স্বপ্নপুরীর দেয়ালে রক্তের আর্তনাদ

মন মাঝি এর ছবি
লিখেছেন মন মাঝি [অতিথি] (তারিখ: রবি, ১৮/০৫/২০১৪ - ৬:৪০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১।

শহর থেকে দূরে প্রায় জনবিচ্ছিন্ন এক নির্জন স্বপ্নপুরীতে, অফুরন্ত নিষ্কলুষ প্রকৃতির লীলাভূমির মাঝে আমার স্কুলটা ছিল। তিন দিক থেকে পাহাড়ে ঘেরা একটা উপত্যকার মত জায়াগাটা। পুরো উপত্যকা আর দুটো পাহাড় স্কুলেরই সম্পত্তি - স্কুল আর একটা হোস্টেল ছাড়া আর কিছুই নেই ওখানে। পেছন দিকটা যদ্দুর মনে পড়ে প্রায় জনমানবহীন আর শুধু বন-জঙ্গলে ঢাকা আদিগন্ত-বিস্তৃত টিলা আর পাহাড়ের সারি। সেই পাহাড়ে আমি হরিন দেখেছি। শিয়াল আর সম্ভবত গেছো-মেছো বাঘ-টাঘও হয়তো ছিল। আরো অনেক বন্যপ্রাণীও ছিল।

স্কুলের বিশাল এলাকাতে কোন দেয়াল ছিল না, তিন দিকের সবুজ পাহাড়ই তার দেয়াল। সামনের দিকটা খোলা। ঢুকতেই প্রথমেই একটা সুবিশাল খেলার মাঠ আর তার এক পাশ কাটিয়ে ধনুকের মত বেঁকে এগিয়ে যাওয়া প্রায় সিকি মাইল লম্বা সুদীর্ঘ ড্রাইভওয়ে। ড্রাইভওয়ের শেষ মাথায় মূল স্কুল ভবন।

পুরো স্কুল-কমপ্লেক্সটা অনেকটা ইংরেজি ‘U’ আকৃতির মত ধরা যেতে পারে। এর দুটি বাহুর একটি মূল দোতলা স্কুল ভবন। পেছনে সমান্তরালে অবস্থিত ‘U’-এর অন্য বাহু - দোতলা হোস্টেল। আর এই বিশাল ‘U’-এর তলার দিকটার এক অংশে নীচতলায় হোস্টেলের কিচেন, ডাইনিং আর দোতলায় মসজিদ। অন্য অংশে প্রশাসনিক অংশ, প্রিন্সিপালের অফিস, টিচার্স রুম, মেয়েদের কমন-রুম, ইত্যাদি। এর দোতলায় প্রিন্সিপালের বাসা। মূল স্কুল-ভবন আর হোস্টেলের মধ্যখানে, অর্থাৎ ঐ কাল্পনিক ‘U’-এর মধ্যকার ফাঁকা অংশটায় আরেকটা খেলার মাঠ - যেখানে আমাদের বাস্কেটবল আর ভলিবল গ্রাউন্ড ছিল। ছিল পিটি গ্রাউন্ড। আর এই ‘U’-এর তিনদিকেই সবুজে ঢাকা পাহাড়ে ঘেরা প্রকৃতির অকৃপন লীলাভূমি।

শুরুতেই যেমন বলেছি, হোস্টেলের পেছন থেকেই সেই জনমানবহীন বন-জঙ্গলে ঢাকা সবুজ ‘পাহাড়ের সারির’ শুরু। অন্য দুপাশেও পাহাড়। এর মধ্যেই, সুদূর কোন শহর থেকে যেন “ডে-স্কলার” নামধারী নানা-রঙের ফড়িং আর প্রজাপতির মত অজস্র শিশু-কিশোররা স্কুলবাসে বা গাড়িতে চড়ে এই স্কুলে আসতো। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ২টা-৩টা পর্যন্ত তাদের কলকাকলিতে মাতিয়ে রাখত, সরগরম করে রাখত এই জনবিচ্ছিন্ন নৈশব্দ্য আর একাকীত্বের রাজত্বকে। ওরা চলে গেলে নেমে আসত আরেক পৃথিবী।

সন্ধ্যা নামলে এক অদ্ভূত, সুদুর, অচেনা গ্রহের মত পরিবেশ সৃষ্টি হত চারপাশে। মনে হত সারা দুনিয়া থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি। তাতে যে অবশ্য খুব বেশি অসুবিধা ছিল তা নয়, কারন ৬০-৭০ জন ছাত্র ছিল হোস্টেলে। সেইসাথে দুইজন হাউজ টিউটর তাদের কোয়ার্টারে, আর মূল স্কুল বিল্ডিং-এ প্রিন্সিপাল পরিবারসহ। অবশ্য এরপরও অত বড় আর জনবিচ্ছিন্ন জায়গাটার জন্যে এই সংখ্যাটা ছিল নিতান্তই নগন্য - প্রায় অতিজাগতিক নির্জনতা আর নৈশব্দ্যের সমুদ্রে বারিবিন্দুসম!

আমাদের স্কুল ও হোস্টেল ভবনের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল যে - দুটি ভবনই পুরোপুরি সারি-সারি পর্দাবিহীন কাঁচের জানালায় ঢাকা। একটা থেকে আরেকটা খুব সামান্য ছেদ দিয়ে এই সারি - সবদিক থেকেই - সামনে-পিছনে-সাইডে। প্রায় এ্যাকুইরিয়ামের মত অবস্থা। যাতে কোন লুকোছাপার বালাই না থাকে। এবং সেই সাথে প্রাইভেসিরও! এর অন্য ফল হলো - বাইরের প্রকৃতি ভেতরে ঢুকে যেত। অন্য ভাবে বললে, আমরা সর্বক্ষন, প্রতিটি মুহুর্ত - সেই অপার প্রকৃতির সাথেই মিলেমিশে বসবাস করতাম। প্রায় কোন আড়ালই ছিল না। ঝড়-বৃষ্টি-শিলাবৃষ্টি-কালবোশেখি যাই হোক না কেন -- সেসব আমাদের চারপাশে ফেনিয়ে উঠত, গর্জাত আর প্রায় ছুঁয়ে দিয়ে যেত। এক আধটা জানালার কাঁচ কোন কারনে ভেঙে গেলে তো আর কথাই নেই, অন্তত একটি রাতের জন্য।

একবার সারারাত ঝড়ের পর ভোরে উঠে দেখি, ভেতরের এবং একদম সামনের বিশাল সবুজ খেলার মাঠ দু”টি একেবারে আক্ষরিক অর্থেই 'দুগ্ধফেননিভ' রূপধারন করেছে। চারিদিকটা, সুবিশাল এলাকা জুড়ে, শুধু সাদা আর সাদা - আর কোনই রঙ নেই। যেন উত্তরমেরু বা আলাস্কা / গ্রীনল্যান্ডে এসে পড়েছি। সে এক অলৌকিক দৃশ্য! সেবার সারা দেশেই অস্বাভাবিক শিলাবৃষ্টি হয়েছিল।

আর স্বাভাবিক দিনে (রাতে) থাকত তিন দিকের পাহাড় ছেয়ে যাওয়া নীলচে-সবুজ ঝিকিমিকি জোনাকির অফুরন্ত আলোকসজ্জা। সেও এক অসাধারন দৃশ্য ! যেন পুরো পাহাড় বিয়েবাড়ির সাজে সেজে বসে আছে।

সন্ধ্যের পর হোস্টেল ভবন ছেড়ে আমাদের স্কুল ভবনে গিয়ে ক্লাস রুমে বসে প্রতিদিন বাধ্যতামূলক ভাবে রাতের পড়া পড়তে হতো। আমরা একে বলতাম 'প্রেপ ক্লাস'। শীতের রাতে সোয়েটার পরেও একটু কাঁপতে কাঁপতে যখন প্রেপ ক্লাসে যেতাম, তখন ক্লাসের জানালা দিয়ে মাঝে-মধ্যে ঐ জোনাকিরা ঢুকে পড়তো। হাউজ টিউটর স্যার পাহারায় না থাকলে বা একটু উঠে গেলে, আমাদের মধ্যে তখন হুড়োহুড়ি পড়ে যেত সে জোনাকিটাকে হাতের মুঠোয় বন্দী করে তার আলো পর্যবেক্ষন করার আনন্দে মাততে।

রাত সাড়ে নয়টায়, ডিনার শেষে একেবারে ডরমিটরিতে ফেরার পর বিছানায় যাওয়ার আগেই লাগোয়া জানালা দিয়ে চোখে পড়ত পিছন দিকে খুব কাছ থেকেই শুরু হওয়া জঙ্গুলে ঘুটঘুটে অন্ধকার পাহাড়। সেইসাথে ঝিঁঝিঁ পোকা থেকে শুরু করে ছোটবড় নানান কিসিমের পশুপ্রাণীর ডাক আর অরন্যের অন্যান্য নিশীথচারীদের সঙ্গীতের ঐকতান। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতাম সেদিকে।

আরো অনেক মধুর স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই স্কুলটার সাথে। আমার স্বপ্নপুরীর সাথে। ‘রেসিডেন্ট স্কলার’ তক্‌মাধারী, সহজ ভাষায় – হোস্টেলবাসী, সতীর্থ বন্ধুদের সাথে নানা দলবদ্ধ এ্যাডভেঞ্চারের কথা মনে পড়ে যায়।

ইটকাঠপাথরগাড়িঘোড়াভাঙারাস্তাঅসহগরমঘামমানুষভীড়হাউকাউসন্ত্রাসদূর্নীতিগুমখুনমারামারিকাটাকাটিবর্বরতা -র অবিশ্বাস্য পেষনযন্ত্রে থাকতে থাকতে মাঝেমাঝে মন আনচান করে ঐ দিনগুলির জন্য। কিছুদিনের জন্যে হলেও একবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে প্রিয় শৈশবস্মৃতির শান্তিময় মায়াবী যাদুবাস্তবতার নির্ভার জগতে। প্রকৃতির মাঝে। স্বপ্নপুরীতে।

----------------------------------

২।

কিন্তু না! আদম-ঈভের স্বর্গপুরীতে যেমন সাপ ছিল, আমার স্বপ্নপুরীতেও তেমনি একটা স্মৃতি রয়েই গেছে – যা আজও সাপের মতই দংশন করে। এটা ভোলার নয়।

উপরে যে মূল স্কুল-ভবনের কথা বলেছি, তার দোতলায় একটা দুরবর্তী বিচ্ছিন্ন রুম ছিল যা সবসময় তালাবদ্ধ থাকতো। হোস্টেলের ছাত্রদের মধ্যে গুজব প্রচলিত ছিল যে রাতের বেলা ঐ ঘর থেকে ভুতুড়ে ধুপধাপ শব্দ, পাথর গড়ানোর শব্দ, নারীকন্ঠের কান্না, ইত্যাদি না-না ধরণের শব্দ শোনা যায়। তাই ভয়ে কেউ এর ধারে-কাছে ঘেষত না। পাশ কাটিয়ে যেতে হলে দোয়া-দরূদ পড়তে পড়তে দৌড় দিয়ে পার হয়ে যেত। একবার কোন খালি ক্লাশঘর না পেয়ে আমাদের মানবিক বিভাগের ৪/৫ জন ছাত্র-ছাত্রীর জন্য কর্তৃপক্ষ ঐ ঘরটা খুলে দিতে বাধ্য হন। তখন আবিষ্কার করি ঘরটার সারা দেয়াল জুড়ে প্রায় ছাদ পর্যন্ত খয়েরি ছোপ ছোপ দাগ। পুরনো কিছু কর্মচারীকে প্রশ্ন করে জানতে পারলাম - ঐ দাগ পুরনো রক্তের। ঐ ঘর নাকি স্বাধীনতার পরে (তখনো পর্যন্ত এবং এটা আশির দশকের কথা) আর চুনকাম করা হয়নি ইচ্ছে করেই। দাগগুলি বোধহয় সংরক্ষন করে রাখা হয়েছিল। ৭১-এ পাকিস্তানি আর্মি এই স্কুলে ঘাটি গেঁড়েছিল। তারা আর তাদের সহযোগীরা আশপাশ বা শহর থেকে বাঙালি তরুণীদের ধরে এনে ধর্ষন ও হত্যা করে এই ঘরে স্তুপ করে রেখে দিয়েছিল। স্বাধীনতার পরে পালিয়ে যাওয়া বাঙালি কর্মচারিরা ফিরে এসে এই ঘরে অজস্র ধর্ষিত, রক্তাক্ত, বিকৃত, নগ্ন নারীদেহ স্তুপীকৃত অবস্থায় আবিস্কার করে। এদের আনেককেই আবার গোপনাঙ্গ দিয়ে বেয়নেট প্রবিষ্ট করে হত্যা করা হয়েছিল। মোট কয়টা মৃতদেহ সেখানে পাওয়া গিয়েছিল সেসময় আর আমার জিজ্ঞেস করা হয়নি, তবে ঐ দাগ যেহেতু প্রায় ছাদের কাছাকাছি পৌঁছেছিল - সেহেতু সেটা হয়তো অনুমান করা যেতেই পারে।

এই বিবরন শোনার পর, আর ঐ রক্তের দাগ দেখার পর, ঐ বয়সে বহুদিন রাতে ঠিকমত ঘুমাতে পারিনি। রাতে বিছানায় গেলেই বারবার সেই পৈশাচিক, জান্তব, বীভৎস নৃশংসতার রক্তাক্ত নিধনদৃশ্য মানসপটে ভেসে উঠত। ভাসত গড়িয়ে পড়ে মেঝেতে থিক-থিক করা জমাট রক্তের পুকুরে স্তুপীকৃত রক্তাক্ত ছিন্নভিন্ন লাশের দৃশ্য। কানে বাজত বহু নরনারীর মরণচিৎকার। ডরমিটরির জানালার ওপারে জঙ্গলাকীর্ণ, ঘুটঘুটে, ভুতুড়ে অন্ধকার পাহাড় তখন মূর্তিমান আতঙ্ক। প্রকৃতির সান্যিধ্যের রোমান্টিকতা উধাও। দিনের বেলা আবার ঐ ক্লাশরুমে গিয়েই বসতে হত। তখন মনে হত রক্ত বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বোবা দেয়ালগুলিও কাঁদছে। একটা তীব্র অভিযোগ আর তিরষ্কারের আঙুল ছুড়ে দিচ্ছে আমার দিকে। আমাদের দিকে। আজও সেই স্মৃতি তাড়া করে বেড়ায়। ঐ রক্তের দাগ, ঐ রক্তের পেছনে এককালে ঐ রক্ত বহনকারীদের প্রায় যেন জীবন্ত অশরীরি কান্না – দেয়ালের বুক থেকে আজ মুছে গেলেও, আমার বিবেকে যে গভীর ক্ষত তৈরি করেছিল, যে অপরাধ আর গ্লানিবোধ তৈরি করেছিল, সেখান থেকে কিছুই মুছে যায়নি। বরং বয়সের সাথে আরও বেড়েছে, যতই এই ঘটনা আর এইরকম অসংখ্য ঘটনা ভুলে যাওয়া ও ভুলিয়ে দেয়ার ততোধিক নৃশংস ভদ্রবেশী প্রচেষ্টার অসীম অমানুষিকতা সম্পর্কে উপলব্ধি উত্তোরত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে।

আমি কোন সংস্কার বা কুসংস্কারে আদপেই বিশ্বাস করি না। কিন্তু এই ব্যাপারটায় কেন জানি ঠিক পুরোপুরি বস্তুবাদি হতে পারি না আমাদের অতীত ভুলে যেতে পরামর্শ দেয়া ‘ভবিষ্যতমুখী’ অত্যাধুনিক বাস্তববাদীদের মত। সত্যি তো, এসব মনে করে বা রেখে কি হবে - ভুলে গেলেই বা কি হবে? এই কঠিন দুনিয়ায় এইসব ছেঁদো সেন্টিমেন্টালিজমের জায়গা কোথায়? দেশের শনৈ শনৈ উন্নতি বিয়াল্লিশ বছর আগে মরা কিছু ভুতের সাধ্য কি রুখে? তাছাড়া, রক্তের দাগ পানিতেই দিব্যি ধুয়ে যায়, কান্নার শব্দ অট্টহাসিতে। নো প্রোবলেমো।

কিন্তু তারপরও ভুলতে পারি না। প্রায় তিন দশক পরেও ঘুরেফিরে হঠাৎ-হঠাৎ প্রায়ই মনে পড়ে যায়। একটা অপরাধবোধ, গ্লানি আর দায়বোধের দংশন অনুভব করি। তবে আমার কিসের অপরাধ, কিসের গ্লানি, কিসের দায় তা আপনি যদি না বোঝেন বা বুঝতে না চান, তাহলে আপনাকে বোঝানোর সাধ্য আমার নেই। অ-সেন্টিমেন্টাল ‘বাস্তব’ যুক্তি দিয়ে বোঝালেও আপনি বুঝবেন না। বিয়াল্লিশ বছর না, আপনার আসলে বিয়াল্লিশ সেকেণ্ডও লাগেনি ভুলতে।

যা বলছিলাম। যতদিন এই এবং এইরকম সব পৈশাচিকতার যথার্থ ও পূর্ণ বিচার না হবে, শুধু রুটিন ও রিচুয়াল বিচারই না - যতদিন ৭১-এ ঘটে যাওয়া সমস্ত অন্যায়ের তুলনারহিত অন্যায়পরতা আর পৈশাচিকতার পৈশাচিকত্ব সম্পর্কে জনমনে পূর্ণ স্মৃতি ও উপলব্ধি পূর্ণ গুরুত্বের সাথে জাগ্রত না হবে, যতদিন না আমরা বুঝেশুনেই ঐ কান্নার মূল্য ও আমাদের মনুষ্যত্বের দায় চোকাবো - ততদিন ঐ রক্ত, কান্না আর তাদের নীরব অভিযোগ ও হয়তো অভিশাপ নানা চেহারা ধরে আমাকে – আমাদের সবাইকে - তাড়া করে বেড়াবেই। আমরা সেটা চাই বা না-চাই, বুঝি বা না-বুঝি, টের পাই বা না-পাই। ঐ কান্নার মূল্য আর আমাদের মনুষ্যত্বের দায় আমরা স্বেচ্ছায় না চোকালে, ঐ মূল্য ও দায় আমাদের অন্যভাবে চোকাতে হবে আরও অনেক রক্ত ও কান্নার নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি করে। রক্তের দাগ সত্যি সত্যি পানিতে বা কান্নার শব্দ অট্টহাসিতে ধোয় না। অন্যায়ভাবে ক্ষরিত বিচারবঞ্চিত রক্তের বোধহয় একটা অন্যরকম প্রতিশোধ আছে। বাংলাদেশ ওই প্রতিশোধের এক ভয়ঙ্কর রূপ দেখার অপেক্ষায় আছে। তার যৎসামান্য আলামত কিছুটা দেখেছেও ইতিমধ্যে। যতদিন এই বিচার ও মনুষ্যত্বের দায়মোচন না হবে, ততদিন বাংলাদেশ একটা অভিশপ্ত দেশ হয়েই পড়ে থাকবে। এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

----------------------------------

৩।

নাহ্। ভেবে দেখলাম শৈশবস্মৃতির মায়ামেদুর, বিকেলের সোনালি-নরম আলোয় উজ্জ্বল, অপার শান্তির মধুর কল্পজগতে ফিরে যেতে চাই না আসলে। খানিক সময়ের জন্য হলেও। বুড়োবয়সের নস্টালজিয়ার রঙিন চশমায় দেখা এই সুখস্মৃতির অনেকটাই হয়তো আসলে অতিরঞ্জন, যা নিজের কাছেই ধরা পড়ছে না এখন। ফিরতে গেলে এখনকার বাস্তবতার সাথে সেটা মিলবে না। তাই ফিরে না যাওয়াই ভাল, স্মৃতি আজীবন বেঁচে থাকুক স্মৃতিতেই। যা চলে গেছে তাতো গেছেই, যেটা আছে সেটুকু অন্তত থাকুক!

তবে এর চেয়েও বড় কথা হল, আমিও আসলে এক হিসেবে পিছনে ফিরে তাকাতে চাই না। সামনের দিকে – ভবিষ্যতের দিকেই তাকাতে চাই। সেই ভবিষ্যতে, যেখানে আমার কোন অপরাধ বা গ্লানিবোধ বা তার কোন কারন আর থাকবে না। যেখানে কোন অভিযোগ, তিরষ্কার বা অভিশাপের আঙুল আমাকে তাড়া করে বেড়াবে না। যেখানে অমানুষ, বর্বর আর পিশাচদের রাজত্বে আমাদের বিবেক ও মনুষ্যত্ব হেয় আর কুঞ্চিত হতে হতে ইঁদুরের বিষ্ঠায় পরিণত হবে না। যে ভবিষ্যতে আমি আর আমরা সবাই আমাদের অতীত ও ভবিষ্যতের সমস্ত দেনা চুকিয়ে একটা সহজ স্বাভাবিক স্বর্ণোজ্জ্বল মানবিকতায় স্থিত ও আত্নস্থ হতে পারব। শৈশবের কাল্পনিক নস্টালজিয়াতে আত্নগোপনের চেষ্টা না করে এমন একটা ভবিষ্যতের প্রত্যাশাই করি। এমন একটা বাংলাদেশেই মৃত্যুবরণ করতে চাই।



পাদটীকাঃ ওহ্‌হো, আমার স্কুলের নামটাই বলা হয়নি! এটা চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল। এখন হয়তো কলেজও হয়েছে। চট্টগ্রাম সেনানিবাসের এক কোনায় অবস্থিত। আমার একটা কৌতুহল থাকল, এই লেখা যদি ওখানকার কোন বর্তমান ছাত্র বা আশেপাশে থাকেন এমন কেউ পড়েন, তাহলে উপরে ১ নং অনুচ্ছেদে বলা আমার স্মৃতির সাথে বর্তমান বাস্তবতার আদৌ কোন মিল আছে কিনা জানালে খুব খুশি হব। আর ২য় অনুচ্ছেদে বলা রুমটার ইতিহাসের ব্যাপারে কেউ যদি কোন খোঁজ নিতে পারেন, তাহলে আরও ভাল হয়।




মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার স্কুলটাকে আমার ভালো লেগে গেল। এমন নীবির সৌন্দর্য দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল একবার কিছুদিনের জন্য।

এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রানি সে যে – আমার জন্মভূমি।

ফাহিমা দিলশাদ

মন মাঝি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

****************************************

তিথীডোর এর ছবি

চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল কলেজ হয়েছে অনেক আগেই। আমার ছোটভাই এখান থেকেই পাশ করেছিল।
আমি খোঁজ নেব।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

মন মাঝি এর ছবি

খোঁজ নিতে পারলে খুব ভাল হয়। তবে ঐ ঘরটার ইতিহাস সম্পর্কে বলতে পারবে এমন কাউকে এখন খুঁজে পাবেন কিনা সন্দেহ আছে। আমি যখন ছিলাম তিন দশক আগে, এমনকি তখনও ৭১ সালের কর্মচারী দু-চারজনের বেশি ছিল বলে মনে হয় না। এখন তারা না থাকারই সমূহ সম্ভাবনা। তবু হয়তো জিজ্ঞেস করে দেখা যেতে পারে।

পড়ার জন্য আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

****************************************

তাসনীম এর ছবি

ভাল লাগল স্মৃতিচারণ।

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

মন মাঝি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

****************************************

এক লহমা এর ছবি

পড়তে পড়তে গলার মধ্যে একটা দলা পাকিয়ে যাওয়া অনুভূতি - বহু ঘন্টা লেগে গেল এই টুকু লিখতে - কি করলে যে ঐ নারকীয়তার শিকার হওয়ার স্মৃতির মোকাবিলা ত পরের কথা, মুখোমুখী হওয়া যায়, শুধু সেই বিহ্বলতাটা কাটিয়ে উঠতে ...

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

সেই অমানবিক অত্যাচারের বিচার তো দূরের কথা! আমরা সেই পাকিস্থান ক্রিকেট দলের পক্ষে নিল লজ্জের মতো স্লোগান দেই। আবার কেউ যখন তাতে বাঁধা দেয়, তাকে চোখ রাঙ্গিয়ে বলি ক্রিকেটের সাথে রাজনিতীকে মিশাবেন না। শুধু কি তাই? রাতে পাকিস্থানি ফ্যানের নীচে আরামে ঘুমিয়ে নতুন নতুন স্বপ্ন দেখি। আর দিনের বেলায় বলি অতীতের সব কিছু ভূলে গিয়ে নতুন ভাবে দেশ গড়তে। কিন্তু! অতীতকে ভূলে গিয়ে কি দেশ গড়া যায়? আর যতক্ষন আমাদের ভীতর থেকে পাকিস্থানী প্রীতি দূর না হবে ততক্ষন আমরা অভিশাপ মুক্ত হব না। শুধু মাত্র রাজাকার, আল-বদর, আল-শাম্সদের বিচার করলেই চলবে না, আমাদের মন থেকে সেই পাকিস্থানী প্রীতিও দূর করতে হবে। আর যতদিন পর্যন্ত আমরা তা না করতে পারব ততদিন আমরা জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব না।
-এ এস এম আশিকুর রহমান অমিত

নীড় সন্ধানী এর ছবি

আপনার স্বপ্নপুরীর ১৯৭১ টাইমলাইনটা পড়ে শিউরে উঠলাম। এই রক্তের দাগ এখনো আছে???

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

মন মাঝি এর ছবি

নাহ্‌, ঐ দাগ এতকাল পরে না থাকারই কথা। আমি দেখার পরও আরও প্রায় তিন দশক পেরিয়ে গেছে!

****************************************

সত্যপীর এর ছবি

আহা বড় খারাপ লাগল পড়তে পড়তে।

..................................................................
#Banshibir.

মন মাঝি এর ছবি

সেটাই --

****************************************

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

আমি ঐ প্রজন্মেরই মানুষ। পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের দেওয়া এক ক্ষত বুকে নিয়ে চলছি। ৪২ বছরে ক্ষতটা অনেকটাই শুকিয়ে এসেছিলো। গণজাগরণ মঞ্চের খোঁচা খেয়ে সেখানে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছিলো। কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় সেখানে মলমের একটা প্রলেপ পড়েছে। এধরনের লেখা পড়লে বা ঘটনার কথা শুনলে আবার রক্তক্ষরণ শুরু হয়। মনটা খারাপ হয়ে গেল।
তারপরও বলবো, এ সব ঘটনাগুলো মানুষের গোচরে আসা দরকার বৈকি।

মেঘলা মানুষ এর ছবি

মানুষের মত স্বজাতির উপর নিষ্ঠুর হতে খুব কম প্রাণীই পারে। মন খারাপ

এক লহমা এর ছবি

চলুক ভয়ংকর সত্য

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

মন মাঝি এর ছবি

কি জানি। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, পাকবাহিনির এমন নৃশংস নির্যাতনের স্বাক্ষর থাকার পরেও আমার স্কুলের একদিকের একটা পাহাড়ের পাদদেশেই, যদ্দুর মনে পড়ে, বেড়া দিয়ে ঘেরা কয়েকটা যুদ্ধে নিহত পাকসেনার কবর দেখেছিলাম। ওদের কুত্তা দিয়ে খাওয়ানো হয়নি এবং খাইয়ে হাড়গোড় ভাগাড়ে ফেলে দেয়া হয়নি - যা ওদের প্রাপ্য ছিল, উলটে মানবতা ও মহানুভবতার পরিচয় দিয়ে মানুষের মতই সম্মানজনক ভাবে কবর দেয়া হয়েছিল। আমি একবার স্কুলে থাকা ঐ সময়ের একজন পিয়ন-চাপরাশি-ঝাড়ুদার টাইপের কাউকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এতকিছু করার পরও এইসব সারমেয়র সাথে এমন মানবিক আচরনের কারন কি। তার উত্তর যদ্দুর মনে পড়ে এরকম কিছু ছিল - মরার পর লাশের সাথে আমাদের শত্রুতা নাই। এতে আমরাই ছোট হয়ে যাই। এখন ওরা ওদের স্রষ্টার দায়িত্বে।

****************************************

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।