সারাদিনটায় মনে থাকে না অত, কিন্তু শেষ বিকেলটায় এসে শুভ’র সময় আর কোন মতেই কাটতে চায় না। বলতে গেলে শরীরের অংশ হয়ে ওঠা চেয়ারটাকে একেবারে অসহ্য লাগতে থাকে, ছোট্ট এক খন্ড নিজের ভূবন হয়ে ওঠা কিউবিকলটাকে মনে হয় নির্ভেজাল জেলখানা, সাদা টেবিলের ওপর একাকী পড়ে থাকা কালো মাউসটাকে মনে হতে থাকে কিলবিলে ইঁদুর, ইন্টারনেট আর দুনিয়া ঘোরার জানালা থাকে না- এক নিমেষে হয়ে পড়ে পৃথিবী আড়াল করা ঝাপসা পর্দা।
বিকেলটা কত সুন্দর হতে পারে আর কত অসুন্দর হয়ে ওঠে তার উদাহরণ হয়ে থাকে শুভ’র এক একটা বিকেল। খোলা ছাদে হাওয়ায় ওড়ে যাওয়া নেই, আকাশে মেঘের ওড়ে বেড়ানো দেখা নেই, ঘরমুখী পাখীদের বাড়ি ফেরা দেখা নেই, পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে স্পেশাল চায়ের চুমুক নেই, এক দঙ্গল বন্ধুর সাথে প্রাণভরা কথা নেই, ঘুমচোখে চেয়ে থাকা সূয্যিমামার লালচে ক্লান্ত চেহারা নেই, আলো হারিয়ে দিন পালানোর ছবি নেই- নিয়ন আলো এসি আর কাজের ফাঁকে হঠাৎ জেগে ফের চুপসে যাওয়া আশেপাশের মানুষগুলোর সাধ্য কি সে আক্ষেপ তাড়ায়!
অথচ কেমন দারুণ ছিল এক একটা দিন।
পাশের বাসার বিশ্ববিদ্যালয়য় পড়ুয়া ছেলেটা ঠিক আটটায় বাসা থেকে বেরিয়ে যায়- সদ্য ঘুম ভাঙ্গা চেহারা- কোনমতে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিতে নিতে একটা ঝোলা কাঁধে হনহন করে হেঁটে যায় কলোনীর পিচঢালা পথটা ধরে- হয়ত তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস ধরার তাড়া- হয়ত সকাল সকাল ক্যাম্পাসের বারান্দায় পোঁছে ধোঁয়ার কুন্ডলী তোলা বন্ধুদের সাথে তাল মেলানোর তাড়া। কখনো কখনো দেখা হয়ে যায় সিঁড়িতে নামার সময়- হাসি আদান প্রদান হয় কখনো কখনো- ছেলেটা হাসিমুখে আনন্দ ধরতে ছোটে- শুভ ধীরপায়ে নেমে মাইক্রোবাসে বন্দি হয়- রোজ।
মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে হয় শুভ’র- যদি একটু অদল বদল করা যেত জীবনটা। ছেলেটার মত ক্লাশ এসাইনম্যান্ট আর গ্রুপ মিটিং এর চাপ নিয়ে আবার ছুটে যাওয়া যেত বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে, আবার যদি বিরক্তিকর সব ক্লাশের পেছনের চেয়ারে বসে পাশের জনের সাথে খোঁচাখুচি আর ফিসফিস করা যেত স্যারের দৃষ্টি বাঁচিয়ে, ভুলে যাওয়া এসাইনম্যান্টের কথা মনে করিয়ে দেয়া ক্লাশের বিশিষ্ট জ্ঞানী ছাত্রটিকে আচ্ছামত ধুয়ে দেয়া যেত সবাই মিলে, ক্লাশ শেষ হতেই সবাই মিলে নীচে নামা যেত চটপট চা আর সিঙ্গারার স্বাদ নেয়া চলবে বলে, ইচ্ছা হলেই ক্লাশ এড়িয়ে বন্ধুর রুমে মেতে থাকা যেত নতুন আসা মুভিটা নিয়ে- কী আনন্দই না হত, কী গভীর আনন্দই না হত!
বেয়ারা ইচ্ছেগুলো সারাদিন দূরে দূরে থাকে, কেবল শেষবেলাটাতেই এসে তাদের আর তর সয় না- এলোমেলো করে দিয়ে যায় সব।
শীতের ছুটি হয়েছে মাত্র, ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে দেখতে দেখতে এসে গেল শেষের দিন। আটপৌরে আঠাশের বদলে আনকোড়া উনত্রিশ দিন দিব্যি বয়ে গেল- একটা থেকে আরেকটা দিনকে আলাদা করার কোন উপায় নেই- একঘেয়ে সব দিন আর গৎবাঁধা সব কাজ। একটুখানি বিরাম নেই, একটুখানি নতুনত্ব নেই।
দু’পা দূরেই দোয়েল চত্তরের হাতছানি- বর্ধমান হাউসের খোলা প্রাঙ্গন হাজার হাজার মানুষের সঙ্গ পেয়ে আনন্দমুখর- এককালে পাগল করে দেয়া এক একজন লেখক এখনো বই বের করে যাচ্ছেন- অটোগ্রাফ দিতে দিতে তাঁদের হাত ব্যথা হয়ে যাচ্ছে এখনো- কিন্তু অটোগ্রাফ খাতার অভাবে বাসায় ফেরার ভাড়াটুকু দিয়ে বই কিনে লেখকের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়া কিশোরটি কেবল নেই- তার আর সময় হয় না, তার জায়গয় চোখে চাপা উচ্ছাস নিয়ে দাঁড়িয়ে হয়ত পাশের বাসার ছেলেটি, হয়ত অন্য কেউ, অচেনা কিন্তু অতিচেনা একজন।
চার বছর বিরতি দিয়ে আসা বিশেষ দিনটা স্মরনীয় করে রাখতে বইমেলার দিকে ছুটে যাওয়ার ইচ্ছে হয় খুব, শুভ তবু চুপচাপ বসে থাকে। দিন শেষ করার, মাস শেষ করার অপেক্ষায়।
ক্লান্ত হাতদুটো কী-বোর্ডের দিকে এগিয়ে যায় আস্তে আস্তে- এক্তা একটা করে শব্দ আসতে থাকে মনিটরে-
শুভ একটু একটু করে লিখে যায়-
“ঝলমলে দিন, উদভুটি বাস,
রাম ঝাকুনি, আড়ষ্ট ক্লাস,
ঠ্যাং দোল দোল, বারান্দা-বাস,
আড্ডা-চা পান, ঠিক যত আশ,
বাদাম ভাঙ্গা, পরীক্ষা পাশ,
বইমেলা, তার আরেক সুবাস,
গান শোনা আর গেমসে কী ফাঁস,
আনন্দে ঘুম; মন, যত চাস-
হয় না কো আর; চার বছরে
বদলে গেছে দিন,
মেঘলা মনে সূয্যি খুঁজে
কাটছে বিরামহীন,
উত্সাহ বেশ অনেকখানি
চারটি বছর পরে
এই জীবনের বায়োস্কোপে
কেমন ছবি ধরে,
দেখবো বলে আজ তাকিয়ে
ভবিষ্যতের দিকে,
পাল্টাবে কী চার বছরে
কী-ই বা যাবে টিকে!
কী হবে হাল
আকাশ পাতাল
চিন্তা দিয়ে ফাঁকি-
এবার চলো মনের কোথাও
সেই ছবিটি আঁকি!!”
‘লম্ফ-বছরে’র শুভেচ্ছাটুকু বন্ধুদের পাঠানোর আগে আর একবার পড়ে নেবার কথা ভাবে শুভ- ছন্দ শব্দ ঠিকঠাক করে নেবার কথা চিন্তা করে একটু-
এরপর পাঠিয়ে দেয় ই-চিঠিতে, অদল বদল ছাড়াই।
থাক না কিছু কথা- অগোছানো। কী আসে যায় অত!?
মন্তব্য
নিত্যদিনের গল্প আমাদের। ভাল লাগল ।
সেটাই
ভাল লাগা জানিয়ে গেলেন, তাই
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
নেই!
আছে কি?
হয়ত। তবে 'নেই'দের তুলনায় 'আছে'রা একেবারেই হাতেগোনা।
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
হোক না কিছু স্বপ্ন মিছে
থাক না কিছু কথা
দুপুর রোদে ছড়িয়ে থাকুক
অল্প বিষণ্ণতা--
খাটি কথা।
--------------------------
পথেই আমার পথ হারিয়ে
চালচুলোহীন ছন্নছাড়া ঘুরছি ভীষণ---
ধন্যবাদ
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
ভাল
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
পড়ন্ত বিকেলে বারান্দায় দাড়িয়ে সামনের রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে থাকি মাঝে মাঝে। একদল ছেলেপেলে নিয়মিত খেলতে আসে এখানে। ওদের চিৎকার চেঁচামেচিতে বিরক্ত হই না একটুও। বরং ভালোই লাগে। কিন্তু কোথায় যেন একটা শূন্যতার সৃষ্টি হয়। কিভাবে জানি জায়গা দখল হয়ে গেছে। কিভাবে জানি অনেক বড় হয়ে গেছি !
আরো একটু ভালো করে লিখতেন! আরো লিখবেন। ভালো থাকবেন।
কোন অংশটুকু কম ভাল লেগেছে জানতে পারলে পরের বার ভাল লেখার চেষ্টাটা আরেকটু সহজতর হত
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
ভাল লাগল ।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
জেনে আমারও ভাল লাগল
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
এইরকম একটা মানুষকে সবাইই বোধ হয় ভেতরে বয়ে নিয়ে বেড়াই। কম বা বেশি।
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
এবং মানুষটা সুযোগ পেলেই ব্যাপক মাত্রায় যন্ত্রণার কারণ হয়!
অট: অনিয়মিত উপস্থিতির মধ্যেও প্রথম পাতা থেকে সরে যাওয়ার পরও লেখাটা পড়েছেন এবং মন্তব্যও করেছেন, খুব ভাল লাগল।
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
আপনার সেলফোন থেকে টেক্সট অপশনটাই বন্ধ করে দিতে পারলে আরাম হতো।
পোস্টটা আগে পড়িনি, চোখ এড়িয়ে গিয়েছিলো। একগাদা টাইপো আছে, লেখা পছন্দ হওয়ায় গালি না দিয়ে তারা দিলাম।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
নতুন মন্তব্য করুন