বাংলাদেশের ক্রিকেটে চলছে একটা ধূসর সময়। জুয়ারীদের কাছে আমাদের মত ক্রিকেট প্রেমীদের আবেগ আর অনুরাগ কি আসলেও বিক্রি করেছে আমাদের ক্রিকেটার রা? ক্রিকেটাদেরের কথা জানিনা। কিন্তু এত টুকু জানি যে ক্রিকেটের প্রতি আমাদের দর্শকদের ভালবাসা নিখাদ। নিচের লেখাটা লিখেছিলাম যখন বাংলাদেশ ৫৮ রানে ধরাশায়ী হল ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে তারপর। আজকে আবার পড়লাম লেখাটা। শেষ প্যারাগ্রাফ টা পরে আজকেও চোখে পানি এসে গেল..."বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রতিটি স্তর উত্তরণের সাক্ষী আমি যদিও ক্রিকেট মাঠের ১০০ গজের মধ্যেও যাওয়া হয়নি কখনো, হয়তো যাওয়া হবেও না কখনো, কপালে কখনো বাঁধা হবে না লাল সবুজ পতাকা, গালে আঁকা হবে না লাল সবুজের আল্পনা। চিৎকার করে গাওয়া হবে না বিজয়ের গান। তবু আমি পরিতৃপ্ত। আমার হৃদয়ের গভীরে লেখা হয়েছে অসীম গর্বের এক কাব্য গাঁথা, যার শিরোনাম " আমি বাংলাদেশকে জিততে শিখতে দেখেছি"। (মনে প্রানে চাইছি যেন আমাদের ক্রিকেটাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ গুলো মিথ্যা হয়)
----------------------------------
আমি সেই এক বাংলাদেশী যে বাংলাদেশ ক্রিকেটের চলার পথের অশরীরি ছায়া। উত্তরণের সকল ইতিহাসের এক নিশ্চুপ সাক্ষী। বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রতি আমার আগ্রহের সূচনা সেই যুগে যখন বাংলাদেশে "ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট" মানে ছিল ভারত আর পাকিস্তানের নামকরা ক্রিকেটারদেরকে একসাথে মাঠে নামিয়ে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা আর ধনী সম্প্রদায়ের দিনভর পিকনিক পালন ....আর ... আমার মত অশরীরি ক্রিকেট ভক্তর জন্যে ছিল বাংলাদেশ বেতারে ভেসে আসা খোদাবক্স মৃধার ধারাভাষ্য।
এরইমধ্যে ঘরোয়া লীগ দাঁড়াতে শুরু করলো। বেতার হয়ে থাকলো আমার আর ক্রিকেটের মধ্যকার যোগসূত্র। আন্তর্জাতিক ভাবে বাংলাদেশের অংশগ্রহন বলতে ছিল বছরে একবার কি বড়জোর দুবার কোনো ত্রিদেশীয় কাপে খেলা এবং বিরাট দীর্ঘশ্বাসের সাথে "জয় পরাজয় নয়,অংশগ্রহনই বড় কথা" বলে আমার মত সমর্থকদের বেতারে কান পাতা। ব্যাটসম্যানের হাঁকান বলের গতি পথ আর অবস্থান বোঝার জন্যে সামনে খোলা থাকত Encyclopedia ব্রিটানিকার ক্রিকেট সেকশন। ব্যাটসম্যানদের ক্রিকেট শট মুখস্ত করেছিলাম বর্ণনা অনুযায়ী কল্পনায় জহির আব্বাস কিম্বা লালা অমরনাথদের ব্যাট চালনা উপভোগ করতে। খারাপ কাটত না পাটিগণিত আর বেতারিও ক্রিকেটের সহাবস্থান। পত্রিকায় খেলার পাতা তখনও শুষ্ক ক্রিকেট ধারাবিবরণীতেই আবদ্ধ যেখানে খেলোয়ারদের স্থির চিত্র ছিল মরুভূমির মধ্যে জলের পরশ। একটু একটু করে এগুচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। জিম্বাবুয়ের সাথে ICC টুর্নামেন্টের শিরোপা নিয়ে আমার মত দৃশ্যপটে না থাকা সমর্থকদের সুপ্ত বাসনা অঙ্কুরিত হচ্ছে। সালটা মনে নেই ঠিক মত, বোধহয় নব্বই এর দশকের শুরুতে, যখন জিম্বাবুয়ে টেস্ট ক্রিকেট খেলুড়ে দেশ হয়ে গেল, তখন হাপ ছেড়ে বাঁচলাম এই ভেবে যে, যাক শিরোপাধারী যখন নাই তখন আমাদের খেলোয়ারদের ICC শিরোপা জয় তো জলবত তরলং। কিন্তু না... আদতে তা ঘটল না। আমরা ছিয়ানব্বই এর ওয়ার্ল্ড কাপে খেলতে ব্যর্থ হলাম। আমাদের পত্রিকা ওয়ালারা ততদিনে ক্রিকেটকে অনেকটা কাব্যিক আঙ্গিক দিয়ে ফেলেছেন এবং নিজেদের মনের মাধুরী মিশিয়ে ক্রিকেটারদের সামর্থ্য বিচারের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সমর্থ হয়ে চলেছেন। ক্রিকেটারদের ওপর চাপ বাড়ছে। প্রাক্তন ক্রিকেটারদের কয়েকজন ধারাভাষ্যকার হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন এবং ধারাভাষ্যে তারা তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে দলকে সাধ্যমত সাহায্য করে চলেছেন করণীয়, অকরণীয়, অনুকরণীয়, পরিত্যাজ্য, শিক্ষনীয় ইত্যাদি সংক্রান্ত নানাবিধ উপদেশাবলীর সমন্বয়ে। এরমধ্যে আমার ভূমিকা এবং প্রতিক্রিয়া যথারীতি খুবই অপ্রতিক্রিয়াশীল। আমি যতটা পারা যায় অপ্রকাশিত থেকে বেতারে ধারাভাষ্যের জন্যে কান পেতে যাচ্ছি। বন্ধুবান্ধব এমনকি পরিবারের লোকজন থেকেও এড়িয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জয়ের জন্যে মৌন প্রার্থনা চালিয়ে যাচ্ছি। বাংলাদেশে ক্রিকেটের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ছে। মাঠে এবং মাঠের বাইরে দর্শক বাড়ছে। অনেক দর্শকই ততদিনে জেনে গেছেন ক্রস ব্যাট চালানো আর ক্রিকেটীয় আত্মহত্যা সমার্থক, এক ওভারে ছয়টি করে বল করেন বোলার, তুলে মারতে গিয়ে ক্যাচ হলে সেটা সমালোচনার খাতায় পাঠানো হয় অ্যাম্বিশাস শট বলে কিন্তু বাউন্ডারীতে পাঠালে পারলে সেটা নিয়ন্ত্রিত মারের কদর পেতে পারে। ফুটবলকে প্রায় কোণঠাসা করে দিয়ে ক্রিকেট হয়ে গেছে খেলার পাতার প্রধান খেলা।
সাতানব্বই-এর ICC চ্যাম্পিয়নশিপের দল গঠন নিয়ে পত্রিকায় ব্যাপক লেখালিখি হলো। ফিকে হয়ে গেছে স্মৃতি, তবুও আবছাভাবে মনে পড়ছে অধিনায়কত্ব নিয়ে পত্রিকার গবেষণাপূর্ণ পরিবেশনা। আকরাম, ফারুক, নান্নু , বুলবুল বিষয়ক চতুর্মুখী আলোচনার ঝড়। আমার বেতারে কান পাতা আর টেলিভিশনে চোখ রাখা বন্ধ হয়নি। যাইহোক, সমস্ত সমালোচনার ঝড়কে পিছনে ফেলে আমাদের দেশের এক ঝাঁক টগবগে প্রত্যয়ী তরুণ/যুবক ৯৯ এর বিশ্বকাপে আমাদের দেশকে পৌঁছে দিলেন। আকরাম নামটি সেই এক শুক্রবার, "জুমমেকা দিনে", বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে মহীরুহের স্থান করে নিল নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে করা এক অবিস্মরনীয় অর্ধশতকের মধ্য দিয়ে। এরপর এলো সেই সেমিফাইনালের দিন। ভুলবার নয় সেই স্মৃতি। ক্লাস টেস্টের মধ্যে প্রায় আলাপহীন ক্লাসমেট এক ছেলের পেছন থেকে পেন্সিলের খোঁচায় বোঝানো আয়ারল্যান্ডের উইকেট পতনের সংবাদ, নিজের এবং অন্য ডিপার্টমেন্টের পরিচিত অপরিচিত সবার ছোড়া নানান রঙের মিশেলে মা কালির চেহারা ধারণ করা, মাথার উপর বালতি বালতি কাদা ঢেলে অতঃপর কেশরাজি থেকে কেঁচো খুঁজে বের করা আর শেষমেষ চিরচেনা অতি প্রিয় কন্যাকে দেখে আমার বাবার আমাকে চিনতে না পারা... সব কিছুই এখনো স্মৃতিতে মধ্যান্যের সূর্যের মতো জ্বলজ্বলে। ফাইনালে শান্তর করা এক বলে এক রান তো জাতীয় স্লোগানেই পরিনত হলো। ফুলেল এবং কড়কড়ে নোটের শুভেচ্ছায় সিক্ত হলো আকরাম বাহিনী। মনে আছে, ক্রিকেট ময়দানে বিসর্জিত পাইলটের সম্মুখ দন্তসমূহ প্রায় শহীদের সমমর্যাদায় আসন করে নিল সকলের হৃদয়ে। কোচ থেকে শুরু করে সবাই পরিনত হলো জাতীয় বীরে। নিরানব্বই-এর বিশ্বকাপে পাকিস্তান বধ করে বাংলাদেশ পেয়ে গেল ক্রিকেটের সেই সোনার হরিন -- টেস্ট স্ট্যাটাস। বিগিনার্স লাক এর জোরে কিনা জানিনা, প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে আমরা ভারতের বিপক্ষে ৪০০ রানের এক চমক দেখে ফেললাম এবং সেই থেকে শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়ের। বাংলাদেশের ক্রিকেটের গায়ে চড়লো বানিজ্যিক আভরণ, ক্রিকেটারদের নিয়ে শুরু হলো অতি কথন, অতি বিশ্লেষণ এবং প্রকারান্তরে তারা বনে গেলেন ক্রিকেটীয় সাহিত্যের কুশীলব। যেন পত্রিকার ক্রিকেট-সাহিত্যিকগণের কাছে ক্রিকেটিক সম্মান এক তৈলাক্ত বাঁশ আর খেলোয়াররা যেন মানুষের কাছাকাছি গোত্রের পাটিগণিতের সেই প্রাণীকুলের প্রতিনিধি যারা কিনা লেখকের কলমের খোঁচায় বাঁশ বেয়ে উঠছেন আর নামছেন, নামছেন আর উঠছেন।
আমার অবস্থান এবং পরিপ্রেক্ষিতের কোনো পরিবর্তন নাই। টিভিতে খেলা দেখি আর হিট ট্রান্সফার বা মাস ব্যালান্সের অঙ্ক করি। বড়জোর BUET ক্যাম্পাসের মাঠে গিয়ে অনুশীলনরত ক্রিকেট হিরোদের এক ঝলক চোখের দেখা দেখে আসি। ততদিনে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ব্যাট বল দুটো থেকেই ভাগ্য দেবী পালিয়েছেন। দিনে দিনে প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে টেস্ট স্ট্যাটাস হারানোর আশংকা। বাংলাদেশকে টেস্ট স্ট্যাটাস প্রদান যে ICC-এর একটি সময়োপযোগী, যৌক্তিক এবং ক্রিকেটের জন্যে মঙ্গলময় সিদ্ধান্ত ছিল এটা প্রমানের জন্যে শুধু উইকেটে খুঁটি গেড়ে টিকে থাকার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন আমাদের প্রিয় ক্রিকেটারগণ। ওয়ানডেতে বছরে দুই বছরে একটা দু’টা আপসেট জয় যে আসছে না তা নয় কিন্তু তা বাংলাদেশের দোদুল্যমান ক্রিকেট আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্থায়ী করবার জন্যে নিতান্তই অপ্রতুল। তবে আশার কথা যে ততদিনে বাংলাদেশ নিয়মিতভাবে "সম্মানজনক" হারের জন্যে সাফল্য সহকারে লড়াই করতে শিখে গেছে। আমি খুশি, খুব খুশি।
এরপর আমার জীবনের কিছু পট পরিবর্তনের কারণে ক্রিকেটের সাথে সাময়িক বিচ্ছেদ। বছর তিনেক পরে অন্তর্জালের কল্যানে আবার বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাথে সম্পর্ক পুনর্স্থাপিত হলো এই প্রবাস জীবনে। লাইভ খেলা কিনে দেখার সামর্থ্য নাই, তাই ইলেক্ট্রনিক পত্রিকার অর্থাৎ কিনা ই-পত্রিকার খেলার পাতায় ক্রিকেট সাহিত্যিকগণের লেখনীই ভরসা। নতুন করে পরিচিত হই বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের সাথে। বেশ কিছু নতুন নামের সাথে পরিচয় ঘটে। তখন বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক হাবিবুল বাশার সুমন। ক্রিকেটার বাশার এর রেকর্ড বেশ ভালো কিন্তু অধিনায়ক বাশার এর অবস্থা বেশ টলমলে .. ....অতীব দুঃখের সাথে উপলব্ধি করলাম বাংলাদেশের ক্রিকেট সেই "সম্মানজনক হার" এর স্তরেই আটকে আছে !! ওদিকে পত্রিকার পাতায় ক্রিকেট সাহিত্যিকগণ আরও অনেক বেশি সপ্রতিভ, আরও অনেক বেশি নির্ভীক, আরও বেশি দুর্বিনীত। বাংলাদেশের ক্রিকেট যেন পত্রিকার কাছেই দায়বদ্ধতার জালে আবদ্ধ। ওয়ানডেতে দুই একটা আপসেট-জয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে বাংলাদেশ দল। অনেকটা নিয়মিত আবার আমি বাংলাদেশের ক্রিকেটের সঙ্গে। এর মধ্যে আমার ক্রিকেট প্রেমিক স্বামী এক বৈপ্লবিক আবিষ্কার করে ফেলল। ফ্রী ক্রিকেট streaming লিঙ্ক পেয়ে গেল। মহা সুখবর। যদিও আনন্দে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটালো বাংলাদেশের সাথে আমেরিকার সময় পার্থক্য আর বাফারিং নামক বিরক্তিকর অন্তর্জাল স্তব্ধতা। রাত্রিকালীন নিদ্রা হার মানলো ক্রিকেটের প্রতি আজন্ম ভালোসার কাছে। বাড়তে লাগলো নিদ্রাবিহীন রজনীর সংখ্যা আর সেই সাথে বেড়ে চললো বাংলাদেশের সম্মানজনক পরাজয়ের মহাকাব্যের দৈর্ঘ্য।
অসম্মানজনক পরাজয়ের আশংকায় মলিন চেহারায় নিদ্রাহীন রাত্রি পার এবং নিস্তেজ ঘুমার্ত শরীরে এক্সট্রা লার্জ কফির মগ হাতে ক্লাসে বসে হাই তোলা, এই চলল বেশ কিছুদিন। তারপর এলো সেই মহেন্দ্রক্ষণ। ২০০৫ এর জানুয়ারী। বাংলাদেশ দল দেশের মাটিতে জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে প্রথম টেস্ট ম্যাচ জিতলো। সময়টা ছিল শীতকালীন ছুটি। বাংলাদেশের এই মহাঅর্জনের বল-বাই-বল সাক্ষী হয়ে রইলাম আবার। পট পট করে পটকা ফোটা আর পত পত করে পতাকা ওড়া মিলেমিশে ধারাভাষ্যকারের কন্ঠে উচ্চারিত সেই স্মরনীয় বাক্য "পট পট পতাকা উড়ছে" পরিনত হলো আরেক জাতীয় স্লোগানে। পরের ম্যাচে ড্র করে বাংলাদেশ খুললো প্রথম টেস্ট জয়ের খাতা। যুগল অর্জনে খুশি আমরা, মহা খুশি। বাংলাদেশ যে বন্যার দেশ, যখন আসে তখন দু’কূল ছাপিয়ে আসে, এটা প্রমান করতেই যেন ২-১ ম্যাচে পিছিয়ে থেকেও আমরা জিতে গেলাম জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে ওয়ানডে সিরিজও। ১২০০০ মাইল দূরে ছোট্ট এক শহরের স্টুডেন্ট ডর্মে দুই শিক্ষার্থী আমরা বাংলাদেশের পতাকাযুক্ত কেক কেটে আবেগময় আনন্দাশ্রু সমেত নিভৃতে উদযাপন করলাম দীর্ঘ লালিত স্বপ্ন, বাংলাদেশের এই ত্রয়ী অর্জন।
এরপর ঘটলো ২০০৫ কার্ডিফ কান্ড, যেখানে অস্ট্রেলিয়া বধ কাব্য রচিত হলো আশরাফুলের ব্যাটে ভর করে।
আবার শুরু হলো অপেক্ষার পালা। শুধু অপেক্ষা নয়, জয়ের আশায় রীতিমত চাতকীয় অপেক্ষা ক্রিকেটের "অভিজাত" দলগুলোর বিরুদ্ধে সাফল্যের। তবু দীর্ঘদিনের অভ্যাসে আশায় বুক বেঁধে দেশের মায়ায় অন্তর্জাল মারফত বাংলাদেশের ক্রিকেটের সাথে থাকি তার শৈশব থেকে কৈশোরে পদার্পণ দেখব বলে। কিন্তু সেই পথ যেন আদিগন্ত দীর্ঘ। আমি শিশু থেকে কিশোরী, কিশোরী থেকে জায়া, জায়া থেকে জননী, সব স্তর পেরিয়ে মধ্য জীবনের শুরুতে দাঁড়িয়ে রীতিমত আতঙ্কিত এই ভেবে যে নাহ, বাংলাদেশের ক্রিকেটের সাবালকত্ব দর্শন বুঝি অদর্শনীয় রয়ে যাবে এই জীবনে।
হঠাৎ করেই যেন নড়ে চড়ে বসলো সারা বাংলাদেশ, সাথে আমিও। একটু একটু করে হৃদকম্পন বাড়িয়ে নতুন কিছু ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্র শাবক যেন শিকারের আকাঙ্ক্ষায় নিরাপদ বলয় ছেড়ে বেরিয়ে আসার জন্যে প্রস্তুতিরত। নতুন মুখের সমন্বয়ে গড়া প্রত্যয়ী এক বাংলাদেশ দল। বল হাতে নড়াইল এক্সপ্রেস ধেয়ে এলো "ধরে দিবানি" বলে আর তাতেই ভঙ্গ ভারতের ২০০৭ বিশ্বকাপ স্বপ্ন। কি আনন্দ, আহ কি আনন্দ। আমার পাঁচ মাসের শিশু পুত্রটিও ল্যাপটপের কিবোর্ড চাপড়ে সামিল আমাদের করতালিতে। যদিও ২০০৭ এ আমাদের জয়রথকে বেশিদূর এগিয়ে নিতে পারেনি ওই ব্যাঘ্র শাবকের দল, তবে তারা যেন পেয়ে গিয়েছিল রক্তের স্বাদ।
বাংলাদেশের জয়যাত্রা হলো শুরু। সাকিব আল হাসান নামের সদ্য কৈশোর পেরুনো সব্যসাচী এক অধিনায়কের আবির্ভাব তার ঘূর্ণি বল আর চতুর্মুখী ব্যাট নিয়ে। এগিয়ে চললো বাংলাদেশ। এগিয়ে চলল সাকিব বাহিনী। ঘরে বাইরে বাংলা ধোলাই এর স্বাদও পাওয়ানো হলো কয়েকটা প্রতিপক্ষকে। হলো আরও অনেক কিছুই। রচিত হলো সেই ঐতিহাসিক ধবল ধোলাই অধ্যায় নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। আমি আনন্দিত, আমি আপ্লুত। বুঝতে পারছি, বাংলাদেশ ক্রিকেট সাফল্যের পথে এগিয়ে এসেছে অনেকটা পথ। আবেগী মন বলছে বাহ !! এই তো !! এই তো বেশ খেলছে বাংলাদেশ। নিয়মিতভাবে সম্মানজনক হার আর নিয়মিত বিরতিতে আপসেট জয়। আর কি চাই? কিন্তু মাথা বলছে অন্য কথা। বলছে কিসের যেন অভাব, কিসের যেন হাহাকার, কি যেন অনুপস্থিত বাংলাদেশের ক্রিকেটীয় সমীকরণে। একটা সূক্ষ অতৃপ্তি।
এলো ২০১১ বিশ্বকাপ। বাংলাদেশ এবার স্বাগতিকদের অংশ। বিরাট প্রাপ্তি এদেশের অতিথি বৎসল উৎসবমুখর ক্রিকেট প্রেমিক জনতার জন্যে। বাংলাদেশের প্রানঢালা আয়োজনে মুগ্ধ ক্রিকেট বিশ্ব। বাংলাদেশী ক্রিকেট প্রেমিকরাও নিজেদের উজার করে দিলেন ক্রিকেটারদের উৎসাহ যোগাতে। বিনিময়ে প্রত্যাশা ভালো ক্রিকেট, সম্মানজনক ক্রিকেট। কিন্তু ঘটে গেল এক অঘটন। মার্চের ১১ তারিখ, আরেক শুক্রবার, বাংলাদেশের ক্রিকেট দল ৫৮ রানের এক অনুকাব্য রচনা করে বসলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ এর বিরুদ্ধে। গোটা জাতি স্তম্ভিত। আবেগী সমর্থকেরা দিশেহারা ইট পাটকেল এবং পরবর্তীতে পুষ্প অর্পনে, প্রাক্তন খেলোয়ারেরা লজ্জিত তাদের গড়ে তোলা ইমেজ আর "সম্মানজনক পরাজয়ে"র তকমা পাওয়া বাংলাদেশকে "অতি অসম্মানজনক ভাবে" পরাজিত হতে দেখে। দেশ বরেণ্য ক্রিকেট সাহিত্যিক উৎপল শুভ্র সেই শুক্রবার দিনটিকে আখ্যা দিলেন "ব্ল্যাক ফ্রাইডে" হিসাবে। এ কালের তারুন্যের কন্ঠে বাংলাদেশের সেই লজ্জাজনক সমর পরাজয়ের প্রতীকি পরিচয় হলো "৫৮ কান্ড" নামে। এক ই-দেয়ালিকায় ছবিসহ ছাপা হলো "আঙ্গুল তত্ত্ব"/ সব কিছু ছাপিয়ে সুনামি হয়ে দেখা দিল ব্যাঘ্র কান্ডারী সাকিবের এক সাহসী উচ্চারণ "আমার কাছে এক রানে হারাও যা, ১০ বা ১০০ রানে হারাও তা"... সাকিব সুনামিতে লন্ডভন্ড আমাদের প্রাক্তন ক্রিকেটারগণ। কলমের খোঁচায় আর ল্যাপটপের কিবোর্ডে পাল্টা ঝড় তুললেন ক্রিকেট বোদ্ধারা। সাহিত্যিক আনিসুল হকের বদৌলতে এই অক্রিকেটীয় আচরণের ক্রিকেটীয় নামকরণ হলো "মিডিয়া স্লেজিং"।
আমি স্তম্ভিত। আমি বাকরুদ্ধ। একি !! কান্ডারী সাকিব যে আমার ক্রিকেট সমীকরণের মিসিং লিঙ্কটা বাতলে দিয়েছে !! আমার মস্তিষ্ক আজ পরিতৃপ্ত। আমার হৃদয় আজ নির্ভার। অনাবেগী এই নিভৃতচারী ক্রিকেট ভক্তের আজ নির্বাক নিস্পন্দ উল্লাস। বাংলাদেশ ক্রিকেট আজ পৌঁছে গেছে তারুন্যে। যে তরুণ জানে, পরাজয়ের নেই কোনো সম্মান বা অসম্মান। পরাজয় মানে আমাদের দলের অসম্মান। উল্টো বললে যেমন বলতে হয়, সব জয়ই সম্মানের, হোক তা ১, ১০ বা ১০০ রানের। আমার দেশ আর হারের ভয়ে খেলবে না। জেতার চেতনায় খেলবে, তারুন্যের উদ্দীপনায় খেলবে। আমাদের অতি সম্মানিত প্রাক্তন ক্রিকেটারগণ বাংলাদেশ ক্রিকেটকে তার শৈশবের অধ্যবসায় আর কৈশোরের নিয়মানুবর্তিতায় গড়েছেন অসীম যত্নে। এখন সময় আমাদের যুদ্ধে যাবার। এখন সময় সাকিবদের গর্জে উঠার। কি অদ্ভুত যোগাযোগ, সেই ’৯৭ এর এক শুক্রবার বাংলাদেশ ফেলেছিল তার শৈশবের প্রথম ধাপ আর ২০১১ এর আরেক শুক্রবার বাংলাদেশ হয়ে উঠলো প্রাপ্তবয়স্ক; হোক না একটার পরিচয় "জুম্মেকা দিন" আর অন্যটার "ব্ল্যাক ফ্রাইডে"।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রতিটি স্তর উত্তরণের সাক্ষী আমি যদিও ক্রিকেট মাঠের ১০০ গজের মধ্যেও যাওয়া হয়নি কখনো, হয়তো যাওয়া হবেও না কখনো, কপালে কখনো বাঁধা হবে না লাল সবুজ পতাকা, গালে আঁকা হবে না লাল সবুজের আল্পনা। চিৎকার করে গাওয়া হবে না বিজয়ের গান। তবু আমি পরিতৃপ্ত। আমার হৃদয়ের গভীরে লেখা হয়েছে অসীম গর্বের এক কাব্য গাঁথা, যার শিরোনাম " আমি বাংলাদেশকে জিততে শিখতে দেখেছি"।
মন্তব্য
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
ধন্যবাদ। আশা করি বাংলাদেশ সব সময় আলোকিত ক্রিকেট খেলুক।
আপনার লেখায় বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের একটা চিত্র উঠে এলো। সাধু।
আমিও আপনার সমসাময়িক কাল থেকেই ক্রিকেট দর্শক। বিশেষ করে বাংলাদেশের। উল্লেখিত সবগুলো ঘটনার সঙ্গেই নিজের গল্পগুলো খুঁজে পাই।
সাম্প্রতিক ঘটনায় খুবই আপসেট...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
ধন্যবাদ। "সবগুলো ঘটনার সঙ্গেই নিজের গল্পগুলো খুঁজে পাই" জেনে ভাল লাগল। আসলে আমাদের জাতিগত ভাবে একতা বদ্ধ ভাবে ভাল লাগার জায়গা খুব কম...ক্রিকেট তার একটি। তাই মনে প্রানে চাই ক্রিকেট এবং ক্রিকেটার রা সত্যের পথে থেকে জয় ছিনিয়ে আনুক বার বার।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত প্রামান্য ইতিহাস; পড়তে পড়তে চোখে পানি এসে গিয়েছিলো..............
ধন্যবাদ পড়ার জন্যে এবং সেই সাথে আপনার অনুভূতি শেয়ার করার জন্যে।
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
ধন্যবাদ।
এই ভাবে টু দি পয়েন্ট মিললো কিভাবে আমার সাথে? আপনি কি আমার ব্যাচ মেট নাকি?
বিদ্র: প্রথম প্যারাটা পড়ে মনে পড়ে গেলো ইডেন গার্ডেনে ভারতের সাথে খেলা রেডিওতে শুনছিলাম, আতাহার আলী চার মারলেই লাফ দিয়ে উঠে নাচা - তখন টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিপক্ষে চার মারতে পারাটাই ছিল আমাদের কৃতিত্ব!!
ব্যাচমেট হতেই পারেন। '৯৩ তে এস এস সি আমি (আমি কিন্তু বয়স ফাঁস করব না আগেই বলে রাখলাম ) ...মনে আছে সেই ম্যাচ টার কথা...আরও কত স্মৃতি !!!!
ব্যাচমেট হতেই পারেন। '৯৩ এস এস সি আমি (আমি কিন্তু বয়স ফাঁস করব না আগেই বলে রাখলাম ) ...মনে আছে সেই ম্যাচ টার কথা...আরও কত স্মৃতি !!!!
নস্টালজিক হয়ে পড়েছিলাম লেখাটি পড়ে। আরেকবার মনে হল, যে দিন পার করে আসলাম, সেটা আসলেই অনেক সুন্দর ছিল। আশা করি, সামনের সময়টা আরও অনেক সুন্দর হবে। -- মুগ্ধ অভিযাত্রিক
আমার ও একই আশা।
নতুন মন্তব্য করুন