সবচেয়ে কঠিন কাজটা সবচেয়ে সহজে হয়ে যাওয়ায় তানিম একটু ফাঁপড়ে পরে যায়। অবশ্য গত কয়েকদিন ধরে সুমির হাবভাব ভালো করে বোঝা যাচ্ছেনা। বোঝার মত মনযোগ দেয়াও তানিম ছেড়ে দিয়েছে অনেকদিন আগে। যাই হোক, কাজটা হয়ে গেছে এটাই আসল, তানিম নিজেকে আশ্বাস দেয়।
তাহলে, আমরা দার্জিলিং যাচ্ছি?
প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে দিয়ে চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে থাকে তানিম। দুজনের মাঝখানে পেটফোলা সময় আরো বেশি করে নৈঃশব্দ্য গিলে কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়ে। সময়ের শামুকগতিতে তানিমের ধৈর্য্যের কর্পুরের শেষ কণাটাও যখন ফুস, তখনই সুমি ছোট্ট করে বলে - হুম। তারপর বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অনেক দূর থেকে মোট বয়ে আসা মজুর যেমন এক মুহূর্ত জিরানোতেই সব ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলার ভান করে; সুমির এই দীর্ঘশ্বাসও তেমনি। বুকে জমে থাকা কথার ভার তাতে কমে না।
তানিমের হাতে সময় নাই। দ্রুত সব আয়োজন শেষ করতে হবে। সময় পেলেই ঘুরতে যাওয়ার অভ্যাস, তাই তানিমের কাছে এগুলা রুটিন কাজ। দার্জিলিং গেছে বহুবার। সুমি একবারও যায় নাই।
ঘুম, সোনাডা, টুং - সুন্দর না নামগুলা? দার্জিলিং আসার আগে এই স্টেশনগুলা পার হইতে হয় - খেতে খেতে বলে তানিম। অনেকদিন পর তানিম আর সুমি একসঙ্গে টেবিলে বসে ভাত খাচ্ছে। তানিমের ব্যাংকে এত কাজ থাকে! সবসময় কাজ, সকালে, দুপুরে, রাতে, ছুটির দিনে।
তুমি ছুটি পাইলা? ভাত মাখতে মাখতে জিজ্ঞেস করে সুমি।
হুম, ছুটি নিলাম।
ঐ মেয়ে কি তোমাকে ছেড়ে দিসে নাকি? সাপচোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করেই আবার চোখ নামিয়ে নেয় সুমি। অনেক সংকোচ ঠেলে গলা দিয়ে বের হয়েছে প্রশ্নটা। যতক্ষণ চিন্তায় আছে ততক্ষণ যেন এই প্রশ্নের কোনো অস্তিত্ব নেই, ঠোঁটে আসলেই প্রশ্নটা একটা জলজ্যান্ত মানুষ হয়ে তাকে তার জীবন থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। তাই বলে এভাবে চিন্তাটা নিজেই শব্দ জোগাড় করে প্রশ্নের আকার নিয়ে নিবে, এটা ভেবে কেমন যেন একটু হাসি পেয়ে যায় সুমির।
তানিমের গলায় ভাত আটকে যেতে চায়। এই মেয়ে তো ঘোড়েল মাল! দেখে কেমন গাধা গাধা মনে হয়। কী রকম পুতু পুতু করতো খালি! কয়দিন পরেই তানিমের মন উঠে গেল।
দ্যাখো সুমি, এইজন্যই আমরা বাইরে যাচ্ছি - গম্ভীর হয়ে বলে তানিম। আমাদের মধ্যে একটা গ্যাপ তৈরি হইসে। কাজের প্রেশার, তোমাকে সময় দেয়া হয়না। তুমি এইসব উল্টা পাল্টা সন্দেহ করো, আর...
সুমি হঠাৎ হাসতে শুরু করে। হাসতে হাসতে হেঁচকি উঠে, গলায় ভাত আটকে যাচ্ছেতাই অবস্থা। হাসতে হাসতে বলে, থাক আর কিছু বলার দরকার নাই, চলো ঘুইরা আসি দার্জিলিং। দেইখা আসি তোমার কাঞ্চনজঙ্ঘা।
তানিম চুপ মেরে যায়। বেকুব মেয়েছেলে। এইজন্যই সহ্য হয়না। এইটাও জানেনা যে বছরের এই সময় কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়না। যাক, জানেনা সেটা ভালো। সাদা-কালো কুয়াশা হঠাৎ হঠাৎ হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে পড়ে এ সময়। ঢেকে ফেলে পাহাড়, রাস্তা, চওড়া খাদ, দোকান, মানুষ। এই রহস্যময় কুয়াশাই তানিমের পরিকল্পনা সফল করার প্রধান উপকরণ।
নির্মেদ সটান দেহ নিয়ে পাহাড়ের পাহারায় স্থির দাড়িয়ে দেবদারু গাছগুলো। পেজা তুলার মত মেঘ গায়ে গায়ে জড়িয়ে তাদের নিবিড় সবুজ নিস্তব্ধতাকে যেন ভেঙ্গে দিতে চায়। তারপর দুষ্টামি ব্যর্থ হলে মুখ ফিরিয়ে সরে যায় দূরে।
এই গাছগুলা কি সারাজীবন এভাবেই আছে, না? সুমি দপ করে কথাটা বলেই আবার নিভে যায়। উত্তরের অপেক্ষা না করেই আস্তে আস্তে বলে - এইখানটাতে মরতে পারলে আরাম লাগতো অনেক, কী নরম সবুজ! কষ্ট লাগবে না বোধহয় একদম তাই না?
তানিম ভয় পেয়ে যায়, এই মেয়ে কি সব বুঝে ফেললো নাকি? মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। সব ঠিকঠাকমত আগাচ্ছে। শেষ মুহূর্তে সব ভেস্তে না যায়।
কী বল না বল? এরকম জায়গায় এসে কেউ মরার কথা বলে নাকি, ধ্যাৎ!
এই বিশালত্বের কাছে আমার শরীরটা কি তুচ্ছ ! একটা পাখির পালকের মতই আমি অদৃশ্য হয়ে যাবো এই সবুজ গহ্বরে। আর কেউ কখনো আমাকে দেখবেনা কিন্তু আমি এই নিঝুম নৈঃশব্দের অংশ হয়ে যাবো চিরকালের মত। ভেসে বেড়াবো আর আর গাছের পাতায় পাতায় জড়াবো মেঘ হয়ে।
ন্যাকামি করো না তো, চলো সামনের দিকে যাই। ধুর, আবার এই কুয়াশা...সুমি..অ্যাই সুমি...
কুয়াশায় সাঁতরে তানিম যখন আলোর নাগাল পায়, তখন সুমির আর দেখা পাওয়া যায়না। ভাড়া করা গাড়ির ড্রাইভার জানায় সুমিকে সে দেখে নাই। আশপাশে দেখে হোটেলে ফিরে দেখা যায় এখানেও ফিরে আসে নাই। তানিম দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। সে যা চেয়েছিল তাই কি তবে ঘটলো? কিন্তু সে তো কিছু করে নাই? হয়তো পা পিছলে...কিন্তু কোনো আওয়াজও তো পায় নাই। হোটেলওয়ালা আর গাড়িওয়ালার উদ্যোগেই পুলিশের কাছে যাওয়া হয়। কোনো হদিস পাওয়া যায়না। বাড়ির লোকদের খবর দিলে, পরিজনরাও এসে হাজির হয় পরে। সবাই সবার পন্থা অনুযায়ী সুমিকে খোঁজার চেষ্টা করে। কিন্তু সুমি যেন সত্যিই অদৃশ্য হয়ে গেছে।
একদিন শামা ফোন করে ফিসফিস করে বলে ‘জব ওয়েল ডান’। তানিমের কেমন যেন অস্থির লাগে। দেশে ফেরার পরও এই অস্থিরতা যায়না। কেমন একটা অদ্ভূত নীরবতা সবসময় তাকে ঘিরে থাকে, সব ধ্বনি, সব শব্দ, সব কোলাহল তাতে চাপা পড়ে যায়। সবাই আহা-উহু করে। শামা ফোন করে। তানিমের কথা বলতে ভাল্লাগেনা।
মন্তব্য
গল্পটা ভালো
ধন্যবাদ।
সত্যি!
শিরোনাম পড়েই ঐরকম ঝাউগাছের সারির পাশের খাদের ছবিই মনে আসছিল । গল্পটা সত্যি ভালো হয়েছে ।
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
গল্পটা সুন্দর।
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
ধন্যবাদ
অনেক সময় প্রেডিক্টেবল গল্পও ভালো লাগে বর্ণনার গুণে , এটাও তেমনি
মনে খুব দাগ কেটে গেল!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
দাগ কাটতে পেরে ভালো লাগছে
ওহো! আমি ভাবতেছিলাম তানিমই বরং পিছ্ল খাইয়া খাদে পড়বে।
-মেফিস্টো
সৌমিত্র্য র অভিনীত একটি পুরনো বাংলা ছায়াছবির রেশ রেখে গেল।
তবে আজকাল দার্জিলিং এ জনতার চাপ বেশি, পটভূমি টা সিকিম ,লাভা বা ললেগাঁও রাখলে আরো ভালো হত।
দার্জিলিং এ জনতার চাপের বিষয়টা সত্যি; তবে জনবিহীন জায়গাও দেখসি। সিকিম, লাভা, ললেগাঁও তো যাই নাই
তানিম খাদে পড়ে না। কেন?
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
খাদে পড়লে তো পড়েই গেল, তাইলে কি আর মজা হইলো?
তানিমের ফাঁসি চাই।
তবে এই ছিল জিয়েমটি (তানিম) আর বিডিয়ারের (শামা) মনে!
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
সত্যি বলছি, এটা ভেবেই শেষে এসে মন খারাপ না হয়ে হাসি পেয়ে গেসিলো!
**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।
মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।
তানিমগুলা মরেনা ক্যান?
**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।
মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।
গল্প ভালো লেগেছে। শেষের চমক বাড়াবার জন্য লেখক অহেতুক খুব ঢেকেঢুকে লিখেননি, সেটা আরো বেশি ভালো লেগেছে।
ধন্যবাদ
আপনার প্রত্যেকটা গল্পই দারুণ হয়! " প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে দিয়ে............" "ভেসে বোড়াবো আর আর.........." এ দুটো লাইন একটু দেখবেন প্লিজ
ভয়ংকর দারুন লাগলো মনামী'পু!
১. মনামী'র সাথে পু শব্দটা অটোমেটিক্যালি এসেছে। আমার কোন দোষ নাই
২. আমার খুব সম্ভবl 'বিশেষণে'র' ব্যবহারে সমস্যা আছে।
বিশেষ অনুভূতি প্রকাশে বিশেষণ, যেভাবেই ব্যবহার করেন সমস্যা নাই।
আগের দুইটা গল্পে বহুত বেশি আড়াল আবডাল ছিলো। গল্প ধরতে ধরতে ছুটে যায় টাইপ। আজকে সেইটা নাই। সহজ সরল এবং কড়া। চলতে থাকুক।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
অলস সময়
দারুণ আপু
[এমন গল্পকারের প্রেমে পড়া আমার ন্যায্য অধিকার! ]
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
এইরে
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
অসাধারণ৷ অসম্ভব ভাল৷
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
ভাল লেগেছে, ভাবিনি হারিয়ে যাবে। শেষ লুকানোর লুকোচুরি না থাকাটাই গল্পকে বেশি আকর্ষনীয় করেছে
নতুন মন্তব্য করুন