বাংলা ভাষায় প্রমিত বনাম অপ্রমিত, শুদ্ধ বনাম অশুদ্ধ, আঞ্চলিকতা বনাম অনাঞ্চলিকতা, অথবা প্রমিত-অপ্রমিতের দ্বৈততার প্রেক্ষিতে সুন্দর বনাম অসুন্দর, রুচি বনাম অপরুচি, সংস্কৃতি বনাম অপস্কৃতি, স্বজাতীয়তা বনাম বিজাতীয়তা, পূর্ব বনাম পশ্চিম, উপযোগিতা বনাম অনুপযোগিতা; এমনকি কর্তৃত্ব, মর্যাদা ও মান্যতা বনাম স্বাধীণতা, সাম্য, অপ্রাতিষ্ঠানিকতা বা প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃত্বহীণতা, মুক্ত বিবর্তনশীলতা, ইত্যাদি বিতর্ক দীর্ঘকাল ধরেই চলমান।
এই বিতর্কটা মনে হয় দমকা বাতাসের মত খানিকটা দমে-দমে, দমকে-দমকে আর ধমকে-ধমকে চক্রাকারে চলে। হঠাৎ করে মাথাচাড়া দেয়, কিছু সময় হাল্কা বজ্র-বিদ্যুৎ সহ ঝড়-ঝাপটা দিয়ে আবার ঝিম মেরে যায়। মনে হয় এই বুঝি সমাধান হয়ে গেল, বা অন্তত যার যা বলার সব বলা হয়ে গেছে। আর কীইবা বলার আছে। ধর্ম, অর্থনীতি বা রাজনীতির ইস্যুগুলি মত অত জটিল বলে তো একে মনে হয় না, যে এটা ওগুলির মতই অন্তহীণ ভাবে চলতে থাকবে। অবশ্য আরোপিত ভাবে ভাষার ইস্যুর মধ্যে বাইরে থেকে ধর্মকে ইঞ্জেক্ট করলে অন্য কথা। তাছাড়া '৫২-র ভাষা-আন্দোলনের পর থেকে, একে মাঝেমধ্যে খৎনা করানোর কিছু বিচ্ছিন্ন ও ব্যর্থ অপপ্রয়াস বাদে বাংলাদেশের প্রায় মনোলিথিক বাঙালিদের মধ্যে অন্তত এই ইস্যুটাকে কেন্দ্র করে সম্ভবত খুব বেশি বা বিস্তৃত উত্তেজনা, দ্বন্দ্ব, গোঁড়ামি বা ছুঁৎমার্গ নেই। যেটুকু আছে, সেটাও আমার মনে হয় পক্ষ-বিপক্ষ সবদিক থেকেই সীমিত সংখ্যক কিছু শহুরে বুদ্ধিজীবি শ্রেণীর মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তবে অন্যদের চেয়ে তাঁদের কণ্ঠের শক্তি একটু বেশি এই যা।
কিন্তু তারপরও, যখন মনে হয় এই বুঝি সব শান্ত, তখনই আবার মেঘ ঘনিয়ে আসে এবং আরেক পশলা বজ্র-বিদ্যুৎ সহ ঝড়-ঝাপটা বয়ে যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেই পুরনো ঝড়েরই পুনরাবৃত্তি। তবে এই ঝড়গুলি ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে বিতর্কের ঝড়গুলির মত অত তিক্ত হয় না সবসময়, বরং বেশ উপভোগ্যও হতে পারে অনেক ক্ষেত্রে।
বিতর্কটা বেশ বড় এবং পুরনো হলেও এটা সাধারণত কিছু সুনির্দিষ্ট পয়েন্টকে ঘিরে আবর্তিত হয়, যার কিছু আভাস লেখার শুরুতেই দিয়েছি। তবে সময়ের বিবর্তনে বিতর্কিত পয়েন্টগুলির খুব বেশি পরিবর্তন বা বিবর্তন না হলেও (কিছুটা হয়েছে যদিও), এনিয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির বিবর্তন হয়েছে যথেষ্ট, এবং হচ্ছে। আবার এই বিবর্তন যে পুরোপুরি একমূখী, তাও হয়তো না। আবার কারো কারো হচ্ছেও না। এটাই মনে হয় ঐ চক্রাকারে ফিরে ফিরে আসা দমকা-ঝড়ের রহস্য, অন্তত যে পরিসরে এই বিতর্কটা হয়।
যাহোক, আমি এই বিতর্কের কোন পক্ষ নিয়ে নতুন কোন যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করতে বা এমনকি ঐ 'বিতর্কের ইতিহাস' জাতীয় কিছু লেখার জন্যেও এই পোস্টের অবতারনা করিনি। সে জ্ঞান, যোগ্যতা, শক্তি বা ধৈর্য্যের ন্যূনতমও আমার নেই। তবে হঠাৎ করে আবারও কিছু বহু শোনা, বহুকাল ধরেই বহুল-আলোচিত, বহু রথী-মহারথী জ্ঞাণী-গুণী-পণ্ডিত-অপণ্ডিত ও পণ্ডিতন্মন্যদের চর্বনধন্য কিছু বিশেষ বক্তব্য ও বিশেষণ নতুন করে শুনে - আমার নিজের এ বিষয়ে মতামত কি তা নিয়ে ভাবতে বসে গেলাম।
আমরা সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশে যে ধরণের বাংলা চর্চা করছি, বিশেষ করে ব্লগে-মিডিয়ায়-ও দৈনন্দিন কথকতায় -- তা কি খিচুড়ি-মার্কা বাংলা? এতে কি অবৈধ, অসঙ্গতিপূর্ণ বা অশ্রেয় মিশ্রণ-দোষ ঘটছে? আমাদের চর্চিত বাংলা কি অপ্রমিত? এটা কি অশুদ্ধ? এটা কি অসুন্দর? এটা কি বিকৃত? এটা কি কোন কথিত মান্য মূলধারার বিরোধী ও তার অবমাননাকারী অ-মূল, অর্থাৎ অবৈধ অভ্যুত্থানাকাঙ্খী নিম্নশ্রেণীর প্রান্তিক ধারা? এতে কি আসল বাংলা বা ভাল বাংলার জাত যাচ্ছে? এতে কি আমাদের 'আসল' সংস্কৃতি, ভাষা বা তার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি কোন বেইমানি বা অবমাননা করা হচ্ছে?
কিন্তু ভাবতে গিয়ে দেখি, আমি এ বিষয়ে প্রায় কিছুই জানি না। বিতর্কটা জানি, কিন্তু এমন তাবড়-তাবড় প্রশ্নের উত্তর বের করা বা তা নিয়ে বিতর্ক করার জন্য, বা এমনকি নিজের জন্য একটা অবহিত মতামত গঠনের জন্যেও, যে জ্ঞান দরকার হয় সেটা আমার প্রায় নেই বললেই চলে। এখন কি করা যায়? এই সময়ই আমার বিখ্যাত ইংরেজ সমাজভাষাতত্ত্ববিদ ও 'ডায়ালেক্ট' বিষয়ে অথরিটি
পিটার ট্রাজিলের একটা লেখার কথা মনে পড়ে গেল, যা পুরোপুরি না হলেও এবং আসলে ইংরেজি ভাষা নিয়ে হলেও - কিছুটা হলেও হয়তো বাংলার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হতে পারে। এটা মনে পড়তেই মনে হল, ঐ লেখাটা নিয়ে, খুব সংক্ষিপ্তরূপে এর বক্তব্যের পিঠাপিঠি যদি বাংলা নিয়ে বিতর্কের দুয়েকটা ইস্যু বা পয়েন্ট একটু পরীক্ষা করি আর ঐ প্রসঙ্গে নিজের মত সংযোগ করি, তাহলে কেমন হয়? সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে না নিশ্চয়ই, তবে আইডিয়াটা আমার কাছে ইন্টারেস্টিং বলেই মনে হল। ভেবে দেখলাম, দেখাই যাক না কি দাঁড়ায়। বাংলা না হোক, অন্তত ইংরেজির বিষয়ে হলেও তো কিছু শিখতে পারব।
প্রমিত/অপ্রমিত, শুদ্ধ/অশুদ্ধ, সুন্দর-অসুন্দর, জাত-বেজাত নিয়ে ইংরেজদের মধ্যে ইংরেজি নিয়েও কিন্তু ব্যপক বিতর্ক ছিল ও আছে। আসলে আমার মনে হয় ভাষা-সৃষ্টির আদিকাল থেকেই বোধহয় এটা সারা দুনিয়াতেই চলে আসছে। তো ইংরেজদের এই বিতর্কটা মনে হয় আমাদের বিতর্কের ক্ষেত্রেও বেশ শিক্ষণীয় হতে পারে। শুধু ইংরেজি-মিশ্রিত বাংলায় ফুটানি মেরে আত্নপ্রসাদ লাভ করে বা শুধু ঐ ফুটানিতে বিরক্ত না হয়ে, ঐ আত্নমর্যাদাহীণ ফুটানি ও সেইসাথে ফুটানি-বিরোধী কিছু ভাষিক মৌলবাদের মধ্যেও যে কত ফুটো - সে বিষয়েও মনে হয় সচেতন হওয়া যেতে পারে। তো ট্রাজিলের লেখাটার প্রেক্ষিতে আমার সম্ভাব্য মতামতটা একটু ঝালাই করে দেখার চেষ্টা নিলাম।
ট্রাজিলের লেখার মূল বিষয় "প্রমিত" ইংরেজি কি তা না, বরং সেটা আসলে কি 'না' - সেটাই। সে সুবাদে সেটা কি, তাও অনেকখানি স্পষ্ট হয়। নিবন্ধটার শিরোনাম, "Standard English: what it isn’t" ।
তিনি দেখিয়েছেন, 'প্রমিত' ইংরেজি এমনকি কোন 'ভাষা'ই পর্যন্ত না। বস্তুতঃ এটা "is less than a language"। হ্যাঁ, অষ্টাদশ/ঊনবিংশ শতকের সেই কট্টর রাজানুরক্ত, শ্রেণীবাদী, বর্ণবাদী, প্রমিত ইংরেজওয়ালা রাজপুরুষ ও ঈশ্বরপুরুষদের ইংরেজিটাই নেহাতই একটা 'ডায়ালেক্ট' মাত্র - সেই ইংরেজরা, যারা কিনা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ভাবেই হোক, আমাদের ভাষার তথাকথিত প্রমিতকরণের খালটা গোড়াতে কেটে দিয়েছিল। তো কেন?
কারন এটা ইংরেজির অনেকগুলি 'ভ্যারাইটির' মধ্যে (সোশিওলিঙ্গুইস্টদের চোখে যার সবগুলি নিয়েই আসলে একটি 'ভাষা' হয়) একটি ভ্যারাইটি মাত্র! তো ঐ প্রমিত ইংরেজিওয়ালা ইংরেজদের প্রমিত ইংরেজির মত আমাদের ছুপা-কর্তৃত্বকাঙ্খী খাঞ্জা খাঁ প্রমিত বাংলাওয়ালা কিছু বাঙালী বুদ্ধিজীবীর প্রমিত বাংলার ক্ষেত্রেও কি একই কথা সত্য না? ইংরেজি-ফুটানিওয়ালাদের মতই ফুটানি-বিরোধী মৌলবাদী/জাতীয়তাবাদীরারাও ঠিক একই ভাবে ঐ সব ইংরেজদের অনুকরণেই অনেক সময় ভাব দেখাই প্রমিতটাই একমাত্র 'ভাষা' হিসেবে গণনীয়, বাকিগুলি ঠিক 'ভাষা' পদবাচ্য, অধিকারী বা মর্যাদাযোগ্য না। এই বিশুদ্ধতা/প্রমিতপ্রেম ও বিজাতীয় ফুটানি-বিরোধীতার নামে মৌলবাদ বা শ্রেণীবাদও কি আসলে ফুটানিওয়ালাদের মতই ঐ ইংরেজদেরই একধরণের অনুকরণ নয় - ভাষিকের বদলে মানসিক ছাঁচের নকলিবাজি? এখানে আমি যা বুঝলাম তা হলো, এই তথাকথিত প্রমিত ভাষা বা যে কোন প্রমিত ভাষাই আসলে একটা ডায়ালেক্ট বা "উপভাষা" মাত্র - "ভাষা" নয়। ঐ 'ভাষা'র ভাষাত্বের আরও অনেক সম-অংশীদার উপভাষার মতই এটা একটা উপভাষা, যেখানে কেউ কারও 'ভ্রংশিত' রূপ বা উপ-টুপ নয়। উপ হলে সবাইই উপ, না হলে কেউই নয়, আর একক পরিচয় ধারণ করতে চাইলে সবাই সমভিত্তিতে একসাথে হলে তখনই কেবল উপ-র লেজটা খসে পড়ে। তার আগে নয়। আমাদের ক্ষেত্রে "উপ"-টা সাঙ্ঘাতিক গুরুত্বপূর্ণ মনে হল। বেনো বনে শিয়াল রাজা সাজা প্রমিতর লুকনো 'উপ'-র টিকি পাকড়ে ধরতে পেরেই মনে হল বিষয়টা অনেক খানি ফর্সা হয়ে গেল। লালনের জাত নিয়ে ঐ গানের লাইনটা এখানেও মনে হয়ে খেটে যায়...
ট্রাজিলের মতে প্রমিত ইংরেজি কোন 'এ্যাকসেন্ট 'ও না। বেশির ভাগ ভাষাতত্ত্ববিদই প্রমিত ইংরেজির সাথে উচ্চারণ বা এ্যাকসেন্টের কোন সম্পর্ক আছে বলে মানেন না। ব্রিটেনে 'রিসিভড প্রোনান্সিয়েশন' (RP)-টাকে এক হিসেবে একটা 'প্রমিতকৃত' উচ্চারণরীতি বলে গণ্য করাও যেতে পারে তর্কের খাতিরে এর উচ্চ স্ট্যাটাস ও গুরুত্বের জন্য, যদিও ট্রাজিল আসলে তাকে সেই মর্যাদাটাও ঠিক দিতে রাজি নন বলে মনে হয়, কিন্তু তিনি বলেন এটা 'প্রমিত ইংরেজি' না - উচ্চারণ রীতিই। তবে তিনি এটাকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সমাজভাষাতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে অদ্ভূত বা খাপছাড়া একটা ব্যাপার বলে মনে করেন, কারন এটা ব্রিটেনের অন্তর্গত কোন নির্দিষ্ট ভৌগলিক অঞ্চলের সাথে জড়িত না। প্রসঙ্গত, এর থেকে আমি অনুমান করছি অন্যান্য দেশে বোধহয় সেটাই হয়ে থাকে। এখানে আমার প্রশ্ন দু'টি - বাংলাদেশে আমাদের রক্ষণশীল বা পুরনোপন্থীরা বাংলার যে 'ভ্যারাইটি'টাকে (এই শব্দটার সমাজভাষাতত্ত্বে একটু বিশেষায়িত এক্সটেন্ডেড অর্থ আছে মনে হয়, তবে আপাতত 'রূপ' ধরে নিলেও চলবে হয়তো) 'প্রমিত' হিসেবে অক্ষয় প্রতিমা সাজিয়ে পুজো করতে চান, তা বর্তমান বাংলাদেশের ভৌগলিকত্বের বিচারেই বা কতটুকু নেটিভ ও কতটুকু সর্বজনীন? এর উচ্চারণরীতিটাই বা কতটুকু নেটিভ ও কতটুকু সর্বজনীন? তাই যদি না হয় পুরোপুরি, তাহলে আমাদের নিজস্ব ও নেটিভ ভ্যারাইটি/গুলির বিবর্তন ও বিকাশের সম্ভাবনার, প্রমিত হয়ে উঠার সম্ভাবনার - টুটি চেপে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে কেন এই ভ্যারাইটি ও তার উচ্চারণ রীতিটাকেই জগদ্দল পাথরের মত সবার উপর চাপিয়ে দিব? তাহলে আর ঐ ইংরেজি ফুটানিওয়ালাদের সাথে অন্যদের কি পার্থক্য থাকল আসলে? এই ভ্যারাইটিটার সাথে আমাদের দেশের ও ভাষার একটা সম্পূর্ণ ভৌগলিক না হলেও, ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যিক সম্পর্ক রয়ে গেছে। সুতরাং এটা ইংরেজির মত 'পর' নয় মোটেই, বরং এদেশে প্রচলিত আর সবগুলি ভ্যারাইটির স্পেক্ট্রামের মধ্যে একটা অন্যতম অংশীদার রঙ বা ভ্যারাইটি হিসেবেই গণ্য করা যেতে পারে। কিন্তু তাই বলে অন্যান্য স্থানীয় বা এখানকার শ্রেণীয় গুলির বৈধতা বা মর্যাদা হ্রাস করে একমাত্র বা কেন্দ্রীয় ভ্যারাইটি হিসেবে কেন?
ট্রাজিলের মতে প্রমিত ইংরেজি কোন বিশেষ 'স্টাইল'-ও না। প্রমিত ইংরেজি এবং ইংরেজি ভাষার আনুষ্ঠানিক (ফর্মাল) ভ্যারাইটিগুলির সাথে সম্পৃক্ত শব্দ-ভাণ্ডারের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে যথেষ্ট বিভ্রান্তি আছে (বাংলাতেও আছে)। 'স্টাইল' বলতে আনুষ্ঠানিক প্রয়োগের (ফর্মালিটি) দৃষ্টিকোন থেকে দেখা ভাষার বিভিন্ন ভ্যারাইটিকে বুঝায়। এই স্টাইল শ্রেণীর ভাষিক ভ্যারাইটিগুলিকে অত্যন্ত আনুষ্ঠানিক থেকে শুরু করে অত্যন্ত অনানুষ্ঠানিক পর্যন্ত একটা বিস্তৃত কন্টিনিয়ামে স্থাপন করা যায়। ট্রাজিল তার আলোচনায় এই 'স্টাইল' বা আনুষ্ঠানিকতা-অনানুষ্ঠানিকতার সাথে প্রমিত ইংরেজির সম্পর্ক নির্ধারণ করতে গিয়ে ফোনোলজি ও লেক্সিস বিশ্লেষন করে দেখান যে, কিছু ব্যতিক্রম বাদে প্রমিত-অপ্রমিতের সাথে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিকের আসলে অন্তত তাত্ত্বিক কোন সম্পর্ক নাই। সম্পূর্ণ প্রমিত ইংরেজিও অত্যন্ত অনানুষ্ঠানিক স্টাইলে দিব্যি বলা যায়, আবার উল্টোটিও, অর্থাৎ অপ্রমিত ইংরেজিও অত্যন্ত আনুষ্ঠানিক বা ফর্মাল স্টাইলে বা ভঙ্গিতে দিব্যি শুদ্ধ ভাবে বলা যায়। অর্থাৎ, এই দুইয়ের মধ্যে আসলে কোন বাধ্যতামূলক সম্পর্ক নাই। ট্রাজিল কিছু উদাহরণ দিয়েছেন এটা বুঝাতে, কিন্তু লেখার আয়তন ছোট রাখতে সেগুলি আর উল্লেখ করলাম না। আগ্রহীরা মূল লেখাটা পড়ে দেখতে পারেন। অথচ আমরা অনেকে বাংলায় ব্লগে, মিডিয়াতে এবং অন্যত্র বাংলার অনানুষ্ঠানিক ভ্যারাইটির চর্চা বা প্রসার দেখে তাকে অপ্রমিত, অশুদ্ধ, অসংস্কৃত, অসুন্দর, খিচুড়ি, বিকৃত, ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে গেল-গেল রব তুলে ফেলি - যেখানে আসলে হয়তো 'যাওয়ার' কিছুই নেই - বরং 'পাওয়ার' অনেক কিছুই থাকতে পারে; অপ্রমিত, অশুদ্ধ, অসংস্কৃত, অসুন্দর, খিচুড়ি বা বিকৃতি তো নয়ই। আমার সন্দেহ হয়, পুরো না হলেও এই দৃষ্টিভঙ্গীটা খানিকটা আমাদের ঔপনিবেশিক ও সামন্তবাদী যুগের মানসিক উত্তরাধিকার।[/i]
ট্রাজিলের মতে প্রমিত ইংরেজি কোন 'রেজিস্টার'-ও না। তিনি দেখান যে, রেজিস্টারের প্রশ্ন আর প্রমিত-অপ্রমিতের প্রশ্ন আসলে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই দুইয়ের মধ্যেও আসলে কোন অবধারিত বা বাধ্যতামূলক সম্পর্ক নেই। স্টাইলের মতই রেজিস্টারের ক্ষেত্রেও যে কেউ প্রমিত ইংরেজি ব্যবহার না করেই টেকনিকাল রেজিস্টার দিব্যি শিখতে ও ব্যবহার করতে পারেন, ঠিক যেমনি অত্যন্ত প্রমিত ইংরেজি বলা বা লেখার সময় অ-টেকনিকাল রেজিস্টারও প্রয়োগ করতে পারেন। বিভিন্ন ভাষা থেকে তিনি এসবের বেশ কিছু ইন্টারেস্টিং কিন্তু প্রচলিত উদাহরণও দিয়েছেন। যেমন জার্মানীয় সুইজারল্যাণ্ডে বার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোরে দুই দর্শনের অধ্যাপককে দর্শনশাস্ত্রের সমস্ত প্রযোজ্য অতি উচ্চ মার্গের বিশেষায়িত ভোকাবুলারি প্রয়োগ করে কান্টের দর্শন নিয়ে গভীর আলাপে ব্যপৃত দেখা যেতে পারে, অথচ কান পাতলে শোনা যাবে তারা হয়তো মোটেই "প্রমিত" জর্ম্মনে নয় - বরং তাঁদের নিজস্ব আঞ্চলিক জর্ম্মন ডায়ালেক্টের ফোনোলজি ও ব্যকরন ব্যবহার করছেন। এখন একবার ভাবুন তো - ঢাকার কোন প্রখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোরে দর্শনের দুই অধ্যাপক কান্ট-হেগেল-নীট্শে বা উইটেন্সটাইনের দর্শন নিয়ে প্রকাশ্যে উচ্চস্বরে নোয়াখালি, সিলেটি, চাটগাঁ বা ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষায় প্যাশনেট বাক্যালাপে ব্যপৃত! কিম্বা আরও ভাল হয় যদি সাহিত্যের দুই অধ্যাপককে দেখা যায় ঐ সব আঞ্চলিক ভাষায় "রবীন্দ্র-সাহিত্য" নিয়ে আলাপ করছেন। কিম্বা বুয়েটের ইঞ্জিনিয়ারিং....। আমার ভাবতেই ভয় লাগছে এর পরে কি হত। কথিত "রবীন্দ্র-মৌলবাদীদের" উষ্কানিতে গায়ক মাকসুদের তথাকথিত "পিট্টি" খাওয়ার মত কিছু না হলেও, জাতীয় গণমাধ্যমে বোধহয় চলে আসত ব্যাপারটা। কিন্তু কেন এমন হবে?
তো প্রমিত ইংরেজিটা কি তাহলে? ট্রাজিলের মতে -- সুতরাং প্রমিত ইংরেজিটা কোন ভাষা, এ্যাকসেন্ট, স্টাইল, বা রেজিস্টার না। এটা আসলে একটা ডায়ালেক্ট মাত্র - স্রেফ একটা সাব-ভ্যারাইটি। এবং অনেকগুলির মধ্যে অন্যতম মাত্র! আগেই যেমন বলেছি, সমাজভাষাতত্ত্বে সবগুলি ডায়ালেক্ট নিয়েই "ভাষা" বলা হয়, আর এই ডায়ালেক্টগুলি (বাংলায় একে অনেকে 'আঞ্চলিক ভাষা' বলেন, কিন্তু তা আসলে 'ডায়ালেক্টের' পূর্ণ অর্থের একটা ক্ষুদ্র অংশ মাত্র, পূর্ণ অর্থ নয়) - ঐ ভাষার উপ-ভ্যারাইটি। আমি অবশ্য বলি - "সোশিওলেক্ট" - উপ-উপ-ভ্যারাইটি! আর একটা উপ-উপ-ভ্যারাইটি নিয়ে আর সবাইকে বাদ্দিয়ে এত মাতমের কি আছে বুঝি না!
ট্রাজিল আরও জানান, অন্যান্য ভাষার মত ইংরেজি ডায়ালেক্টগুলিও সাধারণত একাধারে ভৌগলিক ও সামাজিক ডায়ালেক্ট দুটোই, আর এই দুটো মিলে ভৌগলিক ও সামাজিক ডায়ালেক্টের উভয়ের কন্টিনুয়াই (continua) সৃষ্টি করে। কিন্তু প্রমিত ইংরেজির ক্ষেত্রে এর সাথে অন্যান্য ডায়ালেক্টগুলির এখন আর কোন কন্টিনিয়ামগত সংযোগ নেই, যদিও কোন এক সময় দক্ষিণপূর্ব ইংল্যান্ডে এর জন্ম হয়েছিল বলে প্রমানও হয়। এর ব্যতিক্রমী ইতিহাস আর তীব্র সমাজতাত্ত্বিক কারনে এটা আর ভৌগলিক ডায়ালেক্ট নেই, বরং এখন এটা একটা বিশুদ্ধ সোশাল ডায়ালেক্টে পর্যবসিত। সমাজভাষাতত্ত্বের দৃষ্টিতে এটাই এর প্রধাণতম লক্ষণ। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের রক্ষণশীলরা বাংলাদেশে বাংলার যে বর্তমানে জমিদারি-হারানো ও জাত-খোয়ানোর আতঙ্কগ্রস্ত উপ- বা উপ-উপ-ভ্যারাইটিকে তথাকথিত "শুদ্ধরূপে" "প্রমিত ভাষা" হিসেবে কোরামিন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে চাচ্ছেন, তার অবস্থাটাও কি আসলে উপ্রে ট্রাজিল কথিত প্রমিত ইংরেজির মতই নয় প্রায়? স্বাধীণ বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মধ্যে প্রচলিত অন্যান্য ডায়ালেক্টগুলির সাথে এখন এর আর কোন লিভিং কন্টিনিয়ামগত সংযোগ নেই বললেই চলে, যদিও কোন এক সময় পশ্চিম বা দক্ষিণপশ্চিম বাংলাদেশের অল্প কিছু অংশের সাথে এর জন্মাঞ্চলের হয়তো সুদূর কোন নৈকট্য থেকেও থাকতে পারে (আমি ঠিক নিশ্চিত না)। তা যদি থাকেও, প্রমিত ইংরেজির মতই এখন এটাও আর কোন ভৌগলিক ডায়ালেক্ট না এদেশে - সোশাল ডায়ালেক্ট বা সোশিওলেক্টে পর্যবসিত।
ট্রাজিল বলেন প্রমিত ইংরেজি নামক উপ-ভ্যারাইটিটা মান-ভ্যারাইটি হয়ে গেল ঠিক এই কারনেই - অন্য কোন যোগ্যতায় নয়! অর্থাৎ, ঐতিহাসিক ভাবে এই উপ-ভ্যারাইটিটা সমাজের সবচেয়ে ক্ষমতাধর, মর্যাদাগর্বী ও বিত্ত-প্রতিপত্তিশালী, এককথায় এলিট-শ্রেণীর মুখের উপ-ভ্যারাইটি ছিল। তারাই নিজেদের উপ-ভ্যারাইটিটাকে প্রমিত বানিয়ে দিয়েছে - বাকিদের তা স্বেচ্ছায় ও অনিচ্ছায় মেনে নিতে বাধ্য হতে হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত ইদ্দিশ সমাজভাষাতত্ত্ববিদ ম্যাক্স ওয়েনরাইখের নামে আরোপিত একটা বিখ্যাত উক্তি প্রচলিত আছে যা অনেকেই হয়তো জানেন --
A language is a dialect with an army and navy.
এটা হয়তো খানিকটা রূপকার্থে বলা হয়েছে, কিন্তু মূল অর্থটা স্পষ্ট এবং অতি বাস্তব। পৃথিবীর সবখানেই প্রমিত-করণের ক্ষেত্রে এটা কম-বেশি ঘটেছে। বাংলার ক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু স্বাধীন দেশ ও এই গণতন্ত্রের যুগে এই বাধ্যতা আর গ্রহনযোগ্য নয়। আর প্রমিত ভ্যারাইটির সৌন্দর্যের কথা অনেকে বলেন। আমার ধারণা প্রমিতের নিজস্ব, অবধারিত ও ইনেইট কোন উচ্চতর-সৌন্দর্য বা শ্রেষ্ঠত্ব নাই। এটা নেহাতই সাব্জেক্টিভ ব্যাপার। অনেকে রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদির সৃষ্টির উদাহরণ দিবেন। তবে আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, শেক্সপীয়ার বা রবীন্দ্রনাথ বা অন্যান্য প্রতিভাধররা বেশির ভাগই যুগে যুগে নিজেদের প্রয়োজনেই প্রমিত ভাষাতেই অর্থাৎ রাজভাষা বা এলিট শ্রেণীর উপ-ভ্যারাইটিকেই সৃষ্টিকর্মের জন্য বেছে নিতেন। তাদের প্রতিভার কারনেই ঐ এলিট-উপভ্যারাইটির শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে, এলিট-উপভ্যারাইটির কারনে তাদের প্রতিভার সৃষ্টি হয় নি। তারা অন্য কোন উপভ্যারাইটি বেছে নিলে তখন ঐটারই শ্রীবৃদ্ধি ঘটত, আগেরটার নয়। যেমন কিনা বৃটিশরা ঢাকাকে বাংলার রাজধাণী হিসেবে বেছে নিলে বা ঢাকার লোকেরা তৎকালীণ বঙ্গীয় এলিট-শ্রেণী নির্মান করলে হয়তো দেখা যেত বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতের স্রেষ্ঠ ক্লাসিক্স গুলি কুট্টি ভাষাতেই রচিত হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ তার গীতাঞ্জলি ও গীতবিতান, গোরা বা গল্পগুচ্ছ, কুট্টি ভাষাতেই লিখছেন (কিম্বা সিলেটে হলে সিলেটিতে, ইত্যাদি), নজ্রুলও তার বিদ্রোহী লিখছেন কুট্টিতে, ইত্যাদি। এটা এখন যত অস্বাভাবিক ও হাস্যকর মনে হচ্ছে, ঐ রকম হলে কিন্তু এখন আমাদের মোটেই তা মনে হত না। বরং বর্তমান প্রমিতওয়ালারা তখন হয়তো প্রমিত কুট্টির সাথে পশ্চিম বাংলার 'আঞ্চলিক ' ভাষার মিশ্রণ ঘটিয়ে 'মূল' ভাষার বিকৃতি, সৌন্দর্যহানি, মর্যাদাহানি, ইত্যাদি হচ্ছে বলে ঝড় তুলে ফেলতেন।
যাই হোক, আমি আপাতত যা বুঝতে পারছি তা হল - আমরা ইতিহাস, উত্তরাধিকার ও ঐতিহ্যের সূত্রে যে কথিত প্রমিত ইতিমধ্যে পেয়ে গেছি, তা কোন ছূপা-ধর্মীয়/সাম্প্রদায়িক/সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক বা জাতীয়তাবাদী এজেন্ডা বা মানসিক বৈকল্য, তা প্রকাশ্য বা গোপন যেটাই হোক - তা বাস্তবায়নের জন্য (বা অন্য কোন কারনেই) -- জোর করে বা আরোপিত ভঙ্গিতে এই কথিত প্রমিতকে উৎখাতের বা পরিবর্তনের কোন প্রয়োজন নেই। এইসব প্রয়োজনে চাকা নতুন করে আবিষ্কারের প্রয়াস নিরর্থক ও বোকামি। তবে অন্যদিকে, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সাথে 'ইতিহাসের' পার্থক্য বুঝতে হবে, বুঝতে হবে এই পার্থক্য আছে বলেই ঐ তিনটা আলাদা শব্দের উৎপত্তি। নইলে আজও আমরা হয়তো, রবীন্দ্রনাথ নয়, কোন বানর-জাতীয় প্রাণীর ভাষাতেই কিচির-মিচির করতাম। তাই ইতিহাসকে 'ইতিহাস' হয়ে উঠার, বা অন্তত সেই প্রয়োজন ও সম্ভাবনার সুযোগ উম্মুক্ত রাখতে হবে। ওর মধ্যেই ফসিলিভূত হয়ে গেলে চলবে না। জীবন্ত প্রাণীর মতই জীবন্ত ভাষার বিবর্তন ও সেই বিবর্তনের বাস্তবতা ও সম্ভাবনা অকুণ্ঠ ভাবে মেনে নিতে হবে। অবিবর্তিত শাখামৃগত্ব না চাইলে।
আর একটা কথা মনে আসল। বিবর্তন মানেই অতীতকে ভুলে যাওয়া নয়। কিছুদিন আগে দেখলাম টেলিভিশনে একজন বয়ষ্ক অতি বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব (এককালের টিভি নাটকে আমার এক প্রিয় চরিত্র) গলা কাঁপিয়ে আবেগী মেলোড্রামাটিক ভঙ্গিতে বলছেন - এভাবে চললে আর একশ' বছর পরে 'আমাদের সন্তানরা' রবীন্দ্রনাথ পড়তে পারবে না, বঙ্কিম পড়তে পারবে না, দেশ ও জাতি রসাতলে যাবে এর ফলে...। এই যুক্তিটা প্রায়ই শুনি ইদানীং। সাথে দেখি এক তরুণীকেও এনেছেন তাঁর অনুষ্ঠানে তাঁর সব কথায় বাঘের সামনে বিড়ালের মত মিউ মিউ করে ধুয়ো দিতে আর ব্লগ থেকে শুরু করে অন্যত্র তরুন প্রজন্মের নতুন নতুন বহিঃপ্রকাশকে তাদেরই কাউকে দিয়ে ধোলাই দেয়ার জন্য। চমৎকার কৌশল!
তবে কথা হচ্ছে, ঐ 'আমাদের সন্তানরা' বা উত্তর-প্রজন্ম কি চিরকাল রবীন্দ্রনাথ ও তার বুলিতেই আটকে থাকবে? ঐ মিডিয়া ব্যক্তিত্বের মতই বিশেষ ঢঙে গলা কাঁপিয়ে, উচ্চারণ করে, চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলে আর আবৃত্তি করেই সীমাবদ্ধ ও সন্তুষ্ট থাকবে? আর এগুবে না? নিজেরা নতুন কিছু, নতুন কোন যুগ ও ধারা সৃষ্টি করবে না? অতীতের কোন অতি মহৎ কবি বা সাহিত্যিকই যদি একটি পুরো জাতির ভাষা ও সংস্কৃতির চূড়ান্ত ভাগ্যনিয়ন্তা ও শেষ কথা হন, তাহলে কালিদাস কি দোষ করলেন? তাকেই কেন আদর্শ মানব না? তাঁর ভাষাতেই কেন কথা বলব না? রবীন্দ্রনাথই বা কেন রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠলেন, কালিদাসের কার্বন-কপি হলেন না কেন? ইংরেজরা কেন এখনও শেক্সপীয়ার বা তাঁর যুগের ভাষায় কথা বলে না? কিম্বা চসারের ভাষায়? বা বীউলফের ভাষায়? গ্রীকরা হোমারের ভাষায়? আর ঐসব মহাত্ননদের ভাষায় এখন আর কেউ হুবহু কথা না বললেও বা সবাইই সেই ভাষায় সম্পূর্ণ সড়গড় না হলেও, যাদের আগ্রহ আছে তারা কি আর সেগুলি পড়ে না এখনও? আর যারা পড়ে না, তারা কি কোনকালেই পড়ত আদৌ? হোমার বা রবীন্দ্রনাথ কি তাঁদের নিজেদের যুগেও জনপ্রিয়তম সাহিত্যিক ছিলেন?
যাহোক, বকরবকর করতে করতে খেই হারিয়ে যাচ্ছে। এবার এক কোপে সামনের বকরি-ঈদের মতই এই বিশাল বকরবকরকে বকরি বানিয়ে শেষ করে দেই।
মোদ্দা কথা হল, ট্রাজিলের খুঁটি ধরে " ...what it isn’t" বা অকাম্য কি তা মোটামুটি বুঝলাম মনে হয়। কিন্তু কাম্য অবস্থাটা তাহলে ঠিক কি? বিবর্তন? বিবর্তনের দুয়ার খোলা রাখা? সেই বিবর্তনের চেহারাটা কেমন হবে? ডিজ্যুস? ফারুকী গং? বরবাদ মগবাজার? বিবর্তনের ফলে বানর (জাতীয়) থেকে মানুষ হয়েছে বটে, কিন্তু মানুষ থেকে কি বানর হওয়া সম্ভব? ডিভোলিউশন বলে কি কিছু আছে?
এই যা! চিন্তাটা প্রায় গুছিয়ে এনেছিলাম মনে হয় - আবার গিট্টু লেগে গেল! নাকি গেল না? লাগলে কেউ কি ছুটিয়ে দিবেন প্লিজ?
মন্তব্য
লেখাটা ভাল্লাগলো। মন্তব্যে আরো নানাকিছু আসবে আশা করি...
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
****************************************
বাহ্!
পারি না পারি না করে করেই বাইনারিজম আর ফ্যাসিবাদ নিয়ে পেন্ডিং লেখাটাও দিয়ে দেন।
হবে হবে...
****************************************
আপনার বক্তব্য সুন্দর, চিন্তা গোছানো। প্রথমত, 'অশুদ্ধ' বিশেষণটি আঞ্চলিক ভাষার ক্ষেত্রে ঢালাওভাবে প্রয়োগ করা একটা মূর্খতা এবং আমি দীর্ঘদিন যাবৎ এই প্রবণতার বিরোধিতা করে আসছি। দ্বিতীয়ত, ভাষার 'শুদ্ধ' প্রয়োগ বলতে কি কিছুই নেই? গোটা ব্যাকরণ বিষয়টা কিন্তু তাহলে অদরকারী হয়ে যাচ্ছে! সমাজ-প্রগতির সাথে সাথে মুখের এবং লেখার ভাষা- দুইই বদলায়। সেটার সাথে কিন্তু ব্যাকরণগত ভুলের সম্পর্ক নেই। গুরু-চণ্ডালি , ক্রিয়া-সর্বনামের ভুল প্রয়োগ ইত্যাদির সঙ্গে কিন্তু আঞ্চলিকতার সম্পর্ক নেই।
আমি যেহেতু শুদ্ধ বাংলা কথাটার বিরোধী সেহেতু চলতি বা প্রমিত বাংলা কথাটা ব্যবহার করেছি। প্রমিত ইংরেজি যে একটা ডায়ালেক্ট সেটা পিটার ট্রাজিল সাহেব বই লিখে দেখিয়েছেন। বাংলার বিষয়টা কিন্তু তেমন নয়। কারণ প্রমিত বাংলা যে একটা ডায়ালেক্ট সেটা প্রথমেই স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। তাবড়-তাবড় রেফারেন্সগুলো এখন নেই। অধ্যাপক সৌমিত্র শেখরের মতে "বৃহত্তর নদীয়া জেলা ( বাংলাদেশের কুষ্টিয়াসহ) এবং ভাগীরথী নদী তীরের অধিবাসীদের মৌকিহিক ভাষা বাঙাল শিক্ষিত সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত হয়ে এ ভাষা রীতির বিকাশ ঘটেছে।" কাজেই প্রমিত চলতি বাংলা যে একটা ডায়ালেক্ট সেটা জেনেই কিন্তু এর চর্চা ও বিকাশ করে গেছেন সাহিত্যিক ও বৈয়াকরণিকরা, এর গায়ে শুদ্ধ , আদর্শ ইত্যাদি তকমা কিন্তু জড়িয়েছে অজ্ঞ লোকজন!
এগুলো খুবই চিরন্তন সত্য কথা। আদালতের রুল দিয়ে ভাষার গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করার চিন্তা করা বোকামো এবং প্রগতিবিরোধী। কোন ভাষারীতি টিঁকে থাকবে সেটা মানুষই ঠিক করবে।
না উত্তর-প্রজন্ম রবীন্দ্রনাথের ভাষায় কথা কইবে না, সেটা বাঞ্ছনীয়ও নয়। তবে রবীন্দ্রনাথও একেবারে হারিয়ে যাবেন না। কারণ মানুষ থেকেই ইতিহাস, ভাষা , সর্বোপরি সংস্কৃতি। কাজেই বাঙালির জীবনের সাথে সম্পৃক্ত নয় এমন কৃত্রিম কোন রীতির উদ্ভব হলেও সেটা এমনিতেই স্থায়ী হবে না। তার জন্য আদালতের খবরদারি নিশপ্রয়োজন।
দারুণ বলেছেন! ফারুকী গং নাটকে যে ভাষা ব্যবহার করেন -সেটা বাস্তব নয়, বাস্তবের অতি বিটকেল অতিরঞ্জন! আর বাস্তব শুধুমাত্র প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীদের প্রেমজীবন, বেকার ও ব্যাচেলরদের নিয়ে গঠিত নয়। এদের ভাষারীতিকে পুরোপুরি গুলশান-বনানী ডায়ালেক্টও বলা চলে না! "আবার জিগায়,"মাম্মা, জটিল, জোশ ইত্যাদি কথা যে সবাই ব্যবহার করে- তা নয়, এবং যারা ব্যবহার করে তারা যে নাটক থেকে প্রভাবিত হয়েই করে না- তারও গ্যারান্টি নেই। নাটক-চলচ্চিত্রই শুধু জীবনানুসারী নয়, কখনো কখনো জীবনও নাটক-চলচ্চিত্রকে অনুসরণ করে বৈকি! আমার ছাত্রজীবনে এফ,এম রেডিও(ড়েডীও!)তে আর,জে নুদরাত(পড়ুন নুদড়াত) এবং আরেক ভদ্রলোকের(ভদড়লোকেড়) কথাবার্তা ( নাকি কথাবাড়তা?) শুনে সত্যি খুব খারাপ লাগছিল। এরা কি আদৌ বাঙালি? ইংরেজিটাও যে এরা ভালো বলছিল তা কিন্তু নয়। পুরোটাই ছিল এদের বাঙালি পরিবারে বড় হওয়া এবং ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষার অসামঞ্জস্যের প্রভাব! তাহসান সাহেবে(ড়) গানে একটা 'র' উচ্চারণ(উচ্চাড়ন)ও শুদ্ধ নয়! এগুলো কিন্তু অশুদ্ধই। কারণ এগুলো কোন ডায়ালেক্টের মধ্যে পড়ে না!
তাহলে কি আমরা 'র' এর উচ্চারণ ভুলে যাবো? যথেচ্ছ মিশেলে যদি বাংলার অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে যায় তাহলে খামোখা ভাষা আন্দোলন করে অতগুলো প্রাণ খোয়ানোর কী দরকার ছিল? উর্দুই তো চলত! অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে জনজীবনের সাথে সম্পর্ক-রহিত ভাষারীতি জনতাই প্রত্যাখ্যান করে, তার জন্য আদালতের রুলজারি আসলে প্রতিক্রিয়াশীলতার উদাহরণ!
পিটার ট্রাজিলের বিরুদ্ধ মতবাদগুলোও উঠে আসলে লেখাটা পূর্ণতা পেত। আমি এ বিষয়ের লোক নই, তাই আপনার কাছে জানতে চাইছি।
নির্ঝর অলয়
চমৎকার মন্তব্যের জন্য শুরুতেই ধন্যবাদ। আপনার মন্তব্যের প্রেক্ষিতে আমার ধারণাগুলি বলছি, তবে এক্ষেত্রেও গোড়াতেই বলে রাখা দরকার যে আমার জানার পরিধি অতি সীমিত, ফলে ভুলভাল হতেই পারে --
১।
ব্যাকরণ বিষয়টা অদরকারী নয়। ভাষার স্ট্যাবিলিটির জন্য এর দরকার আছে। আর এই স্ট্যাবিলিটির দরকার ভাব বিনিময় ও যোগাযোগের অপ্টিমাম কার্যকারিতার জন্য। কিন্তু তাই বলে ব্যকরন ভাষা সৃষ্টি করে না, বা তার চালক বা কর্তাও না। বরং ভাষাই ব্যকরণের স্রষ্টা ও চালক। ব্যকরণ তার বিবরণ দেয় ও অনুসরণ করে। মানুষ অত্যন্ত সৃষ্টিশীল প্রাণী। আর সেই সৃষ্টিশীল প্রাণীর সমাজ ও ভাষাও সৃষ্টিশীল ও পরিবর্তনশীল। আর এইসব সৃষ্টিশীলতা ও পরিবর্তনশীলতার তাগিদে ভাষার বিবর্তনও অবধারিত, অন্তত সেটাই কাম্য। আর সমাজ ভাষার কোন পরিবর্তন গ্রহণ করে নিলে তা্র স্ট্যাবিলিটি ও কার্যকারিতা তখন অক্ষুন্নই থাকে - ব্যকরণ বইয়ের পাতায় কি থাকল বা না থাকল তাতে বোধহয় কিছু আসবে যাবে না। বরং তখন ব্যাকরণও সমপরিমানে বদলাতে বাধ্য হবে তাল মেলানোর জন্য। সম্পর্কের সম্পর্ক এক পর্যায়ে না এক পর্যায়ে এসে যাবেই। অতীতে কি আসে নি? সুতরাং আজ যা 'শুদ্ধ' ভবিষ্যতে তা নাও থাকতে পারে। আর ভবিষ্যতের সেই সম্ভাব্য 'শুদ্ধ' হয়ে ওঠা বর্তমানের অশুদ্ধ প্রয়োগটা/গুলিকে কেউ না কেউ কোন-না-কোন সময় তাবৎ 'শুদ্ধের' তর্জনীনৃত্যের মুখের উপ্রেই চালু করবে, করতে হবে। এমনি এমনি তো আর সেটা আসবে না। তবে এটা বোধহয় অত্যন্ত দীর্ঘমেয়াদী ব্যাপার। রাতারাতি হবে না। হয় না। সেই রকম অভাষাগত বহিরাগত উদ্দেশ্যপূর্ণ প্রয়াসের সমর্থক আমি নই। আমি এইটুকুই বুঝি।
২। "গুরুচণ্ডালি"-টা আসলে স্টাইলিস্টিক ইস্যু। আপনি যদি সাধু-চলিতের মিশ্রণের কথা বুঝিয়ে থাকেন, তাহলে বলব এখন এই গুরুচণ্ডালির প্রসঙ্গটাই অপ্রাসঙ্গিক হতে বসেছে। কারন তার গুরু 'সাধু' ভাষার অস্তিত্বই এখন আর নেই বললে চলে, ডাইনোসরের মতই বিলুপ্তপ্রায়। অল্প দু'য়েকটা ক্ষেত্রে যাও আছে এখনও (প্রশাসন, আইন, ধর্মীয় গ্রন্থ, ইত্যাদি), সেটাও আর বেশি দিন থাকবে না। এখনই না থাকার অবস্থায় চলে গেছে। অথচ এই 'সাধু' ভাষা আমাদের ভাষার কত বিশাল একটা অংশ! আমাদের ক্লাসিক্সগুলির বৃহত্তর অংশই বোধহয় ভাষার এই রূপেই লেখা - রবীন্দ্রনাথ-বঙ্কিম থেকে শুরু করে আমাদের সাহিত্যের 'রেনেসাঁ' যুগের প্রায় সব পুরোধা ও পুরোহিতের বেশির ভাগ রচনাই এই রূপেই লেখা। অথচ এটাই আমরা সময়ের বিবর্তনে বাদ দিয়ে দিয়েছি। সুতরাং ব্যাকরণেরও বিবর্তন আছে বলেই তো দেখা যাচ্ছে। আর মিশ্রণ? স্টাইলিস্টিক মিশ্রণ আসলে সাব্জেক্টিভ পার্সেপশনের ব্যাপার। সমাজ গ্রহণ করে নিলে তখন আর কিছু আসবে যাবে না, যদিও মিশ্রণের পরীক্ষাকালীন যুগের কিছু মানুষের তাতে অস্বস্তি হবে ও বিরোধিতা আসবে। আমাদের ইতিহাসে এমন তো হয়েইছে। আপনি যদি সংস্কৃতোদ্ভব শব্দের সাথে দেশি বা গুরুগম্ভীরের সাথে হাল্কা বা আনুষ্ঠানিকের সাথে অনানুষ্ঠানিকের মিশ্রণের কথা বলেন, তাহলে ট্রাজিল সাহেব স্টাইলিস্টিক ও রেজিস্টারের মিশ্রণের ব্যাপারে যা বলেছেন, আমার মনে হয় এখানেও সেটা খানিকটা প্রযোজ্য হবে। তাছাড়া সচলেই বোধহয় এর অনেক চমৎকার নমুনা আছে। এ বিষয়টা শেষমেশ মনে হয় একটা পলিটিকাল ইস্যুতে পর্যবসিত হয় - লড়াইটা বোধহয় এই মিশ্রণ ও পরিবর্তনের উদ্দেশ্য ও কর্তৃত্ব নিয়ে, মিশ্রণ বা পরিবর্তন নিয়ে নয়।
এ প্রসঙ্গে আমার একটা প্রশ্ন ছিল। আমাদের আঞ্চলিক ভাষাগুলিতে তো প্রমিত বাংলার সাথে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সিনটেক্সে হাল্কা-পাতলা পার্থক্য বা বৈচিত্র্য দেখা যায়। এই পার্থক্য বা বৈচিত্র্যগুলি যদি সময়ের সাথে আমাদের প্রমিত রূপেও ঢুকে যায় মানুষের বাস্তব চর্চার হাত ধরে, তাতে কি কোন অসুবিধা আছে? থাকলে সেটা কি? আমি এর পক্ষে উকালতি করছি না, স্রেফ বিরোধী যুক্তিটা জানতে চাচ্ছি।
৩।
আমি "প্রমিত বাংলা" - কথাটারও ঠিক পক্ষপাতী নই। এই শব্দবন্ধটা উচ্চারণ করলেই মনে হয় বাংলার অন্যান্য রূপগুলিকে খানিকটা হেয় করা হচ্ছে - ওগুলি যেন ঠিক "পুরোপুরি" বাংলা নয়, বা পুরো "বাংলা" হওয়ার সম-মর্যাদাযোগ্য নয়। সেজন্যে 'বাংলা' শব্দটা প্রমিতের সাথে আলাদা ভাবে জুড়ে দিয়ে সেটা এসার্ট করা হয়, চট্টগ্রাম-সিলেট-নোয়াখালির "আঞ্চলিক ভাষা" বলা হয় - "নোয়াখালির বাংলা" বা "সিলেটের বাংলা" বলা হয় না। এই শব্দবন্ধ বা ক্যাচফ্রেইজটার এই কনোটেশন আমার স্বকপোলকল্পিত বলতে পারতেন হয়তো, যদি না আঞ্চলিক ভাষাকে হেয় করার একটা দীর্ঘ ইতিহাস আমাদের থাকত। সুতরাং আমি একে "প্রমিত বাংলা"-ও বলব না, বলব "প্রমিত উপভাষা", বা আরও ভাল হয় "সাধারণ উপভাষা" (common-অর্থে) বললে।
৪।
উঁহু! ব্যাপারটা অত হাল্কা নয় মোটেই। প্রমিত ইংরেজি যে একটা ডায়ালেক্ট সেটা পিটার ট্রাজিল সাহেবই মনে হয় না প্রথম বলেছেন বা তার আগে জানা ছিল না। আবার তথাকথিত প্রমিত বাংলা যে স্রেফ একটা 'ডায়ালেক্ট', এটা আধুনিক বিশেষজ্ঞদের জানা থাকলেও সাধারণ ভাবে স্বীকৃতিটা মনে হয় অনেক সাম্প্রতিক ও আধুনিকতর। বাংলার অন্যান্য আঞ্চলিক ও অন্যান্য রূপ যে তথাকথিত "আসল" বাংলার 'ভ্রংশিত', 'অপভ্রংশ' , 'বিকৃত', 'প্রাকৃত', বালখিল্য, ঝুটা-নকল বা 'আসল' নয়, অপূর্ণ-অপুষ্ট বা প্রতিবন্ধী , অসুন্দর-বিশ্রী এমনকি প্রায় অশ্লীল, হীণ হেয় বা খাটো, অসংস্কৃত বা অসভ্য - এধরণের অনেক কথাবার্তা ব-হু প্রচণ্ড রকম রথী-মহারথীরাও কিন্তু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দীর্ঘকাল ধরেই বলে গেছেন, এবং এখনও অনেকে ভাবেভঙ্গিতে তেমনটাই বলেন। আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি-বুদ্ধিবৃত্তির ইতিহাস জুড়েই এর উদাহরণ আছে। যারা বলেন, তারা সবাই অজ্ঞ, মূর্খ, ফেলনা বা ফালতু লোক নন! তাদের অনেকেই বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি-বুদ্ধিবৃত্তির জগতে পুরোধা ব্যক্তিত্ত্ব। রাজনৈতিক ভাবে ইংরেজদের মত বাংলার নিজস্ব কোন রাজতন্ত্র না থাকলেও, বাস্তব সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চর্চায় তেমনটাই অনেকখানি দাঁড়িয়ে গেছিল।
সুতরাং "বাংলার বিষয়টা কিন্তু তেমন নয়" - কথাটার সাথে আমি কিন্তু ঠিক একমত হতে পারছি না। এটা প্রায় তেমনই, হয়তো আরও বেশি। এর সাথে পরোক্ষে এমনকি বর্ণপ্রথারও যোগ ছিল। পাকিস্তানি আমলে এর উপর এথনিক ক্লিনসিং-এর মত লিঙ্গুইস্টিক ক্লিনসিং-এর যেমন চেষ্টা হয়েছিল, ঊনবিংশ শতকেও কিন্তু প্রায় একই রকম লিঙ্গুইস্টিক ক্লিনসিং ভিন্ন প্রান্ত থেকে অত্যন্ত সফল ভাবে এর উপর চালানো হয়েছিল। সেই ইতিহাস আমরা সময়ের দূরত্বের কারনে ততটা জানি না বা খেয়াল করি না, কিন্তু দুই প্রান্তের এটিচ্যুডের ভস্মাবশেষই কিন্তু কমবেশি এখনও প্রচ্ছন্ন ও ক্ষয়িষ্ণু ভাবে হলেও প্রবহমান।
যাই হোক, "প্রমিত বাংলা যে একটা ডায়ালেক্ট" - এটা এখনও কিন্তু অনেকেই মন থেকে পুরোপুরি মেনে নিতে পারেননি। মেনে নিতে পারেননি আমাদের ক্ষেত্রে এটার প্রাসঙ্গিকতা মূলত 'উপযোগিতা'-র ক্ষেত্রে, কিছুটা অভ্যাসের কারনেও হয়তো, কিন্তু কোন মেটাফিজিকাল বা আধিবিদ্যিক কারনে নয়।
৫। নদীয়া ভিত্তি হলেও, শোধণ ও প্রসেসিংটা মনে হয় স্পেসিফিকালি কোলকাতাতেই হয়েছিল। সে সময় অন্যান্য বিবেচনাও এসে তার সাথে জুটেছিল, যেমন এখন জুটছে অনেক ক্ষেত্রে কারও কারও বেলায়। এসবই এটাকে আমাদের ভৌগলিক, এমনকি সামাজিক কন্টিনিয়ামের স্বাভাবিকত্ব থেকে বাইরে নিয়ে গেছে কিছুটা।
৬।
আমরা 'র' এর উচ্চারণ ভুলে যাব কি যাব না, ভুলা উচিত কি উচিত না - এর উত্তর আমার জানা নেই। তবে এটা আন্দাজ করি যে, এমন অনেক কিছুই আমরা ভুলে গেছি। তাতে আমাদের ভাষা দরিদ্র হয়ে যায়নি। আমাদের বর্ণমালা, বানানরীতি আর ব্যাকরণের দিকেই একটু তাকিয়ে দেখুন না। এর মধ্যে অনেক কিছুই এখন আর নেই, যা এক সময় ছিল। আবার যেগুলি এখনও আছে, তারও অনেক কিছুরই অস্তিত্ব বা ব্যবহারের যৌক্তিকতা এখন প্রশ্নসাপেক্ষ। আশা করি উদাহরণ দিয়ে দেখাতে হবে না। সুতরাং "তাহলে কি আমরা 'র' এর উচ্চারণ ভুলে যাবো" কি যাব না, এটা খানিকটা আবেগী প্রশ্ন - অনেকটা ঐ হাজার বছর পরেও রবীন্দ্রনাথের ভাষায় কথা বলব কি বলব না-র মত। এমন আবেগ থাকাটা অন্যায় নয়, বরং এটাই স্বাভাবিক। আমারও আছে। কিন্তু ভবিষ্যতে কি হবে না হবে, সে ইচ্ছেটা উত্তর-প্রজন্মের উপর (বা এমনকি সমকালীনদের উপরও) চাপিয়ে দেয়ার আমি কে? সমস্যা বাধে তখনই, যখন কেউ শ্রেণী-অর্থ-আইন-রাষ্ট্র-মিডিয়া-সমাজের ক্ষমতার বলয়ে বা তার কাছাকাছি থাকার সুবাদে, বা তাদের পৃষ্ঠপোষকতা বা সুবিধাভোগী হওয়ার সুবাদে অনেকটা একতরফা ভাবে এবং ক্ষেত্রবিশেষে উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে বলা, চাপিয়ে দেয়া বা প্রচলনের সুযোগ পান - অন্যদের সমসুযোগের অভাবের বিপরীতে। জনতা প্রত্যখ্যান করে, আবার শক্তি ও একতরফা প্রচারণায় প্রভাবিত ও বিভ্রান্তও হয়। আপনার কমেন্টেই সেটা উল্লেখ করেছেন। সুতরাং আমার কাছে এটাই বেশি আপত্তিকর। সব ধরণের বৈচিত্র্যকে ধারণ করতে ও উৎসাহ দিতে পারে এমন একটা অপেক্ষাকৃত লেভেল ও প্রশস্ত প্লেয়িং গ্রাউন্ড থাকলে মনে হয় র/ড় নিয়ে, বিটলামি বা আঁতলামি - কোনটা নিয়েই তেমন মাথাব্যাথার কিছু থাকত না। এখন ব্লগোস্ফেয়ার ব্যালেন্সিং/লেভেলিং/ব্রডেনিং-এর ভূমিকা কিছুটা পালন করছে, কিন্তু সেখানেও খালিদি আঙ্কেলরা দড়িদড়া নিয়ে অপেক্ষা করছেন। তাদের ভাষায় বাঙালি (খালিদিরা ছাড়া আরকি) নাকি এখনও ম্যাচিউরড হয়নি, তাদের বোধবুদ্ধি বা সীমাজ্ঞান/মাত্রাজ্ঞান হয়নি এখনো। অর্থাৎ শিশুই রয়ে গেছে। এইজন্যে তাদের শাসনে রাখা দরকার। যাতে 'যথেচ্ছ' আচরণ করে দেশ ও জাতিকে 'বিপন্ন' করতে না পারে (ঠিক এই শব্দগুলি ব্যবহার করেই তারা তাদের অসদুদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চান এবং এই ধরণের আশঙ্কায় আতঙ্কিত হওয়ার আসলে কিছু নেই বুঝানোর জন্যই কোট করলাম, আপনাকে ঠাট্টা করার জন্য না)। এইজন্যেই অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা দরকার, ব্লগমাধ্যম নীতিমালাও আসবে এরপর। এটা সেই অতিপরিচিত-অতিপুরাতন ভীষণ বিকট-বিভৎস ও অশ্লীল সামন্তবাদী, বর্ণবাদী, শ্রেণীবাদী, স্বৈরাচারী ও ঔপনিবেশিক মনস্তত্ত্ব ও অশুভ কুযুক্তির বহিঃপ্রকাশ। এই ধরণের কুযুক্তি দিয়েই সহস্রাধিক বছর বর্ণপ্রথা টিকে ছিল, বৃটিশরা ২০০ বছর ধরে সাম্রাজ্যবাদ বিস্তার করেছিল, গাদ্দাফি থেকে শুরু করে সাদ্দাম ও মুবারকরা তাদের স্বৈরতন্ত্র বহাল রেখেছিল ২০শ শতাব্দীতে (তাদের সম্প্রতিকালের ভাষনগুলি মনে আছে?)। পাকিস্তানিদেরও বাঙালিদের বিরুদ্ধে এধরণের কুযুক্তি ছিল। আর এই শ্রেণীবাদ ও বর্ণবাদের ভস্মাবশেষটাই (হোপফুলি!) আমি খানিকটা সুদূর হলেও খুঁজে পাই প্রমিত-অপ্রমিত বিতর্কে যখন প্রমিতের 'উপযোগিতার' প্রশ্ন বাদ্দিয়ে এর উপর এক ধরণের দেবত্ব বা আভিজাত্য আরোপ করে ভিন্নতর সব স্বাভাবিক চর্চার কণ্ঠরোধের প্রয়াস নেয়া হয় বা তাকে হেয় করা হয়। এসব কিন্তু বাস্তবেই হয়। অতীতে নিম্নবর্ণের মানুষের জন্য 'দেবভাষা' সংস্কৃত-চর্চা নিষিদ্ধ ছিল মনে আছে? সেই দেবত্ব মনে হয় প্রমিত বাংলার উপরও খানিকটা আছর করেছে। খালিদি আঙ্কেল হোক আর আমি যে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ত্বের কথা বলেছি, তাদের সবার না হলেও সমশ্রেণীর অনেকের মধ্যেই আমি এই মানসিকতাটা অনুভব করি। এটা সব সময় অত তীব্র, সিরিয়াস বা সচেতন নয় হয়তো, কিন্তু গোঁড়াটা একই জায়গায়। আমার বিরোধিতা এখানেই, এই মনস্তত্ত্বে - প্রমিতের চর্চায় বা এর প্রমিত হিসেবে স্বীকৃতিতে না। উপোযোগিতার ক্ষেত্রে তো নয়ই। আমি বরং তারই পক্ষে, যা আমার লেখাতেই উল্লেখ করেছি। আর হ্যাঁ, এর বিপরীতে আমি যে কোন গোপন বা প্রকাশ্য সাম্প্রদায়িক, সঙ্কীর্ণ আঞ্চলিকতাবাদী বা ভুয়া জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিরও সমভাবে বিরোধী। এর কিছু কিছু নমুনাকে আমার স্রেফ বাঁদরামি মনে হয়।
আমার বক্তব্য বুঝাতে পারলাম?
৭। ভাষা আন্দোলনটা স্রেফ র/ড় বা '৫২-পূর্ব প্রমিতরূপকে টিকিয়ে রাখার জন্য হয়নি বলেই আমার ধারণা। এমনকি শুধুমাত্র ভাষার জন্যেও না (যদিও সেটা কেন্দ্রীয় ও তাৎক্ষণিক কারন ছিল)। এর আসল প্রেরণা মনে হয় আরও অনেক গভীর ও ব্যপক ছিল। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, বাইরে থেকে কেউ আমাদের "আইডেন্টিটি" জোর করে বা কলমের এক খোঁচায় মুছে দিবে, বা এই আইডেনটিটির চরিত্র কি হবে তা আমাদের ইন্টার্নাল গণতান্ত্রিক ডিস্কাশন ও সেই অধিকারের প্রয়োগ ছাড়াই জবরদস্তিমূলক ভাবে ডিক্টেট করবে- এই ব্যাপারটাই তখনকার তরুণদের কাছে এত অসহনীয় বা অগ্রহণযোগ্য মনে হয়েছিল। সে জন্যেই কার্জন হলে সেদিন তখনকার প্রায় অবিসম্বাদিত নেতা জিন্নাহ্র মুখের উপর সাথে সাথে 'না-না' প্রতিবাদ উঠেছিল। প্রমিত বা অপ্রমিতের জোরাজুরির বিরুদ্ধে আমার আপত্তিটাও প্রায় এখানেই। আর ভাষা-আন্দোলনও এজন্যেই ব্যর্থ হয়নি, পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের ভ্রূণ হিসেবে প্রমানিত হয়েছে। স্রেফ র/ড় জাতীয় বিষয় হলে এটা হত না।
৮। আমিও এই বিষয়ের লোক নই, অনেক আগে অতি সামান্য হাল্কা-পাতলা একটু পড়া ছাড়া। তাই ট্রাজিল বিষয়ে এর চেয়ে খুব একটা বেশি কিছু লেখার যোগ্যতা আমার নেই। আপনিই বরং লিখুন না কেন?
আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে অনেক কথা বলে ফেললাম। হয়তো অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী ও বাগাড়াম্বড় হয়ে গেল। কি আর করা, তেমনটা হলে আশা করি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
****************************************
আমি কিন্তু তা বলিনি। আমি বলছি বয়োজ্যেষ্ঠদের আবেগটা বোঝার চেষ্টা করতে। র/ড় এর উচ্চারণ নিয়ে নিশ্চয় ভাষা আন্দোলন হয়নি- তেমন বালখিল্য কথা আমিই কি বলেছি?
তা তো হয়েইছিল, কিন্তু আমি বলছিলাম যে, বাংলা প্রমিত ভাষা বলতে যেটাকে বোঝানো হোত, সেটা যে একটা ডায়ালেক্ট -সেই মোদ্দা সত্যটা মেনে নিয়েই ভাষাবিদরা তার গঠন করেছিল। এর গায়ে বনেদিয়ানার জ্যাঠামো আরোপ করেছে আমজনতা, সুনীতিকুমার-বিদ্যাসাগর বা পরবর্তীতে রবিঠাকুর-প্রমথ চৌধুরীরা কিন্তু জোর করে আরোপ করে দেননি। প্রমিত ইংরেজির ক্ষেত্রে কি ডায়ালেক্ট কথাটা ভাষাবিদরা শুরুতেই স্বীকার করেছেন? তাহলে তো ট্রাজিল সাহেবের কৃতিত্ব একটু ফিকে হয়ে যায়। আমাদের ক্ষেত্রে কিন্তু শুরুতেই বলে নেয়া হয়েছে "বাপু আমার দেশের বাড়ি নদীয়া।" আমি শুধু এই ব্যতিক্রমটা দেখিয়েছি। আপনি যা বলেছেন তার সাথে তো আমি প্রায় একমতই পোষণ করেছি। ভাষার ফতোয়াবাজদের আমি গুরুত্ব দিই না, কারণ এরা তো নিজেরাই ঠিক জানে না!
দারুণ পছন্দ হয়েছে আপনার দেয়া নাম। এখন থেকে এটা ব্যবহার করব।
আপনি তো এখানে আমার মনের কথাই বলেছেন। র/ড় এর সামান্য একটা উদাহরণ আমি দিয়েছি কিছু ব্যক্তির অভাষাগত বহিরাগত এবং আরোপিত পরিবর্তনকে বোঝানোর জন্য। আসলে উচ্চারণগত তফাতের মূল কারণ অঞ্চল, সামাজিক স্তর নয়। ঘটি রিকশাওয়ালারাও ঘটি ভাষাই বলে। নিজের মায়ের ভাষাটাকে জোর করে মার্কিন অ্যাকসেন্ট আরো(ড়ো ;)প করে উচ্চারণ করে নিজেদের উন্নত প্রাণী হিসেবে জাহির করবার চেষ্টা বস্তুত মূর্খতা এবং হীনমন্নতার জারজ সন্তান। আমি এদেরকে প্রগতিবাদীর দলে ফেলতে নারাজ। ভাষার ফতোয়াবাজদের মত এদের আরোপিত ও জনবিচ্ছিন্ন ভাষাও এমনিতেই টিকবে না- তারজন্য হাইকোর্টের সময় বরবাদ করার কোন দরকার নেই। আশা করি আমি আমার বক্তব্য স্পষ্ট করতে পেরেছি! চট্টগ্রাম, সিলেট বা ময়মনসিংহের একটা খেটে খাওয়া মানুষের উচ্চারণ কিন্তু 'ভুল' না, সেটা আঞ্চলিক। কিন্তু সর্বসাধারণের জন্য সাধারণ উপভাষা ব্যভারের সময় উচ্চারণকে "উচ্চাড়ন" বললে সেটা কিন্তু ভুল। ব্যাকরণ শুধু এটাকেই ধরে না,অনেক কিছুকেই ধরে রাখে। আমি একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলাম মাত্র।
আপনার আলোচনার স্পিরিট খুব ভালো লাগল। অনেক কিছু শিখলাম। সিনট্যাক্স নিয়ে আর কচকচিতে যেতে চাচ্ছি না যেহেতু আপনার সাথে আমি প্রায় ৯৯% একমত। বাকিটুকু দ্বিমতই থাক -তাতেই পৃথিবীর সৌন্দর্য।
নির্ঝর অলয়
চমৎকার লিখেছেন! আপনার আলোচনা থেকেও অনেক কিছু শিখলাম আমি।
আর হ্যাঁ, 'পৃথিবীর সৌন্দর্য' ও তার বৈচিত্র্য রক্ষায় আমিও আপনার সাথে সম্পূর্ণ একমত।
****************************************
আপনি যা লিখেছেন তার সঙ্গে প্রায় ১০০% একমত। শুধু নিজের কিছু চিন্তা এখানে যোগ করার চেষ্টা করছি। আমি বাংলা বানানে পটু নই তাই সবার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি প্রথমেই।
ভাষা বিবর্তিত হবে এইটি স্বাভাবিক। ১০০ বছর পর লোকে রবীন্দ্রনাথ পড়ে বুঝবে কিনা সে প্রশ্ন তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয় কারণ মানুষের আগ্রহ থাকলে তা পড়ার চেষ্টা করবে। শেক্সপিয়ার তো ৪০০ বছর আগে লিখে গেছেন। কিন্তু তারপরও যারা শেক্সপিয়ার নিয়ে পড়তে চান পড়েন। যাদের বুঝতে অসুবিধা হয় তারা আধুনিক গদ্যে প্যরাফ্রেইজ পড়েন। তাই ১০০ বছর পর মানুষ রবীন্দ্রনাথ বুঝবে কিনা বা পড়বে কিনা তা নিয়ে আমি একটুও চিন্তিত নই।
তবে আমার মাথাব্যথা অন্যত্র। ইংরেজি ভাষার ইতিহাসের সঙ্গে বাংলা ভাষার ইতিহাস তুলনা করতে গেলে কিছু অসুবিধা রয়েছে। চসার সহ আরও কয়েকজন কবির চেষ্টায় এবং একই সঙ্গে ইংল্যন্ডের রাজা ও জনগণের জাতীয়তা বোধ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীর শুরু থেকেই ইংল্যন্ডের প্রধান ভাষা হয়ে উঠে ইংরেজি। অর্থাৎ অন্তত ৫০০ বছর বা তারও বেশী সময় ধরে ইংরেজি ভাষা ইংল্যন্ডে রাজত্ব করে চলেছে। অপরদিকে বৃহত্তর বাঙলায় ১৯৭১ সালের আগে কখনোই বাংলা ভাষা প্রশাসনিক ভাষা ছিলনা। আর পাকিস্তান আমলে বাংলা ভাষার প্রমিত রূপকে ধবংস করার জন্য পাকিস্তানিরা এবং তাদের অনুগত বাঙ্গালিদের বেশ ধারাবাহিকভাবে চেষ্টা করতে দেখা গেছে। একই সঙ্গে তাদের আঘাতের মূল লক্ষ্য বস্ত ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এজন্য আপনার সেই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের প্রজন্মের যারা তাদের অনেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং প্রমিত বাংলার তৎকালীন রূপ অক্ষুণ্ণ রাখার ব্যপারে এতোটা স্পর্শকাতর।
তাদের এ স্পর্শকাতরতা মাঝে মধ্যে আমার নিজের কাছেও হাস্যকর লাগে। তবে যখন ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে (পূর্ব পাকিস্তান) উর্দু মিশ্রিত বাংলা প্রচলনের জন্য প্রাণান্ত চেষ্টার ইতিহাস পড়ি তখন উপলব্ধি করি যে ঐ প্রজন্মের লোক বাংলার প্রমিত রূপ নিয়ে এতোটা স্পর্শকাতর কেন। দ্বিতীয়ত ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করা হয় রেডিওতে। এর বিরুদ্ধেও আন্দোলন করতে হয় আমাদের ঐ প্রজন্মের লোকদের।
ঠিক এমনটা না হলেও কাছাকাছি সমস্যা ইংরেজি ভাষাকেও মোকাবেলা করতে হয়েছে ১০৬৬ সালের নরমানদের ইংল্যান্ড জয়ের পর থেকে শুরু চসারের সময় পর্যন্ত। রাজভাষা ছিল ফরাসি এবং ইংরেজি ছিল অবহেলিত। তবে যা বললাম, ৫০০ বছর আগেই এ সমস্যার অবসান ঘটে ইংল্যান্ডে।
আর আমাদের সময়ে ফারুকিদের এবং ডিজুস ভাই ও বোনদের বাংলা ভাষার প্রমিত রূপকে বিদায় করার সচেতন প্রচেষ্টার কারনে আমাদের অনেকের মধ্যেই প্রমিত রূপকে ধরে রাখার ব্যপারে একই ধরনের স্পর্শকাতরতা গড়ে উঠলে একটুও অবাক হবো না। তাই ভাষার প্রমিত রূপ নিয়ে এ বিতর্ক ও স্পর্শকাতরতা সহজে বাংলাদেশে শেষ হবে বলে আমার মনে হয়না।
আর ব্লগে বাংলা ভাষার যে চর্চা হচ্ছে তা প্রমিত রূপকে সমৃদ্ধ করছে ও বাড়তি কিছু যোগ করছে- অন্তত আমি তাই মনে করি, কারণ ব্লগে যারা লিখছেন তাদের মধ্যে বাংলা প্রমিত রূপকে ধবংস করার কোন আকাঙ্ক্ষা নেই যেমনটি ছিল পাকিস্তান আমলে পাকিস্তানিদের এবং তাদের বাঙালি দোসরদের বা এ যুগে ফারুকি ও ডিজুস ভাইদের। বরং ব্লগে যারা লিখছেন তাদের সিংহ ভাগই লিখছেন বাংলা ভাষার প্রতি মমত্ববোধ থেকে। তাদের কারনে বাংলা ভাষার প্রমিত রূপের আরও প্রসার ঘটছে বলে আমার মনে হয়।
সবশেষে, অত্যন্ত সুলিখিত একটি লেখার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
খুবই সুচিন্তিত মন্তব্য! আরো একটা ব্যাপার, আইয়ুব খান -মোনেম খানের পাশবিক জাঁতাকলের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক আন্দোলন হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে। নজরুলকে কেন্দ্র করে সরাসরি নয়। নজরুলের মত মহান সাহিত্যিককেও এরা আরবি-ফারসি নামের মহিমায় জাতীয় কবি করেছে- এটা আসলে নজরুলের অপমান। বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে আবেগটা তাই একটু বেশি!
নির্ঝর অলয়
মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
আপনার মন্তব্য থেকে প্রথম যে জিনিষটা বুঝলাম, তা হল -
১। ইংরেজি ৫০০ বছর সময় পেয়েছে তার নিজের প্রমিত ও রাষ্ট্রীয় অবস্থানে স্থিত ও সিকিউরড হতে। এজন্যে এখন তার বেশি স্পর্শকাতর না হলেও চলে। সে জায়গায় বাংলা বিরোধিতার, এর ইনসিকিউরড অতীত এবং এর রাষ্ট্রীয় সিকিউরড অবস্থানের বয়স ৫০ বছরও হয়নি। এটা অনেক সাম্প্রতিক। ফলে এখনও অনেকের মধ্যে ইনসিকিউরিটি রয়ে যেতেই পারে।
আপাত দৃশটিতে আপনার কথায় যুক্তি আছে। তবে আমি পুরোপুরি একমত হতে পারছি না। আপনি যেটা বিবেচনায় আনেননি, তা হল - ইংরেজি ভাষিক ভাবে স্বদেশে সিকিউরড হওয়ার পরেও বিশ্বজুড়ে এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও বিশ্বের বৃহত্তম সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল - এবং সুদীর্ঘকাল - শত শত বছর ধরে - সেটা শাসন করেছে। এই সময় তারা জ্ঞানে-বিজ্ঞানে-প্রযুক্তিতে-শিল্পেসাহিত্যে-ইন্ডাস্ট্রিতে-বাণিজ্যে অভূতপূর্ব উন্নতি লাভ করেছে, যার অনেকটাই আবার তাদের সাম্রাজ্যজনিত সমৃদ্ধির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ফলশ্রুতি। লম্বা একটা সময় তাদের সমকক্ষ ছিল না কেউ। এই সাম্রাজ্যজনিত আর্থিক-রাজনৈতিক-সামাজিক-সামরিক-সাংস্কৃতিক শক্তিমত্তা, একচ্ছত্রতা, স্থিতিশীলতা ও অনিরাপত্তাহীণতাই তাদের ঐ সিকিউরিটি ও আত্নবিশ্বাস দিয়েছিল যা ওদের পূর্বতন ভাষিক ইনসিকিউরিটির ব্যাপারে তাদের স্পর্শকাতরতা অতিক্রম করতে সহায়তা করেছে।
আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি অদূর কিম্বা সুদুর ভবিষ্যতেও - আগামী কয়েক শতাব্দীর মধ্যেও - আমাদের বর্তমান ভূখণ্ডের বাইরে এক ইঞ্চি জমিতেও সাম্রাজ্য বিস্তার করতে পারব, এবং ওদের মত করেই 'সিকিউরড' হতে পারব, এবং হয়ে আমাদেরও 'স্পর্শকাতরতা' দূর করতে পারব? এইভাবে চিন্তা করলে, অনন্তকালেও আমাদের আর 'সিকিউরড' হওয়া হবে না, আর আমাদের স্পর্শকাতরতাও দূর হবে না! কারন ঐ রকম অপ্রতিদ্বন্দ্বী সাম্রাজ্যের মালিক হয়ে আত্নবিশ্বাস অর্জনের কোন বাস্তবসম্মত সম্ভাবনাই নেই আমাদের। তাহলে কি আমরা অনন্তকাল ধরেই এই রকম আপনার ভাষায় "হাস্যকর"-রকম ইনসিকিউরড আর লজ্জাবতী লতার মত স্পর্শকাতর রয়ে যাব ভাষার ব্যাপারে? কোনদিনই আত্নবিশ্বাস ভরে মাথা তুলে দাঁড়াবো না? আপনার এই যুক্তি আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না ঠিক।
২। ভাষার বিবর্তনের বিষয়টা কিন্তু হাওয়া থেকে হয় না। অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-জ্ঞানসম্পদগত-বস্তুগত-মুল্যবোধগত-লাইফস্টাইল ও জীবনযাত্রাগত সহ সমাজের বাস্তব অন্যবিধ অসংখ্য পরিবর্তন-বিবর্তন ও জটিলতা বৃদ্ধির তাগিদে ও চ্যালেঞ্জের মুখেই কিন্তু তার সাথে তাল মেলাতে ভাষার বিবর্তন ত্বরাণ্বিত হয় বলে মনে হয়। এই পরিবর্তনগুলি ও এই পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ ৫০০ বছর, এমনকি ১৫০ বছর আগেও যা ছিল - এখন তার থেকে অনেক-অনেক-অনেক বেশি! সভ্যতার বিবর্তন প্রায় এক্সপোনেনশিয়ালি হচ্ছে। কার্ল স্যাগান না কে যেন বলেছিলেন, গত ২০০০ বছরেও যা বৈজ্ঞানিক উন্নতি হয়নি মানব সমাজে, বিংশ শতাব্দীর শুধু শেষার্ধের ৫০ বছরেই তার চেয়ে বেশি হয়েছে! আর এই পরিবর্তনগুলি আমাদের সমাজের কাঠামো, মানুষে-মানুষে ও প্রতিষ্ঠানের সাথে তার সম্পর্ক, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, জীবনাচার ইত্যাদি দুমড়ে-মুচড়ে আমূল বদলে দিয়েছে ও দিচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে এই পরিবর্তনের গতি বা হার আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে, দ্রুততর হচ্ছে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে অকল্পনীয় উন্নতির কারনে বিশাল বিশ্ব এখন আমাদের, না গ্রাম না - স্রেফ হাতের মুঠোয়। এই সচলায়তনের কথাই চিন্তা করুন না। আপনি কোথায় এখন? হিমালয়ের চূঁড়ায়, মারিয়ানা ট্রেঞ্চের তলায়, নাকি মার্সে? আমিই বা কোথায়? তারেক অণু কোথায়? অথচ সবাইই একই সাথে এখানে। ২০ বছর আগেও কি বাংলাদেশে আমরা এটা কল্পনা করতে পারতাম? ৫০০ বা ১৫০ বছর আগে ভিক্টোরীয় যুগেও পরিবর্তন বা বিবর্তনের এই প্রচণ্ড গতি ছিল তো নাইই - কল্পনাও করা যেত না। সবকিছুই তুলনামূলকভাবে অনেক আস্তে ধীরে চলত, ফলে আমাদের সময় যে চ্যালেঞ্জ তাদের সময় সেসব এত ঘনীভূত রূপে ছিল না, এত তাড়াহুড়ো ছিল না। এখন এক প্রজন্মের ভিতরেই যে পরিবর্তন হয়, তখন সেটা হতে মনে হয় কয়েক প্রজন্ম লেগে যেত। সুতরাং মোদ্দা কথা হচ্ছে - দশকের পর দশক ধরে একাধিক প্রজন্ম পেরিয়ে যাওয়ার পরেও "স্পর্শকাতর" হয়ে বসে থাকার বিলাসিতা এখন আর শোভা পায় না, পোষায় না।
৩। উপ্রের আরেক মন্তব্যে যেমন বলেছি, আমার ধারণা ভাষা-আন্দোলন স্রেফ ভাষার 'প্রমিত রূপ' তো নয়ই, এমনকি স্রেফ ভাষাটাই এখানে সব ছিল না। ভাষা ছাড়াও মূল বিষয় মনে হয় ছিল সমমর্যাদা, গণতান্ত্রিক অধিকারের এস্পিরেশন, ইত্যাদি। ৪৮-এ জিন্নাহ কার্জন হলে প্রমিত বাংলার বিরুদ্ধে কিছু বলেননি বা কোন ভাষার প্রমিত-অপ্রমিত রূপ নিয়েই কিছু বলেননি। স্রেফ অন্য সব ভাষাকে বাদ্দিয়ে মাত্র ৭%-এর ভাষা উর্দুকে বাকি ৯৩% জনগনের উপর, বিশেষ করে সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাগুরু ৫৪% বাঙালির উপর জবরদস্তিমূলক ভাবে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। এটা বাংলার প্রমিত রূপ নয়, গোটা বাংলা ভাষার ও গোটা বাংলাদেশের সমস্ত বাঙালির উপর আঘাত ছিল। কোন বিশেষ রূপ-টুপের উপর নয়। তারা গোটা বাংলা ভাষাটাকেই একটা ডিসেনফ্র্যাঞ্চাইজড সেকেণ্ড ক্লাস ভাষা বানাতে চেয়েছিল ও সেইসাথে বাঙালিদের, পরবর্তী কালে ঐ সব আরবিতে লেখা বা রবীন্দ্র-বিরোধিতা ইত্যাদি ছিল প্রথম ও মূল লক্ষ্যের সাপোর্টিভ সেকেণ্ডারি ফাত্রামি।
৪। বিভিন্ন বিষয়ে অতি স্পর্শকাতরতা বিষয়ে আমার একটা পর্যবেক্ষণ আছে। আমার কাছে মনে হয়, আদর্শ-উদ্দেশ্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নিয়ে বিপক্ষের লাইন-অফ-ফায়ারের মুখোমুখি দাড়িয়ে যারা একটা আন্দোলনে বা যুদ্ধে প্রকৃতই নেতৃত্ব দেন বা অংশগ্রহণ করেন - তাদের সেটা করতে বিশাল গাটস লাগে। আর এদের আবেগ-অনুভূতি কিন্তু অনেক "রোবাস্ট" হয়, তারা লজ্জাবতী লতার মত অযৌক্তিক অতি-স্পর্শকাতরতা রোগে ভুগেন না। আমি যে কজন ভাষা-আন্দোলনকারী ও মুক্তিযোদ্ধা দেখেছি, সে রকমই মনে হয়েছে। এটা কখনো-সখনো হয় একটু পরবর্তী-প্রজন্মের বেলায়, অনেকটা সূর্যের চেয়ে বালুর তাপ বেশির মত। আমি যে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের কথা বলেছি এবং তার সমসাময়িক অনেকেই মনে হয় না '৫২-র আন্দোলনের বয়সী বা তাতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এটা এখন তাদের অনেকের ক্ষেত্রে অনেকটা একটা "ব্র্যান্ডের" মত হয়ে গেছে, যাকে তারা এখন নানা ভাবে ব্যবহার করেন আপন স্বার্থে ও ব্যাবসা-বাণিজ্যে। এদের মধ্যে আবার কেউ কেউ আছেন, অতীতের কোন স্বাধীণতাযোদ্ধা নিয়ে অসামান্য নাট্যরচনা করে ফেলেছেন বা ভাষাকন্যা ইত্যাদি বিষয়ে নানা মাতম করেন - অথচ নিজেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ভয়ে সুদুর বিদেশে পালিয়ে থাকেন - দেশে ফিরতে চান না। ফিরে আবার হিরো বা ঐ ব্র্যান্ডের ব্র্যান্ড-এম্বেসেডর সেজে বসেন। ব্যবসা করেন মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদির আবেগ নিয়ে। এদের স্পর্শকাতরতা নিয়েও আমার কোন আগ্রহ নেই। আমি যার কথা বলেছি মূল লেখায়, তার আবেগ যদি সত্যি সৎ ও পরিশুদ্ধ হত - তাহলে তিনি নিজের কথা নিজের মুখেই বলতেন। কে কি ভাবল তার ধার না ধেরেই। সোজাসাপ্টা - কোনরকম ত্যানাপ্যাচানি না করে। আমার দেখা মুক্তিযোদ্ধা ও ভাষা-সৈনিকরা তাইই করেন। তা না করে ইনি কি করলেন? একটা দুধের বাচ্চাকে ধরে আনলেন যে তার সামনে ঠিকমত কথা বলা তো দূরের কথা স্বচ্ছন্দে বসতেও পারছিল না, সেই মেয়েকে শিখণ্ডীর মত খাড়া করিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার মুখ দিয়ে তার নিজের অর্ধশতাব্দী-প্রাচীণ 'স্পর্শকাতরতার' বা যা তার নিজের বক্তব্য সেই জিনিষটা বের করার জন্য। যে অনুভূতি বা অভিজ্ঞতা হওয়ার বয়স আসলে ঐ মেয়ের হয়নি। দেখে মনে হচ্ছিল মেয়েটা তোতা পাখির মত আগেই রিহার্স করে আসা কথা তার ধরিয়ে দেয়া কিউ ধরে ধরে রিপিট করছে। পুরো ব্যাপারটা মূলে মনে হয়েছে এমন একটা ভঙ্গি আছে যে - আমি তো বুড়ো ভাম বাতিল মাল, আমার কথার মধ্যে তো আধুনিকতা নেই, কিন্তু এই দেখ নতুন প্রজন্মের "ভাল" তরুনরাও একই কথা বলে। এদের মধ্যেও অনেক ভাল ভাল ছেলেমেয়ে আছে, সবাই বখে যায়নি। তোমরাও একে অনুসরন কর। -- এই পুরো ব্যপারটাই আমার কাছে ভীষণ অসৎ মনে হয়েছে, ঐ ভদ্রলোক নিজের কথা নিজের মুখে বললেই বরং অনেক বেশি অথেন্টিক ও ইফেক্টিভ হত। এই সব লোকের তথাকথিত স্পর্শকাতরতার ব্যাপারেও আমি দ্রুত আগ্রহ হারিয়ে ফেলছি। যেমন কিনা বদলে দাউ-বদলে যাউ, দুনিয়া কাঁপানো পৌনে তের মনিট বা মুক্তিযুদ্ধ/একুশে নিয়ে করপোরেট বানিজ্যের গ্লিসারিনে আমার কোন আগ্রহ নেই।
৫। ভাষা নিয়ে স্পর্শকাতরতার সাথে আমি এম্প্যাথাইজ করি, কিন্তু কোন বিশেষ শ্রেণীর কর্তৃত্ববাদিতার সাথে নয়। এই ভাষা কোন বিশেষ ব্যক্তি, শ্রেণী বা যুগের মানুষের সম্পত্তি না।
৬। বাই দ্য ওয়ে, রবীন্দ্র-সঙ্গীত শিল্পীদের বিশেষ একটা শ্রেণী সব সময় অত্যন্ত লক্ষনীয় রকম ভাবে আলাদা একটা বিশেষ উচ্চারণরীতি ও এ্যাকসেন্টে চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলেন - অন্তত মিডিয়াতে যতটুকু দেখি। যে উচ্চারণ বা এ্যাকসেন্টে খুব সম্ভবত বাংলাদেশের একটি লোকও জন্মগত ভাবে বা প্রমিত স্তরেও কথা বলে না - সম্ভবত ঐ শিল্পীদের বেশির ভাগও ঐ এ্যাক্সেন্ট পৈত্রিক সূত্রে পাননি (আমি অবশ্য নিশ্চিত না)। একটা এ্যাকসেন্ট যে দেশের স্বাভাবিক নেটিভ এ্যাকসেন্ট নয়, যাতে আর কেউ কথা বলে না, যেটা তাদের নিজেদেরও নেটিভ এ্যাক্সেন্ট নয় - সেইটা সেই দেশের অডিয়েন্সের সামনে সব সময় জোর করে ব্যবহার করার মানে কি? রবীন্দ্র-সঙ্গীত গাওয়ার সময় বাদে স্বাভাবিক কথাবার্তা বা অনুষ্ঠান উপস্থাপনার সময় কি নেটিভ প্রমিত এ্যাকসেন্ট ব্যবহার করা যায় না? এটা কি ঐ ইংরেজি-ফুটানিওয়ালাদের মতই এক রকম গোপন হীণমন্যতাজাত উচ্চমন্যতার মত কিছু? এর মধ্যে কোথায় যেন এই অকথিত ঘোষণাটা আছে - দেখুন আমরা কত শুদ্ধ ও উচ্চ আর আপনারা কত অশুদ্ধ ও নীচ! আমার অন্তত এই জিনিষটা ভীষণ অপমানজনক মনে হয়।
বিশাল প্রতিমন্তব্য করে ফেললাম। তবে অকপটে নিজের অনুভূতির কথাগুলি বলেছি। ভুলভাল হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।
আর হ্যাঁ, মূল লেখা আর এই ডাইনোসর প্রতিমন্তব্য পড়ার জন্য আবারও অজস্র ধন্যবাদ --
****************************************
খুবই খুবই খুবই ভালো লাগছে এ বিষয়ে ফলোআপ পোস্ট দেখে। 'ভাষা ও সাহিত্য - শুদ্ধতাই সুন্দর?' পোস্ট এ এফ এম রেডিও, অদ্ভুতুড়ে নাটকের ডায়লগ এর বিপরীতে প্রমিত রবীন্দ্রিয় লেখনী কে স্ট্যান্ডার্ড ধরা হয়েছিল। এ দুটোর মাঝখানে যে আরও একটা শ্রেণী আছে, বিবর্তনের মধ্য দিয়ে নতুন রূপ নেয়া বাংলা ভাষা - তার পৃষ্ঠপোষকতায় জোরালো যুক্তি আসলেও অপ্রমিত (?) এ দুটো সংস্করণের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্যটা তুলে আনা হয়নি, যেটা আপনার লেখায় এসেছে।
****************************************
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
****************************************
লেখার বিষয়বস্তু খুব চমৎকার।
এই প্রসঙ্গে আমি একটি কথা বলতে চাই , ভাষা আর যেকোনো জিনিশের মতই পরিবর্তনশীল । একটা সময় সংস্কৃত থেকে বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছে। কালিদাস, বা বঙ্কিম যে ভাষায় কথা বলতেন, রবীন্দ্রনাথ এর ভাষার নিজস্বতা কিন্তু ভিন্ন। আর বর্তমান প্রজন্মের লেখকেরা যে ভাষায় লিখেন তা আমাদের হয়ত আধুনিক নিজস্বতা। রবীন্দ্রনাথ অনেক বেশী আধুনিক ছিলেন, কালে কালে হয়ত একসময় আমরা এমন কোনও ভাষা ব্যবহার করব, যা হয়ত রবীন্দ্রনাথ থেকে আলাদা হবে, কিছুটা সহজ এবং পরিবর্তিত হবে কিন্তু তবুও রবীন্দ্রনাথ যুগে যুগে টিকে থাকবেন আমাদের মাঝে। আর একটি কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই, আমরা কিন্তু এখন যে ভাষা বলি তার অনেকখানি জুড়ে থাকে ইংরেজি, আসলে বাংরেজি আর কি! একটি পূর্ণ বাক্যর মধ্যে ২/৩ টি শব্দ ইংরেজি চলে আসে, যা আসলে মোটেও ঠিক নয় একটি ভাষার নিজস্বতা ধরে রাখতে ছাইলে।
আবার আমাদের সব শব্দ কিন্তু বাংলা নয়, বাংলাতে অনেক পার্সিয়ান এর আধিপত্য লক্ষ্য করা যায়।
আমরা ভাবি বাংলা অথচ অনেক শব্দ পার্সিয়ান শব্দের অপ্রভংশ রূপ।
যাই হোক, সুন্দর বিষয়ধর্মী একটি লেখার জন্য ধন্যবাদ এবং শুভকামনা !!!
পৃথিবীর সব ভাষাই এরকম লেনদেনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। বিদেশি প্রভাবমুক্ত বিশুদ্ধ ভাষা বলে কোন জীবন্ত ভাষা আছে কিনা আমার জানা নেই। আপনি জানেন?
লেখাটা পড়ার জন্য আপনাকে
****************************************
প্রমিত বা মান ভাষার উদ্দেশ্য সম্ভবত একটি ডায়ালেক্টকে সব ডায়ালেক্টভাষীদের মাঝে যোগাযোগের মুখ্য মাধ্যম করে তোলা। এই উদ্দেশ্য সাধন করতে গেলে কোনো একটি অঞ্চলের ডায়ালেক্ট প্রাধান্য পাবে। সবার মন রক্ষা করতে গেলে একেবারে নতুন ডায়ালেক্ট সৃজন করতে হবে, যেটা কষ্টসাধ্য এবং কস্টসাধ্য। আপনার এই লেখাটি নোয়াখালির ডায়ালেক্টে লিখলে আপনি অনেক পাঠকের সাথেই যোগাযোগ করতে পারতেন না। বাংলা মান ভাষার উদ্দেশ্যটাকে যদি এই যোগাযোগ সাধনের কবুতরখোপ থেকে বার করে নদীয়া জেলার মহত্বকীর্তনের কবুতরখোপে ঢোকানো হয়, তাহলে আমরা ভুল করবো।
বাংলা ভাষায় এখনও আমরা এক শব্দে অনেক কিছু প্রকাশ করতে পারি না। পরিভাষার মাঠও একেবারে ফাঁকা। এদিকে নজর না দিয়ে অনেকেই শোরগোল তুলছে 'নিজেদের' প্রতিনিধিত্ব করে, এমন একটা নতুন মান ভাষা প্রবর্তনের। এবাদুল হক ব্রাত্য রাইসু এই দুই উপসর্গজীবী এককালে পূর্ব বাঙ্গালার ভাষা নিয়ে প্রচুর ফাঁকা বাকোয়াজি করেছে। কিন্তু এই প্রস্তাবিত মান ভাষা প্রবর্তনের জন্য যে ক্রিটিক্যাল ম্যাসসম্পন্ন কর্পাস প্রয়োজন, সেটা তৈরিতে কেউ এগিয়ে আসছে না। রবীন্দ্রনাথের পশ্চাদ্দেশে আঙুল ঢোকাতে চাওয়া সহজ, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যে বিপুলায়তন কর্পাস রেখে গেছেন, সেটার সমকক্ষ কাজ করে নতুন মান ভাষা প্রবর্তনের পথে কেউ হাঁটতে চায় না, কারণ কাজটা কঠিন। আর এই উপসর্গজীবীদের উদ্দেশ্য বস্তুত নতুন কিছু প্রবর্তনও নয়, বরং সাময়িক চিৎকার করে মনোযোগ নিজের দিকে ফেরানো। হিটখোরিতা দিয়ে নতুন ভাষা প্রবর্তন সম্ভব নয়।
একটা ভাষায় প্রতিনিয়ত রক্তমাংস যোগবিয়োগ হয়, কিন্তু এই প্রক্রিয়াটা যথেষ্ট সান্দ্র। এই সান্দ্রতাকে অস্বীকার করে কিছু করতে গেলে সেটা নিষ্ফল হবে বলেই মনে হয়। লিখিত আর মৌখিক ভাষাকে যদি দুটো গিয়ার ধরা হয়, এরা একে অপরের দাঁতে লেগে ঘোরে, সেইসাথে ভাষা চলার গতি পায়। কিন্তু আমাদের দেশে আমরা গিয়ার দুটোকে ক্লাচ চেপে আলগা করে রেখেছি। তারা নিজেদের মতো করে ঘুরছে, কিন্তু দাঁতে-দাঁতে সংযোগ কম বলে ভাষার চলার গতি মন্থর হয়ে পড়েছে। যারা ভাষাকে এক রাতে পাল্টাতে চায়, এক রাতের মধ্যে ভাষাকে সেই অনুপাতে মোমেন্টাম যোগানোর মতো বল তাদের থাকতে হবে।
আপনি আসলে মূল বিষয়টার একদম মাথায় হিট করেছেন। প্রমিতের আসল পার্পাস এর উপযোগিতা। আর এই উপযোগ অর্জনের কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে যা আপনি উল্লেখ করলেন। এটা আমিও ঘুরিয়ে উল্লেখ করেছি। তবে উপযোগিতার বিষয়টা আমি বাই ডিফল্ট ধরে নিয়েছি বলেই তা মূল পোস্টে সরাসরি অনুহ্য থেকেছে, সেকেণ্ডারি বিষয়গুলিই এই লেখায় আমার আগ্রহের লক্ষ্য ছিল। এটা আসলে একটু প্রতিক্রিয়ামূলক লেখা, কম্প্রিহেন্সিভ/সার্বিক আলোচনা এর উদ্দেশ্য ছিল না। আমি মূলত প্রমিতের উপর কোনরকম মেটাফিজিকাল মূল্য বা - দেবত্ব বা আভিজাত্য আরোপের বিরোধিতা করতে চেয়েছি। এই দিকটাই এখানে তুলে ধরতে চেয়েছিলাম, তবে অন্য দিকের গোঁড়ামি বা 'বাকোয়াজির' কথাটাও সংক্ষেপে বলেছি। বিশেষ করে সেটা যখন সাম্প্রদায়িক, সঙ্কীর্ণ আঞ্চলিকতাবাদী বা ফাঁপা জাতীয়তাবাদী উদ্দেশ্যপূর্ণ হয়।
রাইসু বা "কঠিন" কাজটার প্রসঙ্গে আপনি যা বললেন, তার সাথেও আমি পুরোপুরি একমত। "ক্রিটিক্যাল ম্যাসসম্পন্ন কর্পাস"-এর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য, আর এই কঠিন কাজটা না পারাও আমাদেরই ব্যর্থতা। নতুন প্রমিত উপভাষা চাই কি না চাই। অন্তত বৈচিত্র ও ভাষা ও চিন্তার সমৃদ্ধির জন্যে হলেও। এক্ষুণি নতুন প্রমিতের জন্য আমি ব্যস্ত নই, যখন তার জন্যে আমরা প্রস্তুত হব তখন সেটা হয়তো হবে - কিম্বা তার পরেও হয়তো হবে না। সেই উত্তর-প্রজন্মই সেটা বুঝবে ও সিদ্ধান্ত নিবে।
আমি শুধু প্রমিতের প্রয়োজন বা উপযোগিতা থেকে কোনরকম সম্ভাব্য অপরিবর্তনীয় ইন্ট্রিন্সিক দেবত্ব, আভিজাত্য, অনাভিজাত্য, শ্রেষ্ঠত্ব, প্লেবত্ব, হেয়ত্ব, কেন্দ্রীয়তা, প্রান্তিকতা, উচ্চতা, নীচতা - ইত্যাদি ভ্যালু জাজমেন্টকে পৃথক করতে চেয়েছি। আর এটা করতে রবীন্দ্রনাথকে খাটো করার প্রয়োজন দেখি না।
****************************************
ভাষা তো মানুষের মনোভাবের প্রকাশ। বাংলাভাষী মানুষ এমন একটা সমাজের অংশ, যেখানে সামন্ততন্ত্র শুধু কিতাবে ফুরিয়েছে, কিন্তু গোয়ালে সগর্জনে বিদ্যমান। তার ওপর সে স্বাধীন হওয়ার আগে প্রায় দুই শতক শাসিত হয়েছে আরেক শ্রেণী-অতিসচেতন জাতির হাতে। বাঙালি পারলে বিষ্ঠার ওপরও আভিজাত্য আরোপ করে, আর এ তো ভাষা। কিছুদিন আগে প্রলাপলেখিকা তসলিমা নাসরিনের এক লেখায় পড়লাম, তিনি 'নেই'কে 'নাই' লেখা নিয়ে অনেক তর্জনগর্জন করছেন। এই যে হাইপারকারেকশনের (এর বাংলা কী করা যায়, অতিশোধন?) প্রবণতা, এটা আসে ঘুরে ফিরে কোনো হীনমন্যতাবোধ থেকেই। কোথায় যেন পড়েছিলাম, একাত্তর সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দালালচূড়ামণি সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন খুব কষ্ট করে ইংরেজি শিখেছিলেন। মুনীর চৌধুরীকে তিনি প্রচণ্ড অপছন্দ করতেন, একবার শিক্ষকদের এক সভায় মুনীর চৌধুরী বিহাইন্ড বলায় তিনি সবার সামনেই তাকে অপদস্থ করে সঠিক উচ্চারণ বাহাইন্ড শিখিয়েছিলেন। ভাষার ওপর আভিজাত্য বা দেবত্ব আরোপের ক্রিয়ার তাই কোনো উদ্দিষ্ট (এবং প্রায়শ অনুক্ত) ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সম্প্রদায় থাকে, মোটা বা সূক্ষ্ম দাগের পটভূমি আর উদ্দেশ্যও থাকে। তাই আমি মনে করি, ঘটনাগুলো পৃথকভাবে বিচার্য। তমদ্দুনী মজলিসকে ঠেকানোর জন্য শীলিত বাংলাকে আশ্রয় করাকে তসলিমার 'নেই'-'নাই' প্রলাপের সঙ্গে মেশালে আমরাও ভুল করবো।
শীলিত বাংলাকে কলকাতার ঘাড়ে চাপিয়ে (পশ্চিমবঙ্গের সবাই নদীয়া জেলার শান্তিপুরের ভাষায় কথা বলে না, কেন আমাদের দেশের নব্য তমদ্দুনীরা মান বাংলাকে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতীয় বাংলাভাষীদের কোলে তুলে দিতে চান, সেটাও আমাদের অনুসন্ধান করা উচিত) এর বিপরীতে 'দেশী' 'ঢাকাই' বাংলা প্রচলনের কাজটিও কিন্তু দেবত্বারোপের বিরোধিতা করেই হয়। কিন্তু এর পেছনে আমি দেবত্ব বিলোপের বদলে নতুন দেবতা প্রবর্তনের উদ্দেশ্যটিই দেখি। ঢাকাই বাংলার নামে যা চালুর চেষ্টা চলছে তা ঢাকাইয়াদের ভাষা নয়, একটা বিচিত্র জগাখিচুড়ি, যার মুখ্য উদ্দেশ্য টেলিভিশনে নাটক-টেলিফিল্মে কলকাতার প্রোগ্রাম থেকে পৃথক এক বাংলা ভাষার মাধ্যমে নিজেদের অনুষ্ঠানের ব্র্যান্ডিং। বিটিভির স্বর্ণযুগে বাংলাদেশে মান বাংলায় প্রচুর নাটক নির্মিত হয়েছে, হঠাৎ কেন কৃত্রিম একটি ভাষাকে 'ঢাকাই' ছাপ্পড় মেরে আমাদের এক রাতের মধ্যে লব্জ পাল্টে ফেলতে হবে? এবং একটু তলিয়ে দেখলে আমরা টের পাই, ঠিক একই কাজ কলকাতার অনুষ্ঠান নির্মাতারাও করে বাংলাদেশের দর্শক টানার জন্য, তারা না-বরিশাল-না-ফরিদপুর-না-ময়মনসিংহ-না-ঢাকার একটি অদ্ভুত জগাখিচুড়ি ভাষাকে "বাঙাল" ভাষা হিসেবে উপস্থাপন করে। অর্থাৎ, এই কৃত্রিম ভাষা চাপিয়ে দেয়ার প্রতিযোগিতায় টিভি-অনুষ্ঠান নির্মাতারা সমানভাবে সচেষ্ট। আমাদের দেশের মূর্খ কাঠবলদেরা এই ভাষাটিকে নতুন প্রমিত হিসেবে প্রচলনের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। দেখতে পাই বরিশাল বা লক্ষ্মীপুর থেকে আগত তরুণ বা তরুণী ঢাকায় এসে শ্রুতমাধ্যমের অদ্ভূত জগাখিচুড়ি ভাষাকে প্রমিত জ্ঞান করে সেটা আত্মস্থ করার চেষ্টায় মগ্ন। তার এই চেষ্টাও নিজেকে চারপাশের সাথে ব্লেন্ড করার আকাঙ্খাজাত। নিজের ভাষা নিয়ে তার মনের হীনমন্যতা যদি দূর না হয়, আভিজাত্য-কৌলীন্য-দেবত্ব একেক সময়ে একেক চেহারা নিয়ে ভাষার ওপর ভর করবেই।
****************************************
সহমত ।
নির্ঝর অলয়
আমার কাছে মনে হয় ইংরেজি ভাষার ওপরে লেখা কোন বক্তব্য বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক নয়। কারণ, বাংলা ভাষার ইতিহাস ইংরেজি থেকে ভিন্ন। এই কারণে ইংরেজি ভাষায় প্রমিত অপ্রমিতের আলাপ বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে ফিট করতে চেষ্টা করা মেথডোলজিকালি ভুল।
বাংলা প্রমিত অপ্রমিত নিয়ে আলাপ পাড়তে গেলে কয়েকটা ঐতিহাসিক সত্য মাথায় রাখতে হয়।
১। বাংলা ভাষার ওপর সাংস্কৃতিক হামলা হয়েছে। এই ভাষাকে মুসলমানি করতে চাওয়া হয়েছে। এই ভাষাকে আবার কিছু ক্ষেত্রে মুসলমানি থেকে হিন্দু বানাবার চেষ্টা হয়েছে। হালে চলছে এই ভাষাকে মার্কিন বানানোর চেষ্টা।
২। এই দেড়শ' দুইশ' বছর আগেও বাংলা ভাষা ব্রাত্য ছিলো। এই সমস্যা ইওরোপিয় ভাষাগুলোতেও ছিলো। কিন্তু সেটা অনেক আগের কথা। উদাহরণস্বরূপ দান্তের ডিভাইন কমেডি যে ভাষায় লেখা হয়েছিলো সেটা ততকালীর বোদ্ধাসমাজ শিল্পের ভাষা মনে করতেন না।
আগে আমরা যখন ব্লগিং শুরু করি তখন এই নিয়ে বেশ আলাপ হতো। এখন এই আলাপ একটা বোঝাপড়া* পৌছেছে মনে হয়। বোঝাপড়াটা সংক্ষেপে এরকম -
- কোন ভাষাই আসলে প্রমিত বা অপ্রমিত না। কেউ নোয়াখালির আঞ্চলিকে লিখলেও সেটা ঠিক। কারণ ইতিহাস মাথায় নিলে আমরা জানি এগুলো এক ধরণেন চাপানউতোর সংস্কৃতি। আমরা অভিজাত, তোমরা দুধভাত ইত্যাদি বর্জনীয়।
- কোন ভাষা যদি প্রমিত অপ্রমিত না হয় তাহলে তো বেড়াছেড়া লেখা যাবে। সেক্ষেত্রে কী করা? সেক্ষেত্রে এটা মাথায় রাখতে হবে যে যে যেকোন ভাষার একটা স্টান্ডার্ডাইজেশনের দরকার আছে। এই স্ট্যান্ডার্ডাইজেশনটা দরকার বিদেশীদের ভাষা শেখাতে, দেশি শিশুদের ভাষা শিক্ষার একটা স্ট্যান্ডার্ড ঠিক করতে বা আরো সঠিক করে বললে এরকম একটা ভাষা যেটা সবাই বুঝবে।
- দুই নাম্বার পয়েন্ট মাথায় নিলে আরেকটা প্রশ্ন সামনে আসে। কোন ভাষাটাকে আমরা স্ট্যান্ডার্ড বলে ধরে নেব। আমাদের হাতে আপাতত নদিয়া সংস্করণ, বা রবীন্দ্রনাথের বাংলা বলে যেটা বললেন সেটার বিকল্প নাই। বিকল্পটা হয়তো ন্যায্য। কিন্তু সেটার প্রস্তাবকেরা রাতারাতি সবকিছুর পরিবর্তন চেয়ে ফেলেন। কেউ কাল সকাল থেকে সবকিছু থেকে কয়েকটা অক্ষর বাদ দিতে চান। কেউ ঢাকার রাস্তার ভাষাটাকে পুরো দেশের উপর চাপিয়ে দিতে চান। এভাবে রাতারাতি আসলে কিছু হয় না। তাছাড়া এসব যারা বলছেন তাদের রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ডটাও স্মর্তব্য। এটা দরকার উপরে উল্লেখিত ঐসব ঐতিহাসিক কারণে।
- বাংলা সোশাল মিডিয়ার টেক্সটগুলো যেটা ব্লগ থেকে শুরু সম্ভবত সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটা আনতে পেরেছে সাম্প্রতিক ইতিহাসে। আগে যেসব লেখা হতো না সেগুলো লেখা হচ্ছে। আগে যেভাবে লেখা হতো না, এখন সেখানে সেভাবে লেখা হচ্ছে। মূল বিষয়টা হলো গণমানুষ যা ভাবছে বা করছে সেগুলো লিখিত আকারে এসে সময়কে ধারণ করছে কিনা। ভবিষ্যতের মানুষ জানবে আমরা কী ভাষায় প্রতিক্রিয়া দেখাতাম। কিন্তু তারা জানবে বা সত্তুরের দশকে মানুষ কী ভাষায় কথা বলতো বা কী ভাষায় তাদের ভাব প্রকাশ করতো।
* বোঝাপড়া বলছি এই অর্থে যে নতুন করে এই নিয়ে আর তুমুল তর্ক উঠছে না। যার যেভাবে খুশি লিখছে।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
এটা একটা ব্ল্যাঙ্কেট স্টেটমেণ্ট। স্পিসিফিকালি কোনটা অপ্রাসঙ্গিক বললে উপকৃত হতাম। বাংলার বিতর্কের প্রেক্ষিতে ট্রাজিলের বক্তব্য পিঠাপিঠি আমি পরীক্ষামূলকভাবে তুলে ধরেছি, সিদ্ধান্তমূলক ভাবে নয়। অমিল বা অপ্রযোজ্যতা থাকতেই পারে। তবে ট্রাজিলের উল্লেখিত পয়েন্টগুলির মধ্যে সুনির্দিষ্টভাবে ঠিক কোনটা অপ্রাসঙ্গিক বললে আপনার বক্তব্য আরও পরিষ্কার হত। মূল লেখাতেও আমি সেটাই জানতে চেয়েছি। মানুষের সমাজে ও ইতিহাসে পার্থক্য যেমন আছে, মিলও তেমনি আছে প্রচুর। এই মিল ও পার্থক্যগুলি নিয়ে আলোচনা না করতে পারলে সামাজিক বিজ্ঞানগুলির আরও বহু বিষয়েই কোনই আলাপ করা যাবে না।
বাকি বিষয়গুলিতে আমি আপনার সাথে একমত।
****************************************
বাংলা ভাষার উপর একটা সাম্প্রতিক দুর্দান্ত বিতর্কের সন্ধান পেলাম এখানেঃ--
সরাসরি ইউটিউব লিঙ্কঃ https://youtu.be/7kwpEoB0-Ds
****************************************
বাংলার উপর আরেকটা দুর্দান্ত আলোচনাঃ
****************************************
নতুন মন্তব্য করুন