বিজয়ের পঞ্চাশ পূর্তিতে কন্যাকে পিতা

মর্ম এর ছবি
লিখেছেন মর্ম [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ২৪/১২/২০২১ - ১১:৩৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

লিয়ানা

বাংলাদেশের-বিজয়ের-৫০-বছর-পূর্তিতে-জীবনের-পয়লা-বছর দেখনিয়াসু,

আসসালামু আলাইকুম,

কত কত দিন ধরে তোমাকে লিখি না। সেই যেদিন শতকে পা পড়ল তখন লিখেছিলাম, তারপর এই এখন! মন খারাপ কর না, কেমন?
মাঝে মাঝে এমন হয়। লেখা-কথা'র চেয়ে কথা-কথাই বেশি। লেখা-কথাও ফিরে ফিরে আসবে মাঝে মাঝে, আজকের মত করে।

আজকের দিনটা কেন বিশেষ জান?

আজকে বাইরে যেতে পারতে যদি দেখতে চারদিকে কত আনন্দ! কত আলো আর আলো। রঙ বেরঙের আলো। তোমার তো পছন্দ। কিন্তু উপায় করা গেল না। তোমার ঠান্ডা লেগে গেছে, তোমার বাবা মায়ের একই হাল- কাজেই টিভিতে দেখা আর একটু আধটু জানালা দিয়ে উঁকি ঝুঁকি! ব্যস!

কিন্তু আসলেই কি আজকের দিনটা এটুকুতেই সারার? মোটেই না।

আমাদের দেশটার বিজয়ের আজ ৫০ বছর পূরণ হলো।

এহ, এখন আর 'আজ' বলা যাবে না। আগের লাইনটা লেখার সময় 'আজ' ছিল, ঘড়িতে রাত বারোটা পার হয়ে গেছে তো- এখন হয়ে গেছে 'গতকাল'! 'আজ' নিয়ে লেখার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু এখন 'গতকাল' নিয়েই লিখতে হবে। কী আর করা!

আমাদের দেশটার বিজয়ের ৫০ বছর হয়ে গেল 'গতকাল'। ১৯৭১ সালের মার্চে আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম পাকিস্তানের অধীনতা অগ্রাহ্য করে। ওরা মানতে চায়নি, আমাদের দেশ আমাদের বুঝিয়ে দিতে চায়নি। ওরা আমাদের দেশ ছেড়ে যেতে চায়নি। বরং আমাদের উপর একটা যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে।

এ যুদ্ধ নিয়ে কত শত বই লেখা হয়েছে। তোমার দাদা দাদী নানা নানী এবং তোমার পরিচিত আরো অনেকেই এ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে গেছেন। আমার অনেক আশা যে সেই সব ইতিহাস তুমি পড়বে, জানবে- উনাদের মুখে শুনবে। তুমি তখন আমাকে আবার সেই ইতিহাস জানিও, কেমন?

এতো ছোট তুমি এখনো, যুদ্ধ নিয়ে আলাপ না করাই ভাল। ওখানে মানুষের ভাল দিক যেমন বের হয় তেমনি বের হয় খারাপ দিক। তোমাকে যেন খারাপ দেখতে না হয় অমন করে, ভালো যেন দেখতে পার জানতে পার শিখতে পার, তারই ইচ্ছা নিশ্চয়ই ছিল আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের- যাঁরা সে যুদ্ধ করেছেন- দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। সে ভালটাই যেন তোমাকে, তোমাদের ঘিরে রাখে সুবর্ণ জয়ন্তীর বাংলাদেশ।

২৬ শে মার্চের স্বাধীনতা থেকে প্রায় নয় মাসের যাত্রা শেষে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বিকাল ৪ টা ৩১ মিনিট যখন বাজে- তখন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান নিয়াজী শেষ পর্যন্ত পরাজয় মেনে নেন তার ৯১ হাজার সৈন্য নিয়ে- বাংলাদেশের আপাতঃ 'অপেশাদার' মুক্তিবাহিনী আর শেষদিকে যুক্ত হওয়া ভারতীয় সেনাবাহিনী নিয়ে গঠিত 'মিত্রবাহিনী'র কাছে- এ এমনই লজ্জা ছিল নিয়াজীর যে স্বীকারই করতে চাননি তার এত বড় সেনাবাহিনী সেদিন ছিল, আজকেই পড়লাম 'প্রথম আলো'-তে কোন এক বই থেকে তার উদ্ধৃতি।

এই বিকাল ৪ঃ৩১ থেকে আমাদের নতুন বাংলাদেশের শুরু, মা। এক মুক্ত, স্বাধীন, শত্রুমুক্ত বাংলাদেশ। আমার পক্ষেও তোমাকে হয়ত সে আনন্দ বোঝানো মুশকিল হবে- আমি তো জানিই না সে আনন্দ কীরকম, আমি তো স্বাধীন বাংলাদেশেরই মানুষ, তোমার মতই।

তবে এটা নিশ্চিত আমি যে বাংলাদেশ দেখেছি বা দেখছি তার চাইতে অনেক সুন্দর হবে আগামীদিনের বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশ তুমি বা তোমরা পাবে।

আমরা বদলে যাচ্ছি। খুবই দ্রুত। এখন থেকে মাত্র ১২ বছর আগেও কল্পনা করিনি বাংলা হরফে একটা লেখা লিখে ফেলব নিজের একটা ফোনে, সেটা আবার মুহুর্তেই পৌঁছে যাওয়ার সামর্থ রাখবে সবার কাছে।

কে জানে, তোমাদের সময়ে তোমাদের হয়ত ফোনই লাগবে না, দেখা যাবে যা ভাবছ যেটাই পৌঁছে যাবে অন্যদের কাছে!

একটা ব্যাপার মাথায় এলো হঠাৎ। বাংলাদেশের যাত্রার সাথে তোমার যাত্রাপথ বেশ মিলে যায় দেখা যাচ্ছে! বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি হলো ২৬শে মার্চ, তুমি এলে ৩০শে মার্চ! এখন বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তি, আর তুমি ঠিক ঠিক নয় মাসের দিকে ছুটছ- বাংলাদেশের বাংলাদেশ বুঝে পাওয়ার যাত্রার মত। সুন্দর না ব্যাপারটা?

একটু কঠিন লাগবে আসলে। তোমার তো এখনো ঘর নিয়ে বাস, তার পরে আরো আরো ঘর, বাসা, গলি, পাড়া, ইউনিয়ন, থানা, জেলা, বিভাগ। তার পরে না দেশ। আস্তে আস্তে করে শিখবে, জানবে, বুঝবে। সবই হবে সময়ে।

কঠিন কঠিন কথার চিঠি শেষ করব এখানেই, দিনটা তো আর আসবে না তাই লিখে রাখা। তুমি যখন এ লেখা-কথা পড়ার আর বোঝার মত বড় হবে, তখন থাকি যদি আরো বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করব, কেমন?

লেখা-কথার সুবিধা দেখলে তো? এই যে গেল সোয়া চারদিন ধরে গলায় ব্যাঙ ঢুকে বসে আছে, শব্দটি বের হয় না- কিন্তু এইখানে এতোগুলা কথা লিখে ফেলতে একটুও কষ্ট হল না। কিন্তু বলতে হত যদি- তাহলে দেখতে কেবল ঠোঁট নড়ছে- অবাক হয়ে চোখ গোল করে তাকিয়েই থাকতে- যেমন গেল দুই / তিনদিনে করেছ- গলা কিন্তু শুনতে হত সেই রেকর্ড করা শব্দ থেকেই!

আম্মু যে তোমাকে রেকর্ড করা গান শুনিয়ে ঘুম পাড়াচ্ছে এ গোপন তথ্যটা তোমাকে দিয়ে রাখলাম, পরে আবার আমাকে বল না কিন্তু যে তোমায় আমি জানাইনি।

টুপটাপ বড় হয়ে যাচ্ছ তুমি! দুই হাতের ভেতরে হারিয়ে থাকা তুমিটা এখন সুযোগ পেলেই কেবল মেঝেতে নেমে যাওয়ার চেষ্টা কর- জুতো, কাগজ, ইলেকট্রিক তার- এগুলোর দিকে তোমার দৃপ্ত 'হাঁটুচারনা'- এইগুলি নিয়ে লিখব পরে।

আজকে তোমার সাথে বড়দের আলাপের দিন। বড় হয়ে ওঠো, মা। মনে বড় হতে পার, অন্যদের বড় হয়ে উঠতে সাহায্যের হাত বাড়াতে পার- এই দোয়া করি।

ভাল থেকো অনেক, ভাল রেখো।

তোমার আব-বা, বা-বা, পা-পা, আম-মা (যা বল তা-ই, মেনে না নিয়ে উপায় কোথায়- আপত্তি তো কিছু কানে নাও না!)!!

(বাংলাদেশের বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তিতে এখনো বছরের হিসাবে পৌঁছানোর অপেক্ষায় থাকা কন্যাকে লেখা ১৬ ডিসেম্বরের রাতের শেষ প্রহরে। মনে হল থাকতে পারে এখানেও।)


মন্তব্য

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ওয়েলকাম ব্যাক মিঁয়াও!

লেখার স্টাইল ভালো লেগেছে। লিয়ানার জন্য শুভ কামনা।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

মর্ম এর ছবি

ফেসবুকেই লিখি কন্যাকে, এইটা বোধ হয় দশ নম্বর চিঠি হবে। হঠাৎ মনে হল দেই এখানে। প্রকাশিত হয় যদি সব সম্পাদনা পেরিয়ে, থাকল পছন্দের জায়গায়।

প্রথম কমেন্টের জন্য ধন্যবাদ, দুইদিন পরে একটা মতামত এলো, এও নতুন অভিজ্ঞতা।

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।