আঙ্কল টমস কেবিন

মৃদুল আহমেদ এর ছবি
লিখেছেন মৃদুল আহমেদ (তারিখ: রবি, ১৮/০৫/২০০৮ - ১১:৩৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মিরনভ নামের বিরাট মহাকাশযানটি একটু আগেও অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে ছুটে চলছিল, এখন সেটি অজানা গ্রহের ওপর অনেকটা যেন বোকার মতোই বসে আছে।
রাশিয়ার মহাবিজ্ঞানী মিরনভ, যিনি পর পর দুইবার বিজ্ঞান মহাসম্মেলনের সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁর নামেই এই মহাকাশযানটির নামকরণ করা হয়েছে। পৃথিবীতে এটাই প্রথম আলোর সমান গতিসম্পন্ন মহাকাশযান, সারা পৃথিবী জুড়ে এই মহাকাশযান নিয়ে জল্পনাকল্পনার শেষ নেই।
এই আলোর গতিসম্পন্ন মহাকাশযানের বিশেষত্ব এই, এটা কিছুটা দূরত্ব যাওয়ার পর নির্দিষ্ট গতি পেলেই হাইপার ডাইভ দিয়ে মুহূর্তে আলোর সমান গতিতে ছুটতে শুরু করে। পৃথিবী থেকে যেদিন এই মহাকাশযানটি ছাড়া হল, সেদিন পৃথিবীতে এমন কোনো মানুষ ছিল না, যে টিভির সামনে বসে এই দৃশ্য দেখে নি। মহাকাশযানটি ছাড়ার পর আস্তে আস্তে সেটা আকাশে মিলিয়ে গেল, তারপরও আট ঘণ্টা সেদিকে টিভি ক্যামেরা ধরে রাখা হয়েছিল। আট ঘণ্টা পর সেটির হাইপার ডাইভ দেয়ার কথা। বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন এই হাইপার ডাইভ দেয়ার সময় অবিস্মরণীয় দৃশ্যের সূচনা হবে। কেউ তাই এক মুহূর্তের জন্যও টিভি স্ক্রিন ছেড়ে সরতে পারে নি।
হাজার মাইল দূরের দৃশ্য চট করে চলে আসা সম্ভব নয়, হাইপারডাইভ দেয়ার নির্দিষ্ট সময়ের প্রায় এক ঘণ্টা পর পৃথিবী থেকে সেই দৃশ্য দেখা গিয়েছিল। বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন বটে অবিস্মরণীয় দৃশ্য, কিন্তু পৃথিবীবাসীর মনে হয়েছিল এটা আরো অনেক সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার। হাইপার ডাইভ দেয়ার সময় একটা ভয়াবহ আলোক বিচ্ছুরণ হয়, এই আলোক বিচ্ছুরণ যে না দেখেছে, তাকে সেটা বলে বোঝানো মুশকিল। অলিম্পিকে বা ওয়ার্ল্ড ফুটবলে যেসব দামি দামি আশ্চর্য সুন্দর বাজি পোড়ানো হয়, সেগুলো এর কাছে কিছুই নয়।
কিন্তু সারা পৃথিবীর হার্টথ্রব সেই মহাকাশযানটি এখন অদ্ভুত একটি বিপদে পড়ে থমকে আছে। মহাকাশযানে যারা আছে, তারা সবাই অভিজ্ঞ এবং সাহসী মানুষ, কিন্তু বিপদটি এমন যে, কেউই আর কোনোরকম ভরসা পাচ্ছে না।
মহাকাশযানের টিমলিডারের নাম টম, আঙ্কল টমস কেবিনের আঙ্কল টমের মতো তার চামড়াও কালো কুচকুচে, আবার তার বাড়িও আফ্রিকাতে। কিন্তু মাথার চুলগুলো ধবধবে সাদা। বয়স ষাটের ওপরে হবে, এখনও যে কোনো যুবকের চেয়ে বেশি কর্মক্ষম। অনেকে বলে তিনি প্রথম জীবনে ছিলেন ব্যাঙ্কের এক সামান্য কেরানি, তারপর নিজের চেষ্টায় এতদূর উঠে এসেছেন। তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ তাঁর অসম্ভব মানসিক শক্তি।
এই মুহূর্তে তাঁকে দেখা যাচ্ছে কন্ট্রোল বোর্ডের পাশেই একটা পাতলা হার্ডবোর্ডের চেয়ারে বসে নিবিষ্ট মনে কী যেন ভাবছেন, তাঁর ভ্রু দুটো অসম্ভব কুঁচকে আছে। দুই সহকারি ম্যাক আর সুসান কাছেই দাঁড়িয়ে, তাঁরা কোনো কথা বলতে সাহস করছে না।
এ ধরনের বিপদ সবার জন্যই একেবারে নতুন। হাইপার ডাইভ দেয়ার পর বেশ অনেকদূর পর্যন্ত যাত্রা নির্ঝঞ্ঝাটই ছিল, তাঁদের লক্ষ্য ছিল এক আলোকবর্ষের দশ ভাগের এক ভাগ দূরত্বের নতুন আবি®কৃত গ্রহটি, যেটা কিনা সূর্যকে কেন্দ্র করেই ঘুরছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। সেটাকে স্পর্শ করে হালকা জরিপ সেরেই তাঁদের ফিরে আসার কথা।
কিন্তু গতির মধ্যেই হঠাৎ একটা বড় ঝাঁকুনি দিয়ে মহাকাশযানটি স্থির হয়ে গেল। এবং তার সঙ্গে সঙ্গেই সবকিছু বন্ধ। মহাকাশযানের মূল ইঞ্জিনটি কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই চুপ করে রইল, পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগের পুরো বোর্ডটিই দেখা গেল একদম নষ্ট হয়ে গেছে, একটি সুইচও কাজ করছে না। আরো বিভিন্ন সব ভূতুড়ে কাণ্ড ঘটতে শুরু করল, এবং একসময়ে দেখা গেল, সম্পূর্ণ অন্ধকার অবস্থায় পুরো মহাকাশযানটি এক জায়গায় থমকে দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকে অসীম শূন্যতা।
একটু পরেই টের পাওয়া গেল মাধ্যাকর্ষণের প্রভাব। থমথমে একটা পরিবেশের ভেতর এক অদ্ভুত মাধ্যাকর্ষণের টানে মহাকাশযানটি আস্তে আস্তে এই গ্রহটির ওপর নেমে এল।
মহাকাশযানের প্রায় সবারই সৌরম্যাপ সম্বন্ধে ভালো ধারণা আছে, কিন্তু এটা কোন গ্রহ কেউই ঠিকমতো বলতে পারল না। দূরত্ব, অবস্থান এ সমস্ত মাপার প্যানেলগুলো নষ্ট, তার মধ্যে গ্রহটার রঙ এবং মাটিও অদ্ভুত ধরনের, কারো কাছেই পরিচিত নয়। সবারই মুখ শুকনো, মাথা পুরোপুরি বিভ্রান্ত।
এই গ্রহটির দুটো সূর্য, একটা সূর্য ওঠার প্রায় ঘণ্টাখানেক পর দ্বিতীয় সূর্যটি ওঠে। আলো ওঠার পর সবাই এই গ্রহটিকে ভালোমতো দেখতে পেল। রুক্ষ পাথুরে মাটি, আকাশের রঙ লাল আর প্রচণ্ড গরম। মহাকাশযানের ভেতরেও সবাই সমানে ঘামতে শুরু করল। মহাকাশযানের তাপ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা অনেক আগে থেকেই কাজ করছে না।
সবাই ভাবছিল, নিঃসন্দেহে এটা একটা স্যাবোটাজ। পৃথিবী থেকে যখন এই প্রথম আলোর সমান গতিসম্পন্ন মহাকাশযান ছাড়ার কথা হচ্ছিল, তখন অনেকেই ঠোঁট উল্টে সন্দেহ প্রকাশ করেছে, অনেক ঈর্ষাকাতর দেশগুলো এই প্রজেক্ট ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়েও লেগেছিল। আবার অনেকে চুরি করতে চেয়েছিল এই ফর্মূলা। ভ্যান গগ নামের এক আকাশদস্যু তো হুমকি দিয়েই বসেছিল, সে যে করেই হোক এ মহাকাশযান চুরি করবে, কেউ ঠেকাতে পারবে না!
বিচিত্র এবং ভয়ানক মানুষ এই ভ্যান গগ, অনেক রকমের ভেল্কি এবং চালাকি সে জানে। গত ত্রিশ বছর ধরে তাকে অনেক চেষ্টা করেও বিশ্ব সংস্থার দুঁদে পুলিশ অফিসাররা ধরতে পারেন নি। ভ্যানের আসল নাম কেউ জানে না, তার এক কান কাটা, এবং সে নাকি আবার ছবিও আঁকে, সে কারণে প্রাচীন এক কানকাটা চিত্রশিল্পী ভ্যান গগের নামেই তাকে সবাই ডাকে। এ সমস্ত কারণে স্যাবটাজের কথা মনে আসবেই, যদিও নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল মারাত্মক, এই মহাকাশযানটির সঙ্গে আরো দুটি পুলিশ মহাকাশযানও নিক্ষিপ্ত হয়েছিল, যেগুলো হাইপার ডাইভ দেয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের সঙ্গে সঙ্গে এসেছিল। ভ্যান গগের হুমকিকে কেউ হালকা করে দেখে নি।
গ্রহে নামার পর প্রায় বারো ঘণ্টা কেটে যাবার পরও বিশেষ কোনো সুরাহা হয় নি, টেকনিশিয়ানরা কোনো সমস্যাই খুঁজে বের করতে পারছে না, সবই ঠিক আছে, কিন্তু কিছুই ঠিক নেই। তখনও কেউ বুঝতে পারে নি, সামনে আরো কী ভয়ানক বিপদ এগিয়ে আসছে!
সবার ধারণা ছিল গ্রহটি সম্ভবত প্রাণীহীন। প্রাণের বিকাশ ঘটার মতো আবহাওয়া এই গ্রহে নেই। কিন্তু ধারণাটি ছিল ভুল। সবাই যখন মহাকাশযানের ট্রাবলশ্যুটিং নিয়ে ব্যস্ত, সে সময় আচমকা চারদিক কাঁপিয়ে শোনা গেল তীক্ষè একটা ডাক।
সবার দৌড়ে এগিয়ে এল জানলাগুলোর সামনে। একটা হুড়োহুড়ি পড়ে গেল চারদিকে। একটু পরেই দেখা গেল রূপকথার রক পাখির চেয়েও বিশাল এক অতিকায় পাখি কোত্থেকে এসে বসে আছে এই মহাকাশযানটির সামনে। এবং বসে বসে তীক্ষè চোখে পর্যবেক্ষণ করছে যানটিকে। তার বিশাল বাজপাখির মতো তীক্ষè চোখের দিকে তাকালে মাথা ঘুরে যায়।
একটু পরই সে তার বিশাল ঠোঁট দিয়ে সে মহাকাশযানটিকে টানাটানি শুরু করল, তখন ভয়ে পাঁচ-ছয়জন একেবারে অজ্ঞান হয়েই পড়ে গেল। আর তার গগনবিদারী ডাক মহাকাশযানের ভেতরে বসেই শোনা যাচ্ছে।
এরকম একটি মহাকাশযানের যে পরিমাণ বিধ্বংসী ক্ষমতা আছে, তাতে এরকম দশটা পাখিকে উড়িয়ে দেয়া যায়! কিন্তু ফায়ারিং প্যানেলটি পুরোপুরি হ্যাঙ হয়ে আছে।
ভয়ে সবার মুখ পাংশু, মনে মনে সবাই মৃত্যু দেখতে পাচ্ছে। কেউই কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না, আর টম শুধু একমাত্র নির্বিকার, ভ্রুঁ কুচকে চোখ বন্ধ করে বসে আছেন।
টম হঠাৎ চোখ খুলে খুব সহজ স্বাভাবিক গলায় বললেন, ম্যাক আর সুসান, তোমরা দুজনেই কিন্তু একই কথা বলেছ, তাই না?
ম্যাক আর সুসান নিজেদের দিকে চোখ তাকাতাকি করল। তারপর জিজ্ঞেস করল, কোন কথাটা মহামান্য টম?
এই যে... তোমাদের মনে হচ্ছে স্পেসশিপের দরজা খুলে দৌড় দিয়ে ঐ ডানদিকের পাহাড়ে গিয়ে লুকোতে। মনে হচ্ছে ওটা করলেই তোমরা সবচেয়ে নিরাপদ থাকবে, তোমরা দুজন নিজেদের মধ্যে আলাপও কর নি, তারপরও কেন এরকম মনে হচ্ছে? সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, আমার নিজেরও এরকম মনে হচ্ছে, কিন্তু কেন? আমরা কেউই কারো সঙ্গে কোনো আলাপ করি নি!
ম্যাক আর সুসান আবার চোখ তাকাতাকি করল। তারা কিছুই বুঝতে পারছে না! টিমলিডার হিসেবে এখন টমের উচিত সবার প্রাণ বাঁচানোর জন্য প্ল্যান করা। সে এখন এরকম মহান মানুষের মতো আধ্যাত্মিক চিন্তা নিয়ে মেতে উঠলে তো মুশকিল!
টম আপনমনেই বললেন, এই গ্রহে এত বড় একটা পাখি, সেই পাখি খায় কী? আর কোনো প্রাণী তো দেখলাম না!
তারপরই ছোট্ট একটা হাততালি দিয়ে মূল কন্ট্রোল বোর্ডের দরজায় দাঁড়ানো মিলিটারি দুজনকে ডাকলেন, বললেন, তোমরা এখানেই দাঁড়াও, যেকোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থেকো।
তারপর সবার অবাক চোখের সামনেই ঝটপট করে স্পেসস্যুট পরতে লাগলেন, তারপর কোমরের বকলসে চেইন আটকালেন, যেটা ধরে প্রয়োজনে টেনে আনা যায়।
নামার আগে স্পেসশিপের দরজায় হাত দিয়ে সবাইকে বললেন, যদি নাও ফিরে আসি, ভালো থেকো সবাই। আশা করি, এই সমস্যার সমাধান করে তোমরা নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারবে।
মহাকাশযানের নিয়মে আবেগ প্রদর্শন বাঞ্ছনীয় নয়, কিন্তু সুসান তাঁর হাত ধরে কাতর গলায় বলল, মাননীয় টম, কী করতে যাচ্ছেন?
টম রাগলেন না, নরম গলায় বললেন, ছোট একটা পরীক্ষা করব, যেটার ওপর সবার জীবন নির্ভর করছে। একটু থেমে হেসে বললেন, ভয় নেই!
তারপর স্পেসশিপ থেকে তিনি নামতেই সবাই আতঙ্কে তাকিয়ে রইল।
আর তার নামার পরই দেখা গেল একটা অদ্ভুত দৃশ্য, তাঁর পা মাটিতে পড়ছে না, তিনি যেন ভাসতে ভাসতে চলেছেন। কখনো কখনো আবার তাঁর শরীরটা অর্ধেক মাটির ভেতর ঢুকে যাচ্ছে।
তিনি সেরকম ভাসতে ভাসতেই পাখিটির সামনে উপস্থিত হলেন। পাখিটি তীক্ষè চোখে তাঁকে একবার দেখেই আকাশফাটা চিৎকার দিয়ে উঠল। তারপর ছোঁ মারার আগে শিকারি পাখি যেরকম ভঙ্গি করে, সেরকম ভঙ্গি করতেই সবাই চোখ বুঁজে ফেলল ভয়ে। মনে হল, এই শেষ, কিন্তু চোখ খুলতেই দেখা গেল এক অভুতপূর্ব দৃশ্য। পাখিটি বারবার ঠোঁট দিয়ে কামড়ে ধরতে চাইছে তাঁকে, অথচ তাঁর শরীরটা যেন বাতাসের তৈরি, পাখির ঠোঁট যেন বারবার তাঁকে ভেদ করে যাচ্ছে। আর তিনি কোমরে দু-হাত দিয়ে হা হা করে অট্টহাসি হেসেই চলছেন। এ কি ম্যাজিক, নাকি অন্যকিছু? সবাই উর্ধ্বশ্বাসে তাকিয়ে রইল। আর তার ঠিক পরপরই একটা অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটল।
হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি দিয়ে চালু হয়ে উঠল মহাকাশযানটি। তারপরই সবাই আবিষ্কার করল, মহাকাশযান আগের মতোই ছুটে চলেছে, মুহূর্তে পুরো মহাকাশযানের আলো জ্বলে উঠেছে, কন্ট্রোল প্যানেলগুলোতে বিভিন্ন রঙের সুইচগুলো জ্বলছে। গ্রহটা নেই, পাখিও নেই, চারদিকে শুধু তারাজ্বলা মহাজাগতিক অন্ধকার।
আর কন্ট্র্লো বোর্ডের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে একটা দানবীয় আকৃতির লোক একের পর এক সুইচ চেপে যাচ্ছে, লোকটির জামাকাপড় নোংরা, আর সবচেয়ে দ্রষ্টব্য জিনিসটি হচ্ছে, তার একটি কান কাটা!
তাকে দেখামাত্র মিলিটিারি দুজন গুলি ছুঁড়ল, কন্ট্রোল প্যানেলের রুমে অনুমতিবিহীন যে কাউকে দেখামাত্রই গুলি করা নিয়ম।

০২.

প্রায় আধঘণ্টা পর গুলি খেয়ে পড়ে থাকা লাশটির সামনে নিজের চেয়ারটিতে বসে টম বললেন, তাহলে এই হচ্ছে ভ্যান গগ! এত চাতুর্য নিয়েও বেচারা বাঁচতে পারল না!
তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি জানি তোমরা সবাই খুব অবাক হয়েছ। আসলে আমি নিজেও কম অবাক হই নি। এমন কি, আমি যতক্ষণ ঐ পাখিটার দিকে যাচ্ছিলাম, তখনও আমি এতটা ভাবি নি। পুরোটাই ছিল একটা ভাঁওতাবাজি। এই যে ভ্যান, সে একজন বিচিত্র মানুষ, অনেক রকমের বিদ্যা সে জানে। এত নিরাপত্তাব্যবস্থার ভেতরেও হয়ত সেরকম একটা কিছু করেই সে ঢুকে পড়েছিল। কিন্তু তাঁকে একলাই ঢুকতে হয়েছিল, এবং প্রত্যেকটা প্যানেলের নিজস্ব কোড থাকায় সে কোনোটার নিয়ন্ত্রণ নিতে পারছিল না। একসময় পেরে যেত, কিন্তু সেটা সময়সাপেক্ষ। সে কারণে সে আশ্রয় নিয়েছিল মনোবিদ্যার।
...সে আমাদের যা করেছিল, সেটার নাম সম্মোহন। এরকম প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি সংখ্যক মানুষকে গণসম্মোহন করার ভয়ানক মানসিকশক্তিসম্পন্ন লোক পৃথিবীতে এই এক ভ্যান গগই আছে। এই মহাকাশযান থেমে যাওয়া, অন্য গ্রহে নেমে আসা, লাল মাটি, দুটো সূর্য, অতিকায় পাখি, সবই আসলে স্বপ্ন। সম্মোহন করে আমাদেরকে সে এসব দেখাচ্ছিল। আসলে মহাকাশযান কখনোই থামে নি, কোনোকিছু নষ্টও হয় নি, সবকিছু আগের মতোই চলছিল। আমার সন্দেহ হয় এখান থেকেই, সবাই কেন ঐ একটা জিনিসই মনে করছে, কেন ভাবছে এই মহাকাশযান থেকে পালিয়ে গিয়ে পাশের পাহাড়ে গেলেই সে নিরাপদ। আসলে ভ্যান ঐ একটা সাজেশানই সবাইকে সম্মোহনের মাধ্যমে পাঠাচ্ছিল, আমরা মহাকাশযান থেকে নেমে গেলেই সে এটার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিত!
...যে মুহূর্তে আমি তার সম্মোহনটাকে আমার বিশ্বাস দিয়ে ভেঙ্গে ফেললাম, তখন গণসম্মোহনের চেইন ভেঙ্গে যাওয়ায় আর সবাই সম্মোহনমুক্ত হয়ে গেল!
...তারপর বোধহয় সে কন্ট্রোল বোর্ডে লাফিয়ে পড়ে তাৎক্ষণিক কিছু করতে চাচ্ছিল, কিন্তু তপ্ত বুলেট অনেক নিষ্ঠুর!
সবাই নিশ্বাস বন্ধ করে কথা শুনছিল, সুসান বলল, আপনি বললেন, যখন পাখির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন পর্যন্ত জানতেন না, আপনি ঠিকই করছেন কিনা। যদি পাখিটা সত্যি হত, আপনাকে খেয়ে ফেলত?
টম মুচকি হেসে বললেন, খেত না, আমার শত্রুরা আমাকে বলে যমের অরুচি, আর খেলেও হজম করতে গিয়ে মারা পড়ত নির্ঘাত্। তাতে যা হত, তোমরা অন্তত বেঁচে যেতে। পৃথিবীতে ফিরে গিয়ে বলতে আমাদের দলনেতা কী মহান! কী অপূর্ব তাঁর আত্মত্যাগ! তারপর মাদাম তুস্যোর মিউজিয়ামে আমার মোমের তৈরি মূর্তি শোভা পেত! এই সুবর্ণসুযোগ পেয়েও কে ছাড়ে বল?
এরপর আবার একঝলক মুচকি হেসে চোখ টিপলেন।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়লাম । ভাল লাগল ।
eru

-------------------------------------------------
pause 4 Exam

অনিন্দিতা এর ছবি

বাহ্ , দুর্দান্ত!

খেকশিয়াল এর ছবি

মজা লাগল পড়ে, আরো ছাড়ুন কিছু ।

-----------------------------------------
রাজামশাই বলে উঠলেন, 'পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।