আশেপাশের সবকিছু শব্দহীন হয়ে যাচ্ছে।একটু আগেও পাশের ঘরে কেউ একজন ভ্যাকুয়াম ক্লিনার চালাচ্ছিল, তারও আগে আকাশ ভাঙা বৃষ্টি; বৃষ্টির আগে পরিচিত শব্দে পলতা লোকাল চলে গেল। ট্রেন লাইনের পাশের আকাশছোঁয়া বাড়িগুলোয় কাল সাতারাত ধরে গনেশপূজার আরতি চলেছে। ধুনোর গন্ধ ছাদ অবধি চলে এসেছিল, যদিও ট্রেন লাইন আর কাঁটাতারের বেড়া এড়িয়ে এতদূর আসার কথা নয়। জানালের পর্দা সরিয়ে টের পেয়েছিলাম ধূপের গন্ধ চারতলা পেরিয়ে ওপরে, আকাশের দিকে চলে গেল, সাথে সাথে মানুষের আনন্দ আর কোলাহল। কারা কারা যেন মাটির মালশা উঁচিয়ে নাচছিল। বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমার দেখার কথা নয়, তাও দেখতে পাচ্ছিলাম। হয়তো অপেক্ষা করছিলাম। দুলালদাকে , ভাবছিলাম জিজ্ঞেস করব কারা নেচেছিল সে কথা। সময় হয়নি, অথবা দুলাল দা বোধকরি এদিকে কাল আসেইনি। দুলাল দা আসেনি, ফারজানা আসেনি, তবু যেন কেউ দরজার কড়া নাড়ল, কেউ হয়তো না জানিয়ে এসে সাড়া না পেয়ে চলে গিয়ে থাকবে। আচ্ছা, আজ কত তারিখ? এপ্রিলের কত তারিখ? এপ্রিল মাস কি? বৈশাখ কি এপ্রিল মাসে? বৈশাখ তো এপ্রিলেই...আমার মনে থাকে না কেন? মাঝে মাঝে স্মৃতি খারাপ হয়ে যায়, মাঝে মাঝে ভুল গন্ধ দূর ভাসিয়ে আমার বিছানার পাশে চলে আসেো। মাঝে মাঝে আজকের মত, এই মুহূর্তটির মত শব্দহীন হয়ে যাই...সমস্ত জৈবিক চেতনা হারিয়ে একা হয়ে যাই... বৃষ্টির ফোঁটার মতন ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ভাসিয়ে নিয়ে যায় পায়ের পাতা! কাঁথার প্রান্ত ঘষে পায়ের পাতা দেখতে চাই...এখনো কি ভেসে যাচ্ছে রক্তে? বৃষ্টির ফোঁটা কি পায়ের বুড়ো আঙুলে এসে থেমেছিলো! আর বুঝি চলবার পথ পায়নি?
ও আমার কাছে কী চাইছিলো? কেন ও আমার কাছে কিছু চাইবে? আমি কি কিছু দিতে পারি? আমি কি কাউকে কিছু দিতে পারি? ও ফিসফিস করে কিছু বলছিল, আর পায়ের পাতায় তখন গনগনে লাল সূর্য্য; বেগুনী রশ্মিতে আমি অন্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম, সত্যিকারের অন্ধ। আমি কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না, আমি কিছু ভাবতে পাচ্ছিলাম না, আমার পঞ্চ ইন্দ্রীয় অবশ হয়ে যাচ্ছিল...আমি যে মানুষ, ভুলে যাচ্ছিলাম তা। আমি ওকে হয়তো বলতে চাইছিলাম যে আমি পারিনা। চাইলেই আমি ওকে ধরে রাখতে পারিনা, আশ্রয় দিতে পারিনা, কোলের কাছে ডেকে বসাতে পারিনা। আসলে চাইলেই আমি কিছু চাইতে পারিনা! ও এসব বোঝেনা কেন? ও কেন ধরে নিয়েছে আমিই ওর একমাত্র আশ্রয় এখানে? ও কেন ধরে নেবে আমার ক্ষমতা নিঃশেষিত হবার নয়! ও কেন এত বোকা!
সেবার আমাদের বাড়ির সামনে নতুন রাস্তা বানানো হলো, বাবাকে বলল তাকে কিছু মাটি জোগাড় করে দিতে হবে। বাবা হঠাৎ মাটি কোথায় পাবে? রাস্তা যেখানে হবার কথা তার কোল ঘেঁষে লোকজন ডেকে পুকুর খোঁড়া হলো। ছোট্ট কিন্তু গভীর পুকুর, দারুণ তার অতল। বাবা বললেন, এবার সাঁতার শেখো, আমায় কাঁধে করে মাঝ পুকুরে নিয়ে হঠাৎ ছেড়ে দিয়ে দূরে চলে গেলেন...অতল পুকুরে ডুবতে ডুবতে দূরে দূরে বাবার ডাক শুনি...আয়, আয়... এদিকে আয়...জলের মধ্যে শিং মাছ ডানা মেলে ভেসে চলে যায়, শামুকগুলো শ্যাওলাবিদ্ধ হয়ে কাদায় হাঁটে, চাইলেই আমি ধরতে পারি ওদের, চাইলেই আমি ওদের সাথে হাঁটতে পারি। কিন্তু কেন চাইবো আমি? কেন আমাকে অতল পুকুরের মাঝখানে ছেড়ে দিয়ে জল চিনতে শেখাবে কেউ?
কিন্তু আমার সাথে এমনই হয়, আমি কিছু চাইবার আগেই দুটি সমর্থ হাত আমায় জলের ওপরে নিয়ে আসে। আমি হারিয়ে যাওয়া বাতাসের স্পর্শ পাই, নিঃশ্বাস নেবার সুখে ভরে যায় আমার শরীর। বাবা ভয় পেয়ে বলে,'হাত পা ছেড়ে দিয়ে তলিয়ে গেলি কেন?' আমি মনে মনে বলি,'ভারী অভিমান হয়েছিল, আমায় তুমি একা ছেড়ে দিলে কেন? একা একা ছেড়ে দেবে বলে তো তুমি আমার বাবা নও!'
কাঁথাটি মা অনুমতি দিদিকে দিয়ে বানিয়েছিলো। ছবিটি এঁকে দিয়েছিলো আর একজন। মা তো আর তখন জানত না এই নকশী সব একদিন ভেসে যাবে বৃষ্টির মতন রক্তজলে আর আমি এমন এক আলোজ্বলা সন্ধ্যায় এই কাঁথার এপাশ ওপাশ একজনকে খুঁজে বেড়াবো, যাকে আমি সমস্ত হৃদয় দিয়ে চেয়েছিলাম, শরীরের রক্তকণা দিয়ে পেয়েছিলাম, আর যাকে আমি ধরে রাখতে পারিনি আমার শক্তি নেই বলে, সাহস নেই বলে? আমি ওকে যখন ডাকলাম ও এলো না, এত কান্নাকাটি, বিশুদ্ধ অভিমান, শুনলনা। এখন যখন না বলে এল, আমার কী! আমার কোথায় কী এমন সবুজ বাগান যে সেখানে লুকিয়ে রাখবো ওকে? এমন কোথায় আমার লুকোনো বাড়ি আছে যে ওকে রাখবো আর কেউ জানতে আসবে না, কেউ প্রশ্ন করবে না 'ও,-কে'? ও,-কে আমি তার কি জবাব দিতে পারি? " তুই আমার কে, বলতো দেখি?'
দুলালদার বউ অর্চনাদি বোধকরি নিচে থেকে ডেকেছিলো,'তোমার নাম করে কেউ বলচে, ভিজিটর রুমে বসে আচে গো!' অর্চনা দিদি, আমায় এরকম তড়াসে ডেকোনা গো! ডাকলে বলে আমি ছুটে গেলাম, ডাকলে বলে আমি দেখতে পেলাম না তিনতলা থেকে সোজা একতলায় নেমে এসেছি...আমার উরু, পায়ের পাতা সব রক্তে ভেসে যাচ্ছে, মায়ের এমন ভারি কাঁথাটিও সেই প্লাবন থামাতে পারছে না...তড়াসে ডেকনা আমাকে আর কেউ কোনদিন... ও এসে চলে যাবে...ও এসে চলে গেল!
মন্তব্য
গল্পটা চোখ বুলিয়ে যাবার মতোন নয়, আলাদা মনোযোগ দাবী করে। চমৎকার জীবনঘেঁষা ,হৃদয় ছোঁয়া গল্প
ধন্যবাদ, মামুন ভাই!
____________________________
শান্তিও যদি সিংহের মত গর্জায়, তাকে ডরাই।
--নরেশ গুহ
----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand
সত্যি কথাটাই বলি; গল্পটা বুঝতে পারিনি
তবে বর্ণনা ভালো লেগেছে
"মুক্ত বিহঙ্গ" [অতিথি লেখক]
মোঃ জিয়াউর রহমান ববি
ধন্যবাদ, পড়েছেন এজন্যে।
____________________________
শান্তিও যদি সিংহের মত গর্জায়, তাকে ডরাই।
--নরেশ গুহ
----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand
কাব্যিকবর্ণনা ভালো লাগলো!
..................................................................
আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;
আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
পৌঁছে অনেকক্ষণ ব'সে অপেক্ষা করার সময় আছে।
ধন্যবাদ, পান্থ।
____________________________
শান্তিও যদি সিংহের মত গর্জায়, তাকে ডরাই।
--নরেশ গুহ
----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand
কবিতার মত লাগলো।
মর্ম
হুম! ধন্যবাদ, মর্ম!
____________________________
শান্তিও যদি সিংহের মত গর্জায়, তাকে ডরাই।
--নরেশ গুহ
----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand
কবিদের গল্প থেকেও কবিতার গন্ধ বের হয়।
চতুর্থ লাইনে "ছাঁদ" শব্দটা "ছাদ" হবে না? কয়েক জায়গায় "কি" এর বদলে "কী" হবে।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
ঠিক করে দিচ্ছি।
____________________________
শান্তিও যদি সিংহের মত গর্জায়, তাকে ডরাই।
--নরেশ গুহ
----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand
"কবিদের গল্প থেকেও কবিতার গন্ধ বের হয়। "
বদ্দার ভাষায় বলতে গেলে...কোনটা যে কবিতা আর কোনটা যে ধুনফুন...বোঝা কষ্ট। সেই হিসেবে এটার অবস্থান যে কি, বলা যাচ্ছে না। বানান ঠিক করার চেষ্টা করলাম।
____________________________
শান্তিও যদি সিংহের মত গর্জায়, তাকে ডরাই।
--নরেশ গুহ
----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand
- কিছু বানান বিভ্রাটের পরেও বলবো, দারুণ হয়েছে গল্পটা। চেষ্টা জারী রাখুন।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
- কিছু বানান বিভ্রাটের পরেও বলবো, দারুণ হয়েছে গল্পটা। চেষ্টা জারী রাখুন।
জারি !
ধন্যবাদ!
____________________________
শান্তিও যদি সিংহের মত গর্জায়, তাকে ডরাই।
--নরেশ গুহ
----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand
অ-নে-ক ভালো লাগলো আপু।
*************************************************************************
ভবিষ্যতে কি হবে তা ভেবে বর্তমানকে উপেক্ষা করবো কেনো?
____________________________________________________________________
"জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই বহন করে করুক;
আমি প্রয়োজন বোধ করি না :
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ হয়তো
এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।"
পড়েছো জেনে ভালো লাগছে আমারও। ভাল থেক।
____________________________
শান্তিও যদি সিংহের মত গর্জায়, তাকে ডরাই।
--নরেশ গুহ
----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand
হুম, কবিদের সবকিছুতে কাব্য ঘুঁটে দেয়ার বদভ্যাস আছে বোধয়। সেটা থেকে একমাত্র সুনীলকে দেখেছি মুক্ত হতে, আর কাউকে আপাতত মনে পড়ে না যে কবি হয়েও কাব্যকে দূরে ঠেলে রাখতে পেরেছেন গদ্য থেকে।
গল্প নির্মেদ না হলেও বোধয় আফসোস করার কোন কারণ ঘটেনি। আবেগে, আবেদনে প্রখর লেখাটা, যা একটা গল্প সফল হওয়ার জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। আবেগের পরিমিতিও বজায় ছিল বোধ করি, অন্তত ফস্কে যায়নি।
আপনার গল্প এই প্রথম পড়লাম আপু। উপরের বিশ্লেষণ ধর্তব্যে না এনেই আপনি গদ্য লেখা চালিয়ে যেতে পারেন। সামনে অবশ্যই আপনার কাছ থেকে আরো পরিপূর্ণ গদ্য পাব আশা করি।
ধন্যবাদ পড়ার ও মন্তব্য করার জন্যে।
____________________________
শান্তিও যদি সিংহের মত গর্জায়, তাকে ডরাই।
--নরেশ গুহ
----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand
ভাল লাগল গল্পটা
অফটপিকঃ কাকতলীয় হলেও সত্য, গত কয়েকদিন ধরে এই বিষয় বস্তুর উপর একটা গল্প লিখব ভাবছিলাম
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
পড়ার জন্যে ধন্যবাদ। সেই হিসেবে আপনার ভাবনা সিনিয়র। আমার লেখাটা হঠাৎই ।শুভেচ্ছা।
প____________________________
শান্তিও যদি সিংহের মত গর্জায়, তাকে ডরাই।
--নরেশ গুহ
----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand
শেষে ভাল চমক থাকল!! গল্প বলার ভঙ্গি ভাল লাগল।
-স্নিগ্ধা করবী
ধন্যবাদ!
____________________________
শান্তিও যদি সিংহের মত গর্জায়, তাকে ডরাই।
--নরেশ গুহ
----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand
আমার অনেক অনেক ভাল লেগেছে। আরও লিখুন।
ধন্যবাদ।
____________________________
শান্তিও যদি সিংহের মত গর্জায়, তাকে ডরাই।
--নরেশ গুহ
----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand
আপু খুব অসাধারণ হইছে...
ধন্যবাদ, অর্ক!
____________________________
শান্তিও যদি সিংহের মত গর্জায়, তাকে ডরাই।
--নরেশ গুহ
----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand
সুন্দর, অনেক সুন্দর, অনেক ভালো লাগলো। ধন্যবাদ সুন্দর লেখার জন্য।
কামরুজ্জামান স্বাধীন।
ধন্যবাদ!
____________________________
শান্তিও যদি সিংহের মত গর্জায়, তাকে ডরাই।
--নরেশ গুহ
----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand
নতুন মন্তব্য করুন