আরে ভাইগ্না, এতো দেরি হইলো? আসো। অই, অরে চা দে।
মাহমুদ আলীর আনানো এই চা আর লাঠি বিস্কুটই সাইফুলের সকালের নাশতা। প্রথম যেদিন এখানে এসেছিল সেদিন থেকেই এই নিয়ম। মাহমুদ আলীর দেখাদেখি এখানকার সবাই তাকে ভাইগ্না ডাকে। সে যদিও কাউকে মামা ডাকে না। সাইফুল কথাই বলে কম। বড় বড় চোখ তুলে শুধু চেয়ে থাকে। চকসার্কুলার রোডের দোকানিদের সাইফুলের জন্য বাঁধা বরাদ্দ - দুই টাকা।
সাইফুল খুব দ্রুত হাঁটতে পারে। অবশ্য একে যদি হাঁটা বলা যায়। কাঠির মত সরু পা দুটো, বোধহয় পোলিও হয়েছিল। ছোট্ট ছোট্ট হাতের তালুর ওপর ভর দিয়ে শানের ওপর হেঁচড়ে নিয়ে যায় শরীরটাকে। রাস্তার ময়লা বাঁচিয়ে, পায়ের দঙ্গল এড়িয়ে, রিকশা - সাইকেলের ভীড় কাটিয়ে ঠিকই এগিয়ে যায়, কখোনো ধাক্কা খায়না। আর ভীড়ভাট্টা যতই থাকুক মাহমুদ আলীর চোখও কখোনো এড়ায়না।
চারশো বছর বয়স হলো, তবুও বুড়ির আহ্লাদের শেষ নাই। এখনও তাই বুড়ি চকে হাজার লোকে হল্লা করে। ভাংতির বাক্স থেকে নতুন টাকার সুঘ্রাণে মেশে দোকানের প্রাচীন পাল্লার দেমাকি গন্ধ। প্লাস্টিকের ডলপুতুল, চুড়ি বেলোয়াড়ি, টোপর কিংবা জুতা । তামাম ঢাকা খুঁজে যা পাওয়া যায়না তা এই চকে পাওয়া যায়। লোকে তাই ডাকে সস্তার বাজার । এখান থেকে নতুন ঢাকার চকচকে দোকানে মাল যায়। মাহমুদ আলীর দোকান থেকে যদিও যায় না। চল্লিশ বছরের পুরানা দোকান এই ‘আলী গ্লাস হাউস’, পঁচিশ বছর হলো সে এই দোকানের হাল ধরেছে। কিন্তু ছেলে-পুলেরা আর এই লাশের বোঝা টানতে চায়না। লাশই তো! ঢাকার মানুষ কি এখন আর এইরকম গ্লাসে পানি খায়? ছোট কারখানায় কারিগরদের হাতে বানানো রংহীন কাঁচের গ্লাস। কখনো কখনো হাতেই রং তুলি দিয়ে নকশা করা। কত ডিজাইনের বিদেশী গ্লাসে বাজার ভরে গেছে! তার এই ত্রিশ, চল্লিশ বছর পুরানা গ্লাস কিনবে কে? বাপ-দাদার ব্যবসা ছাড়তে মন চায়না কিন্তু ...
সাইফুলের কয়দিন খুব জ্বর ছিল। জ্বর - টর সাইফুল পাত্তা দেয় না, পাত্তা দিলে ভাত আসবে কোথা থেকে? কিন্তু একেবারে নড়তেই পারছিলো না। পরে নানী বললো থাক কয়টা দিন যাওনের কাম নাই, ভাত জুইটা যাইবো। একটু সুস্থ হয়েই আবার চকে ছুটলো সাইফুল। সবাই নিশ্চয় ভাবছে ও কেন আসছে না।
চক সার্কুলার রোডে পৌছাতেই গতি ধীর হয়ে যায় সাইফুলের। মাহমুদ আলীর দোকান কই? ঝক ঝকে নতুন একটা দোকান। আস্তে আস্তে দোকানের সামনে গিয়ে থামে। তাকে তাকে দেশী-বিদেশী বিস্কুট, চকোলেট, জুস এইসব জিনিস সাজানো। দোকান থেকে একটা চ্যাংড়া ছেলে বেরিয়ে আসে। ওকে তাকিয়ে থাকতে দেখে জোর ধমক লাগায় - ঐ লেইলচা শালা, যা ভাগ!
ভাইগ্না এদিকে আসো।
অন্য এক দোকানির ডাকে সেদিকে এগিয়ে যায় সাইফুল।
মাহমুদ ভাই ব্যবসা ছাইড়া দিছে। পোলারা এই নতুন দুকান বসাইছে। মাহমুদ ভাই আর আসে না। তুমি চা খাইবা?
মাথা নেড়ে সাইফুল সামনের দিকে এগিয়ে যায়। অনেক জায়গায় যেতে হবে।
মন্তব্য
লেখাটা পড়ে কেন যেন মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল
হাম্মাদ আলি
লেখা পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
খেটে খাওয়া মানুষ গুলোর ভাগ্য এভাবেই নিঃশেষ হয়ে যায়। জীবনের চরম সত্যটাকে সাথ নিয়েই পথ চলতে হয়।
গল্পটা পড়ে মনটা ভারী হয়ে গেল।
.<><><><><><><
কামরুজ্জামান স্বাধীন।
খেটে খাওয়া মানুষের ভাগ্য আর ঐতিহ্য নিঃশেষ হচ্ছে পুজির আগ্রাসনে। মেনে নিতে নিতে বিকৃতিও আজ স্বাভাবিক মনে হয়।
প্রিয় মনামী,
ছবিগুলো শব্দের গায়ে আলাদা জেল্লা যোগ করেছে। ধন্যবাদ। আশা করছি সামনে আরো এরকম লেখা পড়ার সৌভাগ্য হবে। ভালো থাকবেন।
---------------------------------------------------মানিক
ছবির কৃতিত্ব সহসচল অনিন্দ্য রহমানের। আশা করি আমার লেখা সবসময় পড়বেন এবং মন্তব্য করবেন। অনেক ধন্যবাদ।
খুব সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন জীবনের রুড় বাস্তবতাকে । ভালো লাগলো ।
ভালো থাকুন নিরন্তর ।
সাবরিনা সুলতানা
ধন্যবাদ সাবরিনা। আপনিও ভালো থাকুন।
আপনার লেখায় যত্নের ছাপ টের পাই।
কি মাঝি, ডরাইলা?
-চমৎকার লিখেছেন। এটা কি গল্প, না সত্যি?
সব গল্পেরই ভিত কোন না কোন সত্যিতে, সেরকমই একটা সত্যিকারের গল্প বলতে পারেন।
বুড়ি চকের আহ্লাদ বোঝানোর বর্ণনাটা অনেক সুন্দর লেগেছে। ইদানিং পুরান ঢাকা তোকে বেশি টানছে নাকি?
গল্পে সাইফুল আর পুরোনো কাঁচের গ্লাসের মধ্যে কোন রূপক মিল আনা যেতো কি? গল্পটার বুনোটে আরো কাজ করা যেতো মনে হচ্ছিলো। গল্পটাকে যদি আরো একটু বেশি সময় দিতিস....!
ছবির ছেলেটি ভারি মিষ্টি। কষ্ট হচ্ছিল দেখে। গল্পে ছবির ব্যবহারটা সুন্দর হয়েছে।
রূপের মধ্যে থাকাটাই ভালো। সত্য যে কঠিন। কঠিনেরে ভালো না বাসলেও তা কঠিনই থাকবে। কী বলেন?
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
পয়লা ছবিটা দিয়াই সব্বনাষটা করছেন।
গপ ভাল্লাগছে
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
বুঝতেসিনা কোনটায় বেশি মন খারাপ হইল - গল্প পইড়া, নাকি গল্প পইড়া উপরে আবার বিটলা পিচ্চিটার হাসি দেইখা।
গল্প ভালা হইসে।
==========================
আবার তোরা মানুষ হ!
==========================
আবার তোরা মানুষ হ!
থ্যাংকু।
ভালো লাগল।
__________♣♣♣_________
না-দেখা দৃশ্যের ভেতর সবই সুন্দর!
__________♣♣♣_________
না-দেখা দৃশ্যের ভেতর সবই সুন্দর!
ছেলেটা ওর ছবি ইন্টারনেটে দেখলে নিশ্চয়ই খুশি হবে। গ্লাসের ছবি দেখে বহুদিন আগের গ্রামের বাড়ির কথা মনে পড়ল। আর মনে পড়ল এরকম গ্লাসে কুয়ার ঠান্ডা পানি খাওয়ার স্মৃতি।
ছেলেটা ওর ছবি ইন্টারনেটে দেখতে পাবে বলে মনে হয় না। গল্প পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
মনাবী, ভাল লাগল। এই হচ্ছে গল্প। অভিজ্ঞতার বাইরে কোন মহৎ গল্প নির্মাণ অসম্ভব। আপনারা সে লাইনে আছে। এজন্য আশা জাগছে।
আমাদের দেশে ইমতিয়ার শামীমের গল্পে এরকম ফ্লেভার পেয়েছিলাম বহুদিন আগে। তার লেখা নিযমিত পাই না। পাই অনেক অগল্প।
গল্পবলার যে সহজাত স্বভাব আমরা অর্জন করি আমাদের পারিবারিক বা সামাজিক উৎস থেকে--সে ধারা একটু চেষ্টা করলেই ধরা যায়।
প্রথম লাইনটা অন্য রকমভাবে লেখা যেত?
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'
আপনার মন্তব্যটি অনুপ্রাণিত করলো। আমি যা দেখি তাই বলে যাই। ভালো লেগেছে জেনে ভাল লাগলো। প্রথম লাইনটা অন্যরকমভাবে লেখা যেত নিশ্চয়। চেষ্টা করবো।
চকের বর্ননা অসাধারন লাগলো। আর গল্পটাও।
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
চকের অসাধারনত্ব বর্ণনার অতীত। আমার প্রয়াসকে সাধুবাদ জানানোর জন্য অনেক ধন্যবাদ।
পুরনো ঢাকা আপনার ব্যতিক্রমী বর্ণনায় নতুন করে প্রাণ পেল। ভালো লিখেছেন।
অভিনন্দন।
জহিরুল ইসলাম নাদিম
পুরান ঢাকা, ঢাকা শহরের প্রাণ। কিন্তু আমরা তা ভুলে গিয়ে ১৯২০ এর দালান ভেঙ্গে টাওয়ার গড়তে ব্যস্ত। লেখা পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
গল্পের কথাগুলো খুবই সুন্দর লেগেছে। ভাল্লাগছে।
পলাশ রঞ্জন সান্যাল
ধন্যাদ পলাশ।
নতুন মন্তব্য করুন