প্রথম যেবার তারা ফ্ল্যাট কিনল- চারতলার দুটো ঘর; নতুন বিয়ে, নতুন চাকরী, নতুন ফ্ল্যাট। জানালা গলিয়ে একটি চড়ুই পাখি একদিন সত্যি সত্যি এসে তার মাথার ওপর বসেছিল। সাহসী সে চড়ুইকে সে তারপর অনেক আদর করে জানালার বাইরে উড়িয়ে দিয়েছে।তখনো বিকেলের ছাঁদ ভালো লাগে, মধ্যরাত ভালো লাগে, নিয়ন্ত্রণ হীন শরীর ভালো লাগে।তখনও কাগজের বিশ্বস্ততাকে ভয়ানক মূল্যবান মনে হয়। তখনও-‘ওকে না হলে আমার আর আমাকে না হলে ওর জীবন মূল্যহীন!’ সেইসব সময়ে এর থেকে আরও বড় সত্য কথাটি মনে পড়ে না যে একদিন সে ভাবত বাবা মাকে ছাড়া কীভাবে বেঁচে থাকবে! এঁদের একজন মাথার ওপর ছাতা হয়ে নেই ভাবতে একসময় মেরুদণ্ড হিম হয়ে যেত। তারও কিছু পরে, প্রতিবেশী সেই যুবকটিকে নিয়েও সেরকম ভাবনা হতো।-'ওকে ছাড়া আমার আর আমাকে ছাড়া ওর জীবন…।' অথচ ও, মানে সেই যুবকটি একদিন কিশোরী প্রেমিকার স্তনের অধিকার আদায় করতে গিয়ে ছিঁড়ে ফেলল তার কামিজ; তার অস্ফুট ‘না না’ চীৎকার কেউ শুনল না। তখন ওকে ছাড়া আমার আর আমাকে ছাড়া ওর…? সত্যিই কি কাউকে ছাড়া কারো জীবন অর্থহীন হয় নাকি? কখনো হয়েছে নাকি? কাউকে সেই উন্মুক্ত স্তনের কাহিনী বলা যায় না, নীরব হয়ে যেতে হয়- ঘৃণা আর ভয় চেপে নিজেকে ধিক্কার দিতে হয়। কারণ আমি প্রেমে পড়েছিলাম; ভালবেসেছিলাম বলেই দায় সব আমার নিজের! আর কেউ কোনও দায় নেবে না। এরপর আস্তে আস্তে সন্ধ্যার অন্ধকারে একা বসে থাকতে থাকতে মনে হয়েছে- বেঁচে থাকা যায়। এদের সবাইকে ছেড়েই বেঁচে থাকা যায়। মোহনা বোধকরি এটাকেই একটু অন্যরকমভাবে বলতে চেয়ে ছিলো!
‘না’ বলতে না জানার যাতনায় তার সমস্ত কৈশোর দুঃস্বপ্নের অন্ধকারে ডুবে যায়, তার যৌবনের অনিচ্ছার ভুলগুলো শরীরে মনে স্ট্যাম্পের মত দাগ হয়ে থাকে। কেন তাকে কেউ ‘না’ বলতে শেখায় নি? কেউ না শেখালে যে নিজে নিজে কিছু জিনিস শিখে নিতে হয়, এই বোধই বা তার মাঝে আগে আসেনি কেন? তারপর অনেকদিন করবী গাছের পাশে যে বিশাল পুকুরটা ছিল সারা পুকুর ভর্তি মোতি পানার কাঁথা- সে ঘাটে নেমে দুই হাতে পাতা সরিয়ে কালো জলের তলায় ডুবে যেতে যেতে জপের মালার মতন বলতে থাকত-না না না!”
একদিন নদীর মতন চোখ নিয়ে এই তীব্র মানুষটি যেদিন তার চোখের দিকে সরাসরি তাকাল, ময়াল সাপের মোক্ষম শিকারের মতন সে সেই অভূতপূর্ব চোখের ছন্দে চলতে শুরু করেছিল। যখন সে চোখ একতালার ঢিমেতালে চলে তার নিজের লয় মন্থর হয়, যখন সে চোখ লাউনীতে দোলে সে নিজেও বাহ্যজ্ঞান ভুলে দোলে। এসবের কারণ সে খোঁজে নি। সেরকম অবস্থা তার ছিল না। ভাবেননি কি হচ্ছে, কারণ ভাবার মতন সময় হয়নি। সে পেছনের বা সামনের দিকেও তাকায় নি, নিজের উঠান কিংবা রান্নাঘরে নিজেকে মনে করেছে প্রচণ্ড বন্দ্বী! ফলত: যেদিন মানুষটি তার দুই চোখে হাত রেখে বেসমেন্টের আলো আধারিতে নিয়ে জড়িয়ে ধরে গভীর আবেগে চুমু খেয়েছিল, তার প্রথম ‘না’ বলার কথা মনে হলেও সে পারেনি। সেই একই সময়ে তার শরীর ও মন জুড়ে মরুভূমিতে বর্ষা যাপন। শুধু মনে পড়েছে জানুয়ারির প্রচণ্ড শীতে বাস স্ট্যান্ডে বাসের জন্যে বসে থাকতে থাকতে সে কতদিন এইরকম একটা সময়ের কথা ভেবেছে। দূর থেকে হেঁটে আসা পথিকদের মধ্যে এই মুখটি খুঁজেছে! ‘না’ বলতে গিয়ে তার সেইসব চর পড়া মৌসুমের কথা মনে হয়েছে খুব। অন্ধকারের বিছানায় দুটি প্রেমহীন শরীরের উত্থান-পতন-প্রশ্রয়-ঘৃণার কথা মনে হয়েছে। হারিয়ে যাওয়া গানের কথা মনে হয়েছে, দার্জিলিং এর পর্বতশৃঙ্গে দুহাত তুলে পাখি হবার ইচ্ছে ধারণকারী বালিকার কথা মনে হয়েছে। বেসমেন্টের আলো আধারিতে তার মনে একমাত্র যে কথাটি ঘুরে ফিরে এসেছে তা হল –সে সত্যিই একটি পাখি, লুকোবার মতন একটি উপযুক্ত বুক খুঁজে পেয়েছে! এবং…ওইরকম একটি অদ্ভুত আলো-আঁধারের ঘরে চারপাশের রঙের নেশায় ডুবে যেতে যেতে তার মোহনা আর বাবার কথা মনে পড়েছে।
--বাবা, তুমি স্বপ্না আন্টিকে সত্যই ভালবাসতে? ওই যে একদিন আমায় আর ভাইকে নিয়ে ওদের বাড়ি গেলে…? অনেকদিন পরে মেয়ের সাথে কথা বলতে আসা বাবার কণ্ঠস্বর ফোনের অপর প্রান্তে চুপ হয়ে যায়। মেয়ে আবার বলতে থাকে-‘ তোমার অপরাধবোধ হতো না বাবা?’ বাবার উত্তর আসে না। মেয়ে নিজের কথা বলে যায়- ‘আমার জানো তো, অপরাধবোধ হয়না। মনে হয়না কোথাও কোন ভুল করেছি! ভুল আর অন্যায় কি সমার্থক, বাবা?’
৩/
পর্দা খুলে রাখা জানালা গড়িয়ে নিয়নের আলো এসে নীল রঙের বিছানার চাদর বাদামী করে দিয়ে যায়। তার শরীর থেকে উষ্ণ একটি হাত স্থানান্তরিত হয় বালিশের অপর প্রান্তে। ড্রয়ারের কোণায় রাখা ব্যাগের মধ্যে সাত বছর আগের একটা মূল্যবান কাগজ কাঁপতে থাকে-‘আই ডু-আই ডু!’ আসার সময় শুধুমাত্র এই কাগজটিকে সে সঙ্গে করে এনেছিল। বাকী কোনকিছু গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি বলে নেয়ার কথা ভাবেনি। মোহনার কথা মনে পড়ে, ওর সাথে কি তার নিজের কোনও পার্থক্য আছে, অথবা থাকার কি কোনও প্রয়োজন রয়েছে?
বিছানায় বসে থাকা তার প্রার্থিত মানুষটি বলে,‘টেবল লাইট বন্ধ করে মোমবাতি জ্বালাই?’
মোমবাতির আলোয় শাদা সোফা আর বিছানার চাদর অন্ধকার লাগে। কল্পনায় বালিশের ওয়াড়ে বেগুনী ফুল ফুটতে শুরু করার আগেই-
- তোমার কোমরের বাঁক খুব স্পেশাল, এত ছোট্ট শরীরে এমন বিশাল সম্পদ কোথায় পেয়েছ তুমি?
অন্ধকার পাতলা হয়ে বালিশের ওয়াড়ে সামান্য ফুল ফুটতেই আবার-‘ তোমার বুকের মতন মৌসুমি… না, সম্ভবত: শম্পার বুকেও এরকম চোখে পড়ার মতন একটি দাগ আছে…!’
কথা শেষ হবার আগেই প্রচণ্ড শীত লাগে তার হঠাৎই! পাখির মতন মেলে দেয়া তার দুই বাহুতে শীত লাগে, হাতের পাতা নিস্তেজ হয়ে আসতে থাকে। নীল বিছানা টেনে ধরে অসহ্য ঠাণ্ডার মধ্যে নিক্ষিপ্ত করতে চায় পাখির শরীর!
বাথরুম খুঁজে পেতে একযুগ লেগে যায়; দ্বিতীয় এক যুগ লাগে খুঁজে পেতে ঠাণ্ডা ঘিয়ে রঙের কমোড। নিজেকে যাবতীয় উষ্ণতা শূন্য করে দিয়ে কমোড ভাসিয়ে বমি করতে থাকে সে আরও এক যুগ ধরে। বাথরুমে আলো নেই; আলো নেই বলেই একরাতে তিন যুগ বেড়ে যাওয়া বয়সটার কোনও প্রতিচ্ছবি আটকে থাকে না কোথাও।
ঘরের আলো ততক্ষণে নিভে গেছে। নীল চাদরে জবুথবু হয়ে বসে থাকা তার প্রেমিকটি বলে-‘ চা খাবে?’
-না
-বস তাহলে একটু
-না!
বেডসাইড টেবিলের ওপর পড়ে থাকা নিজের ব্যাগটি তুলে নিতে একটু ঝুঁকতে হয়।
-এই অন্ধকারে কোথায় যাবে? সকালে যেও না হয়!
কার্নিশের ওপর রাখা মোমবাতিটি সে বিনা দ্বিধায় জ্বালতে পেরে বলে-‘ অন্ধকারে যাবো না। আলো জ্বেলে নিয়েই যাচ্ছি -যতক্ষণ থাকে।‘
দরোজা বন্ধ করার শব্দ হয়তো একটু জোরে হয়ে থাকবে, নয়ত স্বাভাবিকই ছিল। একই সাথে মোম আর ছায়া পোড়াতে পোড়াতে জঙ্গলের কাছাকাছি শুয়ে থাকা আকাশের দিকে চোখ যায়। সকাল দেখতে তাকে হয়ত চতুর্থ যুগ অপেক্ষা করতে হবে!
আগের পর্ব এখানে-
http://www.sachalayatan.com/monika_rashid/33846
মন্তব্য
দারুন লাগল দিদি।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
গরম পছন্দ করি বলেই হয়তো শীত শীতান্ত ঠিক উপভোগ করতে পারলাম না। কবিতা খুব সংক্ষেপে লেখা যায়, কিন্তু গল্প একটু বিস্তারিত হলে পড়তে/বুঝতে আরাম লাগে। যাই হোক; আমি বুঝব এমন করে গল্প লিখতে হবেই বা কেন। আশা করি পরেরটি বুঝতে পারব আরামে। অপেক্ষায় রইলাম।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
পুতুল ভাই, এটা গল্পটির দ্বিতীয় পর্ব, প্রথম পর্বের লিঙ্ক লেখার শেষে দেয়া আছে।
----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand
পুরোটাই পড়েছি।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
গল্প আকারে বড় হলেই যে সার্থক গল্প হবে বা পড়তে আরাম লাগবে তেমন কোনো কথা কিন্তু নেই আসলে।
----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand
খুব ভাল লেগেছে।
----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand
----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand
খুব ভালো লাগলো।
সাফিনাজ আরজু
ভালো লাগলো মনিকা দি। পরের পর্ব আসুক।
অমি_বন্যা
----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand
ভাল লাগল, ধন্যবাদ ভাল থাকবেন।
তুহিন সরকার
tuhin_preeti@yahoo.com
----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand
ভালো লাগলো
ভুল আর অন্যায় কি সমার্থক?
মাথার ভেতর দিলেন তো প্যাঁচ লাগিয়ে!
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
প্যাঁচহীন জীবনে কি আর তেমন আনন্দ আছে নাকি! প্যাঁচ খোলায় ব্যস্ত থাকুন না হয় কদিন এখন!
----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand
প্রথম প্যারায় ধাক্কা খেলাম। লেখার ডিটেইলগুলো ভালো লেগেছে।
একটা টাইপো আছে শেষ প্যারায়: জোড়ে > জোরে
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
টাইপো ঠিক করে দিলাম। পড়েছেন জেনে ভালো লাগলো। শুভেচ্ছা।
----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand
পরবর্তী পর্ব, পরবর্তী পর্ব ...
ভালোই। বেশ টিভি সিরিয়ালের মত।
নতুন মন্তব্য করুন