দশ বছর আগের কথা।
সেদিন বাসায় তাড়াতাড়ি ফিরতে চেয়েছিলাম ইউনিভার্সিটি থেকে... দ্রুত কাজ গুছাচ্ছিলাম তাই। অন্যান্যদিন এক্সপেরিমেন্ট চালাই রাত আট টা দশটা পর্যন্ত কিন্তু সেদিন এক্সপেরিমেন্টের পাম্প বন্ধ করে দিলাম সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে। তাড়াতাড়ি করে লগবুকে সেইদিনকার উল্লেখযোগ্য খুঁটিনাটি তথ্যাদি টুকে রাখছি... উদ্দেশ্য রাত সাড়ে আটটার মধ্যে বাসায় ফেরা যেন কম্পিউটারের সামনে বসে হাই ভলিউমে সেইদিনের বিবিসি বাংলার অনুষ্ঠান "প্রভাতী" টা শুনতে পারি। তারিখ টা ছিল ইউএসএ তে ১৩ এপ্রিল আর বাংলাদেশে ১৪ এপ্রিল ২০০৪ অর্থাৎ ১৪১১ বাংলা সালের শুরুর দিন পহেলা বৈশাখ। না। বাংলাদেশের বিবিসি বাংলার নববর্ষের কোন অনুষ্ঠান শুনব বলে এত তড়িঘড়ি করছিলাম না সেদিন। তড়িঘড়ি করছিলাম কারণ সেদিন ছিল বিবিসি বাংলার চালানো "হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী" জরিপের সব চাইতে বেশী নাম আসা বাঙালীর নাম ঘোষণার দিন। ২৬ মার্চ ২০০৪ থেকে বিবিসি বাংলা প্রতিদিন যে একজন করে বাঙালী ব্যক্তিত্বের নাম ঘোষণা করে আসছে, আজ তার বিশতম এবং শেষ দিন। এরই মধ্যে উনিশ জনের নাম জেনে গেছি।
আগের দিন অর্থাৎ চৈত্রের শেষ তারিখে ঘোষিত হল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া ব্যক্তির নাম। সেদিন টিই ছিল টান টান উত্তেজনার কারন উল্লেখযোগ্য বাঙালীদের মধ্যে বাকী তখন দুজনঃ একজন নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী একমাত্র বাঙালী সাহিত্যিক বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর অন্যজন বাঙলার রাজনীতিবিদ শেখ মুজিবুর রহমান। এটা তাই অনেকটা ধরেই নেওয়া যাচ্ছিল যে একজন দ্বিতীয় অবস্থানে থাকলে অন্যজন হবেন হাজার বছরের সর্বসেরা। তো সেই ১৯ তম দিনের ভোরে বিবিসি বাংলার প্রভাতী অনুষ্ঠানে ঘোষিত হয়ে গেল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম। একটু বিস্মিত যে হইনি তা বললে মিথ্যা বলা হবে। বাংলাদেশ আর ভারত মিলিয়ে যত বাঙালী আছে তাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব বা রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয়তা তো প্রশ্নাতীত...দুইবাংলাতেই রবীন্দ্রনাথের সমান কদর। আর অন্যদিকে শেখ মুজিবকে পশ্চিম বাংলার মানুষ যে বাঙালী হিসাবে রবীন্দ্রনাথের উপরে স্থান দেয় না সেই ব্যাপারে সন্দেহ নেই তেমন। সেই হিসাবে শেখ মুজিবের পক্ষে ভোট দেয়া মানুষ মূলত বাংলাদেশেরই হবার কথা। কিন্তু আমাকে বিস্মিত করে দ্বিতীয় সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী হিসাবে যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম ঘোষিত হল তখন একটু অবাক হলাম বৈকি! কিন্তু সেইসাথে বেশ খানিকটা শঙ্কাও তৈরী হল মনের মধ্যে...আসলেই কি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী হিসাবে শেখ মুজিবের নাম টা আসবে...নাকি আদৌ আসবেই না? স্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়নি তো পূর্ব পাকিস্তানের জনতাকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখানো এবং সেই স্বপ্ন পূরনের লক্ষ্যে বাঙালীকে এগিয়ে নেয়া মূল চালিকা শক্তির নামটি? আমার আব্বা যেমনটি করে এই স্বপ্ন দ্রষ্টার গল্প শোনায়, যেমন করে সেই তর্জনীর ক্ষমতার কথা বলে, যেমন ভাবে এই দীর্ঘদেহী ঋজু ব্যক্তিটির বজ্র কন্ঠের উচ্চারণকে অনুভব করে সেরকম ভাবে কি অন্য বাঙালীও ভাবে তাঁকে? আসলেই কি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালী হিসাবে আসবে সেই ব্যক্তির নাম যার ১৭ মিনিটের দেয়া রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ ছিল আমার ২৪ বছর পর্যন্ত জীবনে সবচাইতে বেশী শোনা রেকর্ড... ঈদ, জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকী থেকে শুরু করে ভাল রেজাল্টের সেলিব্রেশান সবকিছুর জন্যেই আমার আব্বার একটাই ব্যাক গ্রাউন্ড মিউজিক "আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার একটা মানুষকে হত্যা করা হয়, তবে তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল ...............রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো রক্ত আরো দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা-আল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম"।
যাই হোক, দেখতে দেখতে বেজে গেল সন্ধ্যা সোয়া সাতটা। সাড়ে সাতটার বাস ধরব, বাস স্ট্যান্ডে যেতে লাগবে মিনিট পাঁচেক, কিন্তু কোন রিস্ক না নিয়ে আগেই বের হয়ে গেলাম ল্যাব থেকে... কোন মতেই বাস মিস করা যাবে না। ল্যাবের দরজা দিয়ে বের হয়ে যেই না মেইন গেটের কাছে গেছি, দেখি আমার এডভাইজার হন্তদন্ত হয়ে ঢুকছেন। আমাকে দেখে যেন তিনি হাপ ছেড়ে বাঁচলেন বললেন "আমি আশা করছিলাম যে তোমাকে পাব, জাস্ট দুটা ওয়াটার স্যাম্পেলের মেটাল কনসেন্ট্রেশান একটু জেনে দাও। জাস্ট ফোর পয়েন্টের একটা ক্যালিব্রেশান কার্ভ হলেই চলবে এর জন্যে। সব মিলিয়ে জন্যে ঘন্টা খানেকের বেশী লাগবে না তোমার। আগামীকাল যে প্রজেক্ট আপডেট ডিউ তার জন্যে দরকার।"
আমি কি করব ভেবে পেলাম না...মন টা এক্কেবারে খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু কি কিছু বলারও নেই...এই প্রজেক্ট থেকেই আমার একাডেমিক এসিস্ট্যান্টসিপ আর রিসার্চের ফান্ডিং আসে আর সেটারই ইয়ার্লি রিপোর্টের ব্যাপার, না তো করা যায় না। আমি হাত বাড়িয়ে স্যাম্পেল দুটো নিয়ে বললাম "ওকে নো প্রবলেম। You will get the results by nine".
ল্যাবে এসে মন খারাপ করে বসে থাকলাম মিনিট পাঁচেক। তারপর নিজেকে বুঝালাম এটা কোন ব্যাপার না.....জরীপের ফলাফল তো বিবিসি বাংলার ওয়েবসাইটে থাকবেই, পরে দেখে নিলেই চলবে। কিন্তু মন কি আর মানে? ক্রিকেট খেলা লাইভ দেখা আর পরে খেলার রেজাল্ট পেপারে পড়ে নেয়ার মধ্যে পার্থক্য তো আছেই। হঠাৎ মনে হল আসলে কি আমি বোকা নাকি অন্য কিছু? বিবিসি বাংলা শুনতে বাসায় কেন যেতে হবে? এখানেই তো কাজ করতে করতে ল্যাপটপে শুনা যায়...খালি একটা হেড ফোন দরকার যেন অন্য কারো অসুবিধা না হয়। আমার সাথে সেদিন হেড ফোন ছিল না তাই টিফেনী নামে ল্যাবমেটের কাছ থেকে কিছুক্ষনের জন্যে হেড ফোন টা ধার নিলাম।
রাত প্রায় সাড়ে আট টা বেজে গেল দেখতে দেখতে। এর মধ্যে আমার স্যম্পেলের মেটাল ডিটেকশান আর এনালাইসিসের কাজ শেষ। রেজাল্ট জানিয়ে এডভাইজারকে ইমেইল পাঠাতে পাঠাতেই শুরু হয়ে গেল বিবিসি বাংলার ১৪ এপ্রিল, ২০০৪ এর অনুষ্ঠান ... হেড ফোনে শুনতে পেলাম "আপনারা শুনছেন বিবিসি বাংলার সকালের আয়োজন প্রভাতী......" । বিশ্ব সংবাদ সহ আরো কিছু খবরের পর আসল হাজার বছরের সর্ব শ্রেষ্ঠ বাঙালী নির্বাচনের জরীপের এক নম্বর আসনের বাঙালীর নাম ঘোষণার সেই মহেন্দ্রক্ষন। সকল চিন্তার/দুশ্চিন্তার সমাপ্তি ঘটিয়ে উচ্চারিত হল সেই আকাঙ্খিত নাম টি ..."শেখ মুজিবুর রহমান"।
তখনকার অনুভূতি টা ঠিক ভাষায় প্রকাশের মত নয়। কেমন যেন একটা মিশ্র অনুভূতি হল। ভাল লাগা উচিত না খারাপ লাগা উচিৎ নাকি রাগ হওয়া উচিৎ বুঝতে পারছিলাম না। তবে আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে যে প্রথমেই কিছুটা ক্ষোভ জন্মেছিল মনে, যেই বাঙ্গালীরা মুজিব কে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী বলে ভোট দিল, তারা কি সুযোগ দিবে এই লোকটিকে যারা নির্মম ভাবে হত্যা করল তাদেরকে বিচারের কাঠ গোড়ায় আনার। নাকি এই জরীপের ভোটে মুজিবকে সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী বানানো আসলে জনগণের একটা প্রহসন মূলক নাটক... সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালীর নির্মম হত্যার বিচার রোধে যারা সংবিধানে তালা পড়িয়েছিল তাদেরকেই এই জনগন আবার ক্ষমতায় আনবে যেন বিচারের বানী চিরকালের মত চাপা পড়ে যায়। তারপরই ভাবনা টা সরিয়ে দিলাম। মনে হল আসলে তো এই জনতাই মুজিব হত্যার বিচার এতদূর আনতে দিয়েছে তার মেয়েকে... কত অপপ্রচার উপেক্ষা করে মনে রেখেছে সেই তর্জনী তুলে বজ্র হুঙ্কারে একটা স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখানো মানুষটাকে। বাংলাদেশ থেকে হাজার মাইল দূরে থেকে আমার মত আরো হয়ত হাজার মানুষ এভাবেই হয়ত এই বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে মনে রেখেছে, স্মরণ করেছে। যাদের হাতে আর কোন অস্ত্র নাই মুজিবের খূনীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের, তাদের কাছে হয়ত এই রায়টাই জনতার রায় হয়ে থাকবে... হয়ত তারা সান্ত্বনা খুঁজে পাবে যে মুজিবের খূনীরা শাস্তি না পেলেও দেখতে তো পেল যে যাকে তারা নির্বংশ করে তাঁর অস্তিত্বকে জনতার মন থেকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে চেয়েছিল, সেই মুজিবই আজকে জনতার রায়ে ফিরে এসেছে আরো বিরাট হয়ে। এরকম নানান ভাবনার খেলার মধ্যেই হাটতে হাটতে বাসায় ফিরে আসলাম আর এসেই বাংলাদেশ থেকে আনা সিডিতে ৭ই মার্চের ভাষণ টা চালালাম। ভাষন টা শুনতে শুনতে কেমন একটা বিশ্বাস জন্মাতে থাকল মনের মধ্যে যে সত্যিই হয়ত বাংলার মাটিতে মুজিব হত্যার বিচার হবে। বাংলার মানুষ মুজিব হত্যার বিচার না করে ছাড়বে না ... বাংলার মানুষকে আর দাবায় রাখা যাবে না। বাংলার মানুষ তাদের প্রিয় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালীর রক্তের ঋণ শুধবে।
========
যদিও বড় অসময়ে নির্মম ভাবে তাঁকে হত্যা করেছে ঘাতকেরা কিন্তু মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে বরং অমরত্ব অর্জন করেছেন বাংলাদেশ নামের দেশটার এই স্বপ্ন দ্রষ্টা। সেই স্বপ্ন দ্রষ্টা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী শেখ মুজিবুর রহমানের আজকে ৯৪ তম জন্মদিন। এই দিনে তাঁর জন্যে শ্রদ্ধা আর ভালবাসা; আল্লাহ্ তাঁকে জান্নাত বাসী করুন।
মন্তব্য
খুব ভালো লাগলো আবেগময় ও সুন্দর বর্ণনার লেখাটি।
শুভকামনা রইলো।।।
-masum.badal
মাসুম বাদল
.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল
শুভ জন্মদিন!
খুব ছুঁয়ে গেল রে আপু আপনার লেখাটা! আরো লিখুন।
চটপট টাইপোগুলো শুধরে নিন দয়া করে: বাঙলা-বাংলা, কারন-কারণ, পূরন-পূরণ, খূনী-খুনী/খুনি, হাটতে হাটতে-হাঁটতে হাঁটতে,
ভাষন-ভাষণ
"হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী শেখ মুজিবুর রহমানের আজকে ৯৪ তম জন্মদিন।"
এই নাম আজো রক্তে শিহরণ বয়ে আনে।
জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য তাঁকে।
লেখা ভালো লেগেছে।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ভোট দিয়ে হাজার বছরের সেরা বাঙালী নির্বাচনের ব্যাপারটি সস্তা এবং অগ্রহণযোগ্য। এবং এই রকম নির্বাচনের প্রক্রিয়াতে বঙ্গবন্ধু বা গুরুদেবের নাম ঢোকানো আরো অগ্রহণযোগ্য। শ্রোতাদের দেয়া ভোটে হিসেব করা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু জিয়াউর রহমান বা গোলাম আজমের থেকে কত বেশি বা কত কম ভোট পেয়েছেন এটা ভাবতেই তীব্র বিবমিষা বোধ করি।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
সহমত।
সুবোধ অবোধ
নতুন মন্তব্য করুন