মদ্য নহে--সুধা! (উৎসর্গ : যাবতীয় সুধাময়দের...)

মৃদুল আহমেদ এর ছবি
লিখেছেন মৃদুল আহমেদ (তারিখ: রবি, ০৮/০৬/২০০৮ - ১১:০৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কে বলে উহা মদ্য? যে উহাকে বলে মদ, সে লোক বদ।
উহা সুধা, উহা অমৃত, উহা প্রাণস্পন্দনসৃজনের অতুলনীয় আরক। শুধুই আরক নহে, কারকও বটে। সম্প্রদান কারক। কেবলই দান করে, নিজের তরে কিছুই রাখে না। চোখে দান করে স্বপ্ন, মনে শান্তি, পেটে সুধা, বুকে বেদনা উপশমকারী আগুন, পায়ে অতুলনীয় ছন্দ আর সমস্ত শরীর জুড়িয়া চমৎকার মাধ্যাকর্ষণহীনতা।
কেবলই দান আর দান। হাজী মহসীনের পর এই একজনই বর্তমান, যাহার আরেক নাম কারণবারি।
সন্ন্যাসী বৈরাগীরা উহার এই নাম রাখিয়াছে। এই নামের সঙ্গত ব্যাখ্যা বোধকরি ইহাই, কারণসহ এবং কারণ ছাড়া--উভয় প্রকারেই উক্ত বারি পান করা হয়।
কৈশোরে আমাদের গ্রামের হারুণ ড্রাইভারকে দেখিয়াছি, লোকে উহাকে বলিত মেদো হারুণ। হারুণ প্রকাশ্যেই গগনবিদারী কণ্ঠে হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিয়া বলিত--আমি পান খাই না কিন্তু পান করি!
তখন তাহার এই কথার অর্থ বুঝিবার মতো যথেষ্ট প্রাপ্তবয়স্ক হইয়াছি। যদিও পান করিবার মতো সৌভাগ্যের অধিকারী তখনও হইয়া উঠি নাই, কিন্তু পান খাইবার কিঞ্চিত্ অভিজ্ঞতা ঘটিয়াছে।
এক গ্রাম্য বিবাহ উৎসবে আমার অপেক্ষা কিঞ্চিৎ অধিক বয়স্কা উদ্দীপক গোছের এক রমণী আমাকে অন্ধকারে টানিয়া লইয়া ব্যাকুল আবেগে চাপিয়া ধরিয়াছিল। তারপর আমার সেই সমস্ত রোমকণ্টকিত শরীরের শক্ত ঘাড়ের ওপর হতবুদ্ধি মস্তকটাকে ঘুরাইয়া আনিয়া মুখগহবরের ভেতর নিজ মুখ হইতে খানিক কী যেন ঠেলিয়া দিয়া বলিয়াছিল--চিবায়া খা! সেইদিন বুঝিয়াছিলাম, পান চিবানোর সুখের পর্যায় কী দরের হইতে পারে। বিবাহভোজের পোলাওমাংস না চিবাইয়া সমগ্র রজনী কেবল ঐরূপ পান চিবাইতেই পরম আগ্রহ অনুভব করিয়াছিলাম।
বয়স্কদেরও দেখিয়াছি কী পরম সুখেই না উহারা পান চিবাইতে থাকে। আরামে দুই চোখ বুঁজিয়া আসে, মুখের সমস্ত কার্যক্রম অটো সিস্টেমে চলিতে থাকে। তাহাদের মুখেও কেহ ঐরূপ পান ঠেলিয়া দেয়াতেই এত সুখ কিনা বলিতে পারি না, কিন্তু দেখায় যেন ঠিক হালের বলদটিÑমধ্যাহ্নের অবসরে পরম আয়াসে জাবর কাটিতেছে। এই "পান খাওয়া" অপেক্ষা "পান করা" যে আরো কীরূপ রোমাঞ্চকর হইতে পারে, সেই দিন তাহা কিছুতেই বুঝি নাই।
আজ বুঝি। সেইদিন পান চিবাইতে গিয়া শরীরের সমস্ত রোমেরা দাঁড়াইয়া গিয়াছিল। আর আজ পান করা তো পরের ব্যাপার, পানের নামমাত্র মাথার চুলগুলি পর্যন্ত ঝাড়–র শলাকার ন্যায় বীরবেশে দাঁড়াইয়া যায়।
কতদিন কত গল্পের বইয়ের কত চরিত্রের মুখে এইরূপ আস্ফালন শুনিয়াছি যে, তাহারা নাকি বোতলের পর বোতল উড়াইয়া দিয়াছে। বোতল কী করিয়া উড়িতে পারে, তখন ভাবিয়া বিস্মিত হইয়াছি। কিন্তু আজ কত ভালোভাবেই না জানি কী করিয়া কী প্রকারে বোতলের ডানা গজায়, আর তাহারা কী করিয়া একের পর এক পাখা মেলিয়া প্রজাপতির ন্যায় উড়িয়া যাইতে থাকে। চারিদিকে উড়িয়া উড়িয়া আরো কত কী কাণ্ড যে করে সে বলিতে গেলে আরেক মহাভারত।
"প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে"--এই গীতবাক্যটির ন্যায় জীবনে একবারই দাগা খাইয়াছিলাম। তারপর দেবদাস সাজিতে বিশেষ বিলম্ব করি নাই। পার্বতী জানুক আর না জানুক, স্বামীগৃহে সুখে থাকিয়া পার্বতী যতই ভারবতী হউক, আমার ওজন ক্রমশ কমাইয়া নিজেকে আকাশে বাতাসে উড়িবার ক্ষমতা দান করিতেছি।
সতত বলিতে গেলে আমি কদাচ পার্বতীকে চাহি নাই। পার্বতীকে পাইলে আর দেবদাস হইতাম কীরূপে? অতি সাধারণ এক পত্নীদাস হইয়া "লা মিজারেবল" উপন্যাসটির মতো আরেক ক্লাসিক ট্র্যাজেডির বিষয়বস্তুতে রূপান্তরিত হইতাম। তাই আমি চিরকাল দেবদাসই থাকিতে চাই, সেই আমাদের সত্যিকারের হিরো।
পরিশেষে কারণসুধার দিব্যি গালিয়াই বলিতেছি, যদি এই হিরো হইতে গিয়া বাড়িগাড়ি বেচিয়া, ঘটিবাটি বন্ধক রাখিয়া, সমস্ত পাওনাদারদিগকে শোকসাগরে ভাসাইয়া পরলোকে আঙ্গুরের রস পান করিতে যাইতে হয়--আমি তাহাতেও পিছপা নহি!


মন্তব্য

মাহবুব লীলেন এর ছবি

মদ্য আমার- পানীয় আমার
ব্রান্ডি আমার- আমার পেগ
কেন গো তোর দাম বাড়িল
লাগলো কেন ডিউটি প্লেগ...

আহারে সজনীকান্তের সেই প্যারডি.....

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

কিঞ্চিত্ তথ্যভ্রান্তি।

প্যারোডিটি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের! আর "মদিরা মঙ্গল" নামের এই প্যারোডিটি ছিলো এরকম:

মদ্য আমার ! পানীয় আমার!
সরাব আমার! আমার Peg!
কেন কোম্পানী নজর দিলো গো?
কেন হলো এই Duty Plague?

ভাই, রাগ করলেন না তো?

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মৌমাছির জীবন কি মধুর? চিন্তিত

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

মাহবুব লীলেন এর ছবি

আরে কী যে বলেন
আমরা নাখাস্তা বাঙাল
মদের নাম শুনলেই টাল হয়ে যাই
তখন গানের নাম শুনলেই মনে হয় সবগুলো রবীন্দ্রনাথের লেখা
কবিতাগুলা জীবনানন্দের
আর প্যারডি সব র/সজনীকান্তদের

০২
মদের আসরেও মাথা ঠিক রেখে যে আপনি জ্ঞানের কথা বললেন
সেজন্য আপনাকে বিশ্ব মদারু উপাধী দিলাম

সবজান্তা এর ছবি

কোনটাই আগে শুনি নাই। আমার অবশ্য শ্রীযুক্ত সত্যেন্দ্রনাথের চেয়ে শ্রীযুক্ত মাহবুব লীলেনের খানাই বেশি ভালো লেগেছে চিন্তিত


অলমিতি বিস্তারেণ

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍@ মাহবুব লীলেন

বিশ্ব মদারু কি বিশ্ব বেহায়া টাইপ কিছু? চিন্তিত

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মৌমাছির জীবন কি মধুর? চিন্তিত

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

ধুসর গোধূলি এর ছবি
মৃদুল আহমেদ এর ছবি

পড়তে পড়তে সজনীকান্ত...
নাকি
মাল খেতে খেতে রজনী ক্লান্ত? দেঁতো হাসি
---------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়!

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

মাহবুব লীলেন এর ছবি

জনীকান্ত তো কমন
সামনে স থাকুক আর র থাকুক

মাল বিষয়ক লেখায় র এর জায়গায় স আর স এর জায়গা র বসানোর স্বাধীনতা থাকেই

ওইটা রজনীকান্তেরও হতে পারে
সজনীকান্তেরও হতে পারে
তবে আমার যে না সে ব্যাপারে একশোভাগ নিশ্চিত

আর মদের দাম বেড়ে যাবার পরে ডিএল রায়ের মদাহুতাশকে ইঙ্গিত করে যে ওই রচনাখানা লেখা হইয়াছিল তাও নিশ্চিত

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

এখানে আমরা শ্রীকান্তের নতুনদার সেই বিখ্যাত ডায়লগটা তুলে ধরতেই পারি... থাক থাক, শ্রী-এর আর দরকার নেই, কান্ততেই চলবে!
---------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়!

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

হো হো হো

স্পর্শ এর ছবি

'পান খাওয়া' আর 'পান করা' কোনটারই তো অভিজ্ঞতা হয়নাই আমার!! মন খারাপ
তবে আপনার গল্প শুনিয়া 'পন করা'র চেয়ে 'পান খাইতে' ইচ্ছা হইসে বেশি! চোখ টিপি যদিও ঘটনা টা একটু ইয়ে! ইয়ে, মানে...
[][][][][][][][][][][][][][][][][][]
ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ, কোরো না পাখা।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি

পাঁচ তারা। পান করিবার উপযোগী লেখা হইয়াছে। গুল্লি জাঝা

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

আর সব বাদ। শুধুই ধন্যবাদ।
---------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়!

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

অসাধারণ !
যে উহাকে বলে মদ, সে লোক বদ...

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

সুমন চৌধুরী এর ছবি
মুজিব মেহদী এর ছবি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'চিরকুমার সভা'র অক্ষয়ের গান স্মরণে রাইখেন।

অক্ষয় গাইছে--
অভয় দাও তো বলি আমার wish কী--
একটি ছটাক সোডার জলে বাকি তিন পোয়া হুইস্কি।

মিশ্রণে কমবেশি হয় যদি হউক, জীবনটা তবু রসে ভরিয়া উঠুক।

................................................................
আমার সমস্ত কৃতকর্মের জন্য দায়ী আমি বটে
তবে সহযোগিতায় ছিল মেঘ : আলতাফ হোসেন

... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
কচুরিপানার নিচে জেগে থাকে ক্রন্দনশীলা সব নদী

হিমু এর ছবি

মদ্য নিয়ে গদ্য
দারুণ! অনবদ্য!
তাই গেলাসে বিয়ার ঢেলে
এই বসেছি সদ্য।


হাঁটুপানির জলদস্যু

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍বীয়ার পান করতে করতে এই গানটি (২ মেগাবাইট) শুনে দেখতে পারেন। আর লিরিকস আছে এখানে হাসি

নতুন সচল এবং পাঠকদের জন্য মদ্যপানের তরিকা চোখ টিপি

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মৌমাছির জীবন কি মধুর? চিন্তিত

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

সুমন চৌধুরী এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

বিস্বাদ পানীয়। না টক, না মিষ্টি, না ঝাল....
-জুলিয়ান সিদ্দিকী

অতিথি লেখক এর ছবি

মৃদুল ভাই, চালিয়ে যান। কেউ যদি মদ্যসুধা পান না করে নেশা করতে চায় তবে তার আপনার লেখা পড়লেই হবে। আপনার লেখনীতেও মদ্যসুধার মতো নেশা মিশে আছে।

কীর্তিনাশা

খেকশিয়াল এর ছবি

(গ্লগ গ্লগ গ্লগ)... হিক! গুল্লি ... (গ্লগ গ্লগ গ্লগ)... হিক! গুল্লিগুল্লিগুল্লি
-----------------------------------------
রাজামশাই বলে উঠলেন, 'পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

বাহ্
অনেক দেরীতে পড়ার কারণে মন্তব্য দিতে সঙ্কোচ হচ্ছিল। না দিয়েও পারা গেল না!

___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

থ্যাঙ্কু
আপনার মন্তব্যটা দেরিতে চোখে পড়ার কারণে জবাব দিতে সঙ্কোচ হচ্ছিল, কিন্তু জবাব না দিয়েও পারা গেল না! দেঁতো হাসি
---------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়!

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।