লুটুমামার প্রতিবাদ

মৃদুল আহমেদ এর ছবি
লিখেছেন মৃদুল আহমেদ (তারিখ: শনি, ৩১/০৫/২০০৮ - ৯:২১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমাদের লুটুমামাকে আমরা ছোটবেলা থেকেই মেট্রিক পরীক্ষা দিতে দেখে আসছি। প্রতি বছরেই যেমন একটা করে পয়লা জানুয়ারি থাকে, একটা করে একুশে ফেব্রুয়ারি কিংবা ছাব্বিশে মার্চ, অথবা ষোলই ডিসেম্বর, সেরকম অবশ্যম্ভাবীভাবেই প্রতি বছর লুটুমামার পরীক্ষা একটা নিয়মিত ঘটনা।
ঘরের কেউ একজন মেট্রিক পরীক্ষা দিতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই সবার মধ্যে একটা ব্যস্ততার ভাব থাকার কথা, কিন্তু খুব স্বাভাবিকভাবেই কারো কোনো মাথাব্যথা ছিল না এ নিয়ে।
সকালবেলা নাস্তাটা করেই মামা এমনভাবে বেরোতেন যেন দুপুরের রান্নার জন্য কাঁচাবাজারে লাউ কিনতে যাচ্ছেন। শুধু পাড়ার লোকেরাই বুঝতে পারতেন যে, লুটু পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে। তাঁরা বলতেন, কী লুটু, এবার পাস হবে তো? মামা বিনয়ে বিগলিত হয়ে একগাল হেসে জবাব দিতেন, ইনশাল্লাহ এইবার হইব, দোয়া রাইখেন!
মামা হাসিমুখে পরীক্ষা দিতে যেতেন, এবং হাসিমুখেই ফিরে আসতেন। বাড়ি এসে বলতেন, দারুণ হইছে পরীক্ষাটা, সবকয়টা কমন পাইছি--এক্কেবারে হান্ড্রেড পার্সন্ট অ্যানসার!
কিন্তু তাঁর কথা কেউ বিশ্বাস করত না, কারণ প্রতিবারেই তিনি হান্ড্রেড পার্সেন্ট অ্যানসার করে খুব ভালো পরীক্ষা দিয়েই হাসতে হাসতে বাড়ি ফেরেন, কিন্তু বছর শেষে রেজাল্ট দেবার সময় স্কুল থেকে ফ্যাকাসে মুখে বাসায় এসে আমার ছোটমামাকে ডাকতে থাকেন, পুটু--অই পুটু, একবার আমার লগে আয় তো রে ভাই, কী য্যান হইছে, আমার নাম্বার খুইজা পাইতাছি না, বোর্ডের ব্যাডারা মনে হয় ভুল কইরা আমার নাম্বার দেয় নাই!
রান্নাঘর থেকে আমার দাদি চেঁচাতেন, পুটুরে খামাখা ডাকাডাকি কইরা আর পাড়ার লোকরে হাসাইস না ব্যাক্কল, যা, ঘরের ভিতরে চুপ কইরা বইয়া থাক গিয়া!
সেদিন রান্নাঘর থেকে বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থা হিসেবে লাকড়ি সরিয়ে রাখা হত। কারণ বলা যায় না, দাদা হয়ত অফিস থেকে গরম মাথা নিয়েও ফিরতে পারেন। ফিরে তাঁর যদি মনে থাকে, পরীক্ষার খবর জেনেই হয়ত একটা পোক্ত দেখে লাকড়ি নিয়ে ছুটবেন লুটুমামার খোঁজে। আর লুটুমামার মনেও এ সময় দ্বিধাদ্বন্দ্বের দোলা, দাদাকে লাকড়ি হাতে আসতে দেখলেই দৌড়াবেন, তার আগে না।
বলতে গেলে আমাদের গ্রামের আদুভাই ছিলেন লুটুমামা। বলা যায় না, আবুল মনসুর আহমেদের সঙ্গে পরিচয় থাকলে তিনি হয়ত "আদুভাই" গল্প না লিখে "লুটুভাই" নামেও গল্প লিখে বসতে পারতেন।
তবে লুটুমামা কিন্তু আদুভাইয়ের মতো অত সুবোধ বালক ছিলেন না। পরীক্ষায় পাসের জন্য অসদুপায় অবলম্বনের ক্ষেত্রে তাঁর কোনে আপত্তি ছিল না। সেটা করতে গিয়ে একবার কী হল, সে গল্পই বলি।
পরীক্ষার সিট পড়েছে কাছেরই এক স্কুলে। ইংরেজি পরীক্ষা, কাজেই ভয়ানক পরীক্ষা। কানাকানি হচ্ছে যে, এবার নাকি খুব কঠিন প্রশ্ন হবে। সবাই যুদ্ধংদেহি মনোভাব নিয়ে যে যার মতো করে প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে, শরীরের যে যে কয়টা জায়গায় কাগজ ভাঁজ করে রাখা যায়, তার কোনোটাই বাদ নেই। অনেক উদ্ভাবনী মস্তিষ্ক থেকে সাম্প্রতিক কিছু আবিষ্কারও বেরিয়েছে। লুটুমামারও "বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী" অবস্থা !
সেদিন মামাদের হলে যে দুজন টিচারের ডিউটি পড়েছে, তাদের মধ্যে একজন আবার একসময় লুটুমামার নিচের ক্লাসে ছাত্র ছিলেন। তার মানেই লুটুমামার ছোটভাই।
সেই টিচার, তাঁর নাম ইমরান, পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগেই সবাইকে ডেকে বললেন, আমি জানি, তোমরা সবাই পকেটে করে নকল নিয়ে এসেছ। পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগেই ভালোভাবে বলছি, সবাই নকল ফেলে দাও। আমরা এখন কিছুই বলব না, কিন্তু পরে ধরা পড়লে আর মাফ নেই!
লুটুমামা সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে উঠে গম্ভীর গলায় বললেন, এইডা কী কইলা ইমরান, বেবাকে নকল আনছে মানে, তুমি কি আমারেও নকলবাজ কইতে চাও নাকি?
ইমরান স্যার থতমত খেয়ে বললেন, না, না, লুটুভাই, আমি মোটেই এরকম কিছু...
লুটুমামা দরাজ গলায় বললেন, থাক, থাক, বুঝছি, কওন লাগব না। এইডা হইল গিয়া তোমাগোর গণতন্ত্রের সমস্যা। বেবাকেরে একই লাইনে ফালাইবার চাও! আদব-লেহাজ দেশে কিছু রাইখো!
ইমরান স্যার আর কিছু বলতে সাহস পেলেন না। পরীক্ষা শুরু হল। লুটুমামা কিন্তু একটু পরেই ধরা পড়ে গেলেন নকলসহ। আরেকজন টিচার যিনি ছিলেন, তিনি মামার পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে বললেন, এই যে আপনার পকেটে নকলÑআপনি নাকি নকল আনেন নি!
লুটুমামা অমনি ফরটি নাইন ডিগ্রিতে চড়ে গিয়ে ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, আপনে তো আইচ্ছা মক্কেল মিয়া, আমার পকেট থেইকা বাইর হইলেই কি আমার নকল? ব্যাক্কল আর কারে কয়, অই মিয়া, সিনেমায় দ্যাহেন নাই, ভিলেন ব্যাডায় নায়িকার বাপেরে ছুরি মাইরা ছুরিডা নায়কের খাডের তলায় রাইখা দিয়া আহে, তহন কি নায়কে খুনি হয়? আমার কি দ্যাশে শত্র“র অভাব পড়ছে নাকি যে, পকেডের ভিতরে একটা কাগজ ফালায় দিয়ো যাওনের লোকের অভাব ঘটব?
টিচারের সঙ্গে এইভাবে কথাÑলুটুমামা এক্সপেল হয়ে যান আর কী!
ইমরান স্যার "আ হা হা, ঠিক আছে, ঠিক আছে" বলে এবারের মতো লুটুমামাকে বাঁচিয়ে দিলেন।
কিন্তু ঐ টিচার তক্কে তক্কে ছিলেন। একটু পরেই লুটুমামার খাতার নিচ থেকে বিশাল বড় এক কাগজ বেরোল।
লুটুমামা আহত সুরে বললেন, আহা, এইডা আবার কী ঘটল! ঠোঙ্গার কাগজ ভাইবা ভাঙ্গাচোরা বেঞ্চে খাতার নিচে রাইখা লিখতে গেলাম, কইত্থেইকা কী হইয়া গেল! ও স্যার, আমি কি ইংরেজি কম পারি যে, নকল করুম?
টিচার লুটুমামার কোনো কথা না শুনেই খাতা নিয়ে গেলেন। মামার অনেক আবেদন-নিবেদন সত্ত্বেও আর খাতা ফেরত দিলেন না। লুটুমামা আরো কয়েকবার চেষ্টা করলেন, বোঝাতে চাইলেন যে, তাঁর মতো ইংরেজি জানা লোক কেন ইংরেজি পরীক্ষায় নকল করবে।
শেষে যখন কিছুতেই বোঝাতে পারলেন না, তখন লুটুমামার রক্ত গরম হয়ে উঠল। তিনি হিমালয়ের মতো দাঁড়িয়ে উঠে তাঁর বিখ্যাত ডায়লগটি দিলেন, জলদগম্ভীর স্বরে বললেন, ইউ ডু নট নো দ্যাট আই নো ইংলিশ, ইফ আই ডু নট নো ইংলিশ, দ্যান হাউ ক্যান আই টক টু ইউ ইংলিশ? দ্যাট ম্যান, হু নো ইংলিশ, হোয়াই হি উইল গো টু কপি ইন ইংলিশ এক্সামিনেশান? আই ক্যান নট সাপোর্ট ইউ, সো আই মাস্ট লিভ ইউ, দিস ইজ মাই সাইলেন্ট--ইয়ে--ইয়ে--প্রতিবাদ!
বলেই মামা ঝড়ের বেগে হল ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন!


মন্তব্য

স্পর্শ এর ছবি

হা হা হা! দারুণ লেখা।
কিন্তু লুটু মামার জন্য খারাপ লাগছে! কেমন আছেন তিনি এখন? নাকি এটা শুধুই গল্প!!
[][][][][][][][][][][][][][][][][][]
ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ, কোরো না পাখা।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

হিমু এর ছবি

কারণ বলা যায় না, দাদা হয়ত অফিস থেকে গরম মাথা নিয়েও ফিরতে পারেন। ফিরে তাঁর যদি মনে থাকে, পরীক্ষার খবর জেনেই হয়ত একটা পোক্ত দেখে লাকড়ি নিয়ে ছুটবেন লুটুমামার খোঁজে। আর লুটুমামার মনেও এ সময় দ্বিধাদ্বন্দ্বের দোলা, দাদাকে লাকড়ি হাতে আসতে দেখলেই দৌড়াবেন, তার আগে না।

লুটুকে কাকা বানানো খুব পরিশ্রমের কাজ, তারচেয়ে দাদা আর দাদিকে নানা আর নানি বানিয়ে দেয়া সহজ। তবে মনে হচ্ছে দাদামশাই আর ঠাকুর্দামশাই কেস।

দুঃখিত, লুটুমামার মতো সাইলেন্ট প্রতিবাদ জানাতে পারলাম না বলে। তবে জাঝা জানাতে ভুলছি না।


হাঁটুপানির জলদস্যু

রণদীপম বসু এর ছবি

দেহেন, যতই গিবত গান না কেন্, লুটুমামারে থামাইতে পারবেন না। কারণ, লুটুমামা জানেন, বহুকাল আগেই শিখছেন- একবার না পারিলে....। হুঁম !

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি

অসাধারণ হইছে।

নুশেরা তাজরীন এর ছবি

আ্যাত্তো মজা !!!

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

সবাইরে ধন্যবাদ ফালতু গল্পটা পড়ার জন্য... এমনিই, হাতে কাজ ছিল না, তাই আপনাদের একটু জ্বালালাম আর কি!
---------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়!

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

মামুন-উর-রশীদ এর ছবি

মাঝে মাঝে এইরকম জালাতন করবেন।

অতিথি লেখক এর ছবি

হ মাঝে মাঝে জ্বালা, লাগে অনেক ভালা।
থামবেন না মৃদুল ভাই চালিয়ে যান।
কীর্তিনাশা

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন হলো?

গম্ভীর মুখে দার্শনিকের ভঙ্গিতে বন্ধুর উত্তর, দোস্ত পরীক্ষা সবসময় ভালো দিই, রেজাল্টটাই শুধু খারাপ হয়ে যায়! দেঁতো হাসি

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

লুটুমামা দরাজ গলায় বললেন, থাক, থাক, বুঝছি, কওন লাগব না। এইডা হইল গিয়া তোমাগোর গণতন্ত্রের সমস্যা। বেবাকেরে একই লাইনে ফালাইবার চাও!

বেশ দার্শনিক কথা বটে! সাইলেন্টলি উড়িয়ে দেয়া কঠিন! মন খারাপ

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।