মরুযাত্রা শেষ পর্বঃ বিদায় কায়রো, ওয়াদাহান আল মিস্‌র

মন মাঝি এর ছবি
লিখেছেন মন মাঝি [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ১৬/১০/২০১২ - ৯:৪৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কায়রোর কথা আগেই দুটো পর্বে অল্পস্বল্প বলেছি। এর জীবনযাত্রায় বৈপরীত্য আর বৈচিত্র্য, প্রাচূর্য আর দারিদ্র্য, আধুনিকতা আর প্রাচীণত্ব, শৃঙ্খলা আর বিশৃঙ্খলা, ক্যাওস আর ক্যাকোফনির শত বিভ্রান্তির মাঝেও তার নিজস্ব একটা বিটের, ছন্দের, অদ্ভূত সহাবস্থানের কথা বলেছি। তবে এর ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্য স্থানগুলির কথা তেমন কিছু বলা হয়নি। তার কারন অবশ্য বিষয়বস্তুর বিশালত্ব। তাই এই পর্বেও সাম্প্রতিক কিছু রাজনৈতিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে আমার সেসময়ে দেখা আরেকটি বৈপরীত্যের কথা বলে, কিছু টুকিটাকি স্মৃতিচারণ করতে করতে অল্প কয়েকটি দর্শনীয় স্থানে ঢুঁ মারব।

তবে এসব অবশ্য প্রাক-তাহরির মুবারকশাহী যুগের কাহিনি, এখন অবস্থা মনে হয় বেশ ভিন্ন।

......................................................................................

মিশরে একদিকে ধর্মীয় রক্ষণশীলতার সামগ্রিক বাতাবরণ আর মাঝেমধ্যে উগ্রতার ফণা, অন্যদিকে পশ্চিমা আধুনিকতার প্রতি অবদমিত প্রেম - দুটিই বেশ অনুভব করা যায়। দুটো মিলে এক অদ্ভূত অবস্থা। একদিকে মসজিদে মসজিদে জনতার ভীড়, অন্যদিকে নীলনদের বুকে প্রমোদতরীতে প্রকাশ্যে শহরের মধ্যখানে বেলিড্যান্সের আয়োজন। বোরকা-হিজাব-নিকাব সবই আছে, আবার অর্ধনগ্ন বেলি ড্যান্সাররাও আছেন পাশাপাশি। বহাল তবিয়তে। প্রমোদতরীতে বেলি ড্যান্সাররা যখন নাচছেন আর ঘুরতে ঘুরতে ভক্তদের কাছে আসছেন লাস্যময়ী হাসিতে বিগলিত হতে হতে, ভক্তদের সুবোধহস্ত তখন হয়তো পররাজ্যে ইল্লিগাল ইমিগ্র্যান্ট হওয়ার বাসনায় ওৎ পেতে আছে। কেউ কেউ হয়তো সফলও হচ্ছে।

অথচ একই সময় হয়তো... একটু দুরেই নদীর দুই পারে অপূর্ব সব মসজিদের মিনার থেকে ভেসে আসছে ভিন্ন এক সঙ্গীত। ভিন্ন এক জগত থেকে। সেখানে কিন্তু ভক্তকুলের হস্তদ্বয় নিচ্ছে মাটির শীতল পরশ, প্রণতমস্তকে।

এত কাছে, অথচ যেন কত দূরে....

এমনকি কায়রো থেকে কয়েকশো মাইল দূরে গভীর রাতে মরুভূমির অপার্থিব গহীন নির্জনতায় গিয়েও দেখি কায়রো আর বেলি ড্যান্সার! বাহারিয়ার কাছে নির্জন মরুভূমিতে ডেজার্ট সাফারির কথা লিখেছি আগের এক পর্বে। এই অভিযানে যাওয়ার পথে দেখি লোকালয় থেকে বহু দূরে, অচিনগ্রহের মত নির্জন একটা জায়গায় মরুভূমির হৃদয়ে, আরেকটা টুরিস্ট পার্টি (সম্ভবত ইউরোপিয়ান) এসে বিশাল তাঁবু খাটিয়ে ফেলেছে। আলো, হৈ-হল্লা। সুসজ্জিত নারী-পুরুষ (মরুভূমিতে!)। আমি একটু অবাকই হলাম এই পরিবেশে এদের সাথে করে শহরকে নিয়ে আসাতে। এখানে যারা আসে, তারা শহরকে শহরের জায়গাতেই ফেলে আসে। সেজন্যেই তো আসা।

আমরা মরুভূমির আরো গভীরে গিয়ে, ঘুরে ফেরার পথে যখন 'প্রাকৃতিক ভাষ্কর্যের অপ্রাকৃতিক প্রদর্শণীশালা'-র দিকে ফিরছি রাতের মত আমাদের তাঁবু ফেলার জন্য, তখন দেখি দূর থেকে সেই তাঁবুর উপর থেকে ফিনিক দিয়ে আলো বেরিয়ে আসছে আর সেইসাথে ভেঙে ভেঙে ভেসে আসছে নাচাগানার চাপা উল্লাসধ্বণি। অন্তহীন আঁধার, কানে ঝিঁ-ঝিঁ ধরানো নৈশব্দ্য আর গা-শিউরানো নির্জনতার সাগরের মাঝে হঠাৎ করেই টুপ করে এক অদ্ভূত খাপছাড়া দৃশ্য যেন। আমাদের বেদুইন ড্রাইভার চাপা মুচকি হাসি দিয়ে জানালো, ঐ টুরিস্ট পার্টি কায়রো থেকে একটা আস্ত বেলি ড্যান্সার গ্রুপ ভাড়া করে এনেছে। প্রাইভেট পার্টি, প্রাইভেট শো, প্রাইভেট এন্টারটেইনমেন্ট - যোগাযোগবিহীণ নির্জন শীতার্ত মরুভূমির বুকে গভীর রাতে। পথ ভুলে এক টুকরো আরব্য রজনী যেন।

কিন্তু মুসলিম ব্রাদারহুড গেল কই ? তাদের নাকি কত রবরবা এখানে! এই বেটারা কি ঘাস খায় নাকি ? তাদের নাকের ডগা দিয়ে এইসব বেশরিয়তি 'রোমান্টিকতা' চলে কেমনে? নাকি এই বেলি ড্যান্সারদের কামাইতে ভাগ বসিয়েই তাদের পার্টি চালায়? জানি না। এসব 'বৈপরীত্য আর বৈচিত্র্য' বোঝার জন্য যতদিন থাকা দরকার ততদিন মিশরে থাকিনি। তবে এর পরের চমকটা আমার বাসাতেই। গভীর রাতে হঠাৎ টিংটং। দরজা খুলতেই - নিদারুন সুসজ্জিতা এবং অলঙ্কৃতা একা এক তিলোত্তমা। নাহ, হতাশ হয়েই আবিষ্কার করলাম উনি আসলে পাশের বাসায় (এপার্টমেন্টে) যাবেন। ভুল করেই...। পাশের এপার্টমেন্টে (এগুলি এত বড় যে বোমা ফাটলেও প্রতিবেশী টের পাবে না) এক তরুন সৌদি শেঠ থাকেন। থাকেন ঠিক না, হঠাৎ হঠাৎ কাজে কর্মে হোক ছুটিছাটা কাটাতে হোক - সমবয়সী বন্ধুবান্ধবসহ চলে আসেন দেশ থেকে। 'সময়' কাটিয়ে যান। বাকি সময় খালিই পড়ে থাকে। এক স্থানীয়র মুখে শুনলাম এই সময় নাকি এইরকম অচেনা সুসজ্জিতা, সালঙ্কারাদের আনাগোনা দারুন ভাবে বেড়ে যায়। শুধু তাই না, মাঝেমধ্যেই নাকি "প্রাইভেট বেলি ড্যান্স পার্টির"ও আয়োজন হয়। সেটা কখন শেষ হয় কেউ জানে না। হ্যাঁ, শুধু হোটেল-রেস্তোরাঁ-পাব্লিক ভেন্যু নয় - নিজের বাড়িতেও অর্ডারমাফিক কাস্টমাইজড প্রাইভেট বেলিড্যান্স শো/পার্টির আয়োজন করা যায়। খরচ বেশি পড়ে এই যা। একক ড্যান্সার হতে পারে, গ্রুপও হতে পারে। আপনার যেমন চাই। আপনি চাইলে আরব্যোপন্যাস বা সহস্র আরব্য রজনী আপনার বাড়িতেই অবতীর্ণ হবে।

পরে শুনেছি আমাদের সৌদিপ্রেমিক, শিরচ্ছেদপ্রেমিক, সৌদি আইন ও ন্যায়নীতির পরম ন্যায়পরতার বেদীমূলে স্বদেশী ভাইদের সোল্লাসে কোরবানী দিতে ব্যাকুল দেশি ভাইদের এই পরমপুজনীয় ধর্মের মা-বাপ পরমপুরুষরা শুধু মিশর না, আশেপাশে আরো অনেক দেশেই এমন আরব্য-রজনীগৃহ প্রতিপালন করেন। যে ধরণের কর্মের অভিযোগে (আসলেই করুক বা না করুক) তারা নিজ দেশে গরিব বিদেশী শ্রমিকদের ডজনে-ডজনে ধড় থেকে কল্লা নামিয়ে দেন প্রকাশ্যে, পাথর ছুড়ে মারেন বা হাত পা ছেঁটে ফেলেন, সেগুলি তারা নিজেরা কিন্তু দুনিয়াজুড়েই করে বেড়ান প্রবল উল্লাসে।

যাজ্ঞে। অথচ এই শহরই আবার "হাজার মিনারের নগরী" নামে খ্যাত, এখানেই বিশ্বের ও সুন্নী মুসলিমদের প্রাচীণতম ও শীর্ষ ধর্মীয় বিশ্ববিদ্যালয়, এখানেই আধুনিক ইসলামি মৌলবাদের জন্ম, এখানেই মেয়েরা সরকারের বিরুদ্ধে মিছিল করলে ধার্মিকতার (!) পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে গণতন্ত্রপন্থী আত্নমর্যাদাকামী তরুনী প্রতিবাদকারিণীকে অর্ধনগ্ন করে প্রকাশ্য রাস্তায় ফেলে সেনাবাহিনি দিয়ে পিটিয়ে তারপর ধরে নিয়ে সেনাসদস্য দিয়ে জোরপূর্বক তাদের "ভার্জিনিটি টেস্ট" করে মিশরীয় পৌরুষের বীরত্ব প্রমান ও প্রতিষ্ঠা করা হয় ! বীর সেনাবাহিনি দেশরক্ষা ও যুদ্ধজয়ের পরিবর্তে নিঃসঙ্গ প্রহৃত নারীর সতীচ্ছদের প্রতিরক্ষা আর ভার্জিনিটি জয়েই বেশি আগ্রহী মনে হয়। নিজেদের কাজটা বরং কন্সক্রীপ্ট পতিতা স্পেশাল ফোর্সেসের কাছে আউটসোর্স করে দিতেই তারা বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন হয়তো, যেমনটা নাকি দিয়েছিলেন ১ম গালফ যুদ্ধে।

এখানেই আল-আজহার বনাম বেলিড্যান্স, মুসলিম ব্রাদারহুড বনাম পতিতা স্পেশাল ফোর্সেস, মসজিদ-গীর্জা-ভার্জিনিটি টেস্ট বনাম বার-ক্যাবারে-বাগানবাড়ির অপূর্ব সহাবস্থান। এখানেই প্রমোদতরীতে রঙীন পানীয়ভর্তি গেলাসে চুমুক দিতে দিতে লাস্যময়ী নর্তকীর নৃত্যরত দেহবল্লরীর ছন্দসুষমা অতি নিকট থেকে উপভোগ করতে করতে পরপার ও নদীর ওপার থেকে কৃচ্ছ্রতা ও সংযমের পথে ঈশ্বরের আহবান শুনতে পাওয়া যায়। একটু ভেবে দেখলে, জব্বর কম্বিনেশন বটে।

মিশর ভ্রমণ আমার জন্য একরকম আরব্য উপন্যাসীয় প্রায় অর্ধবাস্তব ভ্রমণই ছিল বৈকি।

......................................................................................

অনেকেই বোধহয় মিশরে আসেন কেবল পিরামিড দেখতে আর গিজার পিরামিড, কায়রো যাদুঘরসহ দু'-চারটা নিদর্শন দেখেই ফিরে যান আর ভাবেন সব দেখা হয়ে গেল। এরা যে কতটা ঠকে যান তা তারা নিজেরাও উপলব্ধি করেন না। আমাদের দেশে দেখেছি মিশর বলতে অনেকে শুধু পিরামিডই বুঝেন, যেমন অনেকের ধারনা "ফেরাউন" বলতে বুঝি কোরান/বাইবেল কথিত সেই নির্দিষ্ট একজন ফারাওকেই বুঝায় শুধু।

তবে একটা কথা সত্যি, পশ্চিমা দেশে একটানা দীর্ঘকাল থেকে যারা অভ্যস্ত - তাদের সবার জন্য হয়তো কায়রো বা মিশর খুব স্মুদ রাইড নাও হতে পারে। এটা দুবাই-ধাবি-সৌদি না, বাংলাদেশের মত না হলেও একটা 'দরিদ্র আরব' দেশই বটে। দারিদ্র্যজনিত ৩য় বিশ্বের অনেক বৈশিষ্ট্যই এখানে আছে। মোদ্দা কথায় একটু রাফিং ইট আউট আর এ্যাডভেঞ্চারের মানসিক প্রস্তুতি না থাকলে, একটু 'কষ্ট না করিলে কেষ্ট মেলে না' এ্যাটিচ্যুড না থাকলে বা অত্যুচ্চ মাত্রার ইন্সুলেটেড-স্যানিটাইজড্‌-কাস্টমাইজড পরিবেশের কম্ফোর্টেবল কোকুন ছেড়ে বেরুনোর মনোবল না থাকলে -- এদেশে আসলে না আসাই ভাল।

তবে হ্যাঁ, এটুকু বাঁধা যিনি অতিক্রম করতে পারবেন তার জন্য সম্ভবত অনেক কিছুই আছে এখানে। মিশর, বিশেষ করে কায়রোর পরতে পরতে - স্তরে স্তরে যুগ-যুগান্তরের ইতিহাস আর ঐতিহ্য ধুলোর ধূসর আস্তরের নীচে জমা হয়ে আছে। প্রস্তর যুগের মিশর, পেট্রাগ্লিফিক ও পিক্টোগ্রাফিক রক আর্টের মিশর, মরুভূমির মিশর, প্রাচীন ফারাওনিক মিশর, গ্রেকো-রোমান মিশর, কপ্টিক-খৃষ্টান মিশর, বাইবেলীয় মিথলজির মিশর, মধ্যযুগীয় ইসলামিক মিশর, আধুনিক মিশর - এসবের যে কোন একটারই ভগ্নাংশমাত্র দেখে কুলিয়ে উঠা যাবে না একটি মাত্র সফরে। মিশর দূরে থাক, শুধু কায়রোই কাভার করা কঠিন ব্যাপার। আমিও পারিনি - হাতে গোনা কয়েকটা দ্রষ্টব্যেই শুধু গেছি বিক্ষিপ্ত ভাবে। আগের পর্বগুলিতে যে জায়গাগুলির কথা বাকি থেকে গেছিল, এ দফায় তার কয়েকটির কথা আসবে। অল্প কয়েকটাই মাত্র।

......................................................................................

গাজী সালাউদ্দিনের দূর্গ বা কায়রো সিটাডেল

ক্রুসেডারদের মোকাবেলার জন্য কায়রোর মোকাত্তাম পাহাড়ের নিচে একটা উঁচু জায়গা বা টিলার উপর গাজি সালাউদ্দিনের সিটাডেল অর্থাৎ কেন্দ্রীয় নগরদুর্গটা ১১৭৬ খৃ থেকে ১১৮৩ খৃষ্টাব্দের মধ্যে তৈরি করেন বিখ্যাত মুসলিম শাসক ও জিহাদি সেনাপতি গাজি সালাউদ্দিন। তার উদ্দেশ্য ছিল কায়রো ও ফুস্তাত শহর দু'টি উঁচু একটি এবং একই দেয়ালের প্রতিরক্ষাব্যূহ দিয়ে সম্পূর্ণ ঘিরে ফেলবেন - নীলনদের পার থেকে নীলনদের পার পর্যন্ত। যাতে করে একটি মাত্র অখণ্ড সেনাবাহিনি দিয়ে দুটি শহরকেই একই সাথে ডিফেণ্ড করা যায় শত্রুর বিরুদ্ধে। প্রস্তাবিত এই দূর্গ-নগরীর প্রায় মধ্যখানে টিলার উপরে নির্মিত কেন্দ্রীয়-দূর্গ অর্থাৎ সিটাডেলটা হত তার প্রাণভোমরা।

সিটাডেলটা নির্মিত হলেও, দ্বৈতনগরপরিবেষ্টণী-প্রাকার অর্থাৎ শহরকে ঘের দেয়া পরিকল্পিত দেয়ালটা শেষ পর্যন্ত আর সম্পূর্ণ হয়নি।

সিটাডেলেটায় বর্তমানে একাধিক অংশ রয়েছে। সালাউদ্দিনের পরে একাধিক বংশের একাধিক শাসক এতে নিজ নিজ অংশ সংযোজন করেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত এটাই ছিল মিশরীয় সরকারের প্রাণকেন্দ্র। (স্লাইডশো দ্রঃ)।

ইব্‌নে তুলুনের মসজিদ এবং গেয়ার-এণ্ডারসন যাদুঘর

এক স্থানীয় কিংবদন্তী অনুসারে মহাপ্লাবনের পর নূহের কিস্তি আরারাত পর্বত নয় - 'গেবেল ইয়াশ্‌কুর' নামে কায়রোর একটা ছোট্ট টিলার ধারেই ভিড়েছিল আসলে। এই টিলার উপরেই বর্তমানে ইব্‌নে তুলুনের মসজিদটা অবস্থিত। এখানে বলা দরকার যে, এই কথাটা উইকিতে পেয়েছি। কিন্তু বাস্তবে যখন গিয়েছিলাম তখন কোন টিলাফিলার অস্তিত্ত্ব টের পেয়েছি বলে এখন মনে পড়ছে না। যাজ্ঞে।

মসজিদটাও কম পুরনো নয়। মিশরে আব্বাসীয় গভর্ণর আহমাদ ইব্‌নে তুলুন ৮৭৬ খৃষ্টাব্দে এটা প্রতিষ্ঠা করেন। ভূমির আয়তনের হিসাবে এটাই কায়রোর বৃহত্তম মসজিদ এবং কোন কোন মতে কায়রোতে মূল রূপে এখনো বর্তমান এমন মসজিদগুলির মধ্যে এটাই প্রাচীণতম।

কিন্তু এই ঐতিহাসিক মসজিদের ভেতরে আমার ঢোকা হয়নি। গিয়েছিলাম মসজিদটারই দেয়াল সংলগ্ন গেয়ার-এণ্ডারসন যাদুঘরে। যাদুঘরের ছাদ থেকে পার্শ্ববর্তী মসজিদটার একাংশ দেখা যায় (স্লাইডশো দ্রঃ)।

গেয়ার-এণ্ডারসন যাদুঘরটা কয়েক শতাব্দী প্রাচীণ মূলত ব্যক্তিগত বাড়ি হিসেবে তৈরি দুইটা বাড়িতে স্থাপিত। ১৬শ আর ১৭শ শতাব্দীর স্থাপত্যের চমৎকার ভাবে সংরক্ষিত উদাহরণ হওয়াতে এদের পরে যাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়।

যাদুঘরের দুইটা বাড়ির একটা ১৬৩২ সালে হাজ্জ্ব মোহাম্মদ ইব্‌নে আল-হাজ্জ্ব সালেম ইব্‌নে গালমান আল-গাজ্জার নামে এক ভদ্রলোক নির্মান করেন। অন্য বাড়িটা ১৫৪০ খৃষ্টাব্দে নির্মান করেন আব্দেল-কাদের আল-হাদ্দাদ। প্রথম বাড়িটা পরবর্তীকালে ক্রীট দ্বীপ থেকে আগত এক ধনাঢ্য মুসলিম মহিলার মালিকানায় চলে আসে এবং 'বাই্যত আল-ক্রিত্‌লিয়া' অর্থাৎ 'ক্রীটান মহিলার বাড়ি' নামে পরিচিতি লাভ করে। আর অন্য বাড়িটাও তার শেষ মালিকের নামে পরিচিতি পায় 'বাই্যত আমনা বিন্ত সালিম' হিসেবে। আরও পরে বাড়ি দু'টি ৩য় তলায় একটা ব্রিজের মাধ্যমে সংযুক্ত হলে দুইটা মিলেই এটা ঐ ক্রীটান মহিলার নামে পরিচিত হয়।

২০শ শতাব্দীর ৩০-৪০ এর দশকে এই বাড়িদুটি রিস্টোরেশনের পর ১৯৩৫ সালে মেজর গেয়ার-এণ্ডারসন নামের একজন বৃটিশ অবঃ কালেক্টর ও স্বঘোষিত 'ওরিয়ান্টালিস্ট'-কে বাড়িদুটিতে বসবাসের অনুমতি দেয়া হয়। এণ্ডারসন সাহেব নিজেও পরে বাড়িটাতে অনেক সংস্কার কাজ চালান এবং এতে তাঁর নিজের ব্যক্তিগত শিল্পকর্মের উল্লেখযোগ্য সংগ্রহ, মূল্যবান এন্টিক আসবাবপত্র, প্রাচীণ গালিচা, কিউরিও আর এ্যন্টিক্স দিয়ে ভরে দেন। ১৯৪২ সালে এন্ডারসন সাহেব অসুস্থ হয়ে স্বদেশে ফিরে যাওয়ার সময় বাড়িদু'টি তার ভিতরের সমস্ত জিনিষপত্র, শিল্পকর্ম আর সাজসজ্জাসহ মিশর সরকারকে দিয়ে যান। সেই থেকেই এটা যাদুঘর - এণ্ডারসন সাহেবের নামানুসারে। (স্লাইডশো দ্রঃ)।

জেম্‌স বণ্ডের 'দ্য স্পাই হু লাভ্‌ড মি' ছবিটার অংশবিশেষের চিত্রগ্রহণ এই বাড়িটার ভিতরেই করা হয়েছিল।

কায়রো যাদুঘর

কায়রোস্থ প্রধান মিশরীয় যাদুঘর - 'মিউজিয়াম অফ ইজিপশিয়ান এন্টিকিউটিজ', অধুনা বিশ্বখ্যাত তাহরির স্কোয়ারে অবস্থিত। প্রাচীণ ফারাওনিক যুগের মিশরীয় প্রত্নসম্পদের সংগ্রহের দিক থেকে এটাই পৃথিবীর সমৃদ্ধতম যাদুঘর। এটা শুধুমাত্র ঐ যুগের মিশরীয় প্রত্নসম্পদের জন্যই ডেডিকেটেড। আর কিছু না। এখানে আছে ঐ যুগের প্রায় ১ লক্ষ কুড়ি হাজার প্রত্ননিদর্শন। প্রতিটি আইটেমের পিছনে মাত্র ৩ মিনিট সময় বরাদ্দ করে (যা আসলে কিছুই না) নাওয়া-খাওয়া-ঘুম-বিশ্রাম সম্পূর্ণরূপে বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ বিরতিহীণ ভাবে এক ধাক্কায় যদি আপনি প্রতিটি আইটেম দেখতে চান, তাহলেও আপনার অন্তত সাড়ে ৮ মাস সময় লাগবে (এক আইটেম থেকে আরেক আইটেমে যাওয়ার সময় বাদ দিয়ে)। যদি না আপনি তার বহু আগেই মারা পড়েন। আর আইটেম-প্রতি স্রেফ ১ সেকেণ্ড সময় দিয়ে, আগের মতই সম্পূর্ণ বিরতিহীণ ভাবে দেখতে চাইলে? (ধরে নিচ্ছি সব এক জায়গায় দাঁড়িয়েই দেখা যাবে, হাটতে হবে না) -- তাও লাগবে প্রায় ৩৪ ঘণ্টা! মাথা ও চোখ বিরতিহীণ ভাবে ঘুরাতে ঘুরাতে যদি না সেগুলি যথাক্রমে আপনার ঘাড় ও অক্ষিকোটর থেকে বহু আগেই খুলে পড়ে যায়। বলা বাহুল্য, এই ভয়াবহ জায়গাটাতেই আমি গিয়ে ঢুকলাম, ওয়ান ফাইন মর্নিং। তবে প্রত্নদপ্তরের দয়া, যাদুঘরের ডিসপ্লেতে পুরো ১ লাখ ২০ হাজার আইটেমই রাখা নাই, স্রেফ একটা প্রতিনিধিত্বশীল অংশ রাখা হয়েছে। বাকিগুলি গুদামে। কিন্তু এই তথাকথিত "প্রতিনিধিত্বশীল অংশ"-টাই যে কত বিশাল, ঘন্টার পর ঘন্টার ঐ যাদুঘরের ভিতর ঘুরতে ঘুরতে এর অতি সামান্য অংশ দেখতে গিয়েই আমার পা, ঘাড় আর চোখগুলি মর্মে মর্মে অনুভব করেছে ক্লান্তি কাকে বলে। উপরন্তু, আমাকে হতাশ করেছে যাদুঘর ভবনটার অভ্যন্তরীণ স্থাপত্য। পৃথিবীর অন্যান্য বিশ্ববিখ্যাত যাদুঘরগুলি দেখার অভিজ্ঞতা আমার নেই, সুতরাং তুলনামূলক কিছু বলা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। হয়তো সেগুলিও এরকমই - হয়তো বা না। প্রাচীণ মিশরীয় এক্সিবিটের বিবেচনায় এটা বিশ্বে তুলনাহীণ একটা যাদুঘর সন্দেহ নাই, কিন্তু আমার কাছে অন্তত সেই বিচারে এর অভ্যন্তরীন নকশা বা প্রদর্শণ পদ্ধতিতে সৃষ্টিশীল কল্পনার অভাব পীড়াদায়ক ভাবে প্রকট বলেই মনে হয়েছে। ভবনটাকে আমার মনে হয়েছে বিশাল একটা ক্লান্তিকর গুদামঘর। হাজার হাজার ক্ষুদ্র থেকে শুরু করে দৈত্যাকৃতির এক্সিবিট যেন গাদাগাদি করে এক জায়গায় ঠেসে রাখা হয়েছে। প্রথমে বেশ কিছুক্ষণ দেখার পর এক পর্যায়ে এসে প্রত্ননিদর্শনগুলি থেকে আলাদাভাবে রসগ্রহণের শক্তি মরে যায়। একটু স্পেসের জন্য মনটা আঁকুপাঁকু করতে থাকে - বাইরের ফিজিকাল স্পেস আর মনের ভেতর গ্রহণ ও ধারণক্ষমতার স্পেস - দু'টোর জন্যই। এটা অবশ্য আমার ব্যক্তিগত অভিমত, সবার এমন না-ও মনে হতে পারে।

অবশ্য বর্তমানে একটা নতুন যাদুঘর ভবন নির্মাণ-প্রক্রিয়াধীণ আছে, যা নাকি শেষ হলে বিশ্বের যাদুঘর জগতে একটা অষ্টমাশ্চর্য রূপে আবির্ভূত হবে!

যাদুঘরের ভিতর লুক্সোরের বাদশাহি উপত্যকায় ফারাও তুতানখামুনের ভূঃগর্ভস্থ সমাধিমন্দিরে পাওয়া অতুলনীয় প্রত্নসম্পদের একটা সংগ্রহ রয়েছে, এর জন্যে ডেডিকেটেড প্রদর্শণীকক্ষে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায়। এখানে রয়েছে ঐ সমাধিমন্দিরে পাওয়া অজস্র মহামূল্যবান অলঙ্কার, প্রত্নআসবাব আর প্রত্নতৈজসপত্র, ফারাওর ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র আর যন্ত্রপাতির নির্বাচিত সংগ্রহ। রয়েছে তুতানখামুনের মমির সেই বিশ্ববিখ্যাত সিকি মন ওজনের খাঁটি সোনার বিশাল স্বর্নমুখোশ। এই স্বর্নমুখোশটাই এখন তুতানখামুনের চেহারার একটা প্রতীক হয়ে গেছে, কারন ধারণা করা হয় এটা তার আসল চেহারার প্রতিনিধিত্ব করে। তবে আমার তুতানখামুন সংক্রান্ত দ্রষ্টব্যের মধ্যে তার সিংহাসনটা দুর্দান্ত লেগেছে। নীচে সংশ্লিষ্ট স্লাইডশোতে এর ছবি পাবেন, তবে ছবি দেখে এর মাহাত্ন্য আর জৌলুসের ১০%-ও বুঝা যায় না।

এই যাদুঘরের ভিতরে ছবি তোলার অনুমতি নেই বিধায়, নেট থেকে কিছু ভেতরের ছবি (স্লাইডশো দ্রঃ) আর একটা ৩ পর্বের চমৎকার ভিডিও দিলাম এখানে। বাইরে থেকে তোলা ছবি আমার।

আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়

আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় আরব ও সুন্নী মুসলমানদের অদ্যাবধি-চালু প্রাচীণতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এবং বর্তমানে ধর্মীয় বিবেচনায় শীর্ষ প্রতিষ্ঠানও বটে। হাজার বছর আগে ৯৭০ খৃষ্টাব্দে কায়রোতে এটা প্রতিষ্ঠা হয়। কারও কারও মতে এটা পৃথিবীতেও এখনও চালু প্রাচীণতম বিশ্ববিদ্যালয়।

মজার ব্যাপার হল, এই প্রতিষ্ঠান বর্তমানে রক্ষণশীল সুন্নী ইসলামের একটা বাতিঘর বিবেচিত হলেও, এর সূচনা কিন্তু ঠিক এরকম ছিল না। মিশরের ফাতিমিদ শাসকরা এর প্রতিষ্ঠা করেন। ফাতিমিদরা তুলণামূলক ভাবে অনেক উদারমনা ছিলেন। তাঁরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যুক্তিবিদ্যা, দর্শন, বিজ্ঞান ও এই জাতীয় অনেক বিষয়ে অধ্যয়ন ও গবেষণা ব্যপক ভাবে উৎসাহিত করেন - যখন কিনা আশেপাশের অন্যান্য দেশের শাসকরা এই জাতীয় বিষয়ের অধ্যয়ন/গবেষণাকারীদের কাফের/মুর্তাদ হিসেবে ঘোষণা করতে ব্যস্ত। গ্রীক জ্ঞানভাণ্ডারের অমূল্য সম্পদগুলিকে ফাতিমিদরা স্বাগত জানাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি, এমনকি তাঁরা এই জ্ঞানভাণ্ডারকে আরও অনেক সমৃদ্ধ করে তুলেন। জ্ঞানচর্চার রিলে রেসের ব্যাটন তাঁরা ফেলেননি, বরং সাগ্রহে তুলে নিয়েছিলেন। তাঁরা দর্শনশাস্ত্র চর্চার পৃষ্ঠপোষকতায় বিশেষ উৎসাহী ছিলেন, এবং এই শাস্ত্রের যেকোন শাখায় বূৎপত্তি আছে এমন সমস্ত বিদ্বৎজনকে পৃষ্ঠপোষকতা করতে পিছপা হতেন না। ফাতিমিদ খলিফারা (প্রতিষ্ঠাতা আল-মুইজকে দিয়ে শুরু) আশেপাশের দেশগুলি থেকে এইসব বিষয়ে পণ্ডিত ও বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ করে আল-আজহারে নিয়ে আসতেন। তারা বিদ্যার্থী আর গবেষকদের উৎসাহিত করতে উচ্চতর জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পাঠ্যবই প্রস্তুত ও এসব শাখায় শ্রেষ্ঠতম লেখাগুলি সংগ্রহে ব্যপক উদ্যোগী ছিলেন।

ফাতিমিদদের সংগৃহীত এইসব বইপত্র, লাইব্রেরি ও জ্ঞানসম্প্দের ভাণ্ডার সুলতান গাজি সালাউদ্দিন মিশর দখলের পর ধ্বংস করে চিরতরে নিশ্চিহ্ণ করে ফেলেন, ঠিক যেভাবে তিনি ফাতিমিদদেরও ধ্বংস করেন। দ্বাদশ শতাব্দীতে ইসিমাঈলি শিয়া রাজবংশ ফাতিমিদদের মিশর থেকে উৎখাতের পর আয়ুবী রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ও মুসলিম ইতিহাসে ৩য় ক্রুসেডজয়ী গাজি সালাউদ্দিন হিসেবে বিখ্যাত কট্টর সুন্নী সুলতান কুর্দি সালাউদ্দিন আয়্যুবী আল-আজহারকে একটা শাফীই সুন্নী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করেন। সেই থেকে এটা একটা সুন্নী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

১৯৬১ সালে মিশরীয় প্রেসিডেন্ট গামাল আব্দেল নাসেরের সময় আল-আজহারকে আনুষ্ঠানিক ভাবে পশ্চিমা অর্থে একটা 'বিশ্ববিদ্যালয়' হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং এতে কৃষি, প্রকৌশল, চিকিৎসা, ফার্মেসি, অর্থনীতি, বানিজ্য, এবং এজাতীয় আরও অনেক সেকুলার ফ্যাকাল্টি প্রথমবারের মত যুক্ত করা হয়।

কোন এক বিকেলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম আমি। খুব বেশি কিছু মনে নেই, তবে দেশের/বাড়ির চিন্তায় কাতর বেশ কিছু বাংলাদেশি তরুন/প্রায়-কিশোর ছাত্রের সাথে আলাপের কথা মনে পড়ছে।

......................................................................................

এ্যালিস ইন অপেরাল্যাণ্ড এণ্ড হার বাথ্রুম এ্যাডভেঞ্চার

কায়রোর রফিক ভাইয়ের আমন্ত্রণে রাশিয়ার সফররত বলশয় থিয়েটারের (?) একটা ব্যালে পার্ফর্মেন্স আর একটা সফররত বিখ্যাত তুর্কি গ্রুপের উচ্চাঙ্গীয় গীতিনৃত্যনাট্য জাতীয় পারফর্মেন্স দেখার জন্য এই পাশ্চাত্য ঢঙের কায়রো অপেরা হাউজে তার সঙ্গী হলাম। জীবনে প্রথম কোন অপেরা হাউজে যাওয়া এবং এটা 'খায় না পিন্দে' তখনো সাক্ষাতে জানি না।

আমন্ত্রণের সময় বুঝিনি স্রেফ নাচাগানা দেখব, তাতেও যে এত রকম বায়ানাক্কা থাকবে। যাওয়ার আগের দিন রফিক ভাই ফোন করে মনে করিয়ে দিলেন যে -- পুরা স্যুটেড-বুটেড-এণ্ড-টাইড হয়ে যেতে হবে। নো কম্প্রোমাইজ। রফিক ভাইয়ের অনুরোধ ফেলা কঠিন। মিশর ভ্রমণের একাধিক পর্বে তিনি আমার সফরসঙ্গী ছিলেন, তাঁর মাধ্যমেই মিশরীয় সাংস্কৃতিক জগতের কিছু কিছু দিকের সাথে আমার পরিচয়। এখন আবার আরেকটি দিকের সাথে হতে যাচ্ছে। রফিক ভাই কঠোর ভাবে জানিয়ে দিলেন, আমার ঢাকা থেকে আনা প্রায় সার্বক্ষণিক ভাবে ব্যবহৃত ধূলিধুসরিত বাটার ক্ষ্যাত-মার্কা স্যান্ডেল-শু বা ওয়াকিং শু, জিন্স আর কটন শার্ট পরে আনশেভেন অবস্থায় পুরা মিশর ও মরুভূমি ঘুরা উরাধুরা চেহারা বাড়িতেই ফেলে আসতে হবে। এখানে প্রপার্লি সুটেড-বুটেড ও মাঞ্জা মেরে না আসলে নাকি ঢুকতেই দিবে না। সত্যি না ভুয়া হুমকি জানি না, তবে এতে যে তার মান-সম্মানের অনুভূতি সিরিয়াসলি জড়িত তা বুঝা গেল। এইখানে কায়রোর পশ্চিমা-মনষ্ক এলিট ও অতি-সফিস্টিকেড ক্লাসের লোকজনই আসে শুধু। অবশ্য শুধু এই অনুষ্ঠানের জন্যই এমনটা দেখলাম নাকি সব সময়ই তাই, জানি না। অতএব কায়রোতে এসেই বানানো এক প্রস্থ নতুন স্যুট ও জুতা চাপাতে হল আর আমার হোস্টের কাছ থেকে ধার করা টাই। এখানে কিছু ফর্মাল অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার আশঙ্কা আছে বিধায় আমার চিরাচরিত আরামপ্রদ সুতি শার্ট, জিন্স, ট্রাউজার, শু/স্যান্ডেল-শু ইত্যাদির সাথে শেষ মুহূর্তে প্রায় ভুলে যাওয়া পাদটীকার মত একটা জ্যাকেটও ঢুকিয়ে ছিলাম ভাঙা ব্যাগে। ভাবখানা, নর্মাল প্যান্ট-শার্টের উপর এটা চাপিয়ে দিলেই হবে। এই জ্যাকেট আর আমার বেচারা স্যাণ্ডেল-শু যে পরে ফ্রিতে কত জনকে কত হাসির খোরাক যোগাবে তা তখন ঘুণাক্ষরেও বুঝিনি। এসে দেখি, এইখানে শহরে পান-বিড়িওলাও মনে হয় টাইসহ থ্রি-পিস লাগায়। ঘর থেকে স্যাণ্ডেল-শু পরে সিগারেট ফুঁকার জন্যে একটু বেরুতে গিয়ে প্রথম দিনেই আমার আত্নীয় হোস্টের হায়-হায় শুনতে হল - তার চাকরও নাকি জুতা ছাড়া রাস্তায় বেরোয় না। এখানে নাকি ফকিররাও রাস্তায় স্যাণ্ডেল-ম্যাণ্ডেল পরে না। তার গেস্ট এভাবে বেরুলে তার মান-সম্মান বলে আর কিসসু থাকবে না। ছি ছি। ফলে কায়রো এসে দুয়েক দিনের মধ্যেই একটা পুরো 'ইভনিং স্যুট' বানাতে হল।

অপেরা হাউজে এসে দেখি বিশাল ভাবচক্কর। কেতাকানুন আর ভাবভঙ্গির নানাপদের অপরিচিত বায়ানাক্কা। দমফাটানো দামি পোশাকের খসখসানি আর চোখঝলসানো অলঙ্কারের রিনিঝিনি। বিভিন্ন দেশের মানুষই আছে, তবে কায়েরিয়ানদের ভাবচক্করই একটু বেশি মনে হল। এটা কি একটুখানি 'সূর্যের চেয়ে বালির তাপ বেশি' বা 'ম্যাক্‌কলে' সাইকোলজির ফল? জানি না, তবে নিজেকে কেমন যেন ফাঁপা অন্তঃসারশুন্য ফকির-ফকির লাগতে থাকা অবস্থায় আমার তেমনটা ভাবতেই বেশি ভাল লাগছিল। আমারটাই হয়তো গোপন 'আঙুর ফল টক' মানসিকতার ফল। কে জানে!

যাহোক, ভিতরে মূল শো শুরু হওয়ার পর কি হল বা কি দেখলাম সে সম্পর্কে বেশি কিছু না বলি। কিছুই বুঝিনি তখন, আর বুঝিনি বলে এখন মনেও নেই। তবে যেটুকু মনে পড়ে প্রথম শো-টা ছিল মনে হয় পিনোকিওর কাহিনির উপর ডেভেলপ করা একটা ব্যালে নৃত্যনাট্য টাইপের কিছু। আরও কিছুও বোধহয় ছিল, যার সবই আমার মাথার উপর দিয়ে গেছে। পিছনে তাকিয়ে দেখি দামি ক্লাস থেকে অপেরা-গ্লাস দিয়ে অনেকে দেখছেন। বাহ্‌, আমি তো খালি চোখেই দিব্যি দেখতে পাচ্ছি! আশেপাশে তাকিয়ে দেখি পিনপতন সমঝদার নিস্তব্ধতা ও মনোযোগ। কিন্তু আমি এইসব উচ্চাঙ্গের কার্যকলাপের রসগ্রহণে অক্ষম হয়ে একসময় ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে সৎ অভিব্যক্তির প্রকাশ হিসেবেই কেটে পড়তে চাইলাম। বেলিড্যান্সের জ্ঞান দিয়ে এইসব বুঝা যায় না। কিন্তু পাশে বসে থাকা রফিক ভাইয়ের শো-থেকে-চোখ-না-সরিয়েই একটা চাপা দাবড়ানিতে বসে যেতে হল। তিনটি কারন মনে হলঃ তার সঙ্গী এভাবে উঠে গেলে আনকালচার্ড অতিথি আনায় তাঁর সম্মানহানি হবে, পিছনের ও বেরুনোর পথের দর্শকদের অসুবিধা হবে এবং তারাও আনকালচার্ড ও আনকুথ মনে করবে, ইত্যাদি। তবে মুখে উনি বললেন, "বসে থাকেন! জীবনে আবার কবে বলশয় দেখতে পাবেন তার ঠিক নাই। দেখে নেন।" উনিও দেখলাম চোখের পাতা না ফেলে একদৃষ্টে সার্চলাইটের মত দেখে যাচ্ছেন, যেন রীতিমত গিলছেন। তবে, আমার কেন যেন সন্দেহ কুড়কুড় করতে থাকল - উনিও আসলে বোধহয় তেমন কিছুই বুঝতে পারছেন না বা এনজয় করছেন না। কিন্তু সেটা স্বীকার না করে 'অভিজ্ঞতা-অর্জন' এবং মান-ও-ভাব রক্ষার খাতিরে জোর করেই পুরোটা বেমালুম গিলতে বদ্ধপরিকর। তবে এই চিন্তাটাও আমার 'আঙুর ফল টক' জাতীয় কোন সাইকোলজির ফল হতে পারে অবশ্য।

বিরতির পরের পর্বে ছিল একটা সফররত তুর্কি গ্রুপের পারফর্মেন্স। তুর্কি চর্কি-দরবেশনৃত্য ভিত্তিক সুফি সাধনার উপর নৃত্যনাট্য জাতীয় কিছু একটা বোধহয়। তবে এটা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন টুরিস্টি কালচারাল জগাখিচুড়ি শোতে যে ধরণের চর্কি-দরবেশনৃত্য দেখানো হয়, বা আমি নীলনদের বুকে প্রমোদতরীতে যেটা দেখেছি (স্লাইডশো দ্রঃ), সেরকম কিছু না। অনেক উচ্চমার্গের কিছু। দেখেও মনে হল, শিল্পীদের দলনেতার ইন্ট্রোর কথাবার্তায় ও পরে আমাকে গিফ্‌ট করা তাদের ব্রশিওর ও ডিভিডির ফ্ল্যাপ দেখেও মনে হল। এটা মনে হয় ওদের ভারতনট্যম বা কত্থক বা ঐ জাতের কিছু। অন্তত সেভাবেই ইন্টেন্ডেড। যাজ্ঞে, ভারতনট্যম বা কত্থকও আসলে কাকে বলে জানি না। শুন্যবিদ্যা জাহির করা বিপজ্জনক!

অনেকক্ষণ 'কালচারের' দাম চুকাতে বাথ্রুম চেপে ছিলাম। বিরতি আসতেই থিয়েটার হল থেকে ছিটকে বেরুলাম। কিন্তু বেরিয়ে বাথ্রুমে ঢুকতেই দেখি, ওরেব্বাবাহ্‌, মূত্রত্যাগ করতেও হাই কালচার! ঝাঁ-চকচকে বাথ্রুম-কমপ্লক্সের লবিতে ফর্সা-গোলাপি বদনের ঝকঝকে ফিল্মস্টার-মার্কা মাখ্‌খন-মাখ্‌খন চেহারাওয়ালা আর অতি-স্টাইলিশ কমপ্লিট স্যুট পরিহিত একজন... কি?....একজন মধ্যবয়ষ্ক সুদর্শন বাথরুম-এ্যাটেন্ডেন্ট দাঁড়িয়ে আছেন আমার অপেক্ষায়। হা হা করে মনে মনে অনেকক্ষণ হাসলাম। এবারে ক্লান্তি কেটে গেছে, আবার ভাল লাগছে। উনি স্যর-স্যর করতে করতে কোথায় ক্ষুদ্রকর্ম সারতে হবে দেখিয়ে দিলেন। বাহ্‌! কাজ সারতে সারতে চোখের কোনা দিয়ে দেখি অন্যদের ভদ্রলোক তোয়ালে, ন্যাপকিন, হ্যান্ডওয়াশ, ড্রায়ার সহ নানারকম টয়লেট্রিজ এগিয়ে দিচ্ছেন বা যন্ত্রপাতি ব্যবহারে সাহায্য করছেন ফাইভ-স্টার হোটেলের রেস্তোরাঁ ম্যানেজারের কেতাদূরস্ত পলিশ্‌ড ভঙ্গিতে। বাথরুমের অতিথিরাও কেতাদূরস্ত ভঙ্গিতে সৌজন্যমূলক মাপা-মধুর হাসি দিয়ে, ধন্যবাদ জানিয়ে, তার হাতে দু-পাঁচশ ইজিপশিয়ান পাউণ্ডের বখশিশ গুঁজে দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। এইবার একটা ঝাঁকি খেলাম। স্রেফ মূত্রত্যাগের জন্যে আমাকেও এটা দিতে হবে নাকি?! ৫০০ এল্‌ই অর্থাৎ ইজিপশিয়ান পাউণ্ড মানে তখন বাংলাদেশি টাকায় ৬০০০ টাকা। মাথ্‌থা খারাপ! চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে মিনিমাম ১০০-ও যদি দেই মাত্র কয়েক মিলি ছোটকাজ করেছি বলে, তাহলেও ১২০০ টাকা। কয়েক ফোঁটা পেশাব দানের জন্য ৬০০০-১২০০ টাকা ? ফাত্রামি নাকি! হা হা। ডরোথি ডানেটের একটা ইতিহাস-ভিত্তিক উপন্যাসের কথা মনে পড়ে গেল। মধ্যযুগে অভিজাত টার্কিশ পাব্লিক-হাম্মামখানায় গুরুত্বপূর্ণ অতিথিদের সর্বপ্রকার সেবা দেয়ার জন্য নাকি সুদর্শন বালক-গেলমান এটেন্ডেন্ট নিয়োগ দেয়া হত। এই ব্যাটাও সেরকম কিছু নাকি - মধ্যবয়ষ্ক সংস্করণ? কাজ সেরে বহু কষ্টে লোকটার দিকে একবারও না তাকিয়ে ও সম্পূর্ণ পিঠ ফিরিয়ে থেকে সে যখন অন্য অতিথি নিয়ে ব্যস্ত তখন আস্তে করে বাথরুম থেকে সটকে পড়লাম। যেন কিছুই বুঝিনি। কালচারের গুল্লি মারি!

কায়রো অপেরা হাউজের প্রধান হলে রয়েছে ৪টি লেভেলে ১৩০০ দর্শকের জন্য আসন ব্যবস্থা - অর্কেস্ট্রা আসন, তিনটি টায়ার ও একটি প্রেসিডেনশিয়াল বক্স সহ। এখানে অপেরা, অর্কেস্ট্রা আর ব্যালে পারফরমেন্স হয়ে থাকে। ছোট হলে সিঙ্গেল ফ্লোরে ৫০০ আসন ব্যবস্থা রয়েছে। এটা চেম্বার মিউজিক আর রিসাইটালের জন্য ব্যবহৃত হয়। রয়েছে ওপেন এয়ার থিয়েটার (৬০০ আসন), রোমান এম্ফিথিয়েটার (৬৫০ আসন), এল গোমহুরিয়া থিয়েটার (৬৪৮ আসন), আরব মিউজিক ইন্সটিটিউট (৩০০ আসন), সাঈয়েদ দারভিশ থিয়েটার (১০০০ আসন), ইত্যাদি। এছাড়াও রয়েছে মিউজিক লাইব্রেরি, আর্ট গ্যালারি সহ আরও অনেক কিছু। ছবি ও ভার্চুয়াল টুরের জন্যে স্লাইডশো দেখুন।

......................................................................................

এবার বিদায় নেয়ার পালা। মিশর থেকে যেমন, তেমনি এই "মরুযাত্রা" সিরিজ থেকেও। সুপ্রাচীণ এই সভ্যতার দেশের এমাথা থেকে ওমাথা, উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিমে নদী-সাগর-লেক-হ্রদ-মরুভূমি-পাহাড়-পর্বত-দ্বীপ-মরুদ্যান, মন্দির-মসজিদ-মোনাস্টারি-পিরামিড-স্ফিংক্স-মূর্তি-ওবেলিস্ক-প্রাসাদ-দূর্গ-যাদুঘর-মমি-স্যাকোফ্যাগাস-হিরোগ্লিফিক্স-ভূঃগর্ভস্থ সমাধিসৌধপল্লী-লাইব্রেরি-গ্যালারি-ক্যাটাকম্ব-ফেলুক্কা-বেলিড্যান্স-ব্যালে-অপেরা-নগর-বন্দর বহু কিছুই তিনটি মাস ধরে দেখেছি। সেসবের কিছু কিছু নিয়ে প্রায় দুই বছর ধরে এই সিরিজের ১৩টি পর্বে ধীরে ধীরে লিখলাম। শুরুতে ধারণা ছিল প্রথম পর্বের ঐ আক্ষরিক মরুভ্রমণের কাহিনিটাই শুধু লিখব। সে জন্যেই এর 'মরুযাত্রা' নামকরণ। কিন্তু সেটা যে তের পর্বের এই বিশাল রচনায় এসে ঠেকবে, তা কল্পনাও করিনি তখন। করলে লিখতেই পারতাম না।

আমি লেখক নই। এটাই সম্ভবত আমার জীবনে প্রথম নিজস্ব প্রকাশ্য রচনা, বা রচনার ধৃষ্ঠ প্রয়াস। প্রথম ব্লগ তো বটেই! এই সুযোগ করে দেয়ার জন্য সচলায়তনকে অনিঃশেষ ধন্যবাদ। সেই সাথে পাঠকদেরও - সাথে থাকার জন্য, সব রকম মন্তব্য-প্রশংসা-সমালোচনার জন্য। এর সব কিছুই আমার পাথেয় হয়ে থাকবে। এর পরে আর হয়তো লেখা হবে না।

আর মিশর? তাকেও এক অতুলনীয়, ওয়ান্স-ইন-এ-লাইফটাইম অভিজ্ঞতা উপহার দেয়ার জন্য সীমাহীণ কৃতজ্ঞতা। যে অভিজ্ঞতা, শিক্ষা ও আনন্দের মূল্য কোন কিছু দিয়েই পরিমাপ করা যাবে না।


সমাপ্ত


কায়রো স্লাইডশো

মিশরের প্রধান পিরামিডগুলি কায়রোতেই। তবে সেসবের ছবি আগের পর্বগুলিতে দেয়ায়, এই স্লাইডশো থেকে সেসব বাদ গেল। শহরের ভেতরে যেসব জায়গার ছবি আগে দেইনি, এবারে সেগুলি দিলাম। বেশির ভাগ আমারই তোলা, তবে কয়েকটা কোন সফরসঙ্গীরও তোলা হতে পারে।

মিশরীয় যাদুঘর স্লাইডশো

কায়রোর বিখ্যাত 'মিউজিয়াম অফ ইজিপশিয়ান এন্টিকিউটিজ'-এর ভিতর থেকে প্রাচীণ মিশরীয় সভ্যতা সংশ্লিষ্ট তাদের উল্লেখযোগ্য ও বিশ্ববিখ্যাত কিছু প্রত্ন/শিল্প সম্পদের ছবি। এই স্লাইডশোর যাদুঘর ভবনের প্রথম দৃশ্যমান বাহ্যিক ছবিটি বাদে সব ছবিই নেটপ্রাপ্ত।

অপেরা স্লাইডশো

মূল পোস্টে আলোচিত কায়রো অপেরা হাইজের ভিতর ও বাইরের দৃশ্য সম্বলিত স্লাইডশো ও এনিমেটেড ভার্চুয়াল ট্যুর। এরও সবটাই নেটপ্রাপ্ত।

মিশর ভিডিওপ্লেক্স ও বেলিড্যান্স

এই মরুযাত্রা সিরিজটা লিখতে লিখতে প্রাচীণ মিশরীয় সভ্যতা, ধর্ম, ইতিহাস, সংস্কৃতি, পিরামিড, ফেরাউন, মমি, মরুভূমি, নীলনদ, ক্লিওপ্যাট্রা থেকে শুরু করে আধুনিক কালের বেলিড্যান্স পর্যন্ত - অনেক দুর্দান্ত তথ্যচিত্র ও ভিডিও দেখার সুযোগ হয়েছে। তারই একটা নির্বাচিত সংকলন এই ভিডিওর সমাহার।


তথ্যসহায়তাঃ উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য।



মন্তব্য

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

অনেকদিন পর মরুযাত্রা নিয়ে লিখলেন। দারুন হইছে।
সবগুলো মরুযাত্রা পড়েছি, আপনার লেখা পড়ার সাথে সাথে একটা ছোটখাট মরুট্রিপও সেরে ফেললাম। হাসি

মন মাঝি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

বাই দি ওয়ে, আপনার "জাতীয়তাবাদ" বা 'জাতি' নিয়ে লেখাটার কি হল রাজা ভাই? বিবিসির ওয়েবসাইটে সেদিন একটা বেশ ইন্টারেস্টিং লেখা পড়লাম এখানে, যা বেশ প্রাসঙ্গিক মনে হল আমাদের ঐ পুরনো আলোচনার প্রসঙ্গে। পড়ে দেখতে পারেন। নতুন চিন্তার খোরাক কিছু পেলে জানিয়েন। আমার অন্তত দারুন লেগেছে।

****************************************

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

বাকির খাতায় পড়ে আছেরে ভাই। মন খারাপ
বিবিসির আর্টিকেলটা পড়ে দেখব। হাসি

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

দর্শনীয় স্থানসমূহের বাইরে যে ইতিহাস, ধর্ম, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ের অবতারণা করেছেন সে কারণে আপনি ধন্যবাদার্হ। অনেক বেশী কিছু জানা হলো আপনার এই 'মরুযাত্রা' সিরিজ থেকে।
আবারও ধন্যবাদ। ভাল থাকুন।

মন মাঝি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- -- আপনাকেও অজস্র ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্য!

****************************************

অতিথি লেখক এর ছবি

মিশরে যাওয়া হয়নি তবে ঘুরে এলাম মনে হল। আপনার লেখা আর ছবি এর সম্পূর্ণ কৃতিত্বের দাবিদার। অসাধারণ পোস্ট। ভালো থাকবেন।

অমি_বন্যা

মন মাঝি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

****************************************

সত্যপীর এর ছবি

শেষই কইরা দিলেন?

আরেকটা কিছু ধরেন। এইরকম ভ্রমণ ইতিহাস কালচারের ককটেল মার্কা।

..................................................................
#Banshibir.

মন মাঝি এর ছবি

দিলাম, অনেক তো হইলো! হাসি

দেখি।

****************************************

ফাহিম হাসান এর ছবি

লেখা ভালও হয়েছে।

কেন জানি না - মিউজিয়াম আমাকে খুব ক্লান্ত করে ফেলে (ব্যতিক্রম - মিউজে দহসে)

মন মাঝি এর ছবি

আমার বিশ্বখ্যাত কোন মিউজিয়ামে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নেই, বৃটিশ/ল্যুভর/স্মিথসোনিয়ান থেকে শুরু করে ঐসবে গেলে কেমন লাগবে জানি না। তবে কায়রো মিউজিয়ামে গিয়ে যেটা মনে হয়েছে তা হল - প্রদর্শিত প্রত্ন-আইটেমগুলিকে কন্টেক্সচুয়ালাইজ করা দরকার। তা না হলে এর মর্ম ও মূল্য অনেকখানিই হারিয়ে যায়। অথচ মিউজিয়ামের উৎসপরিবেশ-বিচ্ছিন্ন কৃত্রিম, সীমাবদ্ধ ও শৃঙ্খলিত পরিবেশে সেটাই হয়।

একটা উদাহরন দেই। কায়রো যাদুঘরে বহু ফারাও ও দেবতার গাদা-গাদা বিশাল-বিশাল মূর্তি আছে। যাদুঘরের ভিতরে এগুলি আমাকে খুব একটা আকর্ষন করেনি। রসগ্রহণ করতে বা রিলেইট করতে পারিনি। প্রথম দিকে প্রাথমিক চমক ও অভিনবত্বের কারনে একটু ভাল লাগলেও, পরে যখন দেখলাম মূর্তির আর কোন শেষ নাই - তখন আস্তে আস্তে আমার ইন্দ্রিয়গুলি ভোঁতা হয়ে গেল। একটা থেকে আরেকটাকে আর পৃথক করতে পারছিলাম না - মনে হচ্ছিল সবই এক - প্রাণহীণ পাথরের জঙ্গল মাত্র। অথচ আসলে তাতো নয় - এর সবগুলির মধ্যেই নিজস্বতা আছে, আলাদা সৌন্দর্য আছে, আলাদা-আলাদা কাহিনি আছে। কিন্তু যাদুঘরের কৃত্রিম, প্রসঙ্গবিচ্ছিন্ন, বন্দী পরিবেশে গুদামজাত একত্র অবস্থায় তাদের সেই নিজস্বতা, কাহিনি আর সৌন্দর্য হারিয়ে যাচ্ছিল। তা যতই কিনা ডিস্প্লের সামনে কোন ফলকে গাদা-গাদা "তথ্য" লেখা থাক। ফলে অল্প কিছুক্ষণ দেখেই ক্লান্ত হয়ে সটকে পড়েছি অন্য কোন সেকশনে। অথচ এই একই জিনিষ যখন বহু দূরে কর্নক, লুক্সোর, বা মরুভূমির মাঝে আবু সিম্বেলের মন্দিরে তাদের স্বাভাবিক, আদি পরিবেশে দেখেছি - তখন কিন্তু আমিই আবার বিমুগ্ধ বিস্ময়ে অপলক তাকিয়ে থেকেছি, রসাস্বাদন করেছি - সুদীর্ঘ সময় ধরে!

আমার মনে হয় 'বন্যরা বনেই সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ের' - মত এক্ষেত্রেও হয়তো বলা যায় - প্রত্ন ও সাংস্কৃতিক সম্পদ তার উৎসভূমি/স্থানেই সুন্দর, ঠিক যেমনি বন্যরা বনে ও শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।

****************************************

কড়িকাঠুরে এর ছবি

শেষ পর্ব ছিল... ঠিক আছে- আগেরগুলো পড়তে হবে...

মন মাঝি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

****************************************

তারেক অণু এর ছবি

ভাল লাগল, মিশর যাবার আগে আবার পড়ব খাইছে বিশেষ করে মিশরের আকর্ষণ নিয়ে লেখা লাইনগুলো দুর্দান্ত।

মন মাঝি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- মিশর যাওয়ার আগে সচলে পোস্ট দিয়েন।

****************************************

সাফিনাজ আরজু  এর ছবি

চলুক
খুব ভালো লাগলো।

মন মাঝি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

****************************************

মন মাঝি এর ছবি

আমার দেখা মিশর যে কোন রাস্তায় যাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। 'তাহরির বিপ্লব' দেখলাম। কিন্তু সেটা শেষ হইয়াও হইল না শেষ। এরপর সংবিধান নিয়ে লাগল। এখন আবার লাগসে ফুটবল রায়টে মৃত্যুর জন্য দায়ীদের ফাঁসির আদেশ নিয়ে। টিভিতে পোর্ট সাঈদের রাস্তায় রায়টের দৃশ্য দেখছিলাম। এর শেষ কই? টিভিতে দেখা এখনকার দেশটাকে একেবারেই চিনতে পারছি না। আমি যখন ছিলাম তখন এসব কিছুই দেখিনি।

****************************************

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।