শামসুদ্দিনদের গ্রামের বাড়িতে একটি কৃষ্ণচূড়া গাছ ছিল। বাইরের বারান্দায়, যেখানে গ্রাম্য শালিস ডাকা হতো, ধান মাড়াই হতো আর পানের বিড়া বানানো হতো সন্ধ্যার পর, সেই পুরো এলাকা দখলে ছিল ওই বিশাল কৃষ্ণচূড়া গাছের। ডালপালা চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিয়ে মহারাণীর মত ওখানে সে তার ক্ষুদ্র রাজত্ব করে যাচ্ছিল কয়েক দশক ধরে। সারাবছর তার চিরল সবুজ পাতারা মায়া ছড়িয়ে রাখত উঠানের কোণ জুড়ে, আর বসন্ত এলে তার জৌলুস বেড়ে যেত অনেকগুন—রক্তিম আলোর আভায় উজ্জ্বল হয়ে উঠত সারা বাড়ি। একমাত্র বাড়ির কাজের মেয়ে কোকিলা ছাড়া কারো তার প্রতি কোন বিদ্বেষ ছিলনা। কোকিলা সকাল বেলা উঠানে ঝাড়ু দিতে এসে গজগজ করত---"মরার গাছ, ঝাড়ু দিতা দিতা কোমর গেইল!"
এত রাগের পরেও সেই কোকিলাই আবার কুড়িয়ে সজীব ফুলগুলিকে নিয়ে গামলা ভর্তি পানিতে ভাসিয়ে রাখত বাসন মাজার উঁচু ঢিবির পাশে। গাছটিকে শামসুদ্দিনের মাঝে মাঝে নিজের প্রেমিকা মনে হতো। চৈত্র মাসের দারুণ বাতাসে যখনই গাছের পাতারা-ফুলেরা না বলে তার ঘরে প্রবেশ করত, সে পরম মমতায় তাদের বইএর পাতার মাঝে গুঁজে রাখত। ষাটের দশকের শেষে রাজনীতিতে জড়িয়ে যাওয়ায় বাড়িতে তার ফেরা হতো খুবই কম। ফিরলে ফিরত সে দুজনেরই টানে, সাদা শাড়ী পরা মা আর লাল শাড়ী পরা ওই কৃষ্ণচূড়া গাছ।
সত্তর দশকের মধ্যভাগে শামসুদ্দিনকে পালিয়ে আসতে হয়েছিল দেশ ছেড়ে। উত্তর আমেরিকায় এসে কিছুটা থিতু হবার পর তার দ্বিতীয় বারের মত সন্তান সম্ভবা বউ শামীমা বলল,’ এবার চলেন বাড়িঘর কিনা সেটল করি। কাহাঁতক আর ভাড়াবাড়ি ভাললাগে কন!”
শামীমার প্রথম থেকেই ভাড়া বাড়ির প্রতি বিতৃষ্ণা। ভাড়া বাড়িতে বসবাস করার বহুবিধ সমস্যার মধ্যে প্রথমটি হলো সে মনের সাধ মিটিয়ে শুঁটকী রান্না করতে পারে না। আশেপাশের ফ্ল্যাট থেকে কমপ্লেইন আসে। দ্বিতীয় সমস্যা হলো তার “বাবু” ইচ্ছামতন লাফালাফি করতে বাঁধাগ্রস্থ হয়! নিচের তলা থেকে চাইনীজ প্রতিবেশী এসে কলিংবেলের বোতাম টিপে তাকে দিয়ে দরজা খোলায়, তারপর অবোধ্য-দুর্বোধ্য ইংরেজীতে তাকে কী কী যেন সব বলে বদনার মত মুখ বানিয়ে বিদায় নেয়। শামীমা এই চাইনীজ প্রতিবেশীর ইংরেজী থেকে মুক্তি চায, স্বামীর জন্য মনের সাধ মিটিয়ে লইট্টা, লাক্ষা, ছুরি, কাঁচকীর শুঁটকীর নানা পদ রান্না করতে চায়। শামসুদ্দিন শামীমার জন্যই হোক আর নিজের স্বস্তির জন্যই হোক বাড়ি খোঁজা শুরু করেন।
মন্ট্রিয়লের আশেপাশের ছোট্ট, শান্ত শহরগুলোতে তাদের বাড়ি খোঁজা শুরু হয়। শামীমার সব বাড়িই পছন্দ হতে থাকে, শামসুদ্দিনের কোনটাই হয় না। ছবির মত সুন্দর বাড়িতে প্রবেশ করেও তার চোখ আটকে যায় সিঁড়ির নিচের বাঁ দিকটায়। গাছ আছে?
গাছ থাকলে কি গাছ? সে গাছে কি ফুল হয়? ফুল হলে কীরকম ফুল, কোন রঙ, কোন মাসে ফোটে সে ফুল? গাছের পাতা এতো বড় কেন? হবেনা! এই বাড়ি হবেনা! কোনও বাড়িই হয় না! বছরখানেক অত্যন্ত ধৈর্য ধরে বাড়ি খোঁজায় স্বামীকে যথাসম্ভব সঙ্গ দিয়ে অবশেষে শামীমা একদিন বেদনাহত ও কাহিল হয়ে শব্দ করে কাঁদে—--“আপনার আর বাড়ি কেনা হবে না! ক্যানাডায় আপনার জন্যে কৃষ্ণচূড়া গাছ লাগায়া রাখব কে!”
আরও একবছর ঘুরবার পর শামসুদ্দিনের একটি বাড়ি পছন্দ হয়। ততদিনে শামীমার বড় বাবুর সাথে ছোট বাবুও পাল্লা দিয়ে লাফায়, ফলে তাকে তার চাইনীজ প্রতিবেশীর সাথে যথাসম্ভব খাতির করে নিতে হয়েছে। আর তার শুঁটকী রান্নার সখ বিসর্জিত হয়েছে।
শামসুদ্দিন যখন তাকে এসে বলল---“ বাড়ি পছন্দ হইছে!”
শামীমা তখন নিরুৎসাহিত চোখে তাকায় তার দিকে। শামসুদ্দিন বলে,”—বাম দিকে না হইলেও ডান দিকে একটা ফুলের গাছ আছে। আকার আকৃতি ছোটখাট,তয় ফুলগুলান কৃষ্ণচূড়ার মামাতো বোন!”
শামীমা স্থিরভাবে তার উচ্ছ্বাস পর্যবেক্ষণ করে বলে—“ বাড়ির ভিতর দেখছেন? ঘরগুলান কীরকম, বাথরুম কয়টা? কার্পেট পাতা না কাঠের মেঝে? বাড়ি কয়বছর আগে বানানো? দেয়ালের আবস্থা, ছাদের আবস্থা—দেখছেন?”
শামসুদ্দিন আসহায়ের মতন তাকায়, স্বীকার করে ঐগুলান সে খেয়াল করেনাই। শামীমা তখন তার দুর্দান্ত দুই পুত্র কোলে করে বাড়ি দেখতে যায়। বাড়ির অনেক সমস্যা। চালা বদলাতে হবে, বাথরুম অনেক ছোট, শোবার ঘর চারজনের জন্য যথেষ্ট হলেও গেষ্ট কেউ এলে থাকার জায়গা নাই, রান্নাঘরের কাউন্টারের রঙ সবুজ......এতসব সত্বেও ফিরে এসে সে শান্ত মুখে শামসুদ্দিনকে বলে,” এই বাড়ি চলবে।“
(চলবে)
মন্তব্য
লেখাটা ভারী সুন্দর লাগলো। অধীর অপেক্ষায় রইলাম পরেরটুকুর।
লেখককে শুভেচ্ছা।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
ভাল লাগল তাই পরের অংশের অপেক্ষায় রইলাম
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
চলুক... ।
....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !
....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !
পরের পর্ব চাই, দ্রুত...
চলুক ।
নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)
নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)
নষ্টালজিয়া! পরের পর্ব পড়ার অপেক্ষায় ।
দিদি, এই বছর কৃষ্ণচূড়া বোধহয় ছবি পাঠিয়ে আমিই তোমাকে দেখিয়েছিলাম , তা দুধের সাধ কি আর ঘুলে মিটে? তুমিও তো কত দিন কৃষ্ণচূড়া দেখনা । কৃষ্ণচূড়ার দিনগুলিতে দেশে চলে এসো
লেখাটা চলুক
বেশ গল্প মণিকা!
মন্ট্রিয়াল বলেছো বলে আরো নিজস্ব মনে হলো।
কি হইল আপু, পরের পর্ব তো আর আসল না। পরের বারে এটাকে একটু চালান।
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
নতুন মন্তব্য করুন