হিমে জমে যাওয়া জোৎস্নার বরফে চিড় ধরিয়ে দিয়ে ডেকে ওঠে বাড়ির আশ্রিত নেড়ি কুকুরটি। ওম ওম ঘুমে তা ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনা। কুকুরের মতো মানুষের ইন্দ্রীয় তীব্র ও তীক্ষ্ণ নয়।
ভালোই হইসে, বাড়ির লোককে কোনো কষ্ট করতে হয় নাই, কোনো ঝামেলা নাই।
ঠিকই বলসেন। আমার শ্বাশুড়ির কথাই ধরেন, বাঁচবেনা সবাই জানে তারপরও হাসপাতালে কী দৌড়াদৌড়ি! বিছানায় পেশাব - পায়খানা করে ফেলতেসে, কী যে অবস্থা! আমার বৌ আর তার বোনতো জান দিয়া ফেলসে।
বাড়িভর্তি লোক কেউ টের পায় নাই কখন জান বের হয়ে গেসে। কিন্তু কুলখানির ব্যবস্থা বেশি সুবিধার হয় নাই। ছেলেগুলা তো কম কামায় না, করিম সাহেবের কুলখানিতে কাচ্চি দিসিল।
সদ্যমৃত আব্দুল হামিদ সাহেব জীবদ্দশায় লাট্টুসদৃশ ছিলেন। তার নিজস্ব চালিকাশক্তি ছিলনা। তার সুতা সর্বদাই ছিল অন্যের হাতে । তার লেখালেখির বদঅভ্যাস ছিল। বাজার-সদাইসহ প্রমূখ অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজে তা বিঘ্ন ঘটানোয় একদিন তার স্ত্রী যাবতীয় সৃষ্টিকর্ম চা বানানোর কাজে ব্যবহার করে পরিবারধর্মই যে আসল ধর্ম এই বিষয়টি ভালোভাবে বুঝিয়ে দেয়ার পর তিনি নিজেকে সংবরণ করেন। পরিবারযন্ত্রের অনুৎপাদনশীল ইউনিটে পরিণত হবার পর মৃদুভাষী আব্দুল হামিদ সাহেবের কণ্ঠ আরো নিচুগ্রামে নেমে আসে। পরিবারকর্মপ্রবাহ কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত না করার ব্যপারে সচেষ্ট হয়ে পড়েন। এতটাই সচেষ্ট যে মৃত্যুটাও সেরে ফেলেন চুপিসারে। মৃত্যুপরবর্তী ক্রন্দনপর্বে এই গুণের জন্য তিনি ব্যপক সমাদৃত হন।
কুলখানিতে আশানুরূপ খাবার সরবরাহ না করা এবং বড় ও মেজ পুত্রবধুর পরিবারের লোকদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের অভিযোগ এবং ফলস্বরূপ মন কষাকষিতে সৃষ্ট জটিলতা বাদ দিয়ে আচার পালন পর্বও ভালভাবে সমাধা হয়। রাত্রিকালে এ উপলক্ষ্যে একত্রিত হওয়া ভাই বোনেরা আড্ডায় মেতে ওঠেন, মেয়েরা কাজের মেয়ে ও বাচ্চাদের স্কুল এবং ছেলেরা অফিস থেকে আচমকা ছুটি নেয়ায় যে সমস্যার তৈরি হয়েছে সে আলাপে মগ্ন হয়ে পড়েন। শোকসন্তপ্ত মিসেস আব্দুল হামিদও তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে শোক ভোলার চেষ্টা করেন। সাময়িক এই গোলযোগশেষে সকলেই নিজ নিজ অভ্যস্ত জীবনের প্রাত্যহিকতায় ফিরে যাওয়ার তোড়জোর করতে থাকে।
আচমকা এক উটকো উৎপাত সকলকে তটস্থ করে তোলে। ঘটনার শুরুটা হয় যখন প্রয়াত আব্দুল হামিদ সাহেবের মেজ পুত্রবধু রাতে পানি খেতে ওঠেন। ডাইনিং টেবিলের পাশে তিনি একটি ছায়া দেখতে পান। তার মনে হয় ছায়াটি কিছূ বলার চেষ্টা করছে এবং তিনি মূর্ছা যান। যেহেতু মরাবাড়িতে তিনদিন আগুন জ্বালানোর নিয়ম নেই কাজেই পরদিন প্রতিবেশী বাবলুর মা ভাত নিয়ে এসে পূর্বরাতের ঘটনার সবিস্তার বর্ণনা শোনার পর তার সুচিন্তিত মতামত দেন।
আহারে বুড়া মানুষটারে তো আপনারা কম কষ্ট দেন নাই। এই মেজ বউরে কতদিন দেখসি বাজার নিয়া আসার পর মানুষটারে মুখ ঝামটা দিতাসে। পুলাগুলাও কম না এক্কেরে বৌ ন্যাওটা।
অ্যাই চাচী মুখ শামলায়া কথা বলেন।
আমি কি মিছা কথা কইতাসি, হগলেই জানে ভাইজানের লগে কেমুন ব্যবহার করসো তুমরা। অহন বুঝ।
বাবলুর মাকে উপর্যুপরি অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হলেও থমথমে ভাবটা রয়েই যায় এবং ভেড়ার পালের মত সবাই একজোট হয়ে চলাফেরা, খাওয়াদাওয়া এবং ঘুমাতে শুরু করে। পরদিনই স্থানীয় মসজিদের মৌলানা বাড়িতে দোয়া-খায়ের করেন এবং প্রচুর সম্মানী নিয়ে ও প্রচুর আশ্বাস দিয়ে প্রস্থান করেন। আব্দুল হামিদ সাহেবের ব্যবহার্য দ্রব্যাদির ব্যপক পরিচর্যা চলতে থাকে।
এদিকে বেচারা আব্দুল হামিদ সাহেব ভেবেছিলেন কাউকে বিরক্ত না করে পৃথিবীতে বাঁচা ও পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার মহান দায়িত্বটি সফলভাবে সমাধা করার পর এবার তিনি শান্তিতে দিন গুজরান করতে পারবেন। বাড়ির পাশের গাবগাছে অত্যন্ত আরামদায়ক অবস্থান নেন। কিন্তু বিধিবাম। তাকে যারপরনাই বিব্রত করে তার পরিবারের লোক তারই ভূতের ভয়ে লাট্টুর মত ঘুরছে।
অতএব জীবনে থুরি জীবন ও জীবনপরবর্তী সময়ে প্রথমবারের মত তিনি তার স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে পত্র একটি নাতিদীর্ঘ চিঠি লিখলেন -
প্রিয়তমা আয়েশা,
আমি জীবিত থাকার সময় তোমরা আমাকে নিয়া চিন্তা করিয়া মুহূর্তমাত্র কালক্ষেপন করো নাই। আজ মরণের পর আমাকে লইয়া এহেন টানাহেচড়া করিবার হেতু কী, তা আমার মোটেও বোধগম্য হইতেছে না। কী দেখিয়া তোমরা এরূপ ভীত হইয়া পড়িতেছ? আমি তো গাবগাছ হইতে একবারও বাড়ির ভেতর প্রবেশ করি নাই। ডানপাশের জানালা দিয়া কেবল নজর বুলাইয়াছি মাত্র। বাঁচিয়া থাকিতে তোমাদিগকে কোনোরূপে বিব্রত না করাই আমার পণ ছিল সেই নিমিত্ত নিজের সকল সাধ-আহ্লাদ পরিত্যাগ করিতেও কিছুমাত্র কুণ্ঠা করি নাই। মরিয়াও একই ব্রত লইয়া বাঁচিতেছি। যাই হোক ...
চিঠি আরো জনগুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য ছিল কিন্তু আচানক বালিশের পাশে আবির্ভুত মৃত আব্দুল হামিদের চিঠিখানার এইটুকু পড়েই মিসেস আব্দুল হামিদ...
---
ছবি : ইন্টারনেট
এই সিরিজের আগের গল্পটি এখানে।
মন্তব্য
ভালো লাগলো গল্পটা উপস্থাপন-বৈচিত্র্যে ।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
ধন্যবাদ।
এটা কে কি ঠিক সিরিজ বলা চলে? গল্পটা আমার কাছে স্বয়ংসপম্পূর্ণই মনে হয়েছে।
মরাবাড়িতে তিনদিন আগুন জ্বালানোর নিয়ম নেই, এটা এই প্রথম শুনলাম।
তবে যে জিনিসটা অনেকক্ষেত্রেই দেখেছি আমি তা হলো প্রাথমিক শোকযাপনের পর ছেলেমেয়েরা বাপের মৃত্যুশোকের চেয়ে পৈত্রিক সম্পত্তির অংশীদারিত্ব বিষয়ক বৈঠকেই বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
_____________________
আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।
এটা সিরিজ এই অর্থে করেছি যে বিভিন্ন মানুষের অন্তর্ধানই গল্পগুলোর বিষয়বস্তু। আলাদা করলে ভালো হয় যদি বলেন তাহলে আলাদা করে দিব, কোনো সমস্যা নাই।
আমাদের বাড়িতে এই ধরণের প্রথা পালন করতে দেখেছি তাই...আসলে এই বিষয়গুলো কখোনোই ফিক্সড নয়।
ঠিকই বলেছেন এটাও একটা প্রচলিত প্রবণতা। মূল বিষয় হলো জীবিতদের স্বার্থসংশ্লিষ্টতা। তবে সবক্ষেত্রেই এমন হয় তা দাবী করবোনা।
ধর্মে মানা নেই, তবে এটা আসলে একধরনের সোশ্যাল কাস্টম!
শোকে কাতর স্বজনদের হেঁশেলে যাওয়ার মানসিকতা থাকেনা বলে তিন/ চারদিন প্রতিবেশীরা খাবার পাঠান...
আপু,
গল্প ভালো হয়েছে.. বাকিগুলোর মতোই
--------------------------------------------------
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
অনেক ধন্যবাদ
চারটে টাইপো আছে,
>সামলায়া
>থুড়ি
>ব্যাপক
>টানাহেঁচড়া
হায়, ঠিক করার সুযোগ কোথায়?
--------------------------------------------------
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
দারুণ লেখনী আপনার! অসাধারণ লাগলো পড়তে।
সমালোচনা নয়, তবে হয়ত গল্পটাকে আরো বড় করা যেত।
বিশ্বাস করেন আর নাই করেন অনেক চেষ্টা করেছি বড় করার কিন্তু .... যাহোক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ধন্যবাদ।
বিশ্বাস করলাম
অন্যরকম একটা গল্প!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
সেই সুদুরের সীমানাটা যদি উল্টে দেখা যেত!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
মনে কষ্ট পাইয়েন না জানি। আপনের গল্প মনোযোগ দিয়াই পড়ি কইলাম। কিন্তু এইটার শেষে দিয়া কেমন ব্যারাছ্যারা লাগায় দিলেন বুঝতে পারলাম না। অবশ্য আপনি যেভাবে খুশি হেই ভাবেই শ্যাষ করতে পারেন। আমার কিচু কওনের নাইক্যা। মগর আগে মিঠাই খিলাইয়া পরে চিরতার শরবত পিবার দিবেন এইটা ক্যামুন কথা!
.
___________________________________________
ভাগ্যিস, আমার মনের ব্যাপারগুলো কেউ দেখতে পায় না!
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
নতুন মন্তব্য করুন