আর কত? সহ্যেরও তো একটা সীমা থাকে, নাকি?!
সেই তখন থেকে চেষ্টা তো করে যাচ্ছি- ঘুম আসছে কই? মনটাকে একটু সামলে- চোখ বন্ধ করে- ঘুমের চিন্তা এনে- দশ থেকে এক উলটো গুণে- লাফিয়ে বেড়ানো ভেড়া গুনে- ঘুমানোর চেষ্টা যত করছি, চোখ যেন তত খুলে খুলে যাচ্ছে।
কতক্ষণ হল? অনেকক্ষণ? নাকি- খানিকক্ষণ? মনে তো হচ্ছে- অনন্তকাল।
সেই কখন থেকে- মাথার যন্ত্রনাটা ভুলে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি- আসছে আর কই? রাতে ইউরোর খেলা দেখে শুয়েছি- মাথার পেছনটা একটু কেবল ব্যথা করছিলো তখন- ক্লান্ত শরীর, মন- ঘুম আস্তে দেরী হয় নি। সে ঘুম হঠাৎ-ই ভাঙ্গলো- ব্যথায়।
অসহ্য, ভোঁতা- যন্ত্রনা। মাথার পেছনটা একদম ভারী- ব্যথায় সামনের অংশটাও মনে হচ্ছে কেউ শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছে। মাঝে মাঝে মাথার এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত বুঝিবা ব্লেড দিয়ে চিরে ফেলছে কেউ। কপালের দুপাশে শিরাগুলো হাতের আড়ালে থেকেও দপ দপ করে লাফাচ্ছে থেকে থেকে।
এরপরও তো এতোক্ষণ চেষ্টা করলাম- সব যন্ত্রনা ভুলেই- আর কত?!
ভাইয়া ঘুমুচ্ছে পাশেই। খেলা দেখেই শুয়েছে। সন্ধ্যায় ফিরেছে আজ- ঢাকা থেকে। দূর থেকে আসার ধকলেই হোক, আর বাড়তি রাত জাগার জন্যই হোক, ভালোই ক্লান্ত ছিল; শোয়া মাত্র ঘুম। কারো ঘুম দুই ঘন্টায়-ও আসে না, আর কেউ দশ মিনিটেই নাই হয়; ও এমনিতেও ন্বিতীয় দলের।
মাঝে মাঝে শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ একটু ভারী হচ্ছে। ঘুম-ও? হবে হয়ত। অস্পষ্ট শব্দ করে এপাশ-ওপাশ করেছে বার কয়েক, লাল লাল চোখ খুলে কী বলেছে, কুনুই বাঁকিয়ে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে আবার তলিয়ে গেছে ঘুমে- বেরিয়ে থাকা ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা- কী স্বপ্ন দেখছে ও?
ভাইয়াকে ডাকলে হয়। মাথাটা কেউ একজন একটু টিপে দিলে ভাল লাগবে। বালিশে চাপা দিয়ে, দু'হাতে শক্ত করে ধরে রেখে দেখলাম তো এতোক্ষণ- কমলো কিছু? যদি না কমে- টিপে দিলেও? কী লাভ? মাঝে থেকে ওর ঘুমটা বরবাদ। ঘুমোচ্ছে- ঘুমোক না আরাম করে! ওকে আর কষ্ট দিয়ে কী হবে? যা হবার নয় তা হওয়ানোর আশায় যা হচ্ছে তা থমকে দেওয়ার মানে নেই কোন।
এরচেয়ে বরং বিছানা ছেড়ে ওঠা ভাল। জানালাটা খোলা- বাইরে অন্ধকার, দেখা যাচ্ছে না কিছু। হালকা ঠান্ডা হাওয়া আছে- কে জানে খোলা হাওয়া গায়ে লাগলে ভাল লাগতে পারে একটু। তোমার খোলা হাওয়ায় আমি ডুবতে রাজি আছি- রবি ঠাকুরের গান। কতদিন শুনি না।
রাতের এ সময়টা এমনিতেও ঠান্ডা থাকে। সব দিকেই। কোন শব্দ নাই। আলো নাই। মাঝে মাঝে দূর থেকে আলোর রেখা এক মূহুর্তের জন্য আসে, আবার চলে যায়। রুমের পাশের বাথরুমের বালতিতে টুপ টুপ পানি পড়ছে- টেপ বন্ধ হয় নি ঠিক মত? ঘরের এ কোনায় খুট-খুট শব্দ, ও কোনা থেকে ঘড়ির টিক-টিক। সারাদিন চুপচাপ, ঘড়ির সমস্ত কথাবার্তা কি রাতের জন্য জমা করা? কে শোনে ঘড়ির কথা?
ঘরের অন্ধকার, বাইরের অন্ধকার দুটোই সয়ে গেছে। ছায়াটে একটা ভাব সবকিছুতে, খানিকটা অচেনা চেহারার চেনা ছবি। ভয় লাগে, আবার কৌতুহল-ও হয়।
জানালা পেরিয়ে বাইরের আকাশটা দেখতে কষ্ট হচ্ছে না একটু-ও। বর্ষা কেবল শুরু হল, আকাশ মেঘলা থাকে প্রায়-ই, দিনে- রাতে, বৃষ্টি আর হয় না। আকাশের মেঘগুলোকে কেমন কালচে লাগছে, তাহলে কি বৃষ্টি হবে আজ? বাতাস কি বাড়লো একটু?
কত ভাল লাগে এ সময়গুলো- অন্য যে কোন দিন এর মধ্যে বারান্দায় চলে যেতাম হয়ত- রাতের এ অদ্ভূত বাতাস গায়ে না লাগালে কি চলে? অথচ- কী বিশ্রী লাগছে এখন! বাতাস বাড়ছে যেমন- বাড়ছে মাথার যন্ত্রনাও। বাইরে তাকিয়ে যে দেখবো- চোখ বুজে জানালায় মাথা ঠেকিয়ে বসে বাতাসটা একটু শরীরে ছোঁয়ানোর চেষ্টা করব- সে সাধটুকু পর্যন্ত হচ্ছে না।
চোখ বন্ধ- আরামের আবেশে না- দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রনাটুকু একা একা নিঃশব্দে সহ্য করে নেয়ার জন্য। ঘাড় গরম হয়ে আসছে, টের পাচ্ছি- আরো বাড়বে?
আব্বুকেও ডেকে তোলা যায় ঘুম থেকে, পাশের রুমেই তো। তাঁর কাছে নানান জাতের ঔষধ থাকে সব সময়- দরকার পড়ে না তেমন- তবুও কেমন বাতিকের মত- সব ওউষধ থাকতে হবে সাথে- "যদি দরকার পড়ে?!"
মাথা ব্যাথার ঔষধ-ও কি নেই? নাপা? নাকি নাপা এক্সট্রা? আছে নিশ্চয়-ই। যাবো? ডেকে তুলবো? যদি দেখা যায় ঐ ঔষুধটাই নেই? শুধু শুধু ডেকে তোলা হবে- ঘুমটা ভাঙ্গলে আবার ঘুমুতে কষ্ট হবে খুব। লক্কর-ঝক্কর বাসে নাচুনে রাস্তায় প্রতিদিন তিন ঘন্টার পথ আসা যাওয়া করা- কম তো নয়। শরীরের বিশ্রাম দরকার, ঘুম দরকার। কাল-ও অফিস আছে, এ মধ্যরাতে ঘুম ভাঙ্গালে আর কি ঘুম আসবে?
তাও না হয় ডেকে তুললাম-ই, কিন্তু ঔষধ যে কাজে দেবেই তার গ্যারান্টি কে দেবে? মাস কয়েক আগেই তো- সেবারো মাঝরাতে- তীব্র মাথাব্যথা- আব্বুকে জাগিয়ে তাঁর ভাঁড়ার থেকে কড়া ডোজের ঔষধ-ও মিললো- ব্যথা আর কমলো না। যেমন ছিল তেমন, মাঝে থেকে আব্বুর ঘুম নষ্ট- লাভ হল কোন?
এর চেয়ে বসে থাকাই ভাল, এখন যেমন আছি- খাটের কোনায়- মাথা চেপে ধরে- চুপচাপ থাকার চেষ্টা করতে করতে। শব্দ হলে ভাইয়ার ঘুম ভেঙ্গে যাবে।
রাত জাগাটা নতুন না আমার জন্য, প্রায়-ই জাগি। মাঝে মাঝে গল্পের বই পড়তে পড়তে রাত কেটে যায়, আড্ডা দিয়ে রাত কেটে যায় কত, টিভিতে খেলা দেখতে দেখতে মাঝরাত পেরিয়ে গেছে বহুবার। সে অন্যরকম। নিজের ইচ্ছায় জেগে থাকা আর জেগে থাকতে বাধ্য হওয়া কি এক কথা?
মাথা জমে যাচ্ছে যন্ত্রনায়- কেমন ঝিম ধরে আছে, আবার এক-ই সাথে মনে হচ্ছে মাথার চুলগুলো কেউ একসাথে টেনে টেনে ছেঁড়ার চেষ্টা করছে, আবার মনে হচ্ছে কেউ টেনে যাচ্ছে মাথার ভেতর থেকে- কারা থাকে ওখানে?
কমে যাবে- এ আশা তো কখন থেকে করছি- দাঁতে দাঁত চেপে- ওহ! ব্যথা কমছে না কেন? আর কত?
আম্মুকে ডাকব? হ্যাঁ, সেটাও করা যায়। আগেও হয়েছে এমন। ঐ যে মাথাব্যথার ঔষধ গিলেও ব্যথা কমেনি যেবার- তখন। আব্বুর নাড়াচাড়ার জন্যই হোক বা ঔষধ বের করার জন্য স্টিলের আলমারিটা খোলার ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দেই হোক, আম্মু উঠে পড়েছিল।
ঘুম ঘুম চোখে উঠে এসে কোন দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে গেল, মাথায় ঘাড়ে হাত দিয়ে বোঝার চেষ্টা করল জ্বর উঠে গেল কিনা- জ্বর-কে তাঁর খুব-ই ভয়, এককালে নাকি খুব ভুগিয়েছি তাঁকে এ জ্বর নিয়ে। ঔষধে কাজ হচ্ছিলো না, এক রাশ চিন্তা মাথায় নিয়ে আম্মু ফিরে ফিরে আসছিল কেবল- "কমেছে?" সারা রাত এমনি করেই চলেছিল সেবার, শেষে সকাল হতে আপনাতেই কমে এল- আম্মুর একান্ত দোয়ায় নাকি ঔষধের গুণে- জানি না।
আম্মুকে ডেকে তোলার একটা বড় অসুবিধা আছে। তাঁকে যেভাবেই ডাকা হোক না কেন- এমনভাবে ধড়ফড় করে উঠে বসে- মনে হয় আর যা-ই হোক অসময়ে ঘুম ভাঙ্গানো একদম-ই উচিত হয় নি।
এখন ডাকলে অমনি করে উঠে বসবে এখন, পিঠে হাত বুলিয়ে যাবে হয়ত, হাতের উল্টোপাশ দিয়ে পরীক্ষা করে দেখবে শরীরের তাপ বাড়ল কি কমল, চুলে হাত বুলিয়ে যাবে, একরাশ দুশ্চিন্তা আর দূর্ভাবনা নিয়ে পাশে বসে থাকবে- বাড়তি কষ্ট শুধু। সেই তো ব্যথা কমার অপেক্ষা, নয়তো সকালের- ডাক্তারের চেম্বার খুলবে তখন- কাছেই তো।
ঘাড় না কেবল, কপালও গরম হয়ে গেছে বোধ হয়, হাত না ছোঁয়াতেও বাড়তি তাপ ঠিক ঠিক বোঝা যাচ্ছে। মাথার তালু গরম হয়ে আছে কেমন- চুলের সামনের রেখা বরাবর চিকন ঘাম, ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার কথা- বাড়ছে কেন তবে?
সময় কত হল? কিছু কি পেরিয়েছে?
বাইরের আকাশ দেখা যাচ্ছে এখনো- জানালা দিয়ে। ঐ যে- দূরে, দূউউউউরে- সামনের নারকেল গাছটার পাতার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে- আবছা অন্ধকারে একটু কি লালচে রেখা? ভোর কি হতে চললো? কই, আযান তো শোনা গেলো না- আস সালাতু খাইরুম মিনান নাউম- ঘুম থেকে নামাজ উত্তম- কিছুই তো কানে এলো না।
কখন সকাল হবে? এভাবে বসে বসে অপেক্ষা- সকালের- আর কত?!
[পুরানো ফাইল থেকে; লেখাঃ ২২ শে জুন, ২০০৮]
মন্তব্য
আপনার লেখাটা দারুণ সংক্রামক। পড়তে পড়তে আমার ও মাথাটা চিনচিন করে উঠল।
রাতে না ঘুমিয়ে জেগে থাকাটা আসলেই চরম পেইনফুল। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।
আপনার বর্ণনাভঙ্গি অসাধারণ লেগেছে।
পাগল মন
অসাধারন।
মন ছুয়ে গেল.. :'(
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
নতুন মন্তব্য করুন