কতটুকুই বা পথ? শাপলা চত্ত্বর থেকে দোয়েল চত্ত্বর পর্যন্ত? ২ কিলো হবে কি হবে না। কোনমতে ভার বয়ে চলা বাসে জ্যামে আটকে জেরবার হলে ঘন্টাখানেক লেগে যায়, ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে বড়জোর দশ মিনিট।
মন যদি ভাল থাকে জনতা ব্যাংকের সদর দপ্তরের নীচে বিশ্রামে থাকা রিকশাওয়ালাদের আর পল্টনের জ্যাম ঠেলে বা হঠাৎ পাওয়া ফাঁকা ময়দানে গোল দেয়ার সাধ যদি তাঁদের হয়েই যায় তাহলে পৌঁছে যাওয়া চলে আধ ঘন্টায়, পনের বিশ মিনিটে পৌঁছে যাওয়াও বিচিত্র নয়।
বিরক্তিকর জ্যাম এড়াতে অথবা চলতি পথে চেনা দৃশ্যপট একটু বদলে নিতে যদি হেঁটেই রওয়ানা দেওয়া যায়, তিরিশ মিনিটের মাঝে ঠিক ঠিক দোয়েল পাখির লেজের দেখা মিলতে পারে। এটুকু পথ-ই মাঝে মাঝে কেমন অনতিক্রম্য হয়ে ওঠে ভাবতে অবাক লাগে ভারী।
শীতের আমেজলাগা সকালে শিউরে উঠতে উঠতে নীলক্ষেতের মোড় থেকে অপরাজেয় বাংলার দিকে যাওয়া চলে না আর। ফ্যাকাল্টির বারান্দায় বসে গাছের ডালপাতার আড়াল দিয়ে ঝলমলে সূর্যের দিকে দুয়েকপলক তাকিয়ে নেয়া এখন স্বপ্ন মনে হয়।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ঘুম ভাঙ্গা সূর্যের পরশ নেয়া কেবল স্মৃতিতেই সম্ভব। মধ্যদুপুর পেরিয়ে সূর্য যখন আকাশের তাকিয়ায় হেলান দেয় একটু তখনো মল চত্ত্বরে ছায়া খুঁজে একটু স্বস্তির নিশ্বাস নেয়ার কথা মনে পড়ে না।
টিএসসি’র মোড়ে দাঁড়িয়ে পড়তি দুপুরে হাতদুটোকে ঢাল করে সূর্যের তেরচা রোদ ঠেকানোর প্রয়োজন পড়ে না এখন। বিআরটিসি’র দোতলা বাস থেকে দেখা বিকেল বেলার নীলচে আকাশে তুলোট মেঘেরা এখনো হাতি-ঘোড়া-পাখি হয়েই ওড়ে হয়তো, চোখে দেখার সুযোগ মেলে না।
বদ্ধ ঘরে বায়ু-শীতলীকরণের হিমেল হাওয়ায় শরীর জুড়িয়ে, শাইনপুকুর সিরামিক্সের কাপে কফির স্বাদ নিতে নিতে চোখ বরাবর বসানো আধুনিক গণনাযন্ত্রের মনিটরে ভেসে ওঠা ছোট ছোট খোপে বসানো সংখ্যাগুলোয় মনোযোগ দিয়ে যেতে হয় দিনের পর দিন, মতিঝিলের বিশাল বিশাল বিল্ডিং-এ এই কবুতরের খোপগুলোতে জানালা দিয়ে ঢোকা আলো দেখে চমকিত হবার সময়-ই বা কোথায়?
যদি কখনো বের হতে হয়, বিচ্ছিরি ভিড়, পথের ধুলো, চাকায় চাকা আটকে রিকশাওয়ালাদের কথা কাটাকাটি আর আটকে পড়া গাড়ির পোঁ পোঁ রবে মাথা খারাপ হয়- ছায়াহীন পথ থেকে কোনমতে গন্তব্যে পৌঁছতে পারলেই মনে হয়, “যথেষ্ট!”
তবুও ভাল, সূর্য যখন আকাশের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই বিশ্রামে যায়- আমাদের শেকলও তখন আলগা হয়। দমে থাকা ইচ্ছেরা ধীরে-সুস্থে উঁকি-ঝুঁকি দিতে শুরু করে।
ইচ্ছার ফাঁদে পড়ে কখনো হাতে তুলে নেই মুঠোফোন, অনেক দিন ধরে যোগাযোগের বাইরে থাকা পুরোন কোন বন্ধুর খোঁজ নেবো বলে। কখনো স্রেফ হেডফোন-টা কানে গুঁজে নেই; চলতি পথে তখন সঙ্গী কেবল রবীন্দ্রনাথের সুর গলায় তোলা সাগর সেন, হেমন্ত, বন্যা, পাপিয়া, সাদী মুহাম্মদ, কাদেরী কিবরিয়া, শ্রীকান্ত, ইন্দ্রনীল অথবা হালের অর্ণব, শাহানা, আবিদ এবং নাম না জানা আরো কেউ।
‘বিবিধ’ শিরোনামে আলাদা করে রাখা গানগুলোও মাঝে মাঝে মন ভরানোর দায় নেয়- মান্না দে থেকে সতীনাথ, লতা থেকে শ্রেয়া ঘোষাল, হেমন্ত থেকে শ্রীকান্ত, সুমন থেকে নচিকেতা, আইয়ুব বাচ্চু থেকে জেমস, এন্ড্রু কিশোর থেকে কুমার বিশ্বজিৎ, ফুয়াদ থেকে অর্ণব, এমন অনেকেই।
রিকশায় চলতে চলতে সঞ্জীব, কৃষ্ণকলি, মৌসুমী ভৌমিকের গানগুলো মন ছুঁয়ে যায় যখন তখন পল্টনে বা বায়তুল মোকাররমের সামনের যানজট আর অসহনীয় লাগে না।
সচিবালয়ের সামনে খোলা হাওয়া এসে তখন চুল উড়িয়ে দিয়ে যায়, শীতের হাল্কা শিহরণ হাতের খোলার অংশের লোমগুলোকে দাঁড় করিয়ে দেয় এক পলকে।
লাইনে দাঁড়িয়ে প্রতিদিনকার বাসের অপেক্ষায় থাকা মানুষগুলোকে আর উদ্ভ্রান্ত মনে হয় না, ওদের চেহারায় ফুটে থাকা বাড়ি ফেরার আকুলতা কেমন করে যেন চোখে পড়ে যায়।
হাইকোর্টের সামনের ফোয়ারার পানিতে গোলাপী, লাল, নীল, সবুজ, হলুদের খেলা অপার্থিব মনে হয়- ফটকের আড়ালে পড়ে যাওয়া হাইকোর্টের সাদা ভবন অন্ধকার ফুঁড়ে কেমন করে বেরিয়ে এসে আলিফ লায়লা’য় দেখা ‘কোহেকাফ’ নগরীর রাজপ্রাসাদের রূপ নেয়।
রিকশাওয়ালা মামার হাতের মোচড়ে রিকশা বাঁয়ের পথ ধরতেই চারধার আরেকটু অন্ধকার হয়ে আসে, চশমা ঝোলানো চোখেও দৃষ্টি দুর্বল হয়ে আসে। মনের আর স্মৃতির চোখ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়।
মৎস্য ভবন পেছনে ফেলে চার-রাস্তার মোড়টা পেরোলেই মন অজান্তেই আনমনা হয়। হাতের ডানে থাকা হাইকোর্টের দিকে আর তাকানোর সময় থাকে না, চোখ চলে যায় হাতের বামদিকে গাছ আর ডালপালার আড়ালে লুকিয়ে থাকা গোলাপী আভা ছড়ানো ব্রিটিশ আমলে গড়া পুরানো ভবনটার দিকে- কার্জন হল।
সবুজ ঘাসে মোড়া বিস্তৃত আঙ্গিনায় একটু বিশ্রাম নেবার ইচ্ছে হয়, ঢালাই করা পথে হেঁটে দূরে, অনেক দূরে মনে হওয়া সিঁড়িতে বসার সাধ-ও মনে এসে হারিয়ে যায়।
চোখ ফিরিয়ে নিলেই বা নিস্তার কোথায়? রাস্তার ওপাড়ের ফুটপাথ থেকে মাটির গড়া শো-পিসগুলো ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। কখনো কিছু কেনা হয়নি ওখান থেকে, কিন্তু তাকিয়ে থাকার ভাললাগাটুকু কখনোই কমেনি তাতে।
দোয়েল চত্ত্বর, দুই দোয়েলের আবাস রাস্তার ঠিক মাঝখানটায়। দু’জনে দু’দিকে চোখ রাখছে- ওদের চোখের আড়ালে কিছুই হয় না এখানে। জীবিত হলে ওদের-ও হয়তো পুরানো কথা মনে পরতো।
গ্যাভার্ডিন আর গ্রামীনের চেক শার্ট পড়া চাপদাঁড়িয়াল এক চশমুশ আর তার বন্ধুদের বাদাম, ফুচকা, চানাচুর, ঝালমুড়ি আর চা সহযোগে ‘চৈতালী’র অপেক্ষায় থাকার কথা মনে পড়তো তাদের। কে জানে, হয়তো মনে করে ফেলতো, তিন-চারজন রিকশায় চেপে হুট করে বঙ্গবাজারের দিকে রওয়ানা হবার দৃশ্য। বহুভাষাবিদ পন্ডিত ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ শুয়ে আছেন যে প্রাচীন ছোট্ট মসজিদের পাশে- সে মসজিদ তাদের চোখে পড়লে নিশ্চয়-ই মনে করে ফেলতো চিকন সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে ওযুর অপেক্ষায় বিরক্ত হয়ে ওদের আড্ডা জুড়ে দেয়ার স্মৃতি। ওদের ওসব মনে করার বালাই নেই, দুই দোয়েল তাই কেবল দেখেই যায়।
রিকশাওয়ালা মামার মর্জি অনুযায়ী রিকশা কোন কোন দিন টি এস সি অভিমুখী হয়, ফেব্রুয়ারী ছাড়া সারা বছর ধু ধু মরুভূমি হয়ে থাকা বাংলা একাডেমী কিংবা তিন নেতার মাজার, কালী মন্দির পেরিয়ে রিকশা এগোয়।
মনের তো আর প্যাডেল চাপার অপেক্ষায় থাকতে হয় না, সে সময় করে এরি ফাঁকে বর্ধমান হাউস থেকে ঘুরে আসে, নজরুল মঞ্চের বেদীতে উঠে বিদ্রোহী নজরুল-কে একটুখানি ছুঁয়ে দিয়ে আসে। পাখ-পাখালি’র ‘স্মৃতিচিহ্ন’-ও বিদ্রোহী নজরুলের বিরক্তি বাড়ায় না। “চল চল চল ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদলে”র স্রষ্টা যে সবকিছুর ঊর্ধ্বে চলে গেছেন অনেক আগেই।
একটু দূরে ভাস্কর্য হয়ে দাঁড়ানো ভাষা শহীদেরাও স্মৃতির আড়ালেই থাকেন, এক মাসের ভালোবাসা বাকি এগারো মাসের নির্বাসন ঘোচানোর জন্য কতটুকু যথেষ্ট তার কোন উত্তর না খুঁজেই। বাংলা একাডেমীর বিক্রয়কেন্দ্র-ও ক্যান্টিনের পাশে খালি পড়ে থাকে, জীবন থাকলে দুই-একজন অনিয়মিত দর্শনার্থীর হঠাৎ আগমনে নিশ্চিত করেই পুলকিত হত তারা।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা স্তম্ভের পাশে খোলা মাঠ আর কালীমন্দির বরাবর গেটে দাঁড়ানো ভ্রাম্যমান চটপটির দোকানগুলো পিছু ডাকে, বন্ধুরা মিলে প্লাস্টিকের চেয়ারে গোল করে বসে কাটানো সময় মনে করিয়ে দেয়।
মন ওদিকে সময় না দিয়ে ফের রিকশায় ফেরে- হাতের বামে তাকালেই টিএসসির অডিটরিয়াম, তার সামনে সবুজ আঙ্গিনা, ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকালে কষ্টসাধ্য হলেও দেখা যায় টিএসসি ক্যান্টিন-ও। সন্ধ্যারাতের ঔজ্জ্বল্য বাড়াতে রাস্তার পাশে লাগানো বাতিগুলো টিএসসির চেহারা বদলে দেয় অনেকটাই।
সামনের দেয়ালঘিরে বসে থাকা ছাত্র-ছাত্রীদের ভীড়ে পরিচিত চেহারা খুঁজে ফেরে চোখ, নিরাশ হতে হয় তাকে- দিনের পর দিন। টিএসসি-কে জীবনের অবিচ্ছেদ্য করা ফেলা কাছের-দূরের বন্ধুদের দেখাও মেলে না।
রিকশা থেকে নামা হয় না তাই- ভেতরে গিয়ে অডিটোরিয়ামে কোন অনুষ্ঠানের দর্শক হওয়া হয় না, ঘাসে বসে অপরিচিত সতীর্থের গলা কাঁপানো আবৃত্তি শুনে চুপিচুপি হাসাহাসিও হয় না।
কনভোকেশনের গাউন তোলা, লাঞ্চ, ডিপার্টমেন্টের বর্তমান ছাত্র হয়েও রি-ইউনিয়ন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর আনুষ্ঠানিক নবীন বরণ, বড় ভাই-বোনদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দর্শক হওয়া অথবা নিজেদের বিদায়ের আগে সবাই মিলে দুই ঘন্টার এক জমাট আনন্দ-আসর... স্মৃতির কি শেষ আছে কোন?
ডাস-এর সামনে পা ঝুলিয়ে বসে খুব কাছের বন্ধুদের সাথে রাত বারোটায় বৃষ্টিভেজা পথে দুরন্ত গতির প্রাইভেট কারগুলোর আনাগোনা দেখা অথবা টহল দিতে থাকা পুলিশদের দেখতে দেখতে চা-ওয়ালা মামাকে ডেকে চা খাওয়ার মাঝে যে আনন্দ সে কি ভোলা সম্ভব?
গভীর রাতে হলে ফেরার পথে হঠাৎ নামা বৃষ্টিতে হাল ছেড়ে ভিজতে থাকা, রাস্তার ঠিক মাঝ বরাবর হেঁটে যাওয়া, রোড ডিভাইডারে বসে থাকা, রাস্তার পাশে যাত্রী-ছাউনিতে অযথাই সময় কাটানো- মনে পড়ে যায়, নিজে নিজেই।
রিকশা যদি জিমনেশিয়াম আর সুইমিং পুলের সামনের রাস্তাটা হয়ে চলতে থাকে তাহলেও স্মৃতির কমতি পড়ে না। কী আশ্চর্য, মন যে কোথায় কোন কথা লুকিয়ে রাখে তার খবর কি আমরাই রাখি?
‘বাধ্যতামূলক জিম’-এর ফাঁড়া এড়াতে সেই মিরপুর থেকে সাত-সকালে ক্যাম্পাসে হাজির হওয়ার কথা মনে পড়ে। ৪০ ক্লাসের বদলে ৪ ক্লাশেই রণে ভঙ্গ দেয়ার স্মৃতি-ও আপনাতেই মনে আঁচড় কেটে যায়।
শহীদ মিনারের সামনে এসে ‘দুনিয়া কাঁপানো ত্রিশ মিনিটের’ অপেক্ষা করতে হয় না, বই-তে পড়া অক্ষরগুলোই জীবন্ত হয়, প্রাণ হারানো সেই মানুষগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা আপনাতেই মনে আসে। রিকশা চলতেই থাকে, মন-ও।
আরেকটু এগিয়ে মোড়ে পৌঁছতেই দেয়ালের ওপারে থাকা জগন্নাথ হলের মাঠ ফিরিয়ে নিয়ে যায় একদম শুরুর দিকের দিনগুলোতে। ডিপার্টমেন্টের খেলা দেখতে এ মাঠেই আসা হত, ‘আবির’-এর ব্যাটে ভর করে একের পর এক জয় আমাদের মাঠে যাওয়া সার্থক করেছিল সে বছর। শেষের আগেও এক-ই গল্প, জগন্নাথের মাঠ আমাদের ফেরায়নি খালি হাতে। একরাশ আনন্দ আর বিজয়ির ট্রফি নিয়েই আমরা বিজয় মিছিল করে ডিপার্টমেন্টে ফিরেছি।
রোকেয়া হল আর শামসুন্নাহার হল-এর ঠিক মাঝামাঝি, টিএসসি জনতা ব্যাংকের কাছাকাছি আসতেই বাঁয়ের ফুটপাথে চোখ চলে যায়- অকারণেই। ভীড় নেই কোন, মাঝে মাঝে একজন দু’জন হয়তো যাচ্ছে-আসছে। পাঁচটা সাড়ে পাঁচটার দিকে শেষ বাসটাও ছেড়ে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অতি পরিচিত এই বাস-স্টপ ছেড়ে।
চৈতালী, বৈশাখী, তরঙ্গ, শ্রাবন- আরো কত নাম বাসের- একেক রুটের একেক বাস। ভাড়া লাগে না কোন, টিকিট চেকার এসে যন্ত্রনা দেয় না, চেনা চেনা সব মুখ আর অফুরান গল্প; বাস চলে যায় গন্তব্যে- বাকি সব মনে ঠাঁই নেয় কোন একদিন বেরিয়ে আসবে বলে।
যেদিন যেদিক ঘুরেই আসুক, এরপর বড় বড় স্পীডব্রেকারগুলো পেরিয়ে রিকশা এগিয়ে চলে এক-ই রাস্তায়- পেছনে পড়ে রোকেয়া হল, সেন্ট্রাল লাইব্রেরী, মসজিদ, ভাষা ইন্সটিটিউট, গুরুদুয়ারা, ভিসি’র বাসভবন। অন্ধকারেও অপরাজেয় বাংলা ঠিক ঠিক দেখা যায়। পেছনে পড়ে যায় বুদ্ধিজীবী চত্ত্বর।
পরিচিত কোন মুখের দেখা মেলার আশায় চোখ চলে যায় অন্ধকারে ঢেকে যাওয়া মল চত্ত্বরের দিকে, কিংবা ত্রিভূজের শেষ কোনটায়। মহসীন হলের গেট পিছিয়ে পড়ে, সেই পুরনো দিনের হলুদের উপর কালো অক্ষরে লেখা “সার্জেন্ট জহুরুল হক হল” এর পাল্টে যাওয়া নতুন ফটক-ও চোখে পড়ে, নানান রঙের বাতির খেলা মন ভরে দেয় একবারে। রিকশা এফ রহমান হল পেছনে ফেলে নীলক্ষেত মোড়ে এসে থামে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা পেরিয়ে রিকশা থেকে নামি। নতুন গন্তব্যের নতুন রিকশা নেয়ার আগে ফিরে তাকাই ফেলে আসা পথের দিকে, ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও ঘুরে তাকাতে হয়।
আবার রিকশায় চেপে হাতে থাকা ঠোঙ্গা থেকে বাদামের খোসা ভেঙ্গে মুখে দেই, হেডফোনে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তখন রবিঠাকুরের গান শুনিয়ে যেতে থাকেন-
“পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কী রে হায়...
..ও সে চোখের দেখা প্রাণের কথা সে কি ভোলা যায়...?”
****************************************************************************
[শেষ কথাঃ
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করেছি ঠিক এক বছর পেরিয়ে গেলো আজ। সবাই দূরে দূরে চলে যাচ্ছে। কাছের বন্ধুদের সাথেই দেখা হয় না, একটু দূরের যারা তাদের কথা ছেড়েই দিলাম। অদ্ভূত কথা হল- পুরনো স্মৃতি যখন মনে আসে, তখন অত দূরের কাছের বিবেচনা করে না- সবার কথাই মনে পড়ে। একদম মূল্যহীন কোন স্মৃতি হঠাৎ করেই মূল্যবান হয়ে ওঠে। পেছনে তাকালে তাই সবাইকেই দেখছি- দূরের, কাছের সবাইকেই।
এ লেখাটা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমার কাছাকাছি আসা না আসা সব সতীর্থের জন্য।
সবার জীবন আনন্দময় হোক।]
মন্তব্য
লেখা বেশ ভাল লাগল। স্মৃতির চাইতে বেশী নাড়া দেয়, এমন জিনিস বোধহয় কমই আছে।
একটা শব্দ ঠিক করে শিখলাম: গ্যাভার্ডিন। আমি অন্য কিছু বলতাম । বিনিময়ে আপনার একটা বানান ঠিক করে দেই: চত্বর।
লেখা ভাল লাগল যে বলছেন তার কারণ-ই হয়তো স্মৃতিতে নাড়া পড়েছে আপনার। আর তেমন যদি হয় এই লেখা আমার চোখে সার্থক।
ভুল ধরিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ, পরের বার ঠিক 'চত্বর' লিখবো।
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
একটু বেশিই ভালো লেগে গেল লেখাটা ! গদ্য-কবিতা ভাবতে ইচ্ছে করছে। আপনার সাথে আমার কোথাও প্রচন্ড মিল, তা না হলে ছবিগুলো এত স্পষ্ট কেন?
পথিকের চোখ খুঁজে ফিরুক আরো...
অনেক ধন্যবাদ ভাল লাগাটা জানানোর জন্য।
হয়তো আমাদের দেখার চোখটা একরকম, হয়তো লেখাটার কোন অংশ আপনার কোন পছন্দের স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে।
শুভ কামনা রইল আপনার জন্য-ও!
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
সূর্যসেন হল থেকে কমার্স ফ্যাকাল্টি, একমিনিটের পথ। সকাল ৮টার ক্লাস করতে ঘুম থেকে ৭টা ৫০ মিনিটে উঠলেই চলতো। ঘুমভাঙ্গা চোখ কচলাতে কচলাতে চলে যেতাম। বন্ধুরা প্রায়-ই বলতো, সকালে ক্লাসে আসার হ্যাপা। সেই মধুর দিনগুলো ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে। আড়াল নিচ্ছে কত শত আনন্দ-বেদনার ঘটনা।
আপনি তাহলে ফ্যাকাল্টি'র বড় ভাই! মজা তো!
'কমার্স ফ্যাকাল্টি' বললেন, কোন ব্যাচ?
আর পান্থদা,
কেন জানি মনে হয় মধুর স্মৃতিগুলো ঝাপসা হয়তো হতে চায়, আমরা ওদের আঁকড়ে ধরেই বাঁচতে চাই। আর নানান বেদনার ঘটনা রয়ে যায় মনের গহীন কোন তলে, কোন এক দুর্বল সময়ে কাঁপিয়ে অসহায় করে দেবে বলে।
অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
আমি এইট ব্যাচ! ফিন্যান্স।
আপনি কোন ব্যাচ?
তার মানে দাঁড়াচ্ছে দেখা না হলেও আপনি যখন ফ্যাকাল্টিতে হুসেন বা ফারুক মামার চা খেয়েছেন বা আড্ডা দিয়েছেন তখন হয়তো বন্ধুদের নিয়ে আমিও কাছাকাছিই ছিলাম! কে জানে?!
আমি টেনথ ব্যাচ, মার্কেটিং।
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
তুমি কি পিংকিদের বন্ধু?
পিংকি মনে হয় ইলেভেন্থ ব্যাচ! ভুলে গেলাম সব।
উহহু! কাকে চিনতে পারেন দেখি!
কৌশিক, আদিবা, ফয়সাল, কামাল- নামগুলো কি চেনা লাগছে!?
আবির (শাহরিয়ার নাফিস) আমাদের ব্যাচের ছাত্র।
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
শহরটা বিরক্ত করে। সেই শহর নিয়েই কতজনের কত ভালোলাগা, ভালোবাসা...
টেনে ধরে রাখার মতো একটা লেখা।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
লেখাটা আকারে যত বাড়ছিলো, সাথে বেড়ে যাচ্ছিল চিন্তা।
এত বড় লেখা পড়ার ধৈর্য্য ধরে রাখাটাও তো কঠিন।
আপনার শেষ কথাটা সত্যি আশ্বস্ত করলো।
অনেক অনেক ধন্যবাদ।
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
অনুজপ্রতিম মর্ম ভাই,
অনাবিল, মন জুরিয়ে দেয়া লেখা। কয়েকটি বিষয় নিয়ে আড্ডা ফাঁদতে ইচ্ছে করছে।
দোয়েলের শিস না শুনলেও লেজের দেখা তো মিলে, হোক না কংক্রিটের লেজ!
তার মানে কি এই দাঁড়ালো না, শীতের আমেজলাগা সকাল, গাছের ডালপাতার আড়াল দিয়ে ঝলমলে সূর্যের বিভা, ঘুম ভাঙ্গা সূর্যের কাঁচা রোদ পরশ, ছায়া খুঁজে জিরিয়ে নেবার অলস দুপুর - সবই আছে; নিঃশেষিত হয়েছে শুধু আমাদের আস্বাদনের অভীপ্সা ও ক্ষমতা? কি ভয়াবহ নিদাঘ সময় আমাদের আষ্টেপিষ্টে বেঁধে ফেলেছে ক্রুর অক্টোপাসের মতো! কি বিষাক্ত হলাহল মিশেছে আমাদের মননের গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে!
অর্থাৎ এই নয় কি, যদি সমস্যা দগ্ধ হয়েই থাকে কিছু, সেটা আমাদের মন ও মনন। তাই আমার অনুজপ্রতিম বন্ধু প্রকৌশলী জনাব আসাদউজ্জামানের জবানীতে বলি, "জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের আগে প্রয়োজন জীবনের মানোন্নয়নের"।
খুব, খুব ভালো লাগলো আপনার এই নিরুপম যাত্রা। অনেক ধন্যবাদ আমাদের 'কল্পনার সঙ্গী' হবার সুযোগ করে দেবার জন্য।
-----------------------------------
যে মাঠে ফসল নাই তাহার শিয়রে
চুপে দাঁড়ায়েছে চাঁদ — কোনো সাধ নাই তার ফসলের তরে;
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
রোমেল ভাই,
আপনার মতো এতো গুছিয়ে তো বলতে পারবো না, কাজেই ঠিক করে উঠতে পারছি না কী বলবো?
আপনার কথাগুলোর সাথে একমত না হয়ে কোন উপায় নেই আসলে, কারণ সত্য ওতেই লুকিয়ে।
মাঝে মাঝে সেই পুরানো দিনের নিজেকে ফিরে পেয়ে খুব আফসোসেই পড়ি হয়ত, কিন্তু যান্ত্রিক নগরী পায়ে শেকল পরিয়ে শেষ পর্যন্ত আমাদের যন্ত্র বানিয়েই ছাড়ে। তবু যতটুকু সত্যিকারের 'আমি' লুকিয়ে থাকে জাকিয়ে বসা নতুন কিন্তু পোশাক পড়া 'আমি'র মাঝে, সে-ই আসলে আমাদের বেঁচে থাকার রশদ যোগায়।
এই 'আমি'কে যেদিন হারিয়ে ফেলবো, সেদিনই আসলে আমাদের মৃত্যু হবে- চাই দুনিয়ায় থাকি আর না-ই থাকি।
শুভকামনা আপনার আমার আর সবার জন্য- আমাদের 'আমি'-কে যেন হারিয়ে না বসি আমরা।
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
চমৎকার লাগলো পড়তে।
আর মোটামুটি ছ'মাসের মধ্যে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকবে, তারপর সতীর্থরা সব যে কে কোথায় চলে যাবে...
লেখায় পাঁচ তারা!
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
অভিজ্ঞতা বলে প্রথম প্রথম খারাপ লাগাটা তীব্র হয়, চেনা চেনা মুখগুলো দেখতে না পাওয়া একটা অস্বস্তির কারণ হয়, আস্তে আস্তে সব সয়ে আসে। মাঝে কিছুদিন ভাল-ও লাগতে পারে, পড়া নামের বোঝা শেষ পর্যন্ত ঘাড় থেকে নামল বলে ;)।
মন খারাপ তখনি হয় যখন দেখা যায় কাজের চাপে খুব কাছের বন্ধুদের সাথেই যোগাযোগ বন্ধ হয়ে ওদের হারিয়ে ফেলার পথে। আর বাজে লাগার কোন সীমা পরিসীমা থাকে না, যদি কোন কারণে বন্ধুরা ভুল বুঝে কষ্ট পেয়ে বসে।
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
প্রতিদিন ক্লাস করতে করতে বিরক্ত... তবে মাঝেমাঝে খুব সকালের দিকে ক্লাসে যাওয়ার পথে যখন একা থাকি, যখন চারপাশে তাকাই, তখন খুব মায়া লাগে... খুব মন খারাপ হয়... মনে হয় একটা সময় আসবে যখন এই চেনা মল-চত্বর, ডাস, টি.এস.সি. সবকিছু ছেড়ে যেতে হবে...
"চৈত্রী"
সবচেয়ে বাজে ব্যাপার হলো- 'আমার বিশ্ববিদ্যালয়'- এ কথাটা আর বলার উপায় থাকে না।
তখনো 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়'র ছাপটা পিঠ থেকে সরে যাবে না হয়তো, অদৃশ্য 'সাবেক' শব্দটা যোগ হয়ে যন্ত্রনা বাড়াবে
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
ভালো লাগলো
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
অনেক ধন্যবাদ নজরুল ভাই
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
বেশ ভাল লাগলো মর্ম। অনেক অনেক পুরোনো কথা মনে পড়ে গেল। দোয়েল চত্বর, চৈতালী, জগন্নাথ হলের মাঠে আন্তঃডিপার্টমেন্ট ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নশীপ, টি এস সি তে নবীনবরণ......কত শত যে স্মৃতি। বহু আগে এসব ফেলে এসেছি।
নিজের স্মৃতিতে ঘুরে আসতে গিয়ে যদি সাথে আরো কারো মধুর কোন স্মৃতিকে খানিকটা মনে করিয়ে দেওয়া যায় তার আনন্দ কম নয়!
এ লেখাটার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য আসলে সেটাই ছিল।
আপনিও মিরপুর ছিলেন বুঝি? কোন ডিপার্টমেন্ট আপনার? কোন ব্যাচ?
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
হৃদয়ে নাড়া দিয়ে গেল । আর বেশিদিন হয়তো নেই । এইতো আর কয়েকটা মাত্র দিন । নিয়তির এই কড়া নাড়া ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে ।
সময়গুলো আসেই চলে যাওয়ার জন্য! মেনে নেয়া ছাড়া উপায় কী?
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
লেখাটা অতীত এবং ভবিষ্যৎ মনে করিয়ে দিল। যদিও অতীতের পরিসর এত বড় ছিল না, তাতে কি স্মৃতির তো কমতি নেই। আর ভবিষ্যৎ এ যে এরকম ভাবেই স্মৃতিগুলোকে নাড়া দিয়ে যাবে তাতে আর সন্দেহ কি! তবে পড়ে অনেক ভাল লাগলো। অনেক শুভকামনা।
অতীতটা মনে করিয়ে দিতে পারছে এ লেখাটা, প্রাপ্তি তো এটুকুই! বর্তমানটা ভালো হোক তোমার/তোমাদের, তাহলে ভবিষ্যতে পৌঁছে ফিরে দেখবে যখন, ছবিটা ছিমছাম হবে আর সুন্দর। অনেক অনেক শুভকামনা।
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
নতুন মন্তব্য করুন