স্মৃতিপটে ক্ষণছবির চকিত ঝলক - ১

মন মাঝি এর ছবি
লিখেছেন মন মাঝি [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ০৭/০৩/২০১৮ - ৬:২৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

২৫শে মার্চের পরে কোনো এক মাস। ১৯৭১।

স্থানঃ এলিফ্যান্ট রোডে "এরোপ্লেন মসজিদ"-এর পেছনে কোনো একটি বাড়ি। ঢাকা।

ক্ষণছবি - ১
একটি শিশু গৃহকর্মীর তত্ত্বাবধানে বাড়ির ছাদের এক প্রান্তে গিয়ে "এরোপ্লেন মসজিদ"-এর ছাদের উপর এরোপ্লেনের ডামির দিকে হাত বাড়িয়ে প্লেন-প্লেন বলে চেঁচাচ্ছে। তার কাছে মনে হচ্ছে এরোপ্লেনটা এত কাছে যে আরেকটু হাত বাড়ালেই বা একটা লাফ দিলেই সে ঐ প্লেনটা ছুঁতে পারবে। তারপর প্লেনটায় চড়ে নীল আসমান বেয়ে উড়ে যেতে পারবে সুদূর কোন অচিনপুরীতে।

ক্ষণছবি - ২
শিশুটির বৃদ্ধ নানা-নানু মাথার উপর দু'হাত তুলে পাথরের মূর্তির মতো জমে আছেন তাঁদের বেডরুমের দরজার সামনে। নানা ঠিক চৌকাঠের সামনে, নানু একটু পেছনে। দু'জনেরই বুক বরাবর যমদূতের মতো দেখতে দুই দানব বিশাল দু'টি রাইফেল পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক তাক করে আছে। আশেপাশে আরও অনেক অস্ত্রধারী সৈনিক, ফ্ল্যাটের বাকি বাসিন্দাদের দিকে রাইফেল তাক করে আছে। ফ্ল্যাটের সদর দরজা দিয়ে ঢুকতেই খাবার ঘরটা পড়ে, হাতের বাম দিকে সারিবদ্ধভাবে সম্ভবত তিনটি বেডরুমের দরজা। প্রথম দরজাটাই নানা-নানুর বেডরুমের। পরের দু'টিতে কে-কে ছিলেন তার মনে নেই, তবে সম্ভবত তার তিন অবিবাহিত খালা, বড় খালা -খালু এবং তাঁদের সন্তানরা, এবং তার নিজের মা ছিলেন। খাবার ঘরে ডাইনিং টেবিলে বসে ঐ শিশুটি যে নিজেকে "আমি" ডাকে -- প্লেটের দুধ-কলা-ভাত খাওয়া থামিয়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সামনের দৃশ্যের দিকে। কিছুই বুঝতে পারছে না সে।


অঙ্কনঃ হিমু

ক্ষণছবি - ৩
এক খালা হঠাৎ করেই কোত্থেকে বেরিয়ে এসে শিশুটিকে ছোঁ মেরে তুলে ৩য় বেডরুমের ভেতরে নিয়ে গেলেন। তার পরের দৃশ্যেই দেখা গেল - দুই খালা নামাজে দাঁড়িয়ে গেছেন। শিশুটির পরবর্তীকালের স্মৃতিতে ধরা থাকে শুধু তাঁদের অনবরত সেজদা দেয়ার দৃশ্য -- তাঁরা যেন একটুও না থেমে অতি দ্রুতগতিতে খালি হাঁটু ভাঙছেন, সেজদায় যাচ্ছেন, উঠছেন, দাঁড়াচ্ছেন, আবার একই ভাবে সেজদায় যাচ্ছেন। মাঝখানে কোনো বিরতির কথা তার মনে পড়ে না। ব্যাপারটা একটু অদ্ভূত। শিশুটির মনে অনেক প্রশ্ন আকুলি-বিকুলি করে, কিন্তু জিজ্ঞেস করতে সাহস হয় না।

ক্ষণছবি - ৪
নিজেকে 'আমি' ডাকা শিশুটি -- যে এই লেখায় এরপর থেকে শুধুই "আমি" হয়ে যাবে -- নানা-নানুর শোবার ঘরের পেছনের বন্ধ দরজার তলার ফাঁক দিয়ে ওপারের দৃশ্য দেখার চেষ্টা করছে। বন্ধ দরজার ওপারে একটি ছোট্ট খোলা বারান্দা যেখান থেকে বাইরের জগত দেখা যায়, কিন্তু শিশুটির জন্য ঐ জগৎ দেখা তখন নিষিদ্ধ। শিশুটি বন্ধ দরজার তলা দিয়ে শুধু লাল আলো বা আভা দেখতে পাচ্ছে। শিশুটির এই রক্তিম আভার প্রতি প্রবল কৌতুহল। সে জানতে চায় কিসের এই অদ্ভূত আভা, কিন্তু সে জানতে পারে না। লাল আভাটি তখন তার জন্য এক নিষিদ্ধ জগতের আভা।

পরে শোনা শুন্যস্থানপূরণঃ খুব সম্ভবত একাত্তরের ২৫শে মার্চের আগে-পরে কোন এক সময় আমার নানা-নানু তাঁদের ক্যান্টনমেন্টের বাড়িটা ছেড়ে ঢাকায় থাকা তাঁদের সন্তানসন্ততি-নাতিনাতনিদের নিয়ে এলিফ্যান্ট রোডে এরোপ্লেন-মসজিদের পেছনের কোনো একটি বাড়ির ফ্ল্যাটে এসে উঠেন। খুব সম্ভবত বলছি কারন, ঠিক কবে তাঁরা এই বাড়িতে উঠেন বা সবাই এসে একসাথে জড়ো হন তা আমি নিশ্চিত নই। উপরে ২-নং "ক্ষণছবি"-তে (snapshot) যে চিত্র - সেটা সম্পর্কে পরে শুনেছি যে ঐ যুদ্ধাবস্থাতেই কোনো এক বাঙালি ছোকরা তৎকালীন ইপিআর-এর উর্ধ্বতন এক অবাঙালি অফিসারের মেয়েকে নিয়ে ইলোপ করেছিল। প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ সেই অফিসারের নির্দেশে ইপিআরের সেনা ও পুলিশ সেই জুটিকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। এক পর্যায়ে তারা নাকি ইনফর্মারদের কাছে খবর পায় যে ঐ জুটি আমাদের ভবনেরই কোনো এক ফ্ল্যাটে আত্নগোপন করেছে কারও আশ্রয়ে। সেই সূত্রেই আমাদের ভবনের ফ্ল্যাট-বাই-ফ্ল্যাট সার্চ করতে করতেই বোধহয় তাদের আমদের ফ্ল্যাটে আসা। বলাই বাহুল্য, এদের দেখে এবং তাদের বন্দুকের নলের মুখে দাঁড়িয়ে ওখানে থাকা আমার গুরুজনরা নিশ্চয়ই মৃত্যুভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। তারই একটা নমুনা হচ্ছে, আমার অবিবাহিত দুই ছোটখালা একটা ঘরে লুকিয়ে (এই ঘর পর্যন্ত ইপিআর সেনারা বোধহয় আসেনি) ভয়ে থরহরিকম্পমান অবস্থায় নামাজ পড়তে শুরু করেন। আমার স্মৃতিতে কেন জানি দৃশ্যটা একটু কার্টুনের মতো করে আছে - তাঁরা বিরতিহীণভাবে শুধু দাঁড়াচ্ছেন আর সেজদায় যাচ্ছেন, মাঝখানে দোয়া-দরুদ পড়ার যে বিরতি সেটা স্মৃতিতে নেই - যেন ভিডিওর প্লেব্যাক-স্পিড বাড়িয়ে দিয়েছে কেউ!।

এই বাড়িতে যতদিন ছিলাম, তারই মধ্যে কোনো এক সময় নাকি আমাদের বাড়ির পিছনে থাকা একটা বস্তি পাকসেনারা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিল এবং গুলি চালিয়েছিল। এই দৃশ্য বা ঘটনা-পরবর্তী দৃশ্য দেখতে আমাদের বাসার মহিলা বা কিশোরী গৃহকর্মী আমাকে নিয়ে ঐ বারান্দাতে গেলে নীচে পাহারারত পাকসেনা নাকি আমাদের দিকেও গুলি চালিয়েছিল। এরপর থেকে আমার বারান্দায় বেরুনো বন্ধ হয়ে যায়। তারপরেই সম্ভবত আমি কৌতুহলবশতঃ দরজার তলা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখার চেষ্টা করতাম। ক্ষণছবি-৪-এ উল্লেখিত ঐ লাল আভাটা কিসের আমি জানি না, তবে আমার অনুমান সেটা ঐ আগুনের।
(চলবে)




আগের সব : অণুগল্প | অণুঃআতঙ্ক-সিরিজ | নন-ফিকশন | ভ্রমণ


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লাগলো পড়ে। এরকম পুরনো কত স্মৃতি মনের মাঝে ঘোরাফেরা করে। লিখতে বসলেই পালিয়ে যায়। আবার কিছু ঘটনা, আমি সুনিশ্চিত যে সেটা আমার সামনেই ঘটেছে - আত্মীয়রা অবাক হয়ে বলে ঐ ঘটনার সময় নাকি আমি জন্মাইনি বা ছিলামই না। কি অদ্ভুত!

মন মাঝি এর ছবি

আপনি হয়তো জাতিস্মর! হাসি

****************************************

অতিথি লেখক এর ছবি

এইরে! কি বললেন। কথাটা নাড়া দিল খুব। ধর্ম অনুমতি না দিলেও এই কথাটা ভাবতে খুব ইচ্ছে করে যে আমি জাতিস্মর। সুমনের জাতিস্মর গানটার মতন বার বার একজনের টানে ফিরে আসা। আহা।

অন্তরা রহমান

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এটা আসলে এক প্রকারের স্মৃতি নির্মাণ। বড়দের কাছ থেকে শুনতে শুনতে নিজের মতো করে একটা ছবি তৈরি করে নেয়া। একসময় নিজের কাছেই মনে হতে থাকে আমি নিজেই সেই ছবির ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

এর চাইতে জাতিস্মর শুনতেই ভালো লাগছিল। সবকিছুর ব্যাখ্যা থাকতে হবে ক্যান? ওঁয়া ওঁয়া

অন্তরা রহমান

মন মাঝি এর ছবি

সব ব্যাখ্যাই আসলে শেষ ব্যাখ্যায় মানব-মস্তিষ্কের প্যারামিটারগুলি বা ক্ষমতা এবং সেই মস্তিষ্ক-প্রসূত সমকালীন জ্ঞানের সাপেক্ষে বাস্তবের সমকালীণ মাগজিক ইন্টারপ্রিটেশন মাত্র। হুবহু নিরপেক্ষ নৈর্ব্যাক্তিক বাস্তব না। এই ভেবে আপনি আনন্দিত হতে পারেন যে "জাতিস্মর" আর "স্মৃতি নির্মাণ" দু'টিই এদিক থেকে একই শ্রেণীভূক্ত। সুতরাং, আপনার নিজেকে জাতিস্মর ভেবে ভালো লাগলে কোনোই অসুবিধা নাই! চিয়ার্স!!! দেঁতো হাসি

****************************************

নিঃসঙ্গ গ্রহচারী  এর ছবি

আগ্রহ নিয়ে পড়ছি।

মন মাঝি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

****************************************

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

মুক্তিযুদ্ধের সময় নিয়ে শিশুতোষ স্মৃতি আগে পড়িনি। আগ্রহ নিয়ে পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

মন মাঝি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

****************************************

সত্যপীর এর ছবি

দারুণ।

..................................................................
#Banshibir.

মন মাঝি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

****************************************

সোহেল ইমাম এর ছবি

প্রথম কিস্তিটা আরো একটুখানি বড় হলোনা কেন। কে জানে পরের কিস্তি লেখার উৎসাহটা আদৌ আপনার থাকে কিনা। এমনিতেই অনেক দিন পর লিখলেন। খুব ভালো লাগলো পড়ে।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

মন মাঝি এর ছবি

এই কিস্তিতে শুধু এই বাসার স্মৃতিটাই লিখতে চেয়েছিলাম। এই বাসায় এর চেয়ে বেশি স্মৃতি নেই আমার। দেখা যাক কি হয়! হাসি

****************************************

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

একজন মানুষ তার শিশুকালের কোন বয়স থেকে স্মৃতি ধারণ করতে পারেন? এটা নিয়ে নানা মত আছে, যার কোনটাই খুব শক্তপোক্ত না। প্রত্যেকটা মানুষ ইউনিক বলে প্রত্যেকের স্মৃতির শুরুর পয়েন্টটা ভিন্ন। ইনফ্যান্টাইল অ্যামনেশিয়ার কবলে পড়ে তার অনেক কিছু বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়, আবার কিছু কিছু বড়দের স্মৃতিচারণ থেকে পুনর্নিমিত হয়। আপনি নিজের স্মৃতি যে বয়স থেকে ধারণ করুন না কেন অন্যদের স্মৃতিচারণ মিলিয়ে কিছু মুহূর্ত আপনার মস্তিষ্কে চিরকালের মতো স্থায়ী হয়ে যাবে। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আপনার ক্ষণছবির চকিত ঝলক কথ্য ইতিহাসের উপাদান অথবা ঐতিহাসিক ভাষ্যের সহায়ক সূত্র। গাম্বিয়ার লোকজন এককালে চারণ কবিতা-গানের মাধ্যমে যেমন সাধারণ মানুষের ইতিহাসকে ধারণ করতেন (অ্যালেক্স হ্যালি'র 'রুটস' দ্রষ্টব্য), তেমন করে না হলেও আমাদের এই বিচ্ছিন্ন মানুষদের বিচ্ছিন্ন স্মৃতিকণাতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার অগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সাক্ষ্যগুলো আছে। এগুলো সুতোয় গেঁথে মালা গাঁথা হয়নি, আর হবে বলে মনে হয় না। তবু আপনার এই প্রচেষ্টার জন্য ধন্যবাদ।

আপনার ক্ষণছবি-৩ আমাকে মুক্তিযুদ্ধের বাইরের অন্য কিছু নির্মম, জঘন্য ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয়। আপনার দুই খালার ক্রমাগত সেজদা দিয়ে যাবার দৃশ্য আমি চোখ বন্ধ না করে দেখতে পাই। এক অক্ষম আক্রোশে, তীব্র ক্রোধে চীৎকার করে আমার চারপাশের সব কিছু ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

মন মাঝি এর ছবি

আমার স্মৃতিকণাগুলি কতটুকু অথেনটিক আর কতটুকু বড়দের কথা শুনে নিজের অজান্তেই পুনর্নির্মিত - এই বিষয়টা নিয়ে আমি নিজেও অনেক চিন্তা করেছি। আমার এইসব স্মৃতি নিয়ে যখন কিশোর বয়সে বাবা-মা বা অন্যান্য গুরুজনদের সাথে কথা বলতাম, তখন কেউ কেউ হেসেই উড়িয়ে দিতেন অসম্ভব বলে, আবার আব্বা-আম্মা প্রশ্রয় আর স্নেহের হাসি দিলেও বলতেন এগুলি হয়তো কখনো তাঁদের কথা শুনেই আমি নিজের মনে নির্মান করেছি। এটা আমি কখনই পুরোপুরি বিশ্বাস হয়নি, কারন আমার এইসব স্মৃতি অনেক ক্ষেত্রেই অত্যন্ত ডিটেল্ড ও ঝকঝকে ভিসুয়াল স্মৃতি যা বোধহয় শুধু শুনে সম্ভব না। এমন অনেক স্মৃতি আছে, একটা দু'টো না। এগুলি ঝাপসা না, রঙ-ডিটেলসহ ঝকঝকে ভিসুয়াল অনেক সময়। তাই আমি পরে ঠিক করি আব্বা-আম্মাকে চ্যালেঞ্জ করবো এমন সব স্মৃতি দিয়ে যা তারা নিজেরাও দেখেননি বা মনে রাখেননি, কোনোদিন আলোচনাও করেননি, কিন্তু তার বাস্তবতা অস্বীকার করতে পারবেন না। আমি ঐ সময়ের এমন সব ঘটনা বা খুটিনাটি তাঁদের পরে বলেছি, যা তাঁদের একেবারেই মনে ছিল না, কিম্বা আদপেই দেখেননি। সুতরাং আমাকে বলা সম্ভব না। এমন সব বিষয় - যা অন্য কারও পক্ষেও জানা সম্ভব না, বা জানলেও যাদের সাথে আমার প্রায় সেই সময় থেকেই যোগাযোগ নেই। সুতরাং তাদের কাছ থেকে শুনে স্মৃতি নির্মান সম্ভব না। এইসব স্মৃতি শুনে তাঁরা চুপ করে গেছেন এবং স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে অনেক ক্ষেত্রেই আমার স্মৃতিগুলি অথেনটিক এবং পরে শুনে নির্মিত নয়। যেমন ধরুন ৪ বছর বয়সে আমরা যে ফ্ল্যাটে (বিদেশে) ছিলাম আমি ১৬-১৭ বছর পরে স্মৃতি থেকে তার প্রায় নির্ভুল লে-আউট / ফ্লোর প্ল্যান এঁকে তাঁদের দেখিয়েছি যা তাঁরা ভেরিফাই করেছেন। এই জিনিস ওনাদেরও মনে ছিল না। এবং সবচেয়ে বড় কথা কোনো বাচ্চার সাথে ফ্ল্যাটের ফ্লোর প্ল্যানের খুঁটিনাটি নিয়ে কোনো বাবা-মা আলোচনা করেন না, বিশেষ করে যারা এমনিতেই অতীতের স্মৃতিচারণ করতে অত্যন্ত অনীহ ও অনভ্যস্ত। কিম্বা ধরুন, আমার বড়ভাইর সাথে ঐ বাড়িতেই বিভিন্ন অনালোচনাযোগ্য তুচ্ছাতিতুচ্ছ স্মৃতি আছে যা আমার বাবা-জানতেন না। আমার ভাই ৭৩-৭৪ সালের দিকে খুব অল্প বয়সে দেশ ছেড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান এবং প্রায় হারিয়ে যান। তাঁর সাথে দীর্ঘকাল কোনো যোগাযোগই ছিল না, দেশে আসা দূরে থাকুক। আমার সাথে তাঁর অতীত দূরে থাকুক বর্তমান নিয়েও কোনো আলাপ হয়নি। ২০০৬ সালে যখন আমার মা টার্মিনালি ইল, তখন উনি দেশে আসেন। এই সময় তাঁকে আমার এই তাঁকে নিয়ে স্মৃতিগুলি বলতে গিয়ে আবিষ্কার করি যে আমার এইসব অনেক স্মৃতিই ভুল নয়। অনেক ক্ষেত্রে তাঁর নিজেরও মনে ছিল না, আমি বলায় মনে পড়েছে। এই স্মৃতিগুলি আমার পক্ষে অন্য কারও কাছেও শোনা সম্ভব নয়। অর্থাৎ এগুলি "নির্মান" নয় বলেই আমার যৌক্তিক বিশ্বাস। এরকম আরও অনেক বার হয়েছে, যখন আমি আমিই বরং অতীতের কথা বলে গুরুজনদের চমকে দিয়েছি যা তাদের জানা বা মনে ছিল না। আমার ব্যপারটা একটু অদ্ভূত। আমি যদ্দুর জানি, মানুষের লং-টার্ম মেমোরির চেয়ে শর্ট-টার্ম মেমোরিই বেশি প্রখর হয়, লং-টার্মটা সময়ের সাথে ঝাপসা হয়ে যায়। আমার উলটো! আমার শৈশব-কৈশোরের কথা যত মনে আছে, তার বেশি বয়সের কথা সে তুলনায় অনেক কম মনে আছে। গত কুড়ি বছর তো একটা প্রায় ব্ল্যাক হোল আমার স্মৃতিতে। আমার শৈশবের অনেক খেলার সাথীর কথা বা তাঁদের চেহারা আমার সুস্পষ্ট মনে আছে, অথচ কলেজ-বিশবিদ্যালয়ের বেশির ভাগ সহপাঠীরই নাম-চেহারা অনেককিছুই একদম মনে নেই (যাদের সাথে যোগাযোগ নেই আরকি)!

আপনার মন্তব্য পড়ে উইকিপিডিয়া ঘাটতে গিয়ে শৈশব স্মৃতি সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক যেসব তথ্য পেলাম--
১। মনোবিজ্ঞানী কে নেলসনের বরাতে বলা হচ্ছে -

Newer research suggests that very young children do remember novel events, and these events can be recalled in detail from as young as two and a half years (সূত্র)

২।

Contrary to previous research, newer research has shown that children can recall specific episodic memories for up to two years prior to the onset of the earliest autobiographical memories reported by adults.[1](সূত্র)

৩।

Event-specific knowledge (ESK) is vividly detailed information about individual events, often in the form of visual images and sensory-perceptual features.[2] The high levels of detail in ESK fade very quickly, though certain memories for specific events tend to endure longer.[5] Originating events (events that mark the beginning of a path towards long-term goals), turning points (events that re-direct plans from original goals), anchoring events (events that affirm an individuals beliefs and goals) and analogous events (past events that direct behaviour in the present) are all event specific memories that will resist memory decay.[5]

The sensory-perceptual details held in ESK, though short-lived, are a key component in distinguishing memory for experienced events from imagined events.[6] In the majority of cases, it is found that the more ESK a memory contains, the more likely the recalled event has actually been experienced.[6] Unlike lifetime periods and general events, ESK are not organized in their grouping or recall. Instead, they tend to simply 'pop' into the mind.[2] ESK is also thought to be a summary of the content of episodic memories, which are contained in a separate memory system from the autobiographical knowledge base.[3] This way of thinking could explain the rapid loss of event-specific detail, as the links between episodic memory and the autobiographical knowledge base are likewise quickly lost.[3]

These three areas are organised in a hierarchy within the autobiographical knowledge base and together make up the overall life story of an individual.[3] Knowledge stored in lifetime periods contain cues for general events, and knowledge at the level of general events calls upon event-specific knowledge.[2] When a cue evenly activates the autobiographical knowledge base hierarchy, all levels of knowledge become available and an autobiographical memory is formed.[2](সূত্র)

আমার ক্ষণছবির স্মৃতিগুলি এইরকমই - ভুলে না যাওয়া দীর্ঘমেয়াদী ESK-র মতো বা ESK-ই হয়তো বলা যায় -- vividly detailed information about individual events, often in the form of visual images -- বা আরও সংক্ষেপে বললে হয়তো বলা যায় - vividly detailed visual information (or snapshots?) about individual events! আর আমার আলোচ্য বয়স তখন এই উদ্ধৃতিতে উল্লেখিত সর্বনিম্ন ভায়াবল বয়স থেকে যৎসামান্য বেশিই ছিল! হাসি

বাবা-মার সাথে যখন পরে বেশি বয়সে এইসব স্মৃতি নিয়ে আলাপ করেছি, তখন নিশ্চয়ই অনেক নতুন তথ্য পেয়েছি। সেগুলিই আমি "পরে শোনা শুন্যস্থানপূরণ" শিরোনামের অধীণে যুক্ত করেছি। সুতরাং মোটামুটিভাবে বললে, যেসব স্মৃ্তিকণাগুলিকে আমার নিজস্ব অথেন্টিক ও বিশুদ্ধ স্মৃতি বলে দৃঢ়ভাবে মনে হয়েছে, সেগুলিকেই আমি "ক্ষণছবি" হিসেবে ক্যাটেগোরাইজ করেছি এখানে। আর যেগুলি শোনাকথা বলে মনে হয়েছে, সেগুলিকে "পরে শোনা শুন্যস্থানপূরণঃ" শিরোনামে বিন্যস্ত করেছি। তবে বলাই বাহুল্য, মন ও তার রসায়ন এমন বিচিত্র ও রহস্যময় যে, এ বিষয়ে অর্থাৎ স্মৃতিকণাগুলি কতটুকু নিজস্ব ও কতটুকু গুরুজনদের কাছে শুনে-শুনে "নির্মান" সে বিষয়ে এতকিছুর পরেও আসলে ১০০০% এয়ার-টাইট গ্যারান্টি দেয়া সম্ভব না। কোনো-কোনো জায়গায় এই দুইয়ের মধ্যে পারস্পরিক লিকেজ বা ওভারল্যাপ হওয়া একদম অসম্ভব এমন কথা আমি ১০০% দৃঢ়তম আত্নবিশ্বাসের সাথে বলতে পারবো না। দুঃখিত। তবে মোটামুটি বিশ্বাস আছে! হাসি

আমার এই পরিকল্পিত ধারাবাহিকে ইতিহাস বা তার উপাদান হওয়ার যোগ্য বিষয় কতটুকু থাকবে বা থাকতে পারবে, সে বিষয়ে আমার বেশ সন্দেহ আছে। এ জন্যেই লেখাটাকে "ইতিহাস" হিসেবে ট্যাগ করিনি, এমনকি "মুক্তিযুদ্ধ" হিসেবে ট্যাগ করে অনেকবার ভেবেছি ভুল হলো কিনা, মুছে দিব কিনা ট্যাগটা। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে খুব একটা মাল-মশলা নেই আমার স্মৃতিতে।
যাজ্ঞে, দেখা যাক কি হয়।

****************************************

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আপনার ব্যাখ্যার সাথে সহমত। আমার চেয়ে বয়সে ছোট এমন একজনকে প্রতিনিয়ত দেখি এই প্রকার ছোট ছোট ঘটনাংশের কথা বলেন যেগুলো তার মনে থাকার কথা না, কারণ তখন তার বয়স ছিল দুই/তিন বছর। প্রথম প্রথম আমি এটাকে অন্যদের কাছ থেকে শুনে পুনর্নির্মাণ বলে মনে করেছি। পরে দেখেছি ব্যাপারটা তা নয়। তাছাড়া মনে থাকা ঘটনাংশগুলো খুবই স্বল্প সময় পরিসরের। বানোয়াট গল্প বা পুনর্নির্মাণ হলে এর দৈর্ঘ্য আরও বেশি হতো। ফটোগ্রাফিক মেমোরি বলে প্রচলিত টার্মটা সবার ক্ষেত্রেই সত্য। তবে তা সব ইভেন্টের জন্য নয়। কিছু কিছু ইভেন্ট, কিছু ডিটেইলস মগজের এমন কোণে থেকে যায় যা আমৃত্যু বিনষ্ট হয় না। ন হন্যতে, হন্যমান শরীরে!


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

আপনার বেশ সৌভাগ্যবান ছিলেন। এরকম ক্ষেত্রে অনেকেই অত্যন্ত মর্মান্তিক পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন। পরবর্তি পর্বগুলোর অপেক্ষায় রইলাম।

মন মাঝি এর ছবি

হ্যাঁ, কতটা সৌভাগ্যবান ছিলাম এখন সেটা কিছুটা অনুভব করি। বিশেষ করে এই ঘটনার পরে ঐ সময়ই এর চেয়েও বহুগুন কঠিন পরিস্থিতি পেরিয়ে এসেছি এবং এত বছর পরেও কম্পিউটারের সামনে বসে এই লেখাটা লিখতে পারছি বেঁচে-বর্তে, সেকথা কথা মনে করে মাঝে-মাঝে মনে হয় আমি হয়তো ঈশ্বরের কাছে নির্ধারিত সময়ের অতিরিক্ত ধার করে নেয়া সময়েই বেঁচে আছি এতদিন। ইংরেজিতে একে বোধহয় "বরোড টাইম" বলে। তবে এমনই ধার সেটা যাতে প্রাপ্যের চেয়ে প্রাপ্তিযোগ কম ঘটেছে এমনটা ভাবার কোনো কারন ঘটেনি এখনও। তবে সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য এই যে, কঠিন পরিস্থিতির কাঠিন্য ঠিকমতো বোঝার বয়স হয়নি আমার তখনও। এটা কিন্তু বিরাট ব্যাপার! হাসি
যাজ্ঞে, এসবের কিছু কিছু কথা পরে আসবে।

****************************************

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ডুপ্লি ঘ্যাচাঙ


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

এক লহমা এর ছবি

আব্দুল্লাহ ভাইয়ের মত আমিও বলি -
"আপনার বেশ সৌভাগ্যবান ছিলেন। এরকম ক্ষেত্রে অনেকেই অত্যন্ত মর্মান্তিক পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন। পরবর্তি পর্বগুলোর অপেক্ষায় রইলাম।"

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

মন মাঝি এর ছবি

-- ঘ্যাচাং --

****************************************

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

প্রতিমন্তব্য করার আগেই আপনার মন্তব্যটা ঘ্যাচাঙ করে ফেলেছেন দেখছি! হে মাসুদ রানা! সচলের পাঠকদেরকে এই পদে পদে উত্তেজনা, পদে পদে শিহরণের সাসপেন্স/এস্কেপ থ্রিলার গল্প থেকে বঞ্চিত রাখার হেতু কী?


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

মন মাঝি এর ছবি

হা হা হা হা! গড়াগড়ি দিয়া হাসি
ঠিক এই জন্যই মন্তব্যটা ঘ্যাচাং করে দিয়েছি। বেশি নাটুকে লাগছিল!
বঞ্চিত রাখার হেতুটা হতাশাজনক ভাবে সাদামাটা। আমি তখন শিশুমাত্র (শিশু মাসুদ রানা? হো হো হো ), ৯৯%-ই মনে নেই!
কয়েকটা বিচ্ছিন্ন স্ন্যাপশট (ক্ষণছবি) হয়তো দিতে পারবো,

কিন্তু তার মধ্যে এই পদে পদে উত্তেজনা, পদে পদে শিহরণের সাসপেন্স/এস্কেপ থ্রিলার গল্প

-এর কিছুই পাবেন বলে মনে হয়না ডিটেইলের অভাবে। মন্তব্যরূপী সিনেমার ট্রেইলার দেখে বেশি উৎসাহিত হওয়ার কিছু নাই। দুর্ধর্ষ ট্রেইলারওয়ালা ছবি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিদারুণ ভাবে হতাশ করে! হাসি

****************************************

হিমু এর ছবি

আঁকাটা এখন শিশুস্কুলমার্কা হলো মন খারাপ

মন মাঝি এর ছবি

আঁকাটা এখন শিশুস্কুলমার্কা হলো মন খারাপ

ঠিকই হয়েছে। শিশুর চোখে দেখা স্মৃতির ছবি "শিশুস্কুলমার্কা"ই তো হওয়া উচিৎ! দেঁতো হাসি
না, ছবিটা চমৎকার হয়েছে। দেখি ছবিটা মূল লেখায় নেয়া যায় কি না।

****************************************

মন মাঝি এর ছবি

ছবিটাতে উল্লেখযোগ্য একটা ভুল আছে। আমি নিজেও লক্ষ্য করিনি আগে! হা হা হা..... কি বলুন দেখি? গড়াগড়ি দিয়া হাসি

****************************************

হিমু এর ছবি

অনেক ভুল আছে তো। বাঙালি নারীপুরুষ দু'জন হাত তুলে নেই, আবার পাইক্যাটার ম্যাগাজিনের বাঁকটা উল্টো।

তাসনীম এর ছবি

আমিও পড়া শুরু করলাম। ৭১ সালে আমিও নানা বাড়িতে ছিলাম। প্রানভয়ে ২৫ শে মার্চের পর ধানমন্ডির বাড়িতে পাকিস্তানের ফ্ল্যাগ উড়ানো হয়। একটু পরেই পাকসেনাদের একটা দল এসে হাজির। আমার ছোটখালা (তখন কিশোরী) আমাকে কোলে নিয়ে বাসার পেছনে লুকান। পাকিস্তানের ফ্ল্যাগ নাকি উল্টো লাগানো হয়েছিল। তারা সেটা ঠিক করতে বলে। ভয়ে কারো মাথা কাজ করছিল না। পুরো সময়ে বাসার পেছনে একটা জায়গাতে খালা আমাকে নিয়ে লুকিয়ে ছিলেন। আমার তখন যা বয়েস তাতে এটা মনে থাকার কথা না। কিন্তু সম্ভবত শুনে শুনে আমারও স্মৃতি তৈরি হয়ে গেছে।

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

মন মাঝি এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ। সচলে আবার ফিরুন, পড়ুন, লিখুন, মন্তব্য করুন! সচল মিসেস ইউ। উই মিস ইউ!

****************************************

তাসনীম এর ছবি

আমিও সচল মিস করি। অল্প হলেও লিখি, ইনফ্যাক্ট এই বছর আরও লিখবো। অনেক লেখা ফেসবুকে জমে আছে, এদের স্থায়ী ঠিকানা দরকার। ভালো থাকুন।

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

তিথীডোর এর ছবি

সিরিজ চলুক। চলুক
ভীষণ আগ্রহ রইল পরের পর্ব পড়ার জন্য।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।