“সত্যি আসবে?!”
“আসবে!”
“সত্যি সত্যি আসবে?”
“সত্যি সত্যি আসবে!”
“ও চিনবে কেমন করে?!”
“চিনিয়ে দিতে হবে!”
“তাহলেই হবে?!”
“তাহলেই হবে!”
বর্ণ’র বড্ড অবাক লাগে। নানা’র দিকে বড় বড় চোখ তুলে তাকিয়ে থাকে ও। কাঁচাপাকা লম্বা দাঁড়ি, মাথায় অল্প কটা চুল, চোখে খয়েরি ফ্রেমের চশমা, চশমার কাঁচে ওকে দেখা যাচ্ছে আবছা- আর নানার স্বচ্ছ চোখের তারা, নানা তাকিয়ে ওর দিকেই, মুখে এগাল ওগাল হাসি।
হাতে কলমটা আড়াআড়ি হয়ে দুই আঙ্গুলের ফাঁকে আটকে আছে, নানা চাইতেই ওটা ঠিক সোজা হয়ে তরতর করে লিখতে শুরু করে দেবে! বর্ণ কত চেষ্টা করেছে অমন করে, কিছুতেই হয় না, কেমন করে যেন আঙ্গুল গলে বেরিয়ে যায় পাজি কলম!
নানা সারাদিন লেখে। জানালার কাছটায় বসে। টেবিলে বসে পড়াশোনা করতে হয় কি না- তাই টেবিলটাও ওখানে, চেয়ারও আছে একটা, আর হাতের কাছে ছোট্ট আলমারি- অনেকগুলো বই- যেদিন যেটা খুশি ওটা পড়ে, টেবিলেও মোটা মোটা বই, এমনি পড়ে থাকে একপাশে, হাতের নাগালে- কেউ কিচ্ছুটি বলে না- টেবিলের বাম পাশে একটা বড় মোটা কাগজের বাক্স, শক্ত মলাট তুললেই সাদা কাগজ ভেতরে- আর আছে প্যাড, ওপরে আবার ছোট করে নানার নাম লেখা, ও এখনো বানান করে পড়তে শেখেনি পুরোপুরি, আম্মু পড়ে দিয়েছে ওর হাত ধরে ধরে। কেমন করে হবে জানে না, ও কাউকে বলেনি এখনো- তবে বর্ণ ঠিক করে রেখেছে বড় হলেই অমন নাম লেখা প্যাড ওর চাই, অত ছোট করে নয় একদম বড় বড় করে ওর নামটা লেখা হবে, এত ছোট করে লিখে লাভ আছে? পড়াই তো যায় না কিছু! আর আ-আ-আ-র, কলম লাগবে, ঠিক নানার মত, প্যাকেটে লাল পাতার ছবি চাই আর কালো কলম কালো কালি লাল কলম লাল কালি। নানার সাথে কথা হয়ে আছে অবশ্য- বলেছে, আগে বড় হও, কিনে দেব তোমায়!
বড় হওয়ার আর অল্পই বাকি, স্কুলে গেলেই বড় হয়ে যায় সবাই- ও জানে, আম্মু বলেছে ও বানান করে পড়তে শিখে গেলেই ওকে স্কুলে ভর্তি করে দেবে। পড়তে অবশ্য ও এখনই পারে, আম্মু পাশে থাকলেই হয়!
নানা কখনো খাতায় লেখে, কখনো খালি পাতায়। একটু একটু করে লেখা হতে থাকে, একদম পুরো পাতা, দুই পাতা- এরকম। লেখা শেষ হতেই ডাক পড়ে ওর- “নানুকে বল কতগুলো ভাত দিতে!” “ভাত কী হবে?”- ও জিজ্ঞেস করে। “আগে আন তো!”- নানা বলে। নানু ভাত দেয়- ছোট্ট প্লেটে করে- একটা, দুইটা, আটটা, দশটা- বর্ণ আঙ্গুলে গুণে নেয়- অনেকগুলা ভাত- নানা এইবার টেবিলের বামদিকে ড্রয়ারটা টেনে বের করে- হাতে বড় আর কালো ডায়েরি একটা- আর সেটার পাতা থেকে বের হয় ছোট হলুদ খাম, খামের কোনে ছোট্ট ছবি, সাভার স্মৃতিসৌধের- নানা বলেছে। নানা চটপট করে লেখা কাগজটা খামে পুরে দেয়- সবচেয়ে জরুরী কাজটা বাকি- “আঠা লাগাবে এসো!” “আঠা কোথায়?!”- বর্ণ জিজ্ঞেস করে। “ভাতের প্লেটটা দাও তো এদিকে!”- ও ওটাকে দেয় নানার হাতে। এইবার নানা খামের বাড়তি কাগজে কটা ভাত রাখে, আঙ্গুলের চাপে মিশিয়ে দেয় কাগজের সাথে, আর কাগজটা ভাঁজ করে বন্ধ করে দেয় খামের খোলা মুখ- “নাও! এসো! তুমি শেষ কর!” বর্ণ খুশি হয় কাজ পেয়ে- আঙ্গুল চালায়, সমান করে দেয় খামের মুখটা- কী সুন্দর! ভাত যে আঠা তা কে জানত! “আমরা কি তাহলে আঠা খাই?”- বর্ণ’র প্রশ্ন জাগে মনে- করে না আর- নানা আবার কলম হাতে লিখছে খামটায়।
“আর কি লেখেন?”
“নাম লিখি!”
“নাম লেখেন কেন?”
“নাম লিখলেই না যাবে চিঠি!”
“নাম না লিখলে কি হয়?”
“নাম না লিখলে?! খুঁজে পাবে কী করে?”
“নাম লিখলেই খুঁজে পাবে?”
“খুঁজে পাবে!”
“কে পাবে?”
“ঐ যে মামা আসে প্রতিদিন, চিঠি নিয়ে- দেখ না?”
“চিঠি মামা চিঠি আনে, না?”
“হ্যাঁ আনে তো?”
“এত চিঠি কোথায় পায়?”
“সবাই লেখে, তাই পায়!”
“সবাই লেখে! কেমন করে লেখে?”
“এই যে! আমি যেমন করে লিখলাম!”
“এরপর?”
“এরপর? চিঠি দিয়ে যায়, যার চিঠি তাকে!”
“কার চিঠি কেমন করে জানে?”
“ঐ যে নাম থাকে যে!”
“নাম হলেই হয়?”
“হয়!”
“নাম হলেই আসে চিঠি?”
“নাম হলেই আসে!”
“তাহলে আমার চিঠি কই?”
“তোমার চিঠি? তাইতো-“
“আপনার চিঠি আসে- আমার চিঠি কই?”
“তাই তো! তোমার চিঠি- তোমার চিঠি- হ্যাঁ, আসবে-“
“আসবে?”
“হ্যাঁ, আসবে!”
“কবে আসবে?”
“কালকেই আসবে!”
“তাই!”
“হ্যাঁ!”
বর্ণ’র খুব খুশি লাগে, কালকেই আসবে ওর চিঠি, কী মজা! বড় বুঝি ও হয়েই গেল এইবার! নানার নামে চিঠি আসে, ওর নামেও আসবে! ও দাঁড়িয়ে থাকে নানার পাশটায়, নানা ঝটপট আর একটা খাম বের করেন, ঝটপট লেখেন খামে, খামটা বন্ধও করেন আঠায়- “চল! আজকে চিঠি পাঠাবো, তুমিও চল!”
বর্ণ নানার সাথে যায়, রিকশায় করে। রিকশায় ও চড়তে পারে না এখনো, কোলে করে পাদানীতে তুলে দিলে ও ওঠে বসতে পারে ঠিকঠাক। তবে ও সিটে বসতেই পছন্দ করে, ও বড় হয়ে যাচ্ছে প্রায়- বড় হলে কোলে বসতে নেই!
রিকশা চড়তে বর্ণ’র ভাল লাগে খুব। চারদিকটা আস্তে আস্তে চলতে থাকে। বাসার পাশের মাঠটা। হাতের কাছে পুকুরটা। কালো পর্দা দেয়া চকলেটের দোকানটা। সকালবেলায় হালুয়া-লুচি আর লবঙ্গের দোকানটা। নানার কলেজটা। আর বিদঘুটে লালা রঙের হাসপাতালটা- হাসপাতাল বর্ণ’র ভাল লাগে না, সে একবার যখন ও খুব ব্যথা পেল সিঁড়ি থেকে পড়ে- সবাই ওকে হাসপাতালে আনলো ভাল করে দেবে বলে- নানা বলল ভাল হয়ে যাবে, নানু বললো ভাল হয়ে যাবে, আম্মু বললো ভালো হয়ে যাবে, খালামনি বললো ভালো হয়ে যাবে সাদা কোট পড়া ডাক্তার মামাটা বললো ভালো হয়ে যাবে- এরপর ডাক্তার মামাটা আরো ব্যথা দিলো, এই জন্য হাসপাতাল ওর ভাল লাগে না।
হাসপাতাল পেরিয়ে বড় পুকুরটার পাশে আখের রস আছে, দারুণ মজা। আর একটু পরে বাদাম ভাজা! এর পরই লাল দালানটা, রিকশা গিয়ে ওর পাশেই থামল- “এসে গেছি নানা! এর নাম পোস্ট অফিস! চিঠি এখানেই দিতে হয়!” “সব চিঠি?”-বর্ণ জিজ্ঞেস করে। “সব চিঠি!”- নানা বলে।
কোলে করে নানা ওকে নামিয়ে দেয় নীচে- গেটের পাশটায় দাঁড়ায়- লাল একটা লম্বা কৌটা, মাথাটা গোল- “এখানেই চিঠি দিয়ে যেতে হয়!” নানা বলে- “এসো এসো তোমার চিঠিও দাও!” ও পাশে এসে হাত বাড়ায়- আরো উপরে- নানা হেসে ওকে উঁচু করে ধরেন- এবারে বর্ণ’র চোখে পড়ে চৌকোনা গর্ত-
“ওখানেই ফেলে দাও!”
“ফেলে দেব!”
“তাহলেই তো আসবে চিঠি!”
“না ফেলি যদি!”
“তাহলে তোমার কাছেই থাকবে!”
“যদি ফেলি?”
“তাহলে চিঠি আসবে তোমার!”
“আমার চিঠি!”
“তোমার চিঠি!”
“কবে আসবে?”
“কাল আসবে?”
“কেমন করে আসবে?”
“চিঠি মামা নিয়ে আসবে!”
“কেন আনবে?”
“তোমার চিঠি যে!”
“আমার চিঠি হলেই আসবে?”
“তোমার চিঠি হলেই আসবে!”
“সে চিঠি আমার?”
“হ্যাঁ! তোমার!”
“আমার কেন?”
“তোমাকেই লেখা যে!”
“আমাকে লেখা হলেই আসবে? আমার কাছে?”
“হ্যাঁ! আসবে!”
“চিঠি মামা নিয়ে আসবে? সাইকেলে করে?”
“নিয়ে আসবে, সাইকেলে করে!”
“কালকেই?”
“কালকেই!”
বর্ণ সাহস করে ফেলেই দেয় চিঠিটা। লাল বাক্সে।
ওর নাম লেখা চিঠিতে। নানা বলেছে।
কাল ও চিঠি পাবে। নানার মত করে। নানার চিঠি আসবে, ওর চিঠিও আসবে। ওর নিজের চিঠি। চিঠি মামা নিয়ে আসবে, সাইকেলে চেপে। ওর চিঠি আসবে, কালকেই।
লিখলেই চলে আসে চিঠি, ও জানে। পড়াটা অবশ্য শেখা হয়নি এখনো, তাতে কী? বড় হয়েই ও পড়ে নেবে, নিজে নিজেই- ক’দিনই বাকি আর!
মন্তব্য
কেন যে মানুষ বড় হতে চায়! বর্ণ বাবুটার মত আমরাও দ্রুত বড় হবার জন্য কেমন মরিয়া ছিলাম।
এখন বুড়ি হয়ে ছেলেবেলাকে কেমন মিস করি!
কোথাও না কোথাও ছোট্ট 'আমি'টা ঠিকই বেঁচে থাকে!
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
হাহাহা........পিচ্চিতোষ গল্প ভালো হইছে। আমারো লিখতে মন চায় একখানা
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
লিখে ফেলেন, পড়ি
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
facebook
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
ভাল লাগল। মনে পড়ে গেল চিঠির জন্য প্রতীক্ষার সেই দিনগুলো। এখনকার ছেলে-মেয়েরা আর জানবেই না যে অযুতকাল অপেক্ষারপর পাওয়া সেই চিঠিগুলোর গন্ধ কেমন ছিল। কেমন ছিল সেই অসহনীয় আনন্দ মুহূর্তগুলো।
যদি ভাব কিনছ আমায় ভুল ভেবেছ...
চিঠি তো চিঠি, 'ইনফরমাল মেইল' পাওয়ার ভাগ্যই আর ক'জনে ধরে!
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
নতুন মন্তব্য করুন