আকাশটা একটা মুখের মতই হা হয়ে গেল আর আমাকে গিলে ফেলল...
মনুষত্ব্যকে রেকর্ড করে ফেলতে পারে এমন - মুদ্রিত আলোকতরঙ্গ...
মহাবিশ্বের মহাকাশ ফেড়ে বিশ্বটা যখন উগরে বেরিয়ে যাচ্ছিল...
ডালে ডালে মানুষের আত্না ধরে আছে...
স্পেসটাইমের ফেনায়িত কৃষ্ণতাকে...
ইস্রাফিলের শিঙার মহাহুঙ্কার...
অশ্রুর মত রক্ত বর্ষন করে...
আমার পাপের জন্য ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই পিছমোড়া করে বেঁধে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে, আমার মাথায় এক টুকরো সীসে ঢুকিয়ে দিল ওরা। তারপর আমার ভাগ্যে জুটলো ভিখিরির মত কবর, আর তার ওপর নদীর পার থেকে ছিঁড়ে আনা কিছু বুনো ফুল। ওরা অবশ্য পরে বলেছে আমাকে এভাবে মারার জন্য ওরা অনুতপ্ত, আমাকে বাঁচিয়ে রাখলেই নাকি ভাল হত। মাটির নিচে আমার অন্ধকার কুঠুরিটি থেকে আমি সেসব কেবল শুনেই গেছি। কি আর করতে পারতাম তখন?
কি আর বটে!
মহাবিশ্বের মহাকাশ ফেড়ে বিশ্বটা যখন উগরে বেরিয়ে যাচ্ছিল, আমার তখন মনে হচ্ছিল এই হয়তো সেই বহু প্রতীক্ষিত ইস্রাফিলের শিঙার মহাহুঙ্কার। হাশরের ময়দানে হাজির হবার ডাক বোধহয় শেষমেশ পড়েই গেল আমার। হ্যাঁ, কেয়ামত একটা হয়ে গেল বটে - তবে এ সেই শাস্ত্রবর্ণিত প্রলয় বা এ্যাপোক্লিপ্স নয়। এই মহাপ্রলয়ের নব-নটরাজ প্রোটন-ফিউসিং শক্তিশেলবাহী ক্ষেপণাস্ত্র। ধরণীর বুক থেকে জীবনের চিহ্ন নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে সব মৃতদের তাদের পাতাল-বন্ধন থেকে মুক্ত করে দিল তারা। ছেড়ে দিল এক আমূল পরিবর্তিত পৃথিবীর বুকে।
এখন আমার নতুন ঠিকানার আঙিনায় একটা গাছ আছে যেটা অশ্রুর মত রক্ত বর্ষন করে। আর সামনের বাগানটা, যা আমি আমার কালো লোহার কাস্তেটা দিয়ে ছেঁটে রাখি, তার গাছে গাছে ডালে ডালে মানুষের আত্না ধরে আছে। কিম্ভুত এক নতুন পৃথিবী আমার ভাগ্যে জুটেছে, কিন্তু আমি এবার এটা পরিপূর্ন ভাবেই উপভোগ করতে চাই।
একটাই শুধু খেদ - বোমাগুলি পড়ার আগেই আমার স্ত্রী যদি মারা যেত, তবে বড়ই ভাল হত। তাহলে সেও আজ আমার পাশে বসে এই কৃষ্ণসূর্যের ইউটোপিয়ার সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারত - যে ইউটোপিয়ায় কারো নাড়ি চঞ্চল হয় না, কারন এখানে কারো নাড়িই নেই।
কিন্তু কোন কিছুই নিখুঁত নয় তাই না, কি বলেন?
......................................................................................
আকাশটা একটা মুখের মতই হা হয়ে গেল আর আমাকে টুপ করে আস্ত গিলে ফেলল। আমি তার এস্টার আর মনোমারের গন্ধমাখা, নমনীয় অন্ধকার টিউবের মত গলার ভেতর দিয়ে হড়হড়িয়ে গিয়ে ছিটকে পড়লাম আকাশের মতই প্রশস্ত, কুয়াশার মত গোলাপী আলোয় আচ্ছন্ন একটা ঘরে।
ঘরটায় আমি একা না! আরো অন্তত তিনজনকে আমি দেখতে পাচ্ছি এখানে, সেইসাথে অজস্র অন্য 'সত্তা'দের উপস্থিতিও অনুভব করছি।
আমার সবচেয়ে কাছের জিনিষটা - এটাকে একটা 'ব্যক্তি' বলতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, যদিও এটা একটা 'ব্যক্তি'ই শেষমেশ - আমার দিকে তাকিয়ে হিসহিস আর ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে উঠল। আমি 'জিনিষটার' ভাষা জানি না। কিন্তু তারপরও কি বলছে এটা বুঝলাম ঠিকই - এই ঘরে আমাদের হোস্ট কোন এক অপার্থিব প্রযুক্তি স্থাপন করার ফলে।
কোত্থেকে এসেছো?
"পৃথিবী অবশ্যই," আমি বলি।
বটে। তুমি জানো আমার ভাষায় আমার গ্রহের নামও 'পৃথিবী' ?
একটু থমকালাম। তারপর বললাম, "আচ্ছা বেশ, সূর্যকন্যা-৩ বলতে পারো তাহলে।"
আচ্ছা! 'জিনিষটা' তার একটা শুঁড় নাড়াতেই শুন্যের মধ্যে একটা জানালা খুলে গেল। সেই জানালার ভেতর দিয়ে অনেক দূরে একটা হলুদ সূর্য দেখা গেল - দূর থেকে আরো দূরে সরে যাচ্ছে।
তোমাদের সূর্য, ঠিক কিনা?
"হ্যাঁ," বললাম আমি। গলায় আটকে থাকা এক দলা কান্না ঢোঁক দিয়ে গিলে ফেলতে ফেলতে দেখলাম আমার সূর্য ছোট হতে হতে একসময় একেবারেই মিলিয়ে গেল অন্ধকার মহাশুন্যে।
চিন্তা করো না। অভ্যাস হয়ে যাবে। 'জিনিষটা' বললো। কোন একসময় ।
......................................................................................
প্রথমে আমরা বড়ি-ট্যাবলেট আর নিশানাবদ্ধ বিকিরণ দিয়ে মৃত্যুকে আক্রমণ করেছিলাম, তারপরে কাজে লাগালাম ন্যানোবট, জিন থেরাপি, এমনকি শরীরের মাংসের পরতে পরতে বুনে দেয়া ক্ষয়রোধী আস্তর। এরপর আসলো মানব মনকে ধরে রাখতে পারে, মনুষত্ব্যকে রেকর্ড করে ফেলতে পারে এমন - মুদ্রিত আলোকতরঙ্গ। 'আত্না'-কে তাচ্ছিল্য করা হচ্ছে বলে যার বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলনে একজোট হয়ে গিয়েছিল ক্যাথলিক, প্রোটেস্টান্ট আর মুসলমানরা। ওদিকে শিন্টো পূর্বপুরুষ-পূজা একটা স্পর্শগ্রাহ্য বিষয়ে পরিণত হলোঃ প্রপিতামহদের কোয়ান্টাম-রেকর্ড ধারণ করে রাখে এমন হার্ডউডের গালা-বার্নিশ করা কিউবকে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের সুযোগ পাওয়াতে।
এর অনতিকাল পরেই আমরা একঘেয়ে হয়ে যাওয়া জনজীর্ণ পৃথিবীটাকে পেছনে ফেলে মহাবিশ্ব পানে বেরিয়ে পড়লাম। গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে, নতুন নতুন জগতগুলিকে নিজেদের পছন্দমত সাজিয়ে নিলাম আমরা। তারও পরে একসময়, স্পেসটাইমের ফেনায়িত কৃষ্ণতাকে আমাদেরই চেতনার রঙে রাঙিয়ে নিলাম।
তারও বহুকল্প কাল পরে, আমরা ভারাক্রান্ত জনজীর্ণ ছায়াপথকেও পেছনে ফেলে নতুন অভিযাত্রায় বেরিয়ে পড়লাম।
পেছনে ফেলে গেলাম আত্নপরিচয়, পার হয়ে গেলাম দেবত্বের পুলসিরাত। এরপর আমরা নক্ষত্রের বুকে কাব্যরচনা করে গেছি, সুপারনোভাদের হৃদয়কন্দরে গান গেয়ে বেড়িয়েছি।
কিন্তু এখন... নিয়তির নাটাই অবশেষে হাতছাড়া হয়ে গেছে আমাদের। ট্রিলিয়ন বছর হয়ে গেল সমস্ত তারা নিভে গেছে এই শীতল অন্ধকার মহাবিশ্ব থেকে। আমরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধু এটুকুই ভাবতে পারি - সময়টা ভালোই তো কাটলো।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
মূলঃ প্যাট্রিক জোহানসন
অনুবাদঃ মনমাঝি
মন্তব্য
আপনি একটা কাজ করুন, আপনার আগের অনুবাদ পোস্টগুলোর প্রত্যেকটার জন্যে একটা বিশেষ ট্যাগ যোগ করুন, যেমন ধরুন "মনমাঝির অনুবাদ" বা এই ধরনের কিছু। সেক্ষেত্রে আপনি ট্যাক্সোনোমির লিঙ্কটা ধরিয়ে দিলেই সবাই এক ক্লিকে সব অনুবাদসহ একটা পেইজ পেয়ে যাবে, আপনাকে আর কষ্ট করে এতগুলো লিঙ্ক দিতে হবে না লেখার শেষে।
ভাল বুদ্ধি। থ্যাঙ্কস্!
****************************************
ভালো লাগলো অণুগল্পগুলি। পাঠোদ্ধার করবার অভীপ্সার চাইতে বরং বোধনের ধোঁয়াশা অন্তরালে ডুবে থাকতেই ভালো লাগলো। পরাবাস্তবতার সুস্পষ্ট ছাপ দেখি ছত্রে ছত্রে।
অফটপিক,
আপনার ই-মেল চেক করুন।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
পরাবাস্তব ধোঁয়াশা ভেদ করে বোধনের ইঙ্গিত কিন্তু বিদ্যুচ্চমকের মতই ঝিলিক দিয়ে যায় ক্ষণে ক্ষণে, ছত্রে ছত্রে।
সহৃদয় মন্তব্যের জন্য কবিকে অসংখ্যঃ
অফটপিকঃ
আপনার ই-মেল চেক করুন। জবাব দিয়েছি।
****************************************
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
****************************************
নতুন মন্তব্য করুন