অকস্মাত বৃষ্টিদিনে (মিনি গল্প)

মনজুরাউল এর ছবি
লিখেছেন মনজুরাউল (তারিখ: শনি, ১২/০৭/২০০৮ - ২:০৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অলস একঘেয়ে ভাবে বৃষ্টি ঝরছিল । দাঁড়িয়ে ছিলাম একটা আলসের নিচে । যাব রাস্তার ওপারে । পরিচিত ওষুধের দোকানে। সম্ভত প্যারাসিটামল জাতীয় কিছু একটা কিনব বলে ঠিক কিছিলাম, কিন্তু ঘ্যানঘেনে বৃষ্টির জন্য বিরক্তি । পা বেয়ে একটা কেঁচো উঠে আসতে চেয়ে কি মনে করে আবার নেমে গেল। শরীরটা লম্বা করে দিয়ে আবার গুটিয়ে নিয়ে ওটার অন্যত্র গমণ।ওর সাথের কেঁচোটা জমে ওঠা জলে খাবি খাচ্ছে। একটা জবজবে ভেজা মুরগি ঠোকর মারার ধান্ধায় আছে। ভেসে যাওয়া চিপসের খোসার ওপর এদল ডাঁই পিপড়ে মহা সুখে জলভ্রমণ করছে.....।ঠিক এই সময় রাস্তা পেরুলাম.....।

"কি ভাই ভাল তো? পঁচায়ে দিল..,গা দেখি ভিজ্জ্যা গেছে...,আইজকা ইলিশ আর খিচুঁড়ি জমবো ভাল...,ইলিশের যা দাম....ছোঁয়াই যায় না....,হূহ সেদিন আর নাই.........'এই অনাবশ্যক কথাগুলো আমাকে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছিল সেটা বুঝিনি, কারণ আমার চোখ তখন রাস্তার উল্টো দিকে। মাঝ বয়সি একটা লোক কিশোরী মেয়েটাকে হিড় হিড় করে টেনে রাস্তা পার করে ওষুধের দোকানে এসে দাঁড়াল।"ব্যাথার ওষুধ আছে?"।'আপনার কিসের ব্যাথা?' আমার না, মুখ বাঁকিয়ে মেয়েটাকে দেখাল।আমি জিজ্ঞেস করি...'কি হয়েছে ওর'। 'আমি মারছি'। নির্লিপ্ত উত্তর।এর পর কি বলা উচিত সেটা বুঝতে না পেরে নির্বাক থাকলাম আমি,দোকানি এবং আরো দু'চার জন।
লোকটাকে দোকানদার কি একটা ট্যাবলেট দিল। পয়সা মিটিয়ে লোকটা আসার ভঙ্গিতেই চলে গেল।

বাড়ি ফিরে আমার মনে হলো ঠিক এই রকম গরিব মানুষদের কমকথা কখনো শুনেছি?উত্তর-না। লোকটা সম্ভবত....সম্ভবত কেন ,সত্যিই সে মেয়েটার বাপ । একটা বাপ তার মেয়েকে নিজে মেরে আবার তার জন্য ওষুধ কিনতে এছসছে......। নিজেকে রাম পাঁঠা মনে হলো। নিশ্চই আমার জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল ...কেন লোকটা তার মেয়েকে মেরেছিল.....। বাইরে বৃষ্টিটা বেড়েছে। শহূরে মানুষের বৃষ্টিকালিন ভাবনা পাখা মেলেছিল আগেই।সেই সুখদায়ক ভাবনার ফাঁকফোকোড় গলে আরো একটা ভাবনা ঢুকবো ঢুকবো করছিল.....এই বৃষ্টিতে ফুটপাথে-বস্তিতে ঝুপড়িতে থাকা মানুষগুলোর কষেটর ভাবনা....। এ পর ধারাবাহিক ভাবে প্রোভারটি,স্টেট,প্রোলেতারিয়েত...অনঢ় পাথর...।মধ্যবিত্যের এমনই হয়।কুলকিনারাহীন ভাবনা নিজের পাথেয় সুখটাকে' হেল' করার মূহুর্তে সে রণে ভঙ্গ দেয়।এভাবেই সে চলমান সুখের চাদর তলে সেঁদিয়ে আগামীর জন্য বাঁচে।
গভীর ঘুমে তলানোর আগে স্থির করেছিলাম লোকটাকে খুঁজব।এত বড় শহরে একটা মুহূর্তদেখা মানুষকে খুঁজব? কথাটা মনে করে নিজেকে পাঁঠা নয় আবাল মনে হলো
এর পর সময় সময়ের ঢঙেই পেছনে চলে গেছে। আমার সহৃদয় মধ্যবিত্যভাবনা জল সার মাটি না পেয়ে আর অংকুরিত হয়নি।এ পরেও বৃষ্টি হয়েছে,কেঁচোরা পায়ে উঠতে চেয়েছে,অন্য কেঁচোরা জলে খাবি খেয়েছে,চিপসের খোসায় ডাঁই পিঁপড়েগুলো জলভ্রমণ করেছে......ওই লোকটি আর তার মেয়ে ফ্রেমে আসেনি। হঠাৎ একদিন বাসে উঠব বলে দাঁড়িয়ে আছি,দেখি সেই লোকটা ! বুকের কাছে একটা বাটি চেপে ধরে হেঁটে যাচ্ছে...........। এবার আর ভুল হলো না।লোকটার পিছু নিলাম।পাঁচিলের ওপর থেকে পলিথিন ত্যারসা হয়ে ফুটপাথে মিশেছে,তার ওপর গোটা কতক ইঁট দেওয়া।লোকটা ওখানে এসে বসে পড়ল।আমি পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।'ক্যামন আছেন,আমাকে চিনতে পেরেছেন?' জ্বে না'। আবার সেই নির্লিপ্ত উত্তর।ওই যে একদিন ওষুধের দোকানে......মুখটা নামিয়ে নিল সে। বাটিটা পলিথিনের ভেতর দিয়ে আমার দিকে তাকাতেই জিজ্ঞেস করলাম...'আচ্ছা আপনি মেয়েটাকে মেরেছিলেন কেন,ওতো আপনারই মেয়ে...না? 'হ'। তাহলে? লোকটা খানিকক্ষণ ঘোলাটে চোখে আমাকে দেখে যা বলল তা শোনার জন্য এই আমি নেক্রোপলিস আরবানাইজড হোমো স্যাপিয়েন্স প্রস্তুত ছিলামনা।

....'হেইদিন ঘরে খাওন আছিল না,ওরে কইলাম কাষ্টমার আইছে , বহা। হুনলনা । কাষ্টমারের গা-গতর দেইখ্যা ডরাইল, মিছা কথা কইল...শরিল খারাপ, মেজাজ চইড়া গেল,দিলাম কিল। মনে অয় জোরে দিয়া বইছি। অহনো জ্বর যায় নাই মেয়াডার। ' আমার বনেদি কালচারাল প্রোফাইলে কদর্য রূঢ় বাস্তবতা নেই বলে মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম 'কাষ্টমার...ডর...কি বলছেন?''বোঝেন নাই সার?'আমরা বেশ্যা। অর মা ও ছিল বেশ্যা। অর বিয়া অইলে প্যাটে যেইডা অইব হে ও বেশ্যা অইব.............."

আমার মাথার ভিতর এক সাথে অনেক গুলো টায়ার ব্রাস্ট করল ,লোকটার পিতৃস্নেহ,ক্ষুধা নিবারণের পরাবাস্তব,কচি মেয়েটার ভয়ার্ত মুখ ,আদিমতা সব ঘোট পাকিয়ে প্রবল বেগে ছুটোছুটি করতে লাগল মাথা পেট বুক জুড়ে , এক সময় পেট থেকে কি যেন দলা পাকিয়ে গলার কাছে উঠে এলো....স্বাদটা টক টক, মনে হলো বমি হবে , হলো না ।


মন্তব্য

মনজুরাউল এর ছবি

মনজুরাউল
যা:! তিন নম্বর লাইনেই ভুল! 'ঠিক করেছিলাম' হয়ে গেল ..'কিছিলাম '! মার্জনা করুন প্রিয় পাঠক ।

.......................................................................................
আমাদের মাতৃগর্ভগুলি এই নষ্ট দেশে
চারদিকের নিষেধ আর কাঁটাতারের ভিতর
তবু প্রতিদিন রক্তের সমুদ্রে সাঁতার জানা
হাজার শিশুর জন্ম দেয় যারা মানুষ......

সুমন সুপান্থ এর ছবি

আরেকটা দারুন গল্প ! আপনি কি স্থির করেছেন একের পর এক অদ্ভুত ভালো ভালো গল্প লিখে আমাদের মাথার ভেতর আশ্চর্য
সব বিপন্নতা তৈরী করে করে যাবেন !
---------------------------------------------------------

আমার কোন ঘর নেই !
আছে শুধু ঘরের দিকে যাওয়া

---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !

মনজুরাউল এর ছবি

মনজুরাউল
কি বিপন্ন অবসন্ন ফুটপাথের মেয়ে........

কি যে কষ্ট হয় কী করে বোঝাব । যত সময় ধরে এই 'মিনি' নামাই তার অর্ধেক সময়ে দু'হাজার শব্দের কলাম নেমে যেত !
...........................................................................
বিপন্ন হতে হতেই আমরা এক সময় দাঁড়িয়ে যাব...........

.......................................................................................
আমাদের মাতৃগর্ভগুলি এই নষ্ট দেশে
চারদিকের নিষেধ আর কাঁটাতারের ভিতর
তবু প্রতিদিন রক্তের সমুদ্রে সাঁতার জানা
হাজার শিশুর জন্ম দেয় যারা মানুষ......

ভূঁতের বাচ্চা এর ছবি

মনজুরাউল ভাইয়ের নতুন একটা ফাটাফাটি গল্প পড়লাম।খুব ভাল লিখেছেন ভাইয়া।
তবে এসব অভাবী মানুষদের জন্য মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু কিছুই করার নেই।

--------------------------------------------------------

মনজুরাউল এর ছবি

মনজুরাউল
..............ইয়ে হুয়ি না বাত..............

.......................................................................................
আমাদের মাতৃগর্ভগুলি এই নষ্ট দেশে
চারদিকের নিষেধ আর কাঁটাতারের ভিতর
তবু প্রতিদিন রক্তের সমুদ্রে সাঁতার জানা
হাজার শিশুর জন্ম দেয় যারা মানুষ......

এনকিদু এর ছবি

স্বাদটা টক টক, মনে হলো বমি হবে , হলো না ।

চলুক


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

মুশফিকা মুমু এর ছবি

ইয়ে, মানে... ইয়ে, মানে... এমন কি কখনও হয়? মানে নিজের বাবা কি কখনও এমন করাতে পারে মেয়ে কে দিয়ে ইয়ে, মানে...
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

মনজুরাউল এর ছবি

মনজুরাউল
হয়,আকসার হয়। মুশফিকা মুমু বা মনজুরুল হক দের দেখার সীমানা ই বা কতটুকু ?।

বাবা-মা দুজনেই পারে। আমাদের মিডলক্লাস রাডার বা কর্ণিয়ায় অত কম রেজুলেশনের ছবি ধরা পড়ে না।
....................................................................................
গণগণে আগুন মুখে পুরে খেতে চাওয়ার নাম ক্ষুধা !!

.......................................................................................
আমাদের মাতৃগর্ভগুলি এই নষ্ট দেশে
চারদিকের নিষেধ আর কাঁটাতারের ভিতর
তবু প্রতিদিন রক্তের সমুদ্রে সাঁতার জানা
হাজার শিশুর জন্ম দেয় যারা মানুষ......

মনজুরাউল এর ছবি

মনজুরাউল
....বমিটা হয়ে গেলেই মধ্যবিত্তের আর কিছু থাকে না......

.......................................................................................
আমাদের মাতৃগর্ভগুলি এই নষ্ট দেশে
চারদিকের নিষেধ আর কাঁটাতারের ভিতর
তবু প্রতিদিন রক্তের সমুদ্রে সাঁতার জানা
হাজার শিশুর জন্ম দেয় যারা মানুষ......

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

গল্পে উত্তম জাঝা!
দারুন হইছে...
মুমু... বাংলাদেশে এরকম অহরহ হয়... সত্য এতটাই নির্মম...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।