একটা গল্প লিখতে ইচ্ছে করে

মর্ম এর ছবি
লিখেছেন মর্ম [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ২০/০১/২০১২ - ৬:১৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

“...কেউ বলছে কিছু বলছে কেউ বলব বলব করছে
কেউ বলতে না পারা যন্ত্রনা নিয়ে গুমড়ে গুমড়ে মরছে...।“

ডেস্কটপের স্ক্রিনে নানান রঙের ঢেউ ভেসে বেড়াতে থাকে মিডিয়া প্লেয়ারের জানালায়, আর শ্রীকান্ত গাইতেই থাকেন, অবিরাম। কী-বোর্ডে হাত দিয়ে বসে থাকি কেবল- লেখার খোলা পাতা সাদাই থাকে, মাঝে মাঝে একটা দুটো শব্দ উঁকি দেয় আবার কিসের পিছুটানে ফিরে যায়, হয়ত সঙ্গী শব্দদের খুঁজে আনবে বলে।

আমি বসেই থাকি, শ্রীকান্ত বিশ্রামে গেলে সুমন বলে যান “হাল ছেড়ো না বন্ধু”, কৃষ্ণকলি মনে করিয়ে দেন “বন্ধু তোমার চোখের কোনে চিন্তা খেলা করে”, শাহানা মন ভোলানোর চেষ্টা করেন “মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো দোলে মন দোলে অকারণ হরষে”, অনুপ ঘোষাল কোন রাখালের কথা মনে করিয়ে দেন “তার সুরে বুঝি জাদু আছে মন হল মাতাল” আর হেমন্ত কেবলি মনে করিয়ে দেন “পুরানো সেই দিনের কথা”!

শুনি, কেবল শুনি। কিচ্ছু না করে কেবল বসে থাকতে ইচ্ছা করে- সব ভাবনা ভুলে, সব চিন্তা শিকেয় তুলে। অলস চোখে সামনের দেয়ালটায় তাকিয়ে থাকতে থাকতে হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করে খুব, সুরের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা একটা দুটো শব্দ কানে এসে আলতো টোকা দিয়ে যায় বুঝি- শব্দেরা শব্দদের সাথে খেলতে চায়, লিখতে ইচ্ছে হয় খুব, একটা গল্প লিখতে খুব ইচ্ছে হয়।

কী নিয়ে গল্প হবে তা বুঝি না কেবল।

কী নিয়ে গল্প লেখা চলে? ঘরের অন্ধকারটাকে একাই দূরে সরিয়ে রাখা ঝলমলে টিউবলাইটটাকে নিয়ে কি গল্প হয়, যার সাথে রুমের একমাত্র টিকিটিকিটা সন্ধ্যার পর থেকেই থেকে থেকে লুকোচুরি খেলে? নাকি গল্প হয় গান শোনানো ডেস্কটপটাকে নিয়েই, একটু খুঁজে দেখলেই যেখানে পাওয়া যাবে হরেক ধাঁচের গল্প? হোক না সে কাজের আড়ালে লুকনো, ছবিতে ছড়িয়ে থাকা, গানের সাথে ছবি জুড়ে জুড়ে যত্ন নিয়ে বাসায় তৈরি কোন মিউজিক ভিডিও বা প্রেসেন্টেশন স্লাইডের আবছা পর্দায় ঢাকা?

না কি বিছানার এক কোণে পড়ে থাকা বই-খাতা’র স্তুপটা নিয়েই গল্প হয়? খটখটে আইনের বই আর লীলা মজুমদারের খেরোর খাতা দিব্যি পড়ে থাকে একসাথে – স্পাইরালে বাঁধানো খাতা আস্তে করে মেলে ধরলে গল্প পাওয়া যাবে কোন?

নাকি পায়ের কাছে এলোমেলো পড়ে থাকা ডিভিডির বাক্সগুলোই গল্পের যোগান দিতে পারে? ‘নেভারল্যান্ডে’র দেখা না-ই মিলুক, না-ই থাকুক নিজের মত করে গড়ে নেবার জন্য একটা আস্ত ড্রাগন, পেঙ্গুইনেরাও না হয় মিঃ পপার-এর সাথে থাকুক সেই মেরুর দেশেই, ‘ড্রাগন ওয়ারিয়র’ তার রাজহাঁস বাবার সাথে নুডুলসের দোকানে বা ‘জেড প্যালেসে’-এ ‘ইনার পিস’ খুঁজে দিন পার করে দিক- ক্ষতি তো নেই কোন; ‘পাইরেট’ না হয়ে হ্যারী’র সুরে সুর মিলিয়ে ‘এক্সিও গল্প’ বলে হাওয়ায় আঙ্গুলের একটা ঢেউ তুলে যদি গল্প পাওয়া যায় কোন, ওটা গল্প হবে না?

জানি না, আমি জানি না। আমার কেবল একটা গল্প লিখতে ইচ্ছা করে।

যে গল্পে ‘আমি’ থাকব, ‘আমরা’ থাকবে, ‘তুমি’ থাকবে, ‘তোমরা’ থাকবে, ‘সে’ থাকবে, ‘তারা’-ও থাকবে- যে গল্পে ‘আমি’ ‘তুমি’ ‘আমরা’ মিলে ‘সবাই’ হবে। সেখানে ‘সবাই’ ‘আমাদের’ নিয়ে ‘তাদের’ দেখতে ছুটবে, ‘তাদের’ ‘আমরা আর ‘আমাদের’ ‘আমরা’ দিব্যি ভাব করে মনের সুখে আড্ডা জমাবে!

হয় না, সে গল্প লেখা হয় না। কোনমতেই হয় না।

ঝিরঝিরে বাতাসে হিমেল পরশ বুলিয়ে দেয়া শীতের সকালগুলোর গল্প লিখতে ইচ্ছে করে খুব। পাড়ার মোড়ের ছোট্ট দোকানটায় মালাইদেয়া এক কাপ গরম চায়ে ঠোঁট পোড়ানোর গল্প লিখতে ইচ্ছে করে। লিখতে ইচ্ছে করে শেকলের টানে প্রতিদিনকার জেলখানায় ছোটার, রাস্তার পাশে নাস্তায় ব্যস্ত সিএনজি-ওয়ালাদের বুঝিয়ে পথে এগিয়ে দেবার জন্য রাজী করার গল্প। পছন্দের কিছু মুখে হাসি দেখে মন ভরানোর গল্প লিখতে ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে অসহ্য মুখ দেখেও সয়ে যাওয়ার ভান করার গল্প।

সে গল্পও লেখা হয় না।

বড়সড় খোপে ঢুকে ছোট ছোট হিসেবের ঘেরাটোপে আটকে পড়ার গল্প, চেনা মানুষের অচেনা হয়ে পড়া আর অচেনার চেনা হয়ে পড়ার গল্প, দুই মলাটের জগত থেকে খোলা বইতে আছড়ে পড়ার গল্প, হতে-চাওয়া-না-হতে-পারা আর না-হতে-চাওয়া-হয়ে-পড়ার গল্প, মিনিটকে ঘন্টার আর ঘন্টাকে মিনিটের হিসেবে একাকার করে বসার গল্প- লেখা হয় না সেসবও!

মাঝে মাঝে দুপুর রোদে বা পড়তি বিকেলের চেহারা দেখা নিয়েও গল্প লেখা যায় হয়তো! ট্রাফিক ঠেলে রিকশা চাপা, ইচ্ছে হলে বি আর টি সি’র এসি বাস, অন্ধকার হতে থাকা আকাশ, সন্ধ্যার অন্ধকার দূরে ঠেলে স্টেডিয়ামের ঝলমলে ফ্লাড লাইট, কানের হেডফোনে গুঞ্জন, ঘরমুখী মানুষের তাড়া, ফোয়ারায় আলোর খেলা, ফুটপাথে সংসার, হঠাৎ চোখের সামনে এসে থামা ভিখারীর কাঁপা হাত, নামিয়ে নেয়া অন্যমনষ্ক চোখে রিকশাওয়ালার প্যাডেল চাপা- ইচ্ছে করে গল্পে লিখি সব।

হয় না, গল্প আর লেখা হয় না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মল চত্বরের বাদাম, বিজনেস ফ্যাকাল্টির ভেলপুরি, আইবিএ-র সামনের চা, মধুর ক্যান্টিনে পাটিসাপটা, ডাকসু-তে এক টাকার সিংগারা, ফ্যাকাল্টির বারান্দায় টানা আড্ডা আর দারুচিনি চা, জীবন-থেকে-দেড়-ঘন্টা-দূর-করে-ফেলা বিরক্তিকর ক্লাস আর এসাইনমেন্ট, সেমিনারে আড্ডা, খেলার মাঠে চিল চ্যাঁচানো, পাবলিক লাইব্রেরীতে রবীন্দ্র সম্মেলন, লাল বাসের অপেক্ষা- গল্পে লিখতে ইচ্ছে করে সব। সেও হয় না।

রোদে পুড়ে সাইকেলে চাপা, রিকশাজটের ঠিক মাঝখানটা চিরে শোঁ করে বেরিয়ে যাওয়া, কয়জনে মিলে রাস্তার এধার থেকে ওধার চষে ফেলা, তিতাসের পাড়ের শ্মশানঘাটের পাশ ঘেষে গুদামঘরের পেছনের বাঁধানো ঘাটে কাটানো বিকেল অথবা রেলগেটে রেললাইনের পাশ ঘেঁষে বসে ছুটে চলা রেলের হাওয়ায় উড়ে যেতে যেতে খোলা সবুজে সূর্যাস্তও গল্পে আসতে পারে- আসে না আর।

ধুলোমাখা পথ হেঁটে বাড়ি ফেরা, কোনার রুমটায় টিভি বরাবর বার্নিশ করা কাঠের চেয়ারটায় বসে জ্বলজ্বলে চোখে ঊডি উডপেকার, টম আর জেরী, ক্যাপ্টেন প্ল্যানেট, আঙ্কল স্ক্রুজ, পপাই ডি সেইলর আর কালেভদ্রে টিনটিনের সঙ্গ, বিশালাকায় স্টেডিয়াম-খাটে হা হা হি হি আর মন খারাপের পসরা- গল্প তো কতই, না, লেখা হয় না সেসব ও।

ঘুমিয়ে পড়ার আগে বুকে-মাথায়-চুলে হাতের আলতো ছোঁয়া, গাড়ি ছুটছে ভোঁ-ও-ও-ও-ও-ও, খোলা রাখতে চাওয়া চোখের পাতার আপনাতে বন্ধ হয়ে আসার আগে দেখা অস্পষ্ট মুখ, দূর- দূ-ও-ও-ও-ওর থেকে ভেসে আসা “কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা”, “ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে”- গল্প, কত গল্প।

কী নিয়ে লেখা যায় গল্প?

লেখা হয় না গল্প, গল্প লেখা হয় না।

“...গল্প যদি শুনতে চাও, আমার কাছে এসো...
...দুষ্টুমীটা রেখে এবার চুপটি করে বস...
... গল্প যদি শুনতে চাও...!!”

সেই ভাল বরং, গল্প শোনা-

স-অ-অ-অ-ব ভুলে কেবল গল্প শোনা।


মন্তব্য

তিথীডোর এর ছবি

'লিখে লিখে এইসব যদি আর নাই লিখি...'

আজ সকাল থেকে মন ভার হয়ে আছে....
এটা এখন পড়া ঠিক হয় নি। মন খারাপ

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

মর্ম এর ছবি

মন খারাপ করে দিতে মোটেও চাইনি মন খারাপ

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

মাসুম এর ছবি

চলুক

লেখাটা আমারে টাচ করছে, অনেক টাচ করছে!

মর্ম এর ছবি

মাসুম ভাই, জেনে বড় ভাল লাগল...

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

পথিক পরাণ এর ছবি

মন খারাপ করা গল্প... মন খারাপ

মর্ম এর ছবি

মন খারাপ করে দেয়াটা নেহায়েত অনিচ্ছাকৃত মন খারাপ

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

সুমিমা ইয়াসমিন এর ছবি

গল্প শোনার গল্প

তাপস শর্মা এর ছবি

কেন শেষ করে দিলেন... আরও বলতেন, কি জানি এই নির্জন দুপুরে ঘরে একা বসে বসে জন লেনন শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল আপনার বলা প্রতিটি কথা বুকে বারবার বাজছে। মনে হচ্ছিল এই বুঝি শেষ হয়ে গেলো... সময় হলে আবারো বলুন এই কথা গুলো। এইগুলি আমার কাছে " চেনা দুঃক্ষ চেনা সুখ, চেনা চেনা হাসি মুখ " ... শুনতেই ইচ্ছে করে... কারণ ইচ্ছে হল এক ধরণের রাঙা ফড়িং ।

মর্ম এর ছবি

কিছু লেখা আছে যেগুলো লিখে ফেলতে পারলে মনের গুমোট ভাবটা কেটে যায়, আমার জন্য এ লেখাটা সেরকম। আপনি যখন বলছেন এ কথাগুলৈ শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে আপনারও, তাকে আমি 'উপরি' হিসেবেই নিচ্ছি, এবং বেশ খুশি খুশি লাগছে। ধন্যবাদ আপনাকে। হাসি

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এর ছবি

মায়া!

------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

মর্ম এর ছবি

হাসি

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

মর্ম এর ছবি

সেটাও আগে লিখেছিলাম হাসি

অট: এ কথাটা আসলে সুমিমা আপুকে বলা। পথ থেকে আলাদা হয়ে ভুলে চলে এসেছে এখানে!

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

আশালতা এর ছবি

ভালো লাগলো । অনেক ভালো লাগলো। কেন যেন জগজিতের একটা গান মনে পড়ে গেল।

----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি

মর্ম এর ছবি

নতুন করে আর কী বলি? তবে ভাল লাগাটা জানালে সেটা আসলেই ভাল লাগে! দেঁতো হাসি

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।