পরতে পরতে নাটকীয়তা, অতিনাটকীয়তা, ট্র্যাজেডি, মেলোড্রামা, প্রেম, রোমান্স, সেক্স, পরকীয়া, ইনসেস্ট, কূটনীতি, রাজনীতি, হত্যা, আত্নহত্যা, ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা, যুদ্ধবিগ্রহ, বিলাসব্যসন, গ্ল্যামার, জৌলুস, জ্ঞানচর্চা, মুক্তবানিজ্য, সংস্কৃতি - এক কথায় জীবন নাটকের এক চূড়ান্ত রঙ্গমঞ্চ ছিল ইতিহাসের এই অনন্য নগরী আলেকজান্দ্রিয়া।
দু হাজার বছর আগে এখানেই মঞ্চস্থ হয়েছে রোম-সাম্রাজ্য কাঁপানো আর দু হাজার বছর ধরেই বিশ্ব ইতিহাসের পাতা, সাহিত্য আর রূপালি পর্দায় ঝড় তুলে যাওয়া সিজার-এ্যান্টনি-ক্লিওপ্যাট্রার সেই অতুলনীয় রাজকীয় ত্রিভূজ-প্রেমের ট্র্যাজিক নাটক। এক দেশের রানি আরেক দেশের রাজার সাথে দেখা করতে আসেন কার্পেটের রোলে লুকিয়ে - তাও আবার নিজেরই প্রাসাদে। নাটক আর কাকে বলে!
এখানেই ছিল বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম, এশিয়া-আফ্রিকা-ইউরোপের সাগরপথে বানিজ্যিক মিলনবিন্দু ফ্যারোস দ্বীপের বিশ্বখ্যাত বাতিঘর। এই শহরেই গড়ে উঠেছিল প্রাচীণ বিশ্বের বৃহত্তম ও বিখ্যাততম লাইব্রেরি এবং জ্ঞানসাধনার পাদপীঠ - গ্রেট লাইব্রেরি অফ আলেকজান্দ্রিয়া । আবার এই লাইব্রেরিরও বৃহত্তর প্যারেন্ট প্রতিষ্ঠান ম্যুজিওন অফ আলেকজান্দ্রিয়ায় (যাদুঘর না, সে যুগের অর্থে একরকম গবেষনা প্রতিষ্ঠান) একসময় এসে জড় হয়েছিলেন বর্তমান জগতের পশ্চিমা জ্ঞান-বিজ্ঞানের এককালের আদি জনক ও পথিকৃৎ মহতী বিজ্ঞানী ও জ্ঞানসাধকেরা। এর মধ্যে ছিলেন - জ্যামিতির জনক ইউক্লিড, ইঞ্জিনিয়ারিং-এর জনক আর্কিমিডিস, ভূগোলবিজ্ঞানের জনক ইরাতোস্থিনিস, 'বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি'র জনক হিরোফিলাস, ট্রিগোনোমেট্রির জনক হিপ্পারকাস, মেকানিক্সের জনক হিরো, সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বের জনক এ্যারিস্টার্কাস অফ সামোস, 'একাডেমি অফ মেডিসিন'-এর প্রতিষ্ঠাতা ইরাসিস্ট্র্যাটাস, হোমারিক কাব্যের সর্বশ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ এ্যারিস্টার্কাস অফ সামোথ্রেস, নারী-দার্শনিক ঈডিসিয়া, গণিতজ্ঞ পাপ্পাস, দার্শনিক ও বিশ্বের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ নারী-গণিতবিদ হাইপেশিয়া, ক্যালিমাকাস, প্রমূখ। এমন অতুলনীয় রত্ন-সংগ্রহ পৃথিবীর আর কোথাও ছিল কিনা আমার জানা নেই। এবং এভাবে এই শহরেই সম্ভবত গড়ে উঠল বিশ্বের প্রাচীণতম বিশ্ববিদ্যালয়-কমপ্লেক্স বা তার মডেল। আগেকার ব্যক্তিগত উদ্যোগে তৈরি বিদ্যাপিঠ নয়, বরং সরকারি ব্যবস্থাপনা ও অর্থায়নে তৈরি সুপরিকল্পিত বিশালাকৃতির শিক্ষায়তন ও গবেষনাকেন্দ্র।
কল্পনার জাল বুনতে বুনতে অনেক আশা নিয়ে তাই, জ্ঞান-রোমান্স-সংস্কৃতি-রাজনীতি-যুদ্ধ আর নাটকীয়তায় পরিপূর্ণ এই ঐতিহাসিক নগরীতে পা রেখেছিলাম। কিন্তু হা হতোম্মি! কোথায় কি, ঝঞ্ঝাসঙ্কুল ইতিহাসের এত এত চমকপ্রদ নাটক, জাঁকজমক, মনুমেন্ট, জ্ঞানযুদ্ধ - কোনকিছুরই আর কোন চিহ্ন (প্রাচীণগুলির) বলতে গেলে অবশিষ্ট নেই। আমার একদম ধপাস ধরণীতল অবস্থা যাকে বলে!
সেদিন দু'জনে... (ভূমধ্যসাগর পারে)
আলেকজান্দ্রিয়ার প্রাচীণ রাজকীয় এলাকা ভূমিকম্পের ফলে ধ্বসে গেছে ভূমধ্যসাগরের তলায়, প্রাচীণ লাইব্রেরিটা আর নেই - পুড়ে হারিয়ে গেছে, নেই সেই সপ্তাশ্চর্যের বাতিঘর, নেই ক্লিওপ্যাট্রা আর এন্টনির রোমান্সের লীলাভূমি সেই প্রাসাদপুরী। অথচ এর থেকে ৩ হাজার বছরেরও বেশি প্রাচীণ মনুমেন্ট গিজা থেকে আবু সিম্বেল পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। সাগর ছাড়া কি দেখব এই পুরনো গাড়ির হর্নের চিৎকার, ধোঁয়া, টাঙা, একঘেয়ে বাড়িঘরওলা একবিংশ শতকের এক গতানুগতিক অতি বিস্মরণযোগ্য আরব মফস্বল শহরে? কিছুদিন থাকলে হয়তো অন্তরঙ্গ পর্যবেক্ষণে অনেক কিছু ধরা পড়তো, কিন্তু এই অতি সংক্ষিপ্ত সফরে গ্রেকো-রোমান আমলের আলেকজান্দ্রিয়ার কিছুই না পেয়ে প্রচণ্ড হতাশ হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।
হতাশার চোটে কায়রো থেকে আসার সময় পই-পই করে বলে দেয়া 'ফাটাফাটি' মেডিটের্যাননিয়ান সী-ফুডের রেস্তোরাঁটাতে খাওয়ার প্ল্যানটাও ভুলে মিস হয়ে যায়। এসেছি মর্ত্যধামে উর্বশী রোমান্সের মহারানী - বিশ্বসুন্দরী ক্লিওপ্যাট্রার টানে ও খোঁজে, তাকে না পেয়ে তার বদলে বিড়ালতপস্বীর মত কয়েক টুকরা ভাজা মাছ খেয়েই তৃপ্তমনে বাড়ি ফিরে যাব? এতটাই স্থুলরূচির, উদরসর্বস্ব বর্বর আমি? কাভি নেহি!
যাজ্ঞে! ইংরেজিতে বলে - ট্রাই টু মেক দ্য বেস্ট আউট অফ আ ...কি যেন... তো ভূমধ্যসাগর তীরে ঘুরতে ঘুরতে ঠিক করলাম সেটাই করব। তবে তার আগে এই আলেকজান্দ্রিয়ার প্রাচীণ ইতিহাস একটুখানি বা অনেকখানি বলে নেই তার কোন উল্লেখযোগ্য চিহ্ণ দেখার সুযোগ না হওয়া সত্ত্বেও। কারন বলার মত খুব বেশি কিছু দেখা হয়নি আসলে এই সফরে, সুতরাং যা দেখতে চেয়েছিলাম কিন্তু দেখা হয়নি সেটাই বরং বলি!
...............................................
বর্তমানে মিশরের ২য় বৃহত্তম শহর ও প্রধান বন্দর-নগরী আলেকজান্দ্রিয়া দেশটির উত্তরপ্রান্তে ভূমধ্যসাগর-তীরে অবস্থিত। একটা পুরনো ফারাওনিক শহরকে (সম্ভবত 'রাখোতিস') কেন্দ্র করে আলেকজান্দার দ্য গ্রেট তার মিশর জয়ের পর ৩৩১ বা ৩৩২ খৃষ্ট-পূর্বাব্দে এই শহরটা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে মুসলমান আরবদের হাতে পতনের আগে পর্যন্ত প্রায় এক হাজার বছর এটাই ছিল মিশরের তৎকালীণ রাজধানী।
শহরটা প্রতিষ্ঠার কয়েক মাস পর আলেকজান্দার মিশর ছেড়ে এশিয়ার উদ্দেশ্যে চলে যান এবং আর কখনো এই শহরে অন্তত জীবিত ফিরে আসেননি (তবে বলা হয় তার মৃতদেহ এখানে নিয়ে এসে সমাহিত করা হয়েছিল)। এরপর আলেকজান্দারেরই এক মেসিডোনিয়ান-গ্রীক সেনাপতি ও তার মিশর অভিযানে সহযোগী টলেমি ৩০৫ খৃষ্ট-পূর্বাব্দে নিজেকে মিশরের রাজা বলে ঘোষনা দেন। মিশরীয়রাও তাকে তাদের ফারাওদের উত্তরসূরী হিসেবে স্বাধীন মিশরের নৃপতি ও ফারাও হিসেবে গ্রহণ করে নেয়। এই '১ম টলেমি সোটার'-এর মাধ্যমেই পত্তন হয় মিশরের সর্বশেষ ফারাওনিক (কিন্তু মেসিডোনীয়-গ্রীক বংশোদ্ভূত) রাজবংশ। যার সর্বশেষ নৃপতি ছিলেন ৭ম ক্লিওপ্যাট্রা। ৩০৫ খৃষ্ট-পূর্বাব্দ থেকে ৩০ খৃষ্ট-পূর্বাব্দ পর্যন্ত টলেমি রাজবংশ ২৭৫ বছর মিশর শাসন করে।
আলেকজান্দারের হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত ইতিহাসখ্যাত ফিনিশীয় নগরী টায়ারের (বর্তমান লেবাননে) বানিজ্যের উত্তরসূরী হিসেবে আরব ও ভারতীয় জগতের সাথে ইউরোপের নতুন বানিজ্যের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হওয়ার ফলে, প্রতিষ্ঠার এক প্রজন্মের মধ্যেই আলেকজান্দ্রিয়া আরেক ইতিহাসবিখ্যাত নগরী কার্থেজকেও ছাড়িয়ে যায় আয়তনে। আর প্রতিষ্ঠার এক শতাব্দীর মধ্যেই পরিণত হয় তৎকালীণ বিশ্বের বৃহত্তম নগরীতে, কয়েক শতাব্দী ধরে গুরুত্বে রোমের পরেই যার স্থান ছিল।
রোমান আমলের থিয়েটারের ধ্বংসাবশেষ
রোমান আমলের থিয়েটারের ধ্বংসাবশেষ
১ম টলেমি তার এশিয়া আর মিশরের বিভিন্ন বিজয়লব্ধ ঐশ্বর্য ব্যবহার করে এক দুর্দান্ত নির্মানযজ্ঞে ঝাপিয়ে পড়েন এই আলেকজান্দ্রিয়ায়। এর পোতাশ্রয়ের কাছে ফ্যারোস দ্বীপে নির্মান করেন প্রাচীণ সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম সেই ৪০ তলা বা ৪৪৫ ফুট উঁচু বিখ্যাত বাতিঘর যার মাথার রাত্রিকালীণ বাতিটা কিভাবে জ্বলত কেউ জানে না - কিন্তু তা ভূমধ্যসাগরে ৫০ মাইল কিম্বা তারও বেশি দূর থেকেও নাবিকদের জাহাজ নিরাপদে বন্দরে ভেড়াতে দিকনির্দেশনা দিত। কারও কারও মতে বাতিঘরের উপরে নাকি দেবরাজ জিউসের একটা বিশাল উদ্বাহু মূর্তিও ছিল (নিউ ইয়র্কের 'স্ট্যাচু অফ লিবার্টির' কথা মনে পড়িয়ে দেয় কি?)।
এই বাতিঘরের অন্য একটা ভূমিকাও ছিল -জাহাজযাত্রী নবাগত সওদাগর আর রাজনীতিবিদদের প্রবেশের আগেই সে সাফ জানিয়ে দিত তাঁরা আর দশটা যেনতেন শহরে আসেননি, বরং বিশ্বের এক তুলনাহীণ নগরীতে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন। অতএব, যথাবিহিত সম্মানপুরসর পূর্বক এবং ভক্তিবিনত চিত্তেই যেন প্রবেশ করেন। আলেকজান্দ্রিয়ার ক্ষমতা আর ঐশ্বর্য পদে পদে বিদেশিদের চোখ ঝলসে দিত তার অজস্র রাজসিক মন্দির, থিয়েটার, প্রাসাদ, প্রশস্ত স্তম্ভবীথিশোভিত রাজপথ, বিলাসী গণস্নানাগার, বিশাল জিমনাশিয়াম, অতুলনীয় গবেষনাগার-শিক্ষায়তন-লাইব্রেরি, মানমন্দির, চিড়িয়াখানা, আর অতি অবশ্যই আলেকজান্দার দ্য গ্রেটের সমাধিসৌধের চোখধাঁধানো স্থাপত্যে।
দিমিত্রিয়াস ফ্যালেরিয়াস
এরিস্টটলের ছাত্র দিমিত্রিয়াস ফ্যালেরিয়াসের অনুপ্রেরণায় ১ম টলেমির সময়েই প্রতিষ্ঠিত হয় আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত 'ম্যুজিয়ন' - এক রকম গবেষনা প্রতিষ্ঠান। এরই অংশ ছিল পেরিপাটস পদপথ, পুলওলা বাগান, ডাইনিং হল, রিডিং রুম, লেকচার হল, সম্মেলন-কক্ষ, বিভিন্ন গবেষনাগার ও অতিথি পণ্ডিতদের জন্য পরিবারসহ থাকার মত অতিথিশালাসহ সেই বিখ্যাত লাইব্রেরি। এখানেই আর্কিমিডিস ও ইউক্লিড গণিত ও পদার্থবিদ্যার সমস্যা নিয়ে গবেষনা করেছেন, এখানেই জ্যোতির্বিদ এ্যারিস্টার্কাস অফ সামোস আবিষ্কার করেন যে পৃথিবী নয় - সূর্যই সৌরজগতের কেন্দ্র। এক অর্থে এটা বর্তমান যুগের 'বিশ্ববিদ্যালয়ের' পূর্বসুরী ছিল হয়তো, সেই সাথে আধুনিক 'মিউজিয়াম' টার্মটারও জনক।
প্রাচীণ লাইব্রেরি অফ আলেকজান্দ্রিয়া। কাল্পনিক। ড্রয়িং: অনামা শিল্পী। সূত্র।
'ম্যুজিয়ন'-কমপ্লেক্সের সাথে তার অন্যতম অংশ বিখ্যাত গ্রেট লাইব্রেরিটা ১ম টলেমি বা তার ছেলে পরবর্তী টলেমি যোগ করেছিলেন। এই লাইব্রেরির ৪র্থ প্রধান লাইব্রেরিয়ান ছিলেন সম্ভবত ভূগোলবিদ্যার জনক ইরাতোস্থিনিস। এখান থেকেই তিনি সর্বপ্রথম প্রমান করেন পৃথিবী গোল এবং এর পরিধি সঠিক ভাবে পরিমাপ করেন। কারো কারো মতে তিনি পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বও প্রায় সঠিক ভাবে বের করতে সক্ষম হন। এই লাইব্রেরিতেই ছিল প্যাপিরাস স্ক্রোলের ('বই'-এর পূর্বসুরী) এক অদ্বিতীয় সংগ্রহ, যার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ সংগৃহীত হয়েছিল আলেকজান্দ্রিয়া বন্দরে ভেড়া সমস্ত বিদেশী জাহাজ থেকে রাজকীয় ডিক্রিবলে অনুলিপি তৈরির জন্য জোরপূর্বক সমস্ত বই/স্ক্রোল বাজেয়াপ্ত করার মাধ্যমে। এই বাজেয়াপ্ত করা গ্রন্থগুলির অনুলিপি তৈরি করে লাইব্রেরিতে যোগ করা হত, তারপর মূলগুলি তাদের মালিকদের ফেরৎ দেয়া হত। তবে অনেকের মতে, লাইব্রেরির অনুলিপিকাররা এতই দক্ষ হয়ে গিয়েছিল যে আসলগুলি রেখে অনুলিপিই ফেরৎ দিত। মূল মালিকরা নাকি টেরই পেত না অনেক সময়।
আর এই বিদেশি জাহাজ আসত জ্ঞাত পৃথিবীর সবদিক থেকেই। মৌসুমি বায়ুতে ভর করে সুদুর ভারত থেকে রেশম আর মসলাভর্তি বানিজ্যপোত আসত মিশরের লোহিতসাগর তীরে। সেখানে পন্য খালাস করে স্থলপথে তা নিয়ে আসা হত আলেকজান্দ্রিয়ায়, আবার তা জলপথে ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইউরোপে পরিবহনের জন্য। খৃষ্টপূর্ব ৩য় শতকে একটি জাহাজের পন্যের হিসাব পাওয়া গেছে এমন -সুগন্ধী উদ্ভিদের ৬০টি কনটেইনার, ১০০ টন হাতির দাঁত আর ১৩৫ টন আবলুস কাঠ।
পর্যটক আর সওদাগরদের জন্য শহরে থাকার জায়গা আর বিনোদনের অভাব ছিল না। পান্থনিবাস আর পতিতাপল্লী, থিয়েটার আর চিড়িয়াখানা, সবই ছিল। হাটে-ঘাটে-বাজারে-বন্দরে দেশি-বিদেশি ইহুদি-প্যাগান-এনিমিস্ট গ্রীক, মিশরীয়, আরব, সিরীয়, নাবাতিয়ান, নুবিয়ানদের ভীড় লেগেই থাকত। হয়তো এর মধ্যে ভারতীয় আর চৈনিকসহ আরও অনেকেই ছিল। দুহাজারেরও বেশি বছর আগের কথা।
টলেমিদের এই বিশ্বব্যাপী প্রাণবন্ত মুক্তবানিজ্য আর বহুসাংস্কৃতিক "কানেক্টিভিটি"-র অদ্বিতীয় প্রাচীণ 'হাব' বা মিলনমেলার স্বর্নযুগের অবসান ঘটে তাদের শেষ শাসক ক্লিওপ্যাট্রার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। ক্লিওপ্যাট্রার পর মিশর রোমের উপনিবেশে পরিনত হয় এবং আলেকজান্দ্রিয়া হয়ে দাঁড়ায় অনেকটা মিশর থেকে রোমের শস্য যোগানোর ফানেল।
৮০ খৃষ্ট-পূর্বাব্দে আলেকজান্দ্রিয়া আনুষ্ঠানিক ভাবে রোমান প্রভাব-বলয়ে চলে যায়, তবে বাস্তবে চূড়ান্ত ভাবে রোমান দখলে যায় ৩০ খৃষ্ট-পূর্বাব্দের ১লা আগস্ট, যখন রো্মান সেনাপতি ও শাসক অক্টাভিয়ান (পরবর্তীতে সম্রাট অগাস্টাস) এ্যাক্টিয়ামের বিখ্যাত নৌযুদ্ধে এন্টনি ও ক্লিওপ্যাট্রাকে পরাজিত করে আলেকজান্দ্রিয়া দখল করে নেন। তার আগে অবশ্য মিশরের সর্বশেষ ফারাও ও বিশ্বসুন্দরী ৭ম ক্লিওপ্যাট্রা ফিলোপ্যাটরের বাহুডোরে তার প্রেমিক আরেক দুর্ধর্ষ রোমান শাসক ও সেনাপতি মার্ক এন্টনি নিজ তরবারিতে আত্নহত্যা করে লুটিয়ে পড়েন, এবং তার প্রেমিকা ঈশ্বরসম ফারাও মহান ক্লিওপ্যাট্রা "আস্প্" সাপের ছোবলে আত্নহত্যা করে ঢলে পড়েন । নাটক আর কাকে বলে! একাধারে ড্রামা, মেলোড্রামা আর ট্রাজেডি!
একটা মজার ব্যাপার হল, আলেকজান্দ্রিয়ার পতন একই সাথে দু-দুটি মহান প্রাচীণ সভ্যতার পতন ও পরিবর্তন সূচনা করে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমনটা আর কতবার হয়েছে জানি না। এন্টনি-ক্লিওপ্যাট্রাকে পরাজিত করে মিশর দখলের মাধ্যমে অক্টাভিয়ান যেমন ৩-হাজার-বছরব্যাপী-স্থায়ী প্রাচীণ মিশরীয় ফারাওনিক সাম্রাজ্যের অবসান ঘটান, তেমনি হোম-টার্ফে নিজের সব প্রতিদ্বন্দ্বীকে নিকেশ করার মাধ্যমে তিনি রোমের একচ্ছত্র শাসক হয়ে বসেন এবং পরিশেষে ইতিহাসে 'রোমান রিপাব্লিক' নামে খ্যাত রাষ্ট্রটিকে হত্যা করে "রোমান সাম্রাজ্য"-এর প্রতিষ্ঠা করেন। যার প্রথম সম্রাট হয়ে বসেন তিনি নিজেই "অগাস্টাস" অভিধায় অভিষিক্ত হয়ে।
রোমান দখলে যাওয়ার পরও আরও কয়েক শতাব্দী অবশ্য মিশর ও আলেকজন্দ্রিয়ায় গ্রেকো-ইজিপশিয়ান সভ্যতার ভাবধারা অনেকখানি অব্যাহত ছিল। এমনকি প্রাচীণ মিশরীয় ধর্ম ও সংস্কৃতিও। প্রাচীণ ভূমধ্যসাগরীয় প্যাগানরা কেউই মনে হয় একে অপরের সভ্যতা সমূলে বিনাশ করার সংস্কৃতি ততটা চর্চা করতেন না - যট্টুক ভাল লাগত গ্রহণ করতেন, বাকিটুকু মনে হয় টলারেট করার স্পেস দিতেন বেশি শত্রুতা না করলে। ঐ সমূলে বিনাশ করার রীতি বা চরম ইনটলারেন্স মনে হয় অনেকখানিই পরবর্তীকালের একেশ্বরবাদীদের অবদান। এক মত আর নিজের এক ঈশ্বর ছাড়া ভিন্ন কিছু তাদের রেডারে আসলেই - ফায়ার! আলেকজান্দ্রিয়াই তার উদাহরন! মুক্তবুদ্ধি চর্চার অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই প্রাণকেন্দ্রেই ধর্মের নামে মুক্তবুদ্ধির কণ্ঠরোধ ও বুদ্ধিজীবী-হত্যার সর্বপ্রথম ঐতিহাসিক ভাবে রেকর্ডেড ঘটনাটি ঘটে, খৃষ্টান মৌলবাদীদের হাতে প্যাগান নারী দার্শনিক হাইপেশিয়ার নৃশংস ধর্ষন ও হত্যার ঘটনাটির মাধ্যমে। এদের হাতেই আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত গ্রেট লাইব্রেরি বাদে অন্য যে দুটি অসাধারন পাব্লিক লাইব্রেরির কথা জানা যায় - সেরাপিয়াম ও সিজারিয়ন মন্দির সংশ্লিষ্ট লাইব্রেরি সেগুলিও ধ্বংস হয় - খৃষ্টান রোমসম্রাট ১ম থিওডোসিয়াসের ৩৯১ খৃষ্টাব্দের ডিক্রিবলে ও স্থানীয় খৃষ্টান প্যাট্রিয়ার্কের প্ররোচনায়। এগুলির সাথে প্যাগান সংশ্লিষ্টতা থাকায়। এই সময় ৪র্থ শতাব্দীর শেষের দিকে - আলেকজান্দ্রিয়ার সমস্ত প্যাগান মন্দিরের পাশাপাশি "গ্রেট লাইব্রেরি"-র প্যারেন্ট প্রতিষ্ঠান 'ম্যুজিওন অফ আলেকজান্দ্রিয়া'-ও সম্ভবত খৃষ্টান মৌলবাদীদের হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত বা বিলুপ্ত হয়।
অধঃপতন : ১১৫ খৃষ্টাব্দে আলেকজান্দ্রিয়ার উল্লেখযোগ্য অংশ ইহুদী-গ্রীক যুদ্ধে পুড়ে যায়। পরে অবশ্য খানিকটা পুনর্নির্মিত হয়। ২১৫ খৃষ্টাব্দে রোমান সম্রাট কারাকালার আদেশে এর সমস্ত যুদ্ধ-সক্ষম তরুনকে হত্যা করা হয়। ৩৬৫ খৃষ্টাব্দের ২১শে জুলাই ক্রীট-ভূমিকম্পজনিত সুনামিতে আলেকজান্দ্রিয়ায় ব্যপক ধ্বংসযজ্ঞ সাধিত হয়, যা এই ১৭ শতাব্দী পরেও "বিপর্যয় দিবস" হিসেবে পালিত হয়। ৪র্থ শতাব্দীর শেষের দিকে নব্য-খৃষ্টান রোমানদের হাতে প্যাগান-নির্যাতন ভয়াবহ আকার ধারন করে। ৩৯১ খৃষ্টাব্দে আলেকজান্দ্রিয়ার খৃষ্টিয় ধর্মীয় নেতা থিওফিলাস খৃষ্টান রোমসম্রাট ১ম থিওডোসিয়াসের আদেশে আলেকজান্দ্রিয়ার সমস্ত প্যাগান (মূর্তিপূজক) মন্দির ধ্বংস করে ফেলেন। ৫ম খৃষ্ট-উত্তর শতাব্দী নাগাদ ইহুদীরাও মোটামুটি কেটে পড়ে এখান থেকে। খালি হয়ে যায় 'ব্রুকিয়াম' নামের এর সবচেয়ে আকর্ষনীয় ও রাজকীয় গ্রীক মহল্লা। খৃষ্টধর্মের পদানত রোমের অধীনে এটা খৃষ্টধর্মের জয়জয়কারের যুগ।
৬৪১ খৃষ্টাব্দ নাগাদ আরব সেনাপতি আমর ইব্নে আল-আসের আলেকজান্দ্রিয়া জয়ের মাধ্যমে মুসলিম যুগের শুরু হয় এখানে।
আগেকার প্রত্নতত্ত্ববিদদের উল্লেখযোগ্য আগ্রহ এড়িয়ে গেলেও, অতি সাম্প্রতিক কালে অবশ্য আলেকজান্দ্রিয়ার ইতিহাস নতুন করে লেখা হচ্ছে ভূগর্ভের পাশাপাশি সাগরগর্ভেও অসাধারন অনেক নতুন প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের ফলে। সাগরতলে পাওয়া যাচ্ছে আলেকজান্দারেরও আগের নেটিভ মিশরীয় নমুনা থেকে শুরু করে ক্লিওপ্যাট্রার যুগ হয়ে খৃষ্টোত্তর বহু শতাব্দী পর্যন্ত প্রত্নসম্পদের এক বিশাল রত্নভাণ্ডার। সাগরতলে ধ্বসে যাওয়া এই নগরীর প্রাচীণ বিখ্যাত ও রাজসিক অংশগুলি উম্মোচিত হচ্ছে মেরিন-প্রত্নতত্ত্ববিদদের কাছে, আবার উপরেও পাওয়া যাচ্ছে অনেক কিছু। এসবের ফলে এও জানা যাচ্ছে এখন যে, আগে যেমন মনে করা হত অজস্র প্রাকৃতিক দূর্যোগ, যুদ্ধবিগ্রহ, গৃহযুদ্ধ, বিদ্রোহ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, এবং সবশেষে আব্রামাইক ধর্মের আগ্রাসন - এসবের কারনে আলেকজান্দ্রিয়ার অসাধারনত্ব রোমান শাসনের শুরুর দিকেই বিলুপ্ত হয়ে যায়, তা আসলে হয়তো কিছু হলেও পুরোপুরি সঠিক নয়। সব সত্বেও তাদের উজ্জ্বলতা আগের তুলনায় তুলনামূলক ভাবে হ্রস্ব স্কেলে হলেও টিকে ছিল অনেক দিন। কেবল মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর এর বুদ্ধিজীবী মহল তখনকার পৃথিবীতে উদীয়মান ক্ষমতার নতুন ভরকেন্দ্রগুলিতে (বাগদাদ, দামাস্কাস, ইত্যাদি) ধীরে ধীরে অভিবাসন করেন। আলেকজান্দ্রিয়ার এই পুনরাবিষ্কারের অগ্রসৈনিক দুই প্রতিযোগী ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রত্নতত্ত্ববিদ
Jean-Yves Empereur এবং
Franck Goddio। আগ্রহীরা আরও জানতে আর কিছু দারুন আণ্ডারওয়াটার ছবি দেখতে ফ্র্যাঙ্ক গোডিও সোসাইটির ওয়েবসাইট দেখতে পারেন
এখানে।
...............................................
মহারানি ক্লিওপ্যাট্রার দেখা এ যাত্রায় না পেলেও ১ম শতাব্দীর লেখক প্লুটার্কের কিছু সান্ত্বনাবানী দিয়ে সে দুঃখ দূর করলাম। কিংবদন্তী, সাহিত্য, শিল্প আর চলচ্চিত্রের সুবাদে প্রচলিত মিথটা হল ক্লিওপ্যাট্রা তুলনাহীণ বিশ্বসুন্দরী ছিলেন। অনেকটা ঐ আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর, লাইব্রেরি - সপ্তাশ্চর্য টাইপের অষ্টমাশ্চর্য কিছু আরকি! আধুনিক গবেষকরা কিন্তু এই ধারনার ব্যাপারে সন্দিহান। তাদের ধারনা ক্লিওপ্যাট্রা আসলে হয়তো অনেকটাই সাদামাটা ছিলেন দেখতে, বা অন্যভাবে বললে তার আসল সৌন্দর্য ছিল তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ত্ব, বুদ্ধিমত্তা আর ক্যারিশমায়। ক্লিওপ্যাট্রার মৃত্যুর ১০৫ বছরের মাথায় ৭৫ খৃষ্টাব্দে গ্রেকো-রোমান ঐতিহাসিক ও জীবনীকার প্লুটার্ক লিখেছিলেন, "তাঁর আসল সৌন্দর্য... এত অসাধারন ছিল না যে তাঁর সাথে কারোরই তুলনা চলবে না বা তাঁর দিকে তাকালে তড়িৎস্পৃষ্ট না হয়ে পারা যাবে না, কিন্তু তাঁর সান্নিধ্য বা নৈকট্যে উপস্থিতি... সে এক অপ্রতিরোধ্য অভিজ্ঞতা... তাঁর সমস্ত কথাবার্তা-চলনবলনকে ঘিরে এমন এক ব্যক্তিত্ব বিরাজ করত যাকে যাদুকরী বললেও কম বলা হয়।" মোদ্দা কথায়, ক্লিওপ্যাট্রার কিংবদন্তীতুল্য দৈহিক সৌন্দর্যের আসল সত্য বোধহয় তাঁর অপ্রতিরোধ্য কারিশমার মধ্যেই নিহিত ছিল। এমনি এমনি তো আর সে যুগের সবচেয়ে শক্তিশালী দু-দুজন দুর্ধর্ষ সম্রাট (ডিক্টেটর) ও সেনাপতি - জুলিয়াস সিজার আর মার্ক এন্টনি কুপোকাৎ হননি!
...............................................
মোন্তাজা প্রাসাদ
আলেকজান্দ্রিয়ায় প্রথম যে দ্রষ্টব্যে আমি যাই সেটা সম্ভবত লাইব্রেরি অফ আলেকজান্দ্রিয়া। না, এটা সেই প্রাচীণ ঐতিহাসিক "লাইব্রেরি অফ আলেকজান্দ্রিয়া" নয়। তবে ঐ প্রাচীণ লাইব্রেরির সম্ভাব্য লোকেশনের কাছে বিশেষ ভাবে তারই স্মৃতিকে উদযাপন করতে নির্মিত, এবং ২০০২ সালে উদ্বোধন করা এক দারুন স্থাপত্যের নতুন এক লাইব্রেরি এটা। সেই আদি নামেই - "বিবলিওথেকা আলেকজান্দ্রিনা" । সিডনির অপেরা হাউস বা স্পেনের গাগেনহাইম যাদুঘরের মতই এক স্থাপত্যিক স্বাক্ষর হওয়ার উচ্চাশা নিয়ে এর নকশা করা হয়েছে। এ যেন এক ফিনিক্স পাখির পুনরুত্থান। ৪৮ খৃষ্ট-পূর্বাব্দে জুলিয়াস সিজারের হাতে, মতান্তরে ৩য় শতকে সম্রাট অরেলিয়ানের আক্রমনে প্রাচীণ "লাইব্রেরি অফ আলেকজান্দ্রিয়া" পুড়ে গিয়েছিল। সম্ভবত প্রায় একই জায়গায় প্রায় দুই হাজার বছর পর সে আবার জেগে উঠেছে। সেই একই গুরুত্ব এই নতুন লাইব্রেরি এই যুগে পাবে কিনা সেটা অন্য প্রসঙ্গ, কিন্তু স্মৃতির জীবন্ত মিনার হিসেবে এ এক থ্রিলিং পুনর্নির্মান নিঃসন্দেহে।
নতুন বিবলিওথেকা আলেকজান্দ্রিনা-র ভেতরে
নতুন বিবলিওথেকা আলেকজান্দ্রিনা-র ভেতরে-২
(বাইরের দিকের কিছু ছবি এখানে)
নতুন লাইব্রেরিটাও পুরনোটার নকশায় নাকি কিছুটা অনুপ্রানিত। আমার স্থাপত্যজ্ঞান শুন্য, সুতরাং এর ফিউচারিস্টিক (আমার মনে হয়েছে, কিন্তু এর এক ডিরেক্টরের ভাষায় এটা "ইটার্নাল") স্থাপত্যের সাথে এর দুই সহস্রাব্দ প্রাচীণ সংস্করণের মিল কোথায় বা কিভাবে, তা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। তবে এটাতেও মূল লাইব্রেরির পাশাপাশি আছে নানারকম সম্মেলনকেন্দ্র, এক্সিবিশন হল, গ্যালারি, যাদুঘর, প্ল্যানেটারিয়াম, টাচস্ক্রীন মনিটরওলা (আমার কাছে তখন অভিনব) ডিজিটাইজড প্রাচীণ-ম্যানুস্ক্রীপ্ট আর্কাইভ, এবং আরও অনেক কিছু। এর মধ্যে কিছু প্রদর্শণী আর যাদুঘর দেখলাম। বিশেষ করে এর ভূঃগর্ভস্থ এক্সক্লুসিভ 'মিউজিয়াম অফ এন্টিকিউটিজ'-টা এক কথায় অসাধারণ। এই যাদুঘরটা মনে হয় সুনির্দিষ্ট ভাবে আলেকজান্দ্রিয়ায় টলেমি ও রোমান আমলের পাওয়া প্রত্নসম্পদের জন্য ডেডিকেটেড। এর ভেতর ছবি তোলার অনুমতি না থাকলেও অনেক সাধ্য-সাধনা করে ইন-চার্জ মহিলার কাছ থেকে একটি মাত্র ছবি তোলার অনুমতি মিলল। এবং পুরো মিশরে আমার তোলা ও দেখা শত-শত দর্শনীয় বস্তু ও ছবির মধ্যে এবং শত-শত ফুট উঁচু দৈত্যাকৃতির মূর্তি-পিরামিডের চেয়ে এই পিচ্চি এক রোমান যুগের ঝিমন্ত বাচ্চার ছোট্ট একটা ভাষ্কর্যই কেন জানি আমার সবচেয়ে প্রিয় হয়ে গেছে। এটা ঠিক কিসের বা কার ভাষ্কর্য এখন আর মনে নেই। স্মৃতি বলছে গ্রীক বা রোমান যুগের এক ঢুলতে থাকা 'বালক নৈশপ্রহরীর' ভাষ্কর্য এটা, তবে আমি নিশ্চিত না।
বালক প্রহরী
কায়েত্-বে দূর্গ
লাইব্রেরির পরে গন্তব্য হল ভূমধ্যসাগর পারে কায়েত্-বে দূর্গ। এটা আমার সপ্তাশ্চর্যের বাতিঘর দেখার বিকল্প। চতুর্দশ শতাব্দীতে আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত বাতিঘরটা ভূমিকম্পের কারনে বিধ্বস্ত হলে, ঠিক তার জায়গাতেই ১৪৮০ সালে এই চমৎকার এবং গুরুত্বপূর্ন কোস্টাল দূর্গটা নির্মান করেন মামলুক শাসক সুলতান আল-আশরাফ আবু আনাসর সায়েফ আল-দিন কায়েত্ বে আল-জারকাসি আল-জাহিরি। অত্যন্ত দর্শনীয় এবং ঐতিহাসিক ভাবে গুরত্বপূর্ণ একটা দূর্গ যার সাথে অনেক কাহিনি জড়িত। বিখ্যাত বাতিঘরটার ধ্বংসাবশেষ পর্যন্ত এর নির্মান-উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বর্তমানে এটা একটা যাদুঘর ও সংরক্ষিত ঐতিসিক নিদর্শন।
কায়েত্-বের গবাক্ষপথে ভূমধ্যসাগর
গবাক্ষপথে ভূমধ্যসাগর
গবাক্ষপথে ভূমধ্যসাগর
সদরদৃশ্য
এল-আলামেইনের যুদ্ধ এবং ওয়ার সেমেটারি
সামরিক বাহিনিতে প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত অফিসার, যুদ্ধকৌশলে আগ্রহী, বা যারা ২য় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে কিছুটা হলেও জানেন, ফিল্ড মার্শাল রোমেলের নাম শুনেছেন, বা নিদেনপক্ষে এই যুদ্ধের উত্তর-আফ্রিকা অংশের উপর কোন চলচ্চিত্র দেখেছেন - তারা নির্ঘাৎ বিখ্যাত "
ব্যাট্ল অফ এল-আলামেইন"-এর কথা শুনেছেন। আলেকজান্দ্রিয়া থেকে ৬৬ মাইল পশ্চিমে আর কায়রো থেকে ১৫০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর পারে অবস্থিত এখনকার আল-আলামিন শহর। ১৯৪২ সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে এর কাছেই ফিল্ড মার্শাল রোমেলের নেতৃত্বাধীন জার্মানির দুর্ধর্ষ 'প্যানজার আর্মি আফ্রিকা' বনাম লেফটেন্যান্ট-জেনারেল বার্নার্ড মন্টগোমারির নেতৃত্বাধীণ বৃটিশ এইটথ্ আর্মির সেই ২য় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম উল্লেখযোগ্য মোড়-পরিবর্তনকারী এল-আলামেইনের ২য় যুদ্ধ সঙ্ঘটিত হয়। এতে বৃটিশরা জয়লাভ করে। নাৎসী বাহিনির মিশর দখলের আশা ব্যর্থ হয়ে যায় এবং তারা তিউনিশিয়া পর্যন্ত বিতাড়িত হয়। আলামেইনের ২য় যুদ্ধ জয়ের পর উইন্সটন চার্চিলের মন্তব্য ছিল - "এটাই শেষ নয়। এটা এমনকি শেষের সূচনাও নয়, কিন্তু এটা হয়তো, সূচনার শেষ।" বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি লিখেছিলেন, "আলামেইনের আগে আমরা কোন জয়ের মুখ দেখিনি। আলামেইনের পরে, আমরা কোন পরাজয়ের মুখ দেখিনি।"
এই আল-আলামিনেই আছে সেই বিখ্যাত যুদ্ধে দুই পক্ষের নিহত সৈন্যদের সমাধিক্ষেত্র বা ওয়ার সেমেটারি - জার্মান, ইতালিয়ান, আর কমনওয়েলথ সৈন্যদের। কমনওয়েলথ সমাধিক্ষেত্রে আছে বৃটিশদের সাথে আরও যেসব দেশের যোদ্ধারা অংশগ্রহণ করেছিল তাদেরও কবর - গ্রীক, ভারতীয়, কানাডিয়ান, অস্ট্রেলিয়ান, সাউথ আফ্রিকান, ইত্যাদি। আলেকজান্দ্রিয়ার পর বুড়ি ছুয়ে যাওয়ার মত আমার অতি সংক্ষিপ্ত গন্তব্য ছিল এই আল-আলামিন।
নীচের প্রথম ছবিতে প্রবেশপথের উপরে বিশাল মার্বেলের ব্যানার/ফলকে লেখা রয়েছে এই দু'টি বাক্য (বড়হাতের অক্ষরে) --
Within this cloister are inscribed the names of soldiers and airmen of the British Commonwealth and Empire who died fighting on land or in the air where two continents meet and to whom the fortune of war denied a known and honoured grave with their fellows who rest in this cemetery with their comrades in arms of the Royal Navy with the seamen of the Merchant Navy. They preserved for the West the link with the East and turned the tide of war.
আলামেইন সেনা সমাধিক্ষেত্র
আলামেইন সেনা সমাধিক্ষেত্র
আলামেইন সেনা সমাধিক্ষেত্র
.......................................................
লোহিত সাগর
ভূমধ্যসাগর পারে নানাপদের প্যাগানদের তীর্থ আলেকজান্দ্রিয়া ভ্রমণ করে এবার আমার লক্ষ্য হল অন্য আরেক দিকে আরেকটি সাগরপারে, এব্রামাইক ধর্মবিশ্বাসীদের কিছু তীর্থদর্শন। এর মধ্যে রয়েছে ফেরাউনের ধাওয়া খেয়ে মুসা নবী যে সাগরটা তার যাদুর লাঠি দিয়ে দু ফাঁক করে পেরিয়ে গিয়েছিলেন ইহুদীদের নিয়ে, আর পিছে পিছে এসে যার মধ্যে ডুবে মরেছিল দোর্দণ্ডপ্রতাপ বাইবেলীয় ভিলেন-চূঁড়ামনি 'ফেরাউন বাদশা' - সেই রেড-সী বা লোহিতসাগর। সেই সাথে লোহিত সাগরের দু পাশে দুই মহাদেশে - আফ্রিকার পারে মিশরের মূল ভূখণ্ডে আর এশিয়া অংশে সিনাই পেনিনসুলায় মিশরীয় রেড-সী রিভেরা আর বিভিন্ন ধর্মীয় নিদর্শন দেখা। মিশর থেকে বিতাড়িত হয়ে জেরুসালেমের দেখা পাওয়ার আগে মরুপর্বতসঙ্কুল দুর্গম নরককুণ্ড সিনাই পেনিনসুলায় মুসার নেতৃত্বে ইহুদীরা ৪০ বছর বেদিশা হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছিল তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর আগে। অবশেষে এখানেই, তুর পর্বতের চূড়ায় মুসা (আঃ) ঈশ্বরের দেখা পান, তার কাছ থেকে উপহার পান এব্রামাইক ধর্মের সেই জগত কাঁপানো "টেন কমাণ্ডমেন্টস"। এই তুর পর্বত বা খৃষ্টানদের কাছে মাউন্ট সিনাই নামে পরিচিত পাহাড়টা মিশরের সিনাই পেনিনসুলার মাঝামাঝি অবস্থিত। পাদদেশে রয়েছে পৃথিবীর প্রাচীণতম চালু খৃষ্টান মঠ হওয়ার অন্যতম (অন্যটা মিশরেরই জাফারানায়) দাবীদার 'সন্ত ক্যাথারিনের মঠ' । সিনাইতে আমার আগ্রহের কেন্দ্র এই মাউন্ট সিনাই, সমুদ্রপারের রিসর্ট শহর দাহাব আর সিনাইর দক্ষিণ মাথায় অনেকগুলি আধুনিক কালের আলোচিত আন্তর্জাতিক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের লোকেশন আরেক রিসর্ট শহর শার্ম আল-শেখ। আর শার্মের লোহিতপারেই রয়েছে মিশরীয়দের দাবী মতে ১০০০ প্রজাতির মাছ, ২৫০টি কোরাল রীফ, অপূর্ব কোরাল বাগান, ২৬০০ ফুট গভীর রীফ দেয়াল আর সাগরতলের চমকপ্রদ দৃশ্যনন্দিত পৃথিবীর সেরা স্কুবা ডাইভিং স্পট। সেইসাথে স্নরকেলিং, উইন্ডসার্ফিং, কাইটসার্ফিং, প্যারাসেইলিং, বোটিং, ক্যানোইং সহ নানারকম ওয়াটার স্পোর্টসের সুবিধা। এত চমৎকার জায়গা, অথচ শার্ম আল-শেখ আমার মিশর ভ্রমণের সবচেয়ে বাজে অধ্যায়ও বটে। একজন ইঙ্কম্প্যাটিবল ভ্রমণসঙ্গী যে কি করে একটা সম্ভাব্য অসাধারণ ভ্রমণ-অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিতে পারে - তা এখানে না আসলে জানা হত না।
সিনাই পেনিনসুলার পশ্চিমে লোহিতসাগরের অপর পারে আফ্রিকা মহাদেশে মিশরের মূল ভূখণ্ডের লোহিতপারে রয়েছে সুয়েজ, আইন সুখ্না, জাফারানা, হুরগাদা ইত্যাদি। শেষের তিনটাই সাগরতীরের রিসর্ট শহর/গ্রাম বা রিভেরা। জাফারানার পশ্চিমে মরুভূমি আর মরুপর্বতের গভীরে লুকিয়ে আছে পৃথিবীর প্রাচীণতম আজও টিকে থাকা খৃষ্টান মঠ হওয়ার আরেক দাবীদার 'সন্ত এন্থনির মঠ'।
লোহিত সাগরের পার ধরে পথ ভুলে মরুসন্যাসীদের মঠে
ইউরোপের পথে সুয়েয খাল অভিমুখে (মুজতবা আলী আছেন নাকি ভেতর?)
ফেরাউন গেছে ডুবে, আমি আছি বেঁচে... হে হে (জাফারানা)
সন্ত এন্থনির মঠ
ফাদার অফ অল মঙ্কস্, মরুসন্যাসব্রতের আদি
মরুপিতা বা ডেজার্ট ফাদার, প্রথম খৃষ্টান সন্যাসী ও সাধারণ ভাবে খৃষ্টীয় সন্যাসব্রতের ধারা অর্থাৎ মোনাস্টিসিজমেরও জনক বলে খ্যাত মরুআব্বা এন্টনিয়াস তথা
সেন্ট এন্থনি দ্য গ্রেট বর্তমানের জাফারানা থেকে বেশ কিছু দূরে মরুভূমি আর পাহাড়ের গভীরে এক খা খা নির্জন দুর্গম অঞ্চলে এই মঠ বা আশ্রমটার সূত্রপাত করেন । এখানেই একটা পাহাড়ের গুহায় তিনি দীর্ঘকাল তপস্যারত ছিলেন। ৩৫৬ খৃষ্টাব্দে তিনি মারা গেলে কয়েক বছরের মধ্যেই তার শিষ্যরা এই মঠটা প্রতিষ্ঠা করেন। সেই হিসেবে এটা প্রায় ১৬০০ বছরেরও বেশি পুরনো। বর্তমানে এটা পৃথিবীর প্রাচীণতম জীবিত খৃষ্টীয় মঠ হওয়ার দাবীদার।
সন্ত এন্থনির মঠে
সন্ত এন্থনির মঠে
নিজস্ব বেকারির রুটি
প্রাচীণকালে বেদুঈন মরুদস্যুদের যে পথে খাবার নামিয়ে দেয়া হত। দেখাচ্ছেন এযুগের মরুআব্বা।
জাফারানার লোহিতপারে এক মিশরীয় পরিচিতের খালি ভ্যাকেশন ডুপ্লেক্স-কপ্লেক্সে একটি দিন কাটিয়ে আর তাদের প্রাইভেট বীচে মুসা নবী আর তার পশ্চাদ্ধাবনকারী ফেরাউনের স্মরণে লোহিতজলে একটু ডুবাডুবি করে বেরিয়ে পড়লাম। ইচ্ছে ছিল রেড-সীতে কাছেই একটা বোট ক্লাব থেকে বোট ভাড়া করে একটু ঘুরব, কিন্তু সে ইচ্ছের গুড় নিষ্ঠুর ভাবে লোহিততীরে বালিচাপা দিয়ে ফেরার পথ ধরতে হল। সমস্যাটা বাঁধল তখনই। আমরা কায়রো থেকে পূর্ব দিকে লোহিতপারে আইন সুখনা নামের আরেকটা ছোট্ট রিসর্ট শহর ঘুরে দক্ষিণে এই জাফারানায় এসেছি (মুসা কি এসেছিলেন এখানে?!)। যদ্দুর মনে পড়ে, প্রায় পুরো পথটা ধরেই একপাশে লোহিত সাগরের একটি বাহু গাল্ফ অফ সুয়েয আর অন্যপাশে পাহাড়। অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য। জাফারানা থেকে কায়রো ফেরার পথ হল যেপথে এসেছি সে পথে উলটো যাওয়া, অথবা আমার ম্যাপ অনুযায়ী আরও দক্ষিণে এগিয়ে ধূ-ধূ জনহীণ মরুভূমির মধ্য দিয়ে যাওয়া একটা অচেনা রাস্তা ধরা। ম্যাপে দেখলাম এই রাস্তার ধারেই কোথাও এই সন্ত এন্থনির মঠ। সুতরাং ঠিক করলাম এই পথেই যাব। রথও দেখা হবে, কলাও বেচা হবে। কিন্তু কিছুদূর এগিয়ে ঐ রাস্তার মুখে আসার পর, মরুভূমির বুক চিরে এর সম্পূর্ণ যানবাহনহীন দিগন্তবিস্তৃত দৈর্ঘ্য আর চারপাশের জনশুন্য খা-খা মরুভূমি দেখে আমার ভ্রমণের এই অংশের সফরসঙ্গী কায়রোবাসী জব্বার ভাই বেঁকে বসলেন। তার ভয় এই মরুভূমির মধ্যে মাঝপথে যদি গাড়ি বিগড়ে যায়, তখন কি হবে? শকুনের খাদ্য হব? এখানে আর কোন গাড়ি দেখা যাচ্ছে না যে সাহায্য পাওয়ার আশা করতে পারি, মোবাইল নেটওয়ার্কও এখন আর কাজ করছে না! তার ইচ্ছে আসার পথ দিয়েই ফিরে যাই। তবে শেষমেশ নতুন পথেই যাওয়া ঠিক হল, আর সেই সুবাদে সন্ত এন্থনির মঠে তীর্থদর্শন হল শেষ পর্যন্ত। দেখা হল তার সর্বশেষ উত্তরসূরী, মঠপ্রধান মরুআব্বার সাথে।
নন্দন মরীচিকার খোঁজে যে মরুপথ হারাল ধারা --
ছবিসূত্রঃ সব তৈলচিত্র ও ড্রইং - ক্যাপশনে সূত্র উল্লেখিত। সব আলোকচিত্র - মন মাঝি।
মন্তব্য
এইচবিওর রোম সিরিজটার কথা মনে হলো পড়তে পড়তে। আমাদের মোগল আমল নিয়ে এরকম কি চমৎকার সব মুভি করা যায়। মূর্খদের হাতে মিডিয়া।
একবারে পাঁচতারা পোস্ট খিলাইলেন। ধইন্যবাদ।
..................................................................
#Banshibir.
মোগল আমল দুর অস্ত্, এই সেদিনের অতুলনীয় ড্রামাটিক '৭১ নিয়েই বা কি করতে পারলাম আমরা? অথবা '৪৭-'৭১? অথচ এর অনেক পাত্রপাত্রীরা পর্যন্ত এখনো জীবিত। মিডিয়ার কথা আর বইলেন না, একেকটা চ্যানেল আছে যাদের রিপোর্টাররা ঠিকমত গুছিয়ে কথা বলতে বা উচ্চারন পর্যন্ত করতে পারে না! আর তাদের বসদের দৌড় হচ্ছে 'আপনার প্রিয় খাবার কি?' পর্যন্ত প্রশ্ন করা। এরা করবে ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে ডকুমেন্টারি? নাকি এদের ৪২০ বাটপার মালিকরা টাকা যোগাবে? এদের চিন্তার দৈন্য বা সৃজনশীলতার দৌড় হচ্ছে দুইটা বাটপাররে স্টুডিওর ভিত্রে চুল ছিড়াছিড়ি করতে বসায় দিয়ে সেটাকে 'টক-শো' নাম দিয়ে চালানো। এই হইল মিডিয়া। এরা আছে খালি ভাব নিতে। তা নাহলে, উয়ারী-বটেশ্বর থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত কত উপকরনই না ছড়ানো আছে চতুর্দিকে!
মন্তব্যের জন্য অসংখ্য
****************************************
****************************************
আলেকজান্দ্রিয়াকে ঘিরে থাকা অপরূপ মায়াময় অতীত আপনার লেখায় উঠে এল । চমৎকার লাগলো পড়তে । ধন্যবাদ ভাইয়া ।
সেই চেষ্টাটাই করেছি ভাই, কিন্তু ফুটিয়ে তুলতে পেরেছি সে ব্যাপারে সন্দেহ হচ্ছে। মনে হচ্ছে অনেক বেশি তথ্যভারাক্রান্ত আর ভার্বোস হয়ে গেল। তবু আপনি আমার চেষ্টা যে অন্তত ধরতে পেরেছেন তাতেই লেখাটা সার্থক হয়েছে।
****************************************
****************************************
ভ্রমণ কাহিনীতে এত বেশী তথ্য ভাল লাগে না । ছবি দেখতে ভাল লেগেছে বেশি ।
ছবি ও তথ্য উপস্থাপনা দুটিই মনোহর লেগেছে।
“Peace comes from within. Do not seek it without.” - Gautama Buddha
****************************************
দারুণ, আলেক্সান্দ্রিয়ার লাইব্রেরী নিয়ে কার্ল সাগান কসমসে চমৎকার সব তথ্য দিয়েছিলেন। আচ্ছা এর শেষ অংশ তো ধ্বংস হয়ে যায় মসুলমান মৌলবাদীদের হাতে পড়ে, তাই না ! আর শুরুটা তো আপনেই উল্লেখ করেছেন খ্রিষ্টান মৌলবাদীদের জন্য।
facebook
'লাইব্রেরি অফ আলেকজান্দ্রিয়া' ৬৪১ খৃষ্টাব্দে মুসলমানরা আসার অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে যায়, সম্ভবত এমনকি খৃষ্টানরাও ক্ষমতায় আসার আগে। এটা একাধিকবার আক্রান্ত হয়েছে ঠিক - ১ম বার জুলিয়াস সিজারের হাতে (পরে এন্টনি তার ক্ষতিপূরণ করেন পারগামুম লাইব্রেরি থেকে ২ লক্ষ স্ক্রোল উপহার পাঠিয়ে), তারপরও মনে হয় দুয়েকবার, এবং শেষবার সম্ভবত রোমসম্রাট অরেলিয়ানের সাথে রানি জেনোবিয়ার যুদ্ধের ডামাডোলে (২৭০-২৭৫ খৃঃ)। এসব নিয়ে সে যুগের রেফারেন্সগুলির মধ্যেও নানা মুনির নানা মত, এবং এই বিশেষ ক্ষেত্রে খৃষ্টীয় মৌলবাদীরাও কতটা দায়ী তা ঠিক স্পষ্ট না। তারা পরবর্তীকালে অন্য অনেককিছুর জন্যই দায়ী হলেও স্পেসিফিকালি এই ক্ষেত্রে হয়তো অতটা দায়ী না। আরেকটা জিনিষ মনে রাখা দরকার - খৃষ্টানরা ক্ষমতায় এসেছে আরও প্রায় ১ শতাব্দী পরে, ৪র্থ শতকের শেষের দিকে রোমসম্রাট ১ম থিওডোসিয়াসের খৃষ্টধর্মে কনভার্শনের পরে। তিনি প্যাগানিজমকে ৩৯১ সালে অবৈধ ঘোষনা করেন - প্যাগান অরেলিয়ান-বনাম-জেনোবিয়ার যুদ্ধের ১০০-রও বেশি বছর পরে। সুতরাং বিখ্যাত 'লাইব্রেরি অফ আলেকজান্দ্রিয়া'-টা মনে হয় প্যাগানদের সময়েই ধ্বংস হয়ে যায় - ইচ্ছাকৃত বা যুদ্ধবিগ্রহের নৈরাজ্য আর ডামাডোলের কোন দুর্ঘটনা বা লুটতরাজেই হোক। এখানে ধর্মীয় ভূমিকাটা খুব স্পষ্ট না আমার কাছে। তবে ঐতিহাসিক সূত্রগুলি বলছে খৃষ্টান মৌলবাদীরা পরবর্তীকালে ৪র্থ শতকের শেষের দিকে বা ৫ম শতকের শুরুর দিকে (খৃষ্টধর্ম অফিসিয়াল ধর্ম হওয়ার পর) অন্য দুটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুত্রতর পাব্লিক লাইব্রেরি (মূলটা রাজকীয় লাইব্রেরি ছিল এবং শুধুমাত্র পণ্ডিতদের জন্য উম্মুক্ত ছিল) সেরাপিয়াম আর সিজারিয়নের লাইব্রেরি ধ্বংসের জন্য দায়ী। কিছু কিছু প্রায় হাজার বছর পরে লেখা সূত্র রাজকীয় লাইব্রেরির পুরো বা অংশবিশেষের ধ্বংসের জন্য আরব বিজেতা আমর ইব্নে আল-আস-কে দায়ী করে বটে, কিন্তু বর্তমানে অধিকাংশ পশ্চিমা সিরিয়াস বিশেষজ্ঞই মনে হয় এই দাবীকে বানোয়াট মনে করেন এবং খারিজ করে দেন।
****************************************
সৈয়দ মুজতবা আলী কি জাহাজে করে সুয়েয পাড়ি দিয়েছিলেন নাকি ট্রেনে করে মিশরের উপর দিয়ে গিয়েছিলেন? ত্রিভুজের দুই বাহুর সমষ্টি তৃতীয় বাহুর চেয়ে বৃহত্তর হলেও এক্ষেত্রে সময় কম লাগার থিয়োরীটা মনে পড়ে? রসিকতা থাক, এই সিরিজটা এতো অনিয়মিত ভাবে চলে যে কিছু কিছু জিনিস ভুলেই যাই। তারপর আবার পিছনে গিয়ে খুঁজতে হয়। লেখা-ছবি বরাবরের মতো উপাদেয়। একটা ই-বুক করার কথা মাথায় রাখুন। এই ব্যাপারে আমার উপর আমার হোম মিনিস্ট্রির নির্দেশ আছে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩
আমি আসলে জানি না আলী সাহেব কিভাবে মিশর গিয়েছিলেন। এ সংক্রান্ত তার কোন লেখাও পড়িনি। শুধু অন্য কারো লেখায় মনে হয় উল্লেখ পেয়েছিলাম যে উনি মিশরের পোর্ট সৈয়দ গিয়েছিলেন। সেই থেকে কেন জানি মাথায় ঢুকে গিয়েছে যে উনি সেটা জাহাজেই গিয়েছেন। আমি নিজেও পোর্ট সৈয়দ যাওয়াতে ধারণাটা মাথায় আরও গেড়ে যায়। আমারই বিভ্রান্তি মনে হয়!
অনিয়মিত হওয়ার একটা কারন অবশ্যই সময়, ইত্যাদি। আরেকটা কারন আমার মিশরভ্রমণ অনেকদিন হয়ে গেছে (২০০৭), ফলে স্মৃতিভাণ্ডার থেকে অনেককিছুই হারিয়ে ও ফিকে হয়ে গেছে। হারানো ও ফিকে স্মৃতি থেকে কিছু খুঁড়ে বের করতেও অনেক সময় লেগে যায়। অনেক ক্ষেত্রেই হারানো স্মৃতিগুলির শুন্যস্থান 'তথ্য' দিয়ে পূরণ করতে হয়। এসব কারনে সময় লেগে যায়। এক বসায় স্ট্রেইট মন/স্মৃতি থেকে লেখা হয় উঠে না - একটু একটু করে সময় নিয়ে লিখতে হয়। তবে আমি তো চেষ্টা করি 'ইন্ডিপেন্ডেন্ট' বা 'স্ট্যান্ড-এলোন' পর্ব লিখতে যাতে পিছনের সূত্র বেশি দেখতে না হয়। আপনাকে ঠিক কোন জিনিষটা পিছনের পর্বে গিয়ে দেখতে হয়েছে?
ই-বুকের বিষয়ে আমি আসলে তেমন কিছু জানি না। তাছাড়া এই বারোটা পর্ব লিখতেই জান পানি হয়ে গেছে, আর হয়তো দুয়েকটা পর্ব লিখেই আমার নটে গাছটি মুড়িয়ে দিব। তারপর আর ই-বুক করার এনার্জি থাকবে কিনা জানি না! তবে আপনি আপনার হোম মিনিষ্ট্রিকে "৪৮ ঘন্টার" আশ্বাসের উপর রাখতে পারেন, কোন অসুবিধা নাই
মন্তব্যের জন্য অজস্র
****************************************
_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩
****************************************
পোষ্ট।
বারে বারে ঘুরে ফিরে আসবো নতুন মন্তব্য গুলো দেখতে।
আপনাকে কৃতজ্ঞতা এমন তথ্যবহুল ভ্রমনের স্বাদ দিলেন বলে।
****************************************
নতুন মন্তব্য করুন