কের অভীপ্সা পূরণে যোজন যোজন দূরে লড়তে আসা সেনা শ্বেত বরফের স্লেটে রক্তের আখরে যে লেখা ফুটে ওঠে তার মর্মোদ্ধারে সচেষ্ট হয়। বুঝতে পারে ধীরে ধীরে তার থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে প্রশ্ন করার ক্ষমতা – যা জ্ঞানার্জনের মূলমন্ত্র।

‘বিশ্বসুন্দরী’ গল্পে আব্বাস বর্ণনা করেন বিশ্বসুন্দরী নির্ধারণের নিয়মনীতি। প্রেমের আলোর ঝিলিক যে মুখে, সে মুখই সবচেয়ে সুন্দর। ট্রেনের ঠাসাঠাসি কামরায় তিনি এই সত্যের খোঁজ পান।

পারিবারিক নির্যাতনের ভয়াবহতাকে তিনি নিপুণ হাতে বুনেছেন ‘একটি জ্বলন্ত স্টোভের গল্প’ নামের গল্পটিতে। স্টোভ জ্বালানোর কষ্টকর প্রক্রিয়ার মাঝে ছুটতে থাকে শান্তার ভাবনার ঘোড়া। আর সেই ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে আমরা দেখে নেই প্রথাবদ্ধ সহনশীল নারীর পুরুষশাসিত জীবন। আর শান্তা টের না পেলেও আমরা টের পেয়ে চাই কেন গ্যাসের চুলার চল থাকা সত্ত্বেও শান্তার বাড়িতে স্টোভ জ্বলে। স্টোভ বিস্ফোরণে গর্ভবতী শান্তার মৃত্যু তার স্বামী ছগনের মত আমাদেরও হাসি কেড়ে নেয়।

‘লায়লা – মজনু’ গল্পে আব্বাস শোনান আজকের লায়লা – মজনুর গল্প। আরবের লায়লার মতই বোম্বের বস্তিবাসী খ্রীস্টান লিলির হাতে কালশিটে পড়ে যায় হিন্দু মোহনের হাতে বেতের আঘাতে। যৌবনে শ্রমিক মোহন আর চাকুরিজীবি লিলির পরিণয়ে ধর্ম আর সমাজ বাঁধা হয়ে দাড়ালে মৃত্যুর সিদ্ধান্ত নেয় তারাও। তবে একটি তুচ্ছ তেলেভাজার ঠোঙ্গা তাদের মনে করিয়ে দেয় জীবনের রূপ, রস , গন্ধের কথা। মৃত্যুতে নয় জীবনেই কিংবদন্তী খোঁজে তারা।

স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় কিংবদন্তী খোঁজার এই প্রয়াসে সাবলীল আব্বাস মনে করিয়ে দেন কত শত কণ্ঠ আমাদের চারপাশে কত শত গল্প শুনিয়ে যাচ্ছে। আমরা কান পাতিনা বলেই তা শুনতে পাইনা ।


মন্তব্য

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

খাজা আহমেদ আব্বাস, এই নামটাই চেনা ছিলো শুধু... আর কিছু তেমন জানা ছিলো না। ধন্যবাদ আপনাকে... পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

তানবীরা এর ছবি

আমারো নজরুল ভাইয়ের অবস্থা
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

পুতুল এর ছবি

আমরা কান পাতিনা বলেই তা শুনতে পাইনা ।

কান পাতলাম, আপনি শোনান।
লেখা পড়ে মুগ্ধ হলাম।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

মনামী এর ছবি

লেখা পড়া ও মন্তব্য করার জন্য অশেষ ধন্যবাদ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।