চতুর্দশ শতাব্দীর দিল্লীর সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলুক ছিলেন নাটকীয় বৈপরীত্যে ভরা এক বর্ণাঢ্য চরিত্র। একাধারে তার মহানুভবতা ও চরম নিষ্ঠুরতা, পাণ্ডিত্য ও বোকামি, ভিশনারি দৃষ্টিভঙ্গি ও ভীষণারি ব্যর্থতা – সবকিছু মিলিয়েই তিনি ইতিহাসে ‘পাগলা রাজা’ হিসেবে প্রসিদ্ধি পেয়েছিলেন। আর তার পাগলাটে কীর্তিকলাপই পরে ‘তুঘলুকি কাণ্ড’ নামে পরিচিতি পায়। এতই বৈপরীত্য তার স্ববিরোধী চরিত্রে নিহিত ছিল যে ঐতিহাসিকরা তাকে পাগল না প্রতিভাবান, ভিশনারি না কল্পনাবিলাসী, রক্তপিপাসু স্বৈরাচারী না মহানুভব শাসক, ধর্মনিষ্ঠ না ধর্মবিরোধী – কিভাবে অভিহিত করবেন তা নিয়ে ব্যপক বিব্রত ছিলেন।
এই মুহম্মদ বিন তুঘলুক সম্পর্কে ইস্কুলে থাকতেই ইতিহাসের পাঠ্যবইতে পড়েছিলাম। এখনো ঝাপসা মনে আছে সে সময় পাঠ্যবইতে পড়া তার ‘ন্যায়পরায়নতার’ উদাহরণ হিসেবে শিকারে গিয়ে ভুল করে এক দরিদ্র কৃষক সন্তানকে আহত করা্র কাহিনিটা। এই অপরাধের জন্য সম্রাট নিজেই কাজির দরবারে গিয়ে দোষ কবুল করেন এবং কাজিকে নির্দেশ দেন তাকেও আর সবার মত বিচার করতে। শেষ পর্যন্ত ঐ দরিদ্র কৃষক সন্তানকে দিয়ে সম্রাটকে চাবকানো হয় শাস্তি হিসেবে। গল্পটা ঠিকঠাক মনে পড়ল কিনা জানি না, তবে এরকমই কিছু ছিল। অথচ এই ন্যায়বিচারের পরম ভক্তই নাকি আবার সামান্যতম সন্দেহের ভিত্তিতে সন্দেহভাজন বিদ্রোহী বা ষড়যন্ত্রকারীদের মেরে দুর্গতোরনের বাইরে প্রকাশ্যে তাদের মৃতদেহ টাঙিয়ে রাখতেন জনমনে ভীতিসঞ্চার করার উদ্দেশ্যে। কিম্বা ছুঁড়ে ফেলা হত খুনে হাতির পালের সামনে যাদের দাঁতে ধারালো ব্লেড জাতীয় কিছু লাগানো থাকত যা দিয়ে তারা কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলত লোকগুলিকে। আরেক কাহিনিতে আছে তার নির্দেশে এক লোককে হত্যা করে তার দেহ খণ্ডবিখণ্ড করে সেই হাড়মাংস দিয়ে বিরিয়ানি রান্না করে সেই বিরিয়ানি নিহত ব্যক্তির পরিবারকে খাওয়ানো হয়। অথচ এই পাগলা রাজাই আবার সুবিশাল ক্যাটাপল্ট দিয়ে জনতার মধ্যে প্রায় বৃষ্টির মত স্বর্ণমুদ্রা বিতরণ করে তার দানশীলতা প্রতিষ্ঠা করতেন!
তুঘলুকাবাদঃ ভিতর থেকে বহির্দৃশ্য
মুহম্মদ বিন তুঘলুকের তুঘলুকি কাণ্ডের অসংখ্য উদাহরণের মধ্যে আরেকটি উদাহরণ হল তার রাজধাণী পরিবর্তন। ১৩২৭ সালে তিনি হঠাৎ দিল্লী থেকে ৭০০ মাইল দক্ষিণে দৌলতাবাদে তার রাজধাণী স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেন। আর এই কাজ করতে গিয়ে তিনি নাকি [একটি ভার্শান অনুযায়ী] আস্ত রাজধাণী দিল্লীর সমস্ত লোককে উপড়ে প্রায় ঘেটি ধরে দৌলতাবাদে ঠেলে পাঠিয়ে দেন – বৃদ্ধ, পঙ্গু, অসুস্থ নির্বিশেষে। এর ফলে জনগনকে অকল্পণীয় দুর্দশা পোহাতে হয়। অথচ, এই স্থানান্তর শেষ পর্যন্ত ফেল মারে এবং ১৩৩৫ সালে রাজধাণী আবার দিল্লীতে ফিরিয়ে আনতে হয় তার জনগন সমেত। সমস্ত জনগন সমেত দুই-দুইবার আস্ত রাজধাণী জবরদস্তি করে সেই যুগে ৭০০ মাইল স্থানান্তর করা যে কি তুলকালাম ব্যাপার তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এমন অতুলনীয় দক্ষযজ্ঞ কাণ্ডের জন্যেই ইতিহাসে মুহম্মদ বিন তুঘলুকের কাণ্ডকারখানা তার নিজের নামেই, অর্থাৎ ‘তুঘলুকি কাণ্ড’ নামেই ভাস্বর।
অথচ এই পাগলা রাজাই নাকি সেযুগের হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র শিক্ষিত দিল্লীর সুলতানদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। মুহম্মদ বিন তুঘলুকের পাণ্ডিত্য বিস্তৃত ছিল যুক্তিবিদ্যা, দর্শন, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, শরীরবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, ডায়ালেক্টিক্স, ধর্ম, ক্যালিগ্রাফিসহ আরও অনেক কিছুতে। তিনিই সম্ভবত প্রথম মুসলিম শাসক যিনি সংস্কৃত জানতেন – আরবি, ফার্সি আর তুর্কি-র পাশাপাশি। বিশ্বপর্যটক ইবনে বতুতা তার বিশ্বভ্রমণের পরিক্রমায় ১৩৩৪/৩৫ সাল থেকে এই সুলতান তুঘলুকের রাজত্বেই ৮ বছর কাজির পদে চাকুরি করে গেছেন, লিখে গেছেন তার আর তার রাজত্ব সম্পর্কে অনেক চমকপ্রদ কাহিনি।
তো সেই স্কুলপর্ব থেকেই আমি এই পাগলা রাজার পাগলামির গুণমুগ্ধ একনিষ্ঠ ভক্ত। তারপর যখন আরও অনেক পরে
টিম-ম্যাকিন্টশ স্মিথের অনুবাদে ইবনে বতুতার বিশাল ভ্রমণগ্রন্থ (
‘the greatest travel book ever written’)
রিহ্লা-র সংক্ষিপ্ত ইংরেজি অনুবাদটা পড়লাম, তখনতো আর কথাই নাই নিজেই প্রায় বতুতা হয়ে ৭৫০ বছর আগে তুঘলুকি জগতের অলিতে গলিতে কল্পনায় টাইম-ট্রাভেল শুরু করে দিয়েছি। কান পাতা শুরু করেছি এক সুদূর অজানা যুগের রহস্যময় ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-গুলির আড়ালে কামনা-বাসনা-ইর্ষা-দ্বেষ-রক্ত-হত্যা আর ষড়যন্ত্র গোপনে ধূমায়িত হয়ে ওঠা প্রকোষ্ঠে-প্রকোষ্ঠে আর অলিন্দে-অলিন্দে। এই করতে করতে হঠাৎ একদিন নিজেকে আবিষ্কার করলাম – না কল্পনায় না, এবারে সত্যি সত্যি আর সশরীরে - মুহম্মদ বিন তুঘলুকের প্রথম রাজধাণী ও দুর্গনগরী সাক্ষাৎ ‘তুঘলুকাবাদের’ সিংহদুয়ারে!
দুর্গপ্রাকারঃ বহির্দৃশ্য
কিংবদন্তীর তুঘলুকাবাদ দুর্গনগরী মুহম্মদ বিন তুঘলুকের বাবা এবং তুঘলুক বংশের প্রতিষ্ঠাতা গিয়াসুদ্দিন তুঘলুক ১৩২১ সালে তার রাজধাণী হিসেবে প্রতিষ্ঠা বা নির্মান শুরু করেন। প্রায় সাড়ে ছয় কিলোমিটার বিস্তৃত এবং বিন তুঘলুকের সময় আরও ২৮ কিলোমিটার পরিকল্পিত প্রাকারে বিস্তৃতব্য এই বিশাল দুর্গনগরীর ৫২টি সিংহদুয়ার ছিল। বর্তমানের ধ্বংসস্তুপেও যার ১৩টি পাওয়া যায়। বলা হয়নি - এই দুর্গনগরীর বেশির ভাগই এখন ধ্বংসস্তুপে পর্যবসিত।
আক্রমণকারীদের প্রতিহত করার জন্য ছাদের উপর থেকে স্বপক্ষের সৈন্যদলের নিরাপদে অস্ত্রশস্ত্র নিক্ষেপের জানালা, অর্থাৎ ব্যাট্লমেন্ট প্যারাপেট-সজ্জিত স্থাপনা আর পেট ফুলে ওঠা গোলাকৃতির উলটানো মাগের মত দেখতে অজস্র বহুতল বুরুজ (?=bastion) শোভিত এবং মাইলের পর মাইল বিস্তৃত পরিখাঘেরা দুর্গপ্রাকারের পাশ কাটিয়ে তুঘলুকাবাদের অন্যতম সিংহদুয়ারে পৌঁছুলাম। ঐতিহাসিক ভাবে দিল্লীর পঞ্চম রাজধাণী শহর এই তুঘলুকাবাদ দুর্গনগরী সুলতান গিয়াসুদ্দিন প্রধানত নির্মান করেছিলেন উত্তর-পশ্চিম, বিশেষত মধ্য-এশিয়া থেকে ঘন ঘন আসা মোঙ্গল আক্রমণকারীদের প্রতিহত করতে।
ব্যাট্লমেন্ট প্যারাপেট
প্যারাপেটসহ গোলাকৃতির ব্যাস্টিওন (বুরুজ?)
প্যারাপেটসহ গোলাকৃতির ব্যাস্টিওন
এত বড় দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড খুব একটা কাজে আসেনি অবশ্য, কারন নির্মানকাজ শেষ হওয়ার পর খুব অল্পদিন পরেই তুঘলুকাবাদ আমূল পরিত্যক্ত হয়। আজও পর্যন্ত সেই অবস্থাতেই আছে। ১৩২৫ সালে গিয়াসুদ্দিনপুত্র মুহম্মদ বিন ক্ষমতায় আসার পর ১৩২৭ সালে তিনি তার নবনির্মিত শহর জাহানপানাহে রাজধাণী সরিয়ে নেন। কথিত আছে, তুঘলুকাবাদ পরিত্যক্ত হওয়ার কারন হল সমকালীণ বিখ্যাত সুফী সাধক নিজামুদ্দিন আউলিয়ার একটি অভিসম্পাত। গিয়াসুদ্দিন নাকি তার স্বপ্নের দুর্গনগরী নির্মানের জন্য দিল্লীর সমস্ত রাজমিস্ত্রীকে তার প্রোজেক্টে কাজ করা বাধ্যতামূলক করে করে দেন। আর এর ফলেই প্রবল প্রভাবশালী সুফী দরবেশ নিজামুদ্দিন আউলিয়ার একটি নির্মীয়মান স্থাপনার (কারও মতে কূপ বা পুকুর) কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এতে ক্ষেপে গিয়ে পীরবাবা নিজামুদ্দিন সেই ইতিহাসখ্যাত অভিসম্পাতটি উচ্চারণ করেন – ‘ইয়া রাহে হিসার, ইয়া বাসে গুজ্জার’ !* অর্থাৎ সম্রাটের রাজধাণী পরিত্যক্ত বিরানভূমিতে পরিণত হবে আর সেখানে অল্পকিছু গুজ্জার গোত্রের মেষপালক ছাড়া আর কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। মজার ব্যাপার হল, ঠিক তাইই হয়েছে। লোককাহিনির ব্যাখ্যায় অভিশাপের ভয়ে হোক, কিম্বা কোন স্ট্র্যাটেজিক কারনেই হোক, মুহম্মদ বিন তুঘলুক ক্ষমতায় এসে ১৩২৭ সালে সেই যে তুঘলুকাবাদ ছাড়লেন, তারপরে তিনি বা আর কেউই এখানে ফিরে আসেননি। সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংরেজ উইলিয়াম ফিঞ্চ এখানে এসে দেখেন খালি ঝোপঝাড় আর কিছু গুজ্জার ছাড়া আর কিছু নেই। তার ভাষায়, “প্রাচীণ দিলীর এই শবের... [উপরে] কিছু গুজ্জার ছাড়া আর কেউ থাকে না।” একবিংশ শতাব্দীতে আমিও এসে মোটামুটি একই ঘটনা দেখলাম। বিশাল দুর্গপ্রাকারের ভিতরে খালি ধ্বংসস্তুপ আর ঝোপঝাড়। অবশ্য গুজ্জার দেখিনি, বা দেখলেও চিনিনি!
পোড়ো ভূমিঃ নিজামুদ্দিন আউলিয়ার অভিশাপ?
গিয়াসুদ্দিন এই অভিশাপের প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন।১৩২৫ সালে বাংলায় অভিযানের পর দিল্লীতে ফেরার পথে গিয়াসুদ্দিন নিজামুদ্দিনের উপরে প্রতিশোধের পরিকল্পনা করলে, সেই কথা শুনে নিজামুদ্দিন আউলিয়া তার আরেক বিখ্যাত বচন দেন শিষ্যদের কাছে – “দিল্লী হনুজ দূর অস্ত্” – দিল্লী বহুৎ দূর! অর্থাৎ - তোমার দিল্লী পৌঁছাতে এখনও অনেক বাকি। আগে তো পৌঁছাও! অনুচ্চারিত কথাটা হল – আমাকে যখন হুমকি দিয়েছ, তোমার আর কোনদিনও বাড়ি ফেরা হবে না।আর আসলেই, গিয়াসুদ্দিনের আর কোনদিনও দিল্লী ফেরা হয়নি। বাংলা অভিযান থেকে ঐ ফেরার পথেই তিনি নিহত হন – অনেকের মতে নিজেরই সন্তান বিন তুঘলুকের হাতে। এভাবেই, নিজামুদ্দিনের কথিত দুটি বিখ্যাত উক্তিই নাকি অক্ষরে অক্ষরে ফলে যায়। আর এজন্যেই হয়তো এই দু’টি উক্তিই টিকে গেছে ইতিহাসের সুদীর্ঘ পরিক্রমায়, তুঘলুকদের উছিলায়।
তুঘলুকাবাদের ভিতরে নানারকম ভগ্নদশাপ্রাপ্ত বুরুজ/ব্যাস্টিওন বা পর্যবেক্ষণ-টাওয়ার, প্যরাপেট, নিশ্চিহ্নপ্রায় কিছু ভবনের শেষচিহ্ন সহ কিছু জিনিষ অবশ্য দেখলাম। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুটি নিদর্শন হচ্ছে - ভূঃগর্ভস্থ শস্যাগা্রের ধ্বংসাবশেষ আর মূল দুর্গনগরীর বাইরে - কিন্তু সংযুক্ত - গিয়াসুদ্দিন তুঘলুকের সমাধিসৌধ। তুঘলুক বহিঃশত্রুর দীর্ঘমেয়াদী অবরোধের কারনে জরুরী পরিস্থিতিতে যাতে দুর্গনগরীর ভিতর খাদ্যের যোগানে টান না পড়ে, সেজন্যে ভূঃগর্ভে এক বিশাল শস্যাগার-কমপ্লেক্স গড়ে তুলেছিলেন। ঘুরতে ঘুরতে তারই অংশবিশেষ দেখা হল আমার। ভিতরে ঢুকাও হল। আর মূল দুর্গনগরীর একটু বাইরে একটা - বর্তমানে অস্তিত্ত্বহীণ কৃত্রিম হ্রদের উপর দিয়ে যাওয়া - দীর্ঘ কজওয়ে দিয়ে গিয়াসুদ্দিনের সমাধিসৌধটি সংযুক্ত। এই হৃদের জায়গায় এখন অবশ্য রাস্তা। দুর্গের ভগ্নদশা বিবেচনা করলে, এই সুন্দর সমাধিসৌধটি আজও আশ্চর্যভাবে প্রায় অক্ষত অবস্থায় টিকে আছে। এই সমাধিসৌধের ভিতর পাশাপাশি তিনটি কবর আছে। মাঝেরটি গিয়াসুদ্দিন তুঘলুকের, আর অন্য দুটি অনুমান করা হয় তার স্ত্রী ও সন্তান বিন তুঘলুকের। তবে ভিন্নমতে অন্য দুটি কবর তার মা মাখদুমা জাহান ও ভাতিজা (এবং বিন তুঘলুকের উত্তরসূরী) সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলুকের। এদের কবরের পাশে ফাতিহা পাঠ করলাম চমৎকার ইতিহাসগন্ধী ভাবগম্ভীর পরিবেশে।
তুঘলুকাবাদ মূল দুর্গের ভিতর থেকে গিয়াসুদ্দিন তুঘলুকের মাজারের দৃশ্য
গিয়াসুদ্দিন তুঘলুকের মাজারের ভিতর মূল সৌধ
গিয়াসুদ্দিনের মাজারের ভিতর থেকে পশ্চাৎপটে তুঘলুকাবাদ দুর্গনগরী
গিয়াসুদ্দিনের তুঘলুকের সমাধি
ভূঃগর্ভস্থ শস্যাগার-কমপ্লেক্সের প্রবেশপথের পথে
ভূঃগর্ভস্থ শস্যাগার-কমপ্লেক্সের প্রবেশপথ
এই বাইরের সমাধিসৌধ ছাড়া ভিতরের প্রায় সবকিছুই ধ্বংসস্তুপে পরিণত। তবে এইসব ধ্বংসস্তুপের মধ্য থেকেও আদি তুঘলুকাবাদের বিশালতা আর জাঁকজমক কল্পনা করা যেতে পারে হয়তো। এই দুর্গনগরীর ভিতরে কত কিছুই ছিল এক সময় – মণিমুক্তাময় জমকালো রাজপ্রাসাদ থেকে শুরু করে ছায়াচ্ছন্ন অভিজাতপল্লী বা অমাত্যবর্গের পাড়া, রাজদরবার, জেনানামহল, ব্যতিব্যস্ত মানুষজনে গম্গম্ প্রশাসনিক ও বানিজ্যিক এলাকা, কাজির দরবার, বিচারক ও বিচারপ্রার্থী, জল্লাদ ও গুমঘর, সেনা ছাউনি, বিদেশী দূত ও সওদাগর, বাইজিপাড়া, রঙমহল, বাজার বা সূক, আমজনতার পল্লী, আস্তাবল, সহিস, ঘোড়ার চিহিঁ আর ঘোড়াগাড়ির খটখট, লাদি আর জাফরানের সুগন্ধ – সবই কমবেশি মিলিয়ে-মিশিয়ে ছিল মনে হয়। উঁচু জায়গা থেকে বুঝা যায় ৫২টি প্রবেশপথের এই এলাকাটা কত বিশাল হতে পারে। তবে সবই প্রায় কল্পনার উপর ছেড়ে দিতে হয়। এখন সে জায়গায় নিজামুদ্দিন আউলিয়ার অভিশাপকে সার্থক করে শুধুই ঝোপঝাড়ের জঙ্গল। অবিশ্বাস্য।
তবে কান পাতলে এই ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ থেকেও হয়তো রবীন্দ্রনাথের ক্ষুধিত পাষাণের মত অনেক রোমাঞ্চকর, হৃদয়ভেদী বা গা শিউরানো কাহিনি শোনা যাবে। কিন্তু সেই চেষ্টা আজও কেউ করেছেন কিনা জানি না। হয়তো সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আগে শেষবারের জন্য দপদপিয়ে জীবন্ত হয়ে উঠতে তুঘলুকাবাদ আরেকজন রবীন্দ্রনাথ বা বঙ্কিম, বা নিদেনপক্ষে প্রমথনাথ বিশী, চার্লস ডিকেন্স, ডরোথি ডানেট বা জিন প্লেইডির মত কারও জন্য এখনও অপেক্ষমান।
প্রিয় পাঠক, আপনি কি পারেন না সেই লেখক হতে? ঘুরে যান তুঘলুকাবাদ আর লিখে ফেলুন না একটা রোমাঞ্চকর ঐতিহাসিক উপন্যাস। আমি প্রাণভরে পড়ে দেখি!
* আমি উর্দু/হিন্দি জানি না। তাই ইংরেজি প্রতিবর্ণায়ন থেকে যেটুকু বুঝলাম, সেই অনুযায়ী বাংলা অক্ষরে প্রতিবর্ণায়ন করলাম। মূল ভাষার সাথে তাই এই প্রতিবর্ণায়নের কিছুটা গরমিল থাকতে পারে।
মন্তব্য
চমৎকার লাগল, যেতেই হবে
facebook
অবশ্যই। ইবনে বতুতা গেছেন আর আপনি যাবেন না, এটা কি হয়!
****************************************
ভাল লাগলো।
উপস্থাপনা সুন্দর হয়েছে।
"চেপে রাখা ইতিহাস" বইটি পড়ার অনুরোধ রইল।
আপনার প্রিয় এই সম্রাটের বিরুদ্ধে ওঠা অনেক রটনাই ভুল বলে জানতে পারবেন!!
সুবোধ অবোধ
সহমত
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
লেখাটা আমি কল্পনার ডানা মেলে একটু হাল্কা চালে মজার ছলে লিখেছি। লক্ষ্য করবেন - 'ইতিহাস' ট্যাগ করিনি। এর মধ্যে কিছু কিছু রটনা থাকা যে মোটেই অসম্ভব নয়, সেট আমিও জানি। তাই এই লেখায় বর্ণিত ঐতিহাসিক কাহিনিগুলি আসলে 'এক চিমটি লবন' সহকারে সেব্য!
পড়ার জন্য ধইন্যা
****************************************
আসলেই তুঘলকি কান্ড!
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
****************************************
কৌতূহল থেকে জানতে চাইছি, রাজা-বাদশাহ কিংবা সুলতান হলেই কি তার কবর’কে মাজার বলা যাবে? মাজার শব্দটি’র উৎপত্তি কোন ভাষা থেকে? এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ কি? কার কবর মাজার হিসেবে দেখা হলে সেটা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ঠিক হবেনা? এই রিলেটেড রেফারেন্স আছে?
আজকাল চান্দের দোহাই নিয়ে কাউকে কাউকে মাজার বানানোর পাঁয়তারা চলছে টের পাচ্ছি!
নারে ভাই, এতকিছু আমার জানা নাই!
আমি 'মাজার' শব্দটা স্রেফ 'সমাধিসৌধ' অর্থে ব্যবহার করেছি - অপেক্ষাকৃত বেশি পরিচিত, সহজে উচ্চারণ ও বানানযোগ্য ও সর্বোপরি সহজে টাইপযোগ্য বিধায়। ভুলভাল হলে ক্ষমা করে দিয়েন প্লিজ
****************************************
আরে না। মূল উদ্দেশ্য ছিল জানা, আমার-ও জানা নেই। লাল-সালু’র গল্প এখন যেকোন সময়ের চাইতে বেশি বাস্তবতা, সে কারনে জানতে চাইছিলাম।
"দিল্লী হনুজ দূর অস্ত।" দিল্লী এখনও অনেক দূর।
ঠিক।
****************************************
তুঘলক ভাইরে ভালু পাই, মজার ক্যারেক্টার। তবে কাহিনীগুলান এতই মজা যে মনে হয় আসল না, বানানো কথা। ভাইসাহেবরে নিয়া লেখা ছবি দুইটাতেই দিলাম ইহকাল ও পরকালে উত্তম জাঝা। বিশেষ করে শেষ ছবির ঠিক নিচের প্যারাতে
হিমু ভাইর এই পোস্টটার কথাও মনে পড়ল।
..................................................................
#Banshibir.
এটা ঠিক সিরিয়াস ইতিহাস বিষয়ক লেখা হিসেবে উপস্থাপিত বা উদ্দিষ্ট না। হাল্কা চালে মজার ছলে লিখেছি।
তাছাড়া গবেষণামূলক নিবন্ধের বিপরীতে 'ট্রাভেলার্স ইয়ার্ন' বলে একটা কথা আছে, যেখানে আমি যদ্দুর জানি রটনা-ঘটনা সবকিছুরই কমবেশি ইঙ্কলুশন কিছুটা লাইসেন্সপ্রাপ্ত। স্বয়ং ইবনে বতুতা, মার্কো পোলো সহ বহু বড় বড় পরিব্রাজকের লেখাতেই যার নমুনা প্রচুর আছে - আমি তো কোন ছার!
তবে ঠিক কোন কোন কাহিনিগুলি বানানো মনে হয়েছে বললে সুবিধা হত। কেননা লিখতে গিয়ে আমিও এটা নিয়ে ভেবেছি। রাজধানী পরিবর্তনের ঘটনাটায় একটু অতিরঞ্জন হয়তো থাকতে পারে। এখনকার অনেক ঐতিহাসিকের মতে সমস্ত জনগন নয়, আসলে শুধু এলিট সম্প্রদায় আর প্রশাসন স্থানান্তর করা হয়েছিল। ন্যায়পরতা দেখাতে গিয়ে সম্রাট নিজেই কাজির দরবারে হাজির হওয়া? এটা রটনা হতেই পারে, আবার সম্রাটের স্টান্টও হতে পারে। শাস্তির প্রসঙ্গে ইষৎ অতিরঞ্জন্সাপেক্ষে। পাব্লিক কন্সাম্পশনের জন্য এধরণের স্টান্ট অনেক শাসকই দেখান। নৃশংসতার কাহিনিগুলি? এধরণের নৃশংসতা কিন্তু ইতিহাসে দুর্লভ না। ক্যাটাপল্ট দিয়ে স্বর্ণমুদ্রা বিতরণ করে দানশীলতা? টিম-ম্যাকিন্টশ স্মিথ জানাচ্ছেন এটার নাকি ঐতিহাসিক সত্যতা পাওয়া গেছে। এবং সবশেষে নিজামুদ্দিন আউলিয়ার অভিশাপ? হ্যাঁ, এটা পুরাই রটনা হতে পারে। তবে অন সেকেণ্ড থট - এটা কি খুবই অসম্ভব? কোইন্সিডেন্স বলে একটা কথা আছে না? এধরণের হাল্কার উপ্রে ঝাপসা শাপ-টাপ ঐসব পীরবাবারা অনেকই দিতেন। লাগে তুক, না লাগে তো তাক। এ জন্যেই হয়তো একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে - ঝড়ে বক মরে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে । এরকম কিছুও তো হতে পারে এটা, তাই না? নিজামুদ্দিন হয়তো কথাচ্ছলে বলেইছিলেন এমনকিছু - নেহাতই বাত্ কি বাত্, কিন্তু পরে সেটা ফলে গেছে ঘটনাচক্রে। রাজাবাদশারা যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে মরা বা তাদের প্রাসাদ-দুর্গ পরিত্যক্ত হওয়া ইতিহাসে মোটেই নতুন বা অভিনব কোন ঘটনা না।
যাইহোক, মজাচ্ছলে লেখা বিধায় এই লেখার ঘটনাগুলি 'এক চিমটি নুন' সহযোগে সেবন হাইলি রেকমেন্ডেড।
পড়ার জন্য
****************************************
হিমু সাহেবের ঐ পোস্টে আমিও দেখি কমেন্ট করেছিলাম! এখানে প্রাসঙ্গিক বিধায় ঐ কমেন্ট থেকে এখানে একটু কোট করি -
****************************************
ঝরঝরে লেখা, সুন্দর ছবি। ভাল লাগল।
****************************************
নতুন মন্তব্য করুন