‘একটি মেয়ে এক্ষুনি ঘূর্ণিতে ডুবে মরল। আমি ময়না পাখি। চল আমাকে নিয়ে খাঁচায় পুরে রাখবে।’ - জলদেবী গল্পের নটে গাছটি মুড়ায় এই কথা কটি দিয়ে। যদিও অবশেষে তাহারা সুখে - শান্তিতে বসবাস করিতে লাগলো - গল্পের রূপকথাধর্মীতার কারণে, অন্ত্যবাক্য হিসেবে এটিই বেশি মানানসই হতো। কিন্তু তার বদলে নারীর আত্মবিসর্জনের চিরকালীন সত্যকে মিছরির ছুরির মত পাঠকের বুকে বিঁধিয়ে দিলেন লেখক।
তিনি লক্ষ্ণীনাথ বেজবরুয়া।
জন্ম ১৮৬৮ সালে অসমে। বাংলায় মাতৃভাষাসম জ্ঞান এবং অসামান্য দখল থাকা সত্ত্বেও অসমিয়াতেই রচনা করে গেছেন। জানা যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বাংলা ত্যাগে নাখোশ ছিলেন (এখানে বলে রাখা যেতে পারে তিনি মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জামাতা)। কিন্তু ‘মূলধারা’য় সাহিত্য রচনায় সুখ্যাতি অর্জনের চেয়ে নিজ ভাষায় সাহিত্য রচনার মাধ্যমে ‘মূলধারা’য় তার স্থান পোক্ত করাকেই কর্তব্য স্থির করেছিলেন তিনি। সেসময় পাঠদান কিংবা প্রশাসনিক কোনো প্রক্রিয়ায় অসমিয়া ব্যবহৃত হতো না। তাই নিজের অর্ধশতকের সাহিত্যজীবন তিনি অসমিয়া ভাষা ও সমাজের অগ্রগতিতেই সঁপে দেন। অসমের রাজ্য সংগীত ‘ও মোর আপোনার দেশ’ তিনি লিখেছেন।
সমকালীন সাহিত্যপ্রবনতার সঙ্গে তার সুস্পষ্ট পার্থক্য লক্ষণীয়। লক্ষ্ণীনাথ নিজেই ‘পাতমুগী’ গল্পে তুলে দিয়েছেন তার গল্পের প্রতি সমালোচকদের মনোভঙ্গি - ‘এটাকে যদি গল্প বলতে হয় তাহলে তো তোমার আমার ঘরে সকাল-সন্ধ্যা শাক-ভাত খাবার কথাবার্তাগুলোও গল্প’। আধুনিক অসমিয়া ছোটগল্পের ধারাকে ভিন্ন খাতে বইয়ে দেয়ার কৃতিত্বের দাবীদার এই লেখক প্রাত্যহিকতার কথনে কোনো দোষ দেখেননি, আর আমি মনে করি এমনটা কয়জন পারে। সকাল-সন্ধ্যা শাক - ভাত খাবার মাঝে অভিনীত হয় হাজারো নাটকের অঙ্ক। প্রেম, পরকীয়া, নেশা, প্রতিশোধ, আত্মহনন, হত্যা, ধর্ষণ, হাস্যরস, লৌকিকতার বেড়ী কিংবা অতিলৌকিকতা - দৈনন্দিনতার ভাঁজ খুলে এ সমস্ত কিছু বের করে নিয়ে আসেন এই লেখক।
তাই তার গল্পে ভাত না পেয়ে কোপ বসিয়ে দেয় যে স্বামী হাসপাতালে চোখ খুলে তাকেই ভদরী জিজ্ঞেস করে ‘আজ ভাত খেয়েছ কি?’। আবার পাতমুগীর মত কুমোর জাতের সরলা মেয়েটি পোড় খাওয়া নারীর স্টেরিওটাইপের খোলস ভেঙ্গে আত্মকে অনুধাবন করতে পারে আর যোগ দেয় কংগ্রেসে। কারণ আমাদের এই সাদামাটা জীবনটাই নানা বৈপরিত্যে ঠাসা।
‘স্ত্রীলোকের স্বভাব পুরুষ জানে না, জানতেও পারবেনা। মানুষ তো দূরের কথা, দেবতাও যখন জানেন না। মেয়েদের একটা বড় আকাঙ্খা পুরুষকে হাতের মুঠোয় রাখা। পুরুষকে জয় করার আনন্দ তারা গোপন করতে পারে না। তা সে পুরুষ যেই হোক না কেন। এই কটা দিনের মধ্যে আমি অনেক দেখলাম, অনেক শিখলাম। ওই পরগাছা দুষ্টু বামুনকে আর আমি চাই না; কিন্তু তাই বলে তার কোনও অনিষ্টও করতে চাই না। সংসারে এক ঈশ্বরের বাইরে সত্য বলে কিছু নেই। সত্যই ঈশ্বর, ঈশ্বরই সত্য। তাঁর সেবা ছাড়া মানুষের অন্য কোনও কাজ নেই।’ (পাতমুগী)
তার গল্প মুক্তধারার পাহাড়ী নদীর মত, প্লটের শানবাঁধানো ঘাট নেই তাতে যেখানে বসে কাহিনীর বদ্ধ জলে চিন্তার ঢিল ছোঁড়া যায়। তাই সম্ভব - অসম্ভবের সীমা ছাড়িয়ে ছুটে চলে তার গল্পের ধারা। রতন মুন্ডা গল্পে আঠারো বছরের জোয়ান ছেলে নদীতে ডুব দিয়ে আর উঠে আসেনা, তাকে ডেকে ডেকে নদীতীরে কেঁদে ফেরে জুমুরী। পরিশেষে জ্ঞাতিদের কাছে ভুতে পরিণত হওয়া রক্তমাংসের জুমুরীর ঠাঁই মিশনারিদের বোর্ডিং-এ।
কিংবা মড়ার খুলি এসে শুনিয়ে যায় তার বিধবা জীবনের অবর্ণনীয় যন্ত্রণার কাহিনী। বাল্যবিধবা হয়ে লম্পট ভাশুরের সঙ্গে প্রবৃত্তির তাড়না মেটানো, তারপর সেই ঘাতকের হাতে প্রাণ হারিয়ে পুকুরের জলে নিক্ষিপ্ত হওয়ার করুণ সমাজচিত্র।
‘তোমাদের বিধানমতে একবার স্বামী হারালে আর আমরা বিয়ে করতে পারবোনা; কিন্তু তোমাদের বেলায় সে পথ একেবারে উন্মুক্ত রাজপথ। স্ত্রী যতবারই মরুক না কেন তোমাদের যতবার প্রাণ চায় ততবারই বিয়ে করতে থাকবে আর শাস্ত্রও সেখানে ছাতা মাথায় ধরে আদর করে তোমাদের আগলে নিয়ে যাবে। ছিঃ এই তোমাদের শাস্ত্র! তোমরা এ রকম! সংসারের এই রীতি! এই সংসারের মালিক কে? স্বার্থপর পুরুষকটার বাইরে আর কোনো মালিক আছেন বলে তো মনে হয় না। ’ (মড়ার খুলি)
গল্পগুলো আকারে খর্ব। ছোট ছোট কথার সুনিপুণ গাঁথুনি আর চায়ের আড্ডার গল্পবলিয়ের মত কথনভঙ্গি গল্পগুলোকে সরেস করেছে।
------------------------------------------------------------
প্রাসঙ্গিক :
১. ‘রতন মুন্ডা ও কয়েকটি গল্প’ নামে লক্ষ্মীনাথ বেজবড়ুয়ার গল্পের অনুবাদ প্রকাশ করেছে সাহিত্য অকাদেমি । অনুবাদ করেছেন বীণা মিশ্র।
২. লেখকের জন্মশতবর্ষে ভারত সরকারের ডাকটিকেট :
৩. অসমের রাজ্য সংগীত ইউটিউবে
মন্তব্য
উনার নাম জানতাম না। পরিচিত করানোর জন্য থ্যাংকস।
-----------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার
লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার মত লেখকদেরই হয়তো বলা চলে অর্গানিক ইন্টেলেকচুয়াল। মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ।
অনেক ধন্যবাদ। লেখকের নামটা পরিচিত, এমনকী ‘রতন মুন্ডা ও কয়েকটি গল্প’র নামও কোথাও শুনেছি (মনে করতে পারছি না)। কিন্তু পড়িনি।
ইচ্ছে রইলো
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
মহাশ্বেতা দেবীর "চোট্টি মুণ্ডা এবং তার তীর"- এইটার সাথে মিলায়া ফালান নাই তো ?
অলমিতি বিস্তারেণ
অলমিতি বিস্তারেণ
আপনার যে বিপুল বইয়ের ভান্ডার সেখানে কোথাও হয়ত এই বইটাও উঁকি দিচ্ছে। একটু খুঁজে দেখেন।
জানানোর জন্য কৃজ্ঞতা ।
গল্প গুলো পড়ার জন্য ইচ্ছে রইলো
লেখা পড়ে মন্তব্য করার জন্য কৃতজ্ঞতা।
পড়তে ইচ্ছা করছে গল্পগুলো, কী করে পড়ি.......
ইন্টারেস্টিং!
বইটা পড়তে পারলে হতো।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
পরিচিত হলাম আরেকজনের সাথে। লেখককে ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন