আপনি কি গান গাইতে পারেন?
আচমকা প্রশ্নে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলাম। ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার কারণ আছে। বন্ধুদের সামনে আমি যতই চালবাজি দেখাই না কেন, কোনো অচেনা আড্ডাতে গেলেই আমি ডাঙ্গার মাছ। তখন ‘নাম কী’ জিজ্ঞেস করলেও প্রথমে একটা ক্যাবলামার্কা হাসি আমার মুখে ফুটে ওঠে, তারপর সামলে নিয়ে খুব চালাক চালাক একটা ভঙ্গিতে চোখ বুঁজে নিজের নামটা গড়গড়িয়ে আবৃত্তি করি। এখানে অবশ্য বেশ খানিকক্ষণ থেকেই গান নিয়ে আলাপ হচ্ছে, কিন্তু মূল বিষয়টা হল, এখানে আসার পর থেকেই একটি মেয়েকে আমি বেশ যতœ নিয়ে লক্ষ করে চলছি। সাধারণ একটা চেহারা, কিন্তু সেই চেহারার কোথায় যেন কী একটা আছে। যেটা বলা মুশকিল, কিন্তু চোখ টেনে নেয়। তার চেহারার সেই বিশেষ জিনিসটা কী আবিষ্কার করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, আর আচমকা সেই মেয়েটিই মাথা ঘুরিয়ে একেবারে আমাকেই প্রশ্ন করে বসেছে!
এবারও সামলে নিয়ে চালাক চালাক ভঙ্গি করে একটা জুতসই কথা বলতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই মেয়েটা হতাশ ভঙ্গিতে মুখ ফিরিয়ে নিল। বলল, যাঃ, আপনিও গান গাইতে পারেন না, তাহলে গায়ে হলুদে গান গাইবে কে?
এখানে অবশ্য গান গাওয়ার লোকের অভাব আছে মনে হল না। কারণ মান্না ভাই নামে একজন আছেন, সে ভদ্রলোক রেডিয়োতে গান করেন। আমি নিজেই দু-একবার তার গান শুনেছি, ভালোই গলা।
সে ভদ্রলোক আমার পাশেই বসে আছেন, তাঁর ঐপাশ থেকে আচমকা নেলি নামের একটি মেয়ে ন্যাকা ন্যাকা গলায় বলে উঠল, ও মা, মান্না থাকতে আবার এই কথা কেন ? আর আমরা তো আছিই ! গায়ে হলুদের গান যে একেবারে সুর-তাল মিলিয়ে গাইতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই!
যে মেয়েটি আমাকে গান গাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করেছিল, তার নাম মুনমুন। সে ঘাড় ঘুরিয়ে পাশের একটি ছেলেকে বিরক্ত গলায় বলল, এই রিপন, যা তো, ঐ মাঠ থেকে কয়েকটা গরু-ছাগল ধরে নিয়ে আয়। ওগুলোও আমাদের সঙ্গে গান গাইবে, সুর-তাল মিলিয়ে গাইতে হবে, এমন তো কোনো কথা নেই!
কেউই কোনো শব্দ করল না। এই বিয়ের আসরে আমি এদের সবার ভেতরে একেবারেই নতুন আদমি, কিন্তু আমিও স্পষ্ট বুঝতে পারছি, এখানে একটা ত্রিভুজ প্রেমের খেলা চলছে। খেলা না বলে লড়াইও বলা যায়। মুনমুন নামের ঐ ঝকঝকে মেয়েটি মান্না ভাইকে পছন্দ করে, খুব সম্ভবত তারা লতায় পাতায় আত্মীয়ও হয়, মান্না ভাইয়েরও বোধহয় তার প্রতি কিছুটা আকর্ষণ আছে, কিন্তু নেলি নামের মেয়েটি এসেই যত গণ্ডগোল বাঁধিয়েছে। অবশ্য নেলিকে দোষ দেয়াও ঠিক নয়, মান্না ভাই নিজেই তাকে এই বাড়িতে বগলদাবা করে নিয়ে এসেছেন।
এখানে আসার পর থেকে আমার কিন্তু মুনমুনকেই সবচেয়ে চোখে পড়েছে। গায়ের রঙ একটু শ্যামলা, চেহারাটা ভারী মিষ্টি। সারা মুখে বেশ একটা মায়া মায়া ভাব মাখানো, আর দুই চোখ খুব শান্ত টলটলে জলের মতো পরিচ্ছন্ন। সেই তুলনায় নেলি মেয়েটা কথা বলে ন্যাকা ন্যাকা সুরে, সবসময় বিশ্রি রকমের হাতাকাটা ব্লাউজ পড়ে, তার শাড়ি পরার কায়দাই এমন যে, যখন তখন নাভিটা প্যাটপ্যাট করে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে। মান্না ভাইকে সে প্রথম থেকেই গলাবন্ধের মতো জড়িয়ে ধরে বসে আছে।
মানুষের পছন্দ বোঝা আসলেই মুশকিল, মান্না ভাইয়ের জায়গায় থাকলে আমি কিন্তু মুনমুনকেই বেছে নিতাম। ঐ নেলি মেয়েটার ভেতরে কোন মধু যে আবি®কৃত হচ্ছে, কে বলতে পারে? সম্ভবত কোনো কোনো পুরুষের ভেতরে বাঘ-সিংহ টাইপের মানসিকতা কাজ করে, মাংসের গন্ধ পেলে তারা আর নড়তে চায় না। নেলি নামের মেয়েটির গায়ে স্পষ্ট মাংসের গন্ধ।
আমি এই বিয়েবাড়িতে এসেছি গতকাল। যে মেয়েটির বিয়ে, সে আমার বন্ধু আসিফের খালাতো বোন। গত রাতে মাত্র এ বাড়িতে এসেছি, আর সকালেই আসিফ আমাকে একগাদা চেনা-অচেনা লোকের মাঝখানে বসিয়ে দিয়ে বলে গেছে, কালকে গায়ে হলুদ, এখানে নানারকম পরিকল্পনা করা হচ্ছে, তুইও পারলে ওদেরকে একটু সাহায্য কর। কিন্তু এখন দেখছি মুনমুন আর নেলির ঠাণ্ডা লড়াই। কিংবা তির্যক সংলাপে পরিপূর্ণ একটি শ্র“তিনাটক।
সকালটা এসবের মধ্য দিয়েই কেটে গেল, বরপক্ষকে কতরকমভাবে নাজেহাল করা যায়, তারই মোটা-চিকন নানা ধরনের পরিকল্পনা। আর নেলি-মুনমুনের ঠাণ্ডা লড়াই।
বেলা বাড়তেই সবাই উঠে পড়ল, আসিফকে পেয়ে আমিও কেটে পড়লাম। বিয়ের অনেকরকম যোগাড়যন্ত্র, আসিফের সঙ্গে আমিও কাজে লেগে পড়লাম। এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করলাম আসিফকে, মুনমুনের ব্যাপারটা কী রে?
আসিফ ভুঁরু তুলে বলল, কোন ব্যাপারটা--ও আচ্ছা, আর বলিস না! ঐ মান্না হারামজাদা কোত্থেকে একটা পেতিœ জুটিয়ে এনেছে। বলল তো অফিসের কলিগ না কী যেন, চেহারা দেখে তো মনে হয় ভাড়া খাটে--যাক গে সেকথা, মুনমুন তো মান্নাকে অনেক আগে থেকেই খানিকটা পছন্দ করে, মান্না বোধহয় তার সঙ্গে একটু প্রেম প্রেম খেলাও খেলেছে। এখন গাধার বাচ্চাটা কোত্থেকে ঐ শাকচুন্নি এনে ছেলে-বুড়ো সবার সামনে ঢলাঢলি করছে, সেটা মুনমুনের ভালো লাগবে কেন?
এর মধ্যে কী হয়েছে জানি না, বিকেলবেলা সিগারেট খেতে ছাদে উঠেছি, দেখি মুনমুন একপাশে উদাস মুখে দাঁড়িয়ে। বাতাসে তার চুল উড়ছে, শাড়ির আঁচল খসে পড়েছে, কিন্তু তার যেন কোনো খেয়ালই নেই। একেবারে বিষণ্ণতার প্রতিমূর্তি। আমাকে দেখেও নি, আমি চুপচাপ সিগারেট টানতে টানতে মুগ্ধ চোখে তার এই বিষণ্ণ সৌন্দর্য উপলব্ধি করলাম। মেয়েটা আসলেই সুন্দর। মান্না একটা বোকার হদ্দ!
সন্ধ্যার দিকে আবার বেরোচ্ছি, দেখি বোকার হদ্দ আর তার প্রেমিকা বারান্দার চেয়ারে বসে। বললাম, চলুন একটু ঘুরে আসি!
মান্না ভাই একটু হেসে বললেন, নাঃ এতক্ষণ তো এই বাগানেই হাঁটলাম। এখন ক্লান্ত হয়ে বসে আছি। আপনারা বরং ঘুরে আসুন গিয়ে।
ও, এই ব্যাপার! এরা বাগানে হাঁটছিল দেখেই মুনমুন ছাদে ওরকম উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ! সেই দৃশ্যের কথা মনে পড়তেই আমার মুনমুনের জন্য একটু মন খারাপ লাগল।
টিনএজ প্রেম খুব সাঙ্ঘাতিক জিনিস, সে অবহেলা সহ্য করে না। সারাদিন চোখের সামনে নিজের প্রেমিককে অন্য একটি মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে দেখলে কেমন লাগে? এগুলো এমন এক ধরনের দুঃখ, যা মানুষ কখনো কাউকে বলতে পারে না!
মেয়েটার সঙ্গে খানিক মজা করে তাকে হাসিয়ে দেয়া যায় না? এত বেশি মন খারাপ করে আছে!
তার পাশে গিয়ে অনায়াসেই এরকম করে শুরু করা যায়--এই যে মেয়ে, আপনি এরকম মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? শুনুন, আপনি আমাকে গান গাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমি কিন্তু সত্যি সত্যি গান গাইতে পারি। অবশ্য সাধারণ গান না, রীতিমতো ভৈরব রাগিণী। অনেকদিন রেওয়াজ করি না, কিন্তু এক সময় খুব ভালো গলা ছিল। যখন গাইতাম, তখন বাড়ির পাশের মাঠ থেকে প্রায়ই দুটো তিনটা গরু দড়ি ছিঁড়ে চোঁ চাঁ দৌড় মারত! গরুর মালিকরা রোজ এসে আমাদের বাসায় নালিশ করে যেত! যদি চান তো সেরকম একটা ভৈরব রাগিণী শোনাতে পারি, শুনতে চান?
কিন্তু এরকম বলতে গেলে যদি আবার অন্য কিছু মনে করে বসে? ও রে বাবা, থাক!
মুনমুনকে অবশ্য আমার কোনো কথা বলাই হল না। দেখা গেল বিয়ের কাজকর্ম নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। বিয়েবাড়িতে সবসময়ই দেখা যায় কোনো না কোনো লোক দৌড়াদৌড়ি করছে, মনে হয় সবাই খুবই ব্যস্ত, আসলে কিন্তু পুরো ধাক্কাটা যায় অল্প কয়টা লোকের ওপর দিয়ে। এরকম পরিস্থিতিতে আমার মতো ভারবাহী বলদ গোছের লোকগুলোকে খুব কাজে লাগে। সে কারণেই আমার ব্যস্ত না হয়ে উপায় ছিল না। তবু মুনমুনের কথা আমার মাথায় সেঁটে ছিল, কিন্তু মেয়েটাকে আর কোথাও দেখলাম না। যদিও মান্না আর নেলিকে দু-একবার দেখলাম, আসিফের ভাষায় "ঢলাঢলি" করে বেড়াতে।
গায়ে হলুদের রাতে মুনমুন আত্মপ্রকাশ করল!
এটাকে আত্মপ্রকাশ ছাড়া আর কিছু বলার কোনো উপায় নেই। সারা সন্ধ্যা কোনো খোঁজ নেই, আমি "অতিথিসেবায় দিব প্রাণ" টাইপের প্রতিজ্ঞা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে কুলকুল করে ঘামছি, হঠাত্ ঘাড় ঘুরিয়েই তাকিয়ে দেখি মুনমুন! দোতলার সিঁড়ি দিয়ে রূপকথার রাজকন্যার মতো হালকা পায়ে নেমে আসছে...
অসম্ভব সুন্দর করে সাজগোজ করেছে, তার দিক থেকে চোখ ফেরানো মুশকিল। অন্তত আমি চোখ ফেরাতে পারছিলাম না, মনে হল বুকটাও একটু একটু কাঁপছে। সুন্দরী মেয়েদের দেখলে আমার এমনিতেই একটু আধটু বুক কেঁপে থাকে, সেটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু আরো একটি নতুন তথ্য আবিষ্কার করলাম... মুনমুন মান্নাকে দেখাবার জন্যই এত সাজগোজ করেছে, সেটা ভেবে একটু একটু মন খারাপ লাগছে!
নিজেকে প্রচণ্ড একটা ধমক দিলাম আমি। হলটা কী, আমি কি আবার মুনমুনের প্রেমে পড়ে গেলাম নাকি? সব্বোনাশ! তাহলে কাণ্ড হবে একটা! একেই তো এখানে ত্রিভুজ প্রেমের খেলা চলছিল, এখন শুরু হবে চতুর্ভুজ প্রেম!
নেলিও সাজগোজ করেছে, কিন্তু মুনমুনের পাশে তাকে লাগছে আক্ষরিক অর্থেই "পেত্নি"র মতো। তবু বোকার বাচ্চা মান্নাটা দেখি ঐদিকেই মজে আছে। মুনমুনের দিকে ভালো করে তাকায়ও নি বোধহয়। গাধা!
রাত প্রায় একটা বাজে। বরপক্ষ চলে গেছে, সবাই কনেকে নিয়ে নাচগান করছে, মান্নাকে দেখি নেলির কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। আসিফ তখনও ব্যস্ত দেখে একাই সিগারেট টানতে চলে এলাম ছাদে। নিচে এত হইহল্লা আর আলো, ছাদটা সেই তুলনায় একেবারে শুনশান, যদিও বেশ জ্যোৎস্না আছে। আসিফের খালা-খালু বেশ রোমান্টিক মনের মানুষ, মেয়ের বিয়ে তারা একেবারে পূর্ণিমার দিনেই ফেলেছেন। দুদিন পরেই পূর্ণিমা, কাজেই চাঁদ এখন যথেষ্ট বড়।
ছাদে উঠেই আমি চমকে গেলাম। মুনমুন রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে।
ও যে এখানে থাকতে পারে, আমার মাথাতেই আসে নি। তাহলে অনেক আগেই চলে আসতাম। এখনও সেই বিকেলবেলার মতো করেই দাঁড়িয়ে আছে, বাতাসে চুল না উড়লে মনে হত যেন কোনো শ্বেতপাথরের মূর্তি।
আমি এগিয়ে গেলাম। হালকা গলায় জিজ্ঞেস করলাম, খুব চমত্কার জ্যোৎস্না, তাই না?
ভেবেছিলাম, মেয়েটা বোধহয় চমকে উঠবে। কিন্তু মুনমুন আস্তে করে একবার তাকাল মাত্র, তারপর আবার ঘাড় ঘুরিয়ে নিল। কোনো কথা বলল না।
আমি গলাটা একটু কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিলাম। ওকে সুন্দর করে কিছু কথা বলা উচিত। যেগুলো দুপুরে আমার বলতে ইচ্ছে করেছিল। একটু গুছিয়ে বললে খুব কি খারাপ শোনাবে?
বললাম, দেখুন, আমি কিন্তু পুরো ব্যাপারটা জানি। আপনি শুধু শুধু মন খারাপ করছেন। আপনার জন্য নিশ্চয় অনেক সুন্দর কোনো মন অপেক্ষা করে আছে, কারণ আপনি নিজে খুব ভালো মানুষ, আর আপনি--আপনি, ইয়ে মানে অবশ্যই খুব সুন্দর!
কথাগুলো বলেই একেবারে লজ্জায় মরে গেলাম। আহা, কী ভাষা! যেন অতি আধুনিক প্যাকেজ নাটকের সংলাপ! আমি যেরকম গাধা, আমার কথাবার্তাও গাধার মতোই!
ঢোক গিলে একটু ঘাড় চুলকালাম, মিনমিন করে আবার বললাম, কাজেই আপনি শুধু শুধু মন খারাপ করছেন!
তাকিয়ে দেখি, মুনমুন আমার দিকে কেমন অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে। তারপর আবার সামনের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। আমি একটু শঙ্কিত হয়ে উঠলাম, মেয়েটা রেগে গেল না তো আবার!
কিন্তু চাঁদের হালকা আলোতে দেখতে পেলাম ওর ঠোঁটের কোনায় অল্প অল্প হাসি, তারপর হঠাত্ আমাকে চমকে দিয়ে একেবারে হো হো করে হেসে উঠল!
আমি একটু লজ্জা পেলেও আবার সামলে নিলাম। বরাবরের মতোই। বললাম, এই যে আপনি এখন মহাসুখে হাসছেন। কাজেই আমার ডিউটি শেষ, এবার আমি আসি!
মুনমুন হাসতে হাসতেই বলল, ডিউটি শেষ?
আমার দিকে হাসি হাসি মুখেই তাকিয়ে বলল, সারাদিন ডিউটি দেবার পরও আপনার এত এনার্জি? এই রাতের অন্ধকারে ছাদেও ডিউটি দিতে এসেছেন?
আমি একটু অপ্রস্তুত বোধ করলাম। মুনমুনের গলায় কি ব্যঙ্গের সুর?
হয়ত মনে করছে, এই অন্ধকারে সবার ব্যস্ততার সুযোগে তার পেছনে পেছনে আমি ছাদে উঠে এসেছি। এরকম থাকেই তো কিছু ছেলে, মেয়েদের পিছনে ছোঁক ছোঁক করা অভ্যাস। একটু পরেই হয়ত ভাসা ভাসা রোমান্টিক কিছু কথা বলা শুরু করব। তার খানিক বাদে হয়ত বলেও ফেলতে পারি, যদি কিছু মনে না করেন, এই জ্যোৎস্নাভরা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আমি কি আপনার হাতটা একটু ধরতে পারি?
একটা অপরিচিত ছেলে আচমকা এরকম মিষ্টি মিষ্টি কিছু কথা বলতে এলে একটা মেয়ের এরকম মনে করাই তো সবচে স্বাভাবিক, তাই না?
কিন্তু আমার ঠিক কেন যেন ভালো লাগল না। মনে হল, মেয়েটি এই মুহূর্তে একটু বেহিসেবি হলেও পারত, অকারণেই একটু বিশ্বাস করে ফেলতে পারত একটা মানুষকে! সবাই কি আর একরকম হয়? সব বিশ্বাস কি জলের স্রোতে নিষ্ফলা ভেসে যায়?
আমি একটু কাষ্ঠহাসি হেসে বললাম, আমি খানিকটা বেকুব কিসিমের মানুষ তো, বেকুবদের এনার্জি একটু বেশিই হয়। ছাদে এসেছিলাম সিগারেট টানতে, আপনি মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছেন দেখে হঠাৎ করেই একটু ডিউটি দেয়ার ইচ্ছা হল। আপনার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আমার কথা বলা উচিত হয় নি, তাই না? আমি সত্যি খুবই দুঃখিত, আশা করি আপনি কিছু মনে করবেন না!
মুখ না ফিরিয়েই মুনমুন গম্ভীর গলায় বলল, ব্যাপারটা সবাই কমবেশি জানে, এর আর ব্যক্তিগত সমাজগত কী!
বিরক্তিতে এবং অপরিচিত এক ধরনের অপমানবোধে আমার চোখ কেমন জ্বালা করছিল। আমি আসলেই একটা বেকুব, কোনো অচেনা মেয়ের সঙ্গে নিশ্চয় শুরুতেই এভাবে তার একান্ত ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে যাওয়া উচিত না। যদিও এই মেয়েটি কাছে আমি সরলভাবেই কিছু কথা বলতে এসেছিলাম, কিন্তু মেয়েটি আমার সেই সরলতা বুঝতে যাবে কেন?
বললাম, আমি বরং এখন নিচে ফিরে যাই?
মুনমুন আমার দিকে ফিরে তাকাল। এবং তাকিয়েই রইল। তার সারা মুখে মায়া মাখানো, চোখ দুটো কান্না কান্না। দেখলাম, হঠাৎ করেই তার গলার আওয়াজ বদলে গেছে, কেমন ভেজা অদ্ভুত গলায় বলল, এখনই নেমে যেতে চান?
তারপর আবার সামনের দিকে ফিরে খানিকক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, আপনি তো এই কালকে এসেছেন, আপনি কতকিছুই জানেন না। আপনার সঙ্গে তো বোধহয় এই বিয়ের পর আর কোনোদিন দেখাও হবে না। আপনাকেই বলি, জানেন, মান্না আমাকে একদিন বলেছিল, সে আমাকে তার জীবনের সেরা গানটা গেয়ে শোনাবে! কিন্তু, এখন তো জানি, সে আমাকে কোনোদিনই গান শোনাতে আসবে না। এরকম হয় কেন মানুষ? আচ্ছা, আপনি, আপনি আমাকে বলুন তো, ঐ নেলি নামের মেয়েটি কি আমার থেকে অনেক বেশি সুন্দর?
চাঁদের আলোয় দেখলাম এই এতক্ষণে মুনমুনের চোখ দিয়ে প্রথম জলের ফোঁটাটি নেমে এল।
আমি সঙ্গে সঙ্গেই আবিষ্কার করলাম, এই মেয়েটির কোন জিনিসটা প্রথম থেকেই আমার দৃষ্টি কেড়ে নিচ্ছিল।
মুনমুনের চোখ।
কিছু কিছু বিদেশি আঁকা ছবিতে আমরা দেখি না, একটি মেয়ের চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে একফোঁটা জল? ঐ ছোট্ট একফোঁটা জলটুকু ছাড়া তার চোখ যে কোনো সাধারণ চোখের মতোই সাধারণ সুন্দর। মুনমুনের চোখ দুটোও সেরকম, যেন কোনো এক নির্জন ভোরে পাহাড়ের সবুজ ফাটল থেকে বেরিয়ে এসেছে ছোট এক ঝর্ণা!
আমি খুব যত্ন করে পরিষ্কার গলায় বললাম, মুনমুন, আপনি সুন্দর। আপনি অসাধারণ সুন্দর। এখন স্বীকার করতে লজ্জা নেই, আমি এখানে আসার পর থেকেই আপনার দিকে বারবার ফিরে তাকিয়েছি। নেলি নামের মেয়েটি আপনার নখের যোগ্যও নয়!
মুনমুন চোখ নামিয়ে ঝরঝর করে কাঁদতে কাঁদতেই হেসে ফেলল। চোখ মুছে হাসতে হাসতে বলল, আপনি আসলেই খুব ভালোমানুষ। আমি কিন্তু আসিফ ভাইয়ের কাছে আপনার গানের গল্প শুনেছি। আমি জানি আপনি বেশ ভালো গান জানেন, আমাকে এক্ষুনি একটা গান না শোনালে কিন্তু আপনার ডিউটি শেষ হচ্ছে না!
আমিও হাসলাম। কখনো গান শোনাবার প্রস্তাব উঠলেই একটু ওজর আপত্তি করা নিয়ম। গাইতে বললে একবারেই রাজি হয়ে যাওয়া দুর্বল চরিত্রের গায়কের লক্ষণ। আর তার মধ্যে কতদিন গান গাই না, রেওয়াজ-টেওয়াজ সবই তো কবে চুলায় গেছে! একটু একটু লজ্জা লাগছে, কারণ অনুভব করছি, তারপরও মেয়েটিকে আমার এক্ষুনি গান শোনাতে ইচ্ছা করছে!
সেই আকাশভাসা জ্যোৎস্নার নিচে, নির্জন ছাদে, একটি সদ্য পরিচিত দুঃখিত কিশোরীর সামনে দাঁড়িয়ে আমি অনেকদিন পর গান গাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। কোথায় আমার সেই অতি সাধের চিরপুরাতন গানের গলা, আরেকটিবার, অন্তত আরেকটিবার ফিরে এস আমার কাছে!
গান ধরলাম, চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙ্গেছে, উছলে পড়ে আলো, ও রজনীগন্ধা, তোমার গন্ধসুধা ঢালো...
বহুদিন পর গাইছি, গলায় সেই আগেকার মতো জোর নেই, রেওয়াজের অভাবে গলার মিষ্টিভাবটুকু কমে গেছে, কিন্তু মনে হল বেশ প্রাণ খুলেই গাইতে পারছি। মুনমুন সেই আগের মতোই তাকিয়ে আছে। কী আছে ওর চোখের ভেতর?
আমার মনে হতে লাগল, গানের সুর যেন আমার গলা থেকে নয়, ভেতরের কোনো খুব গভীর একটা জায়গা থেকে বের হয়ে আসছে। আশ্চর্য অনুভূতি! বিখ্যাত যেসব গান শুনে আমাদের আবেগে নাড়া লাগে, সেগুলো গাওয়ার সময় নিশ্চয় গায়কদের অবস্থা এরকমই হয়!
মানুষের চোখের এবং মনের কিছু নিজস্ব ভাষা আছে, কোনো কোনো সময় হয়ত সেই ভাষার সামনে মুখের ভাষা সাময়িকভাবে প্রয়োজন হারায়। আমার মনে হল, এখন আমি মুনমুনের চোখের ভাষা স্পষ্ট পড়তে পারছি। ওর মনের আকুতিগুলো সব আমার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে। আমি এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছি, আমার সামনের মানুষটি আমার কাছে কী চায়। সে চায় তার নিজের হাতটি বাড়িয়ে আমার হাত স্পর্শ করতে, ঠিক যেভাবে সে তার আকাক্সক্ষার পুরুষটির হাতে হাত রাখতে চেয়েছিল! তার প্রত্যাখ্যাত হাত যন্ত্রণা উপশমের জন্য এখন প্রায় অপরিচিত এক পুরুষের আঙ্গুল ছুঁয়ে শুষে নিতে চাইছে উত্তাপ!
যার সঙ্গে তার হয়ত আর কোনোদিন দেখাও হবে না!
রাখ মেয়ে, এক্ষুনি হাত রাখ! ছুঁয়ে দেখ, এই পৃথিবীর সব পুরুষই মাংসাশী নয়, কারো কারো হাতে শুধুই রজনীগন্ধার ঘ্রাণ!
মন্তব্য
দারুণ লিখেছেন। গল্প, নাকি সত্যি??
আমি অবশ্য আপনার মত ভাল মানুষ না!
ইংলিশ মুভি বেশি দেখায় মনে হয় এই অবস্থা হয়েছে আমার। আপনার মত ওইরকম ছাদে উঠলে হাত ধরার পর একটা কি.......
....................................................................................
অতঃপর ফুটে যাবার ঠিক আগে হীরক খন্ডটা বুঝলো, সে আসলে ছিল একটা মামুলি বুদবুদ!
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
এ প্রসঙ্গে জনৈক ক্ষুদ্রকবি জি এম তানিম বলিয়াছেন,
"আমার উড়াল উদাস মন-
প্রেম ও কামনা সম্পৃক্ত দ্রবণ।"
----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।
-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।
হুম এমনিতে তো স্বীকারই করতে চাউ না !! এখন রীতিমত সম্পৃক্ত দ্রবণ নিয়া হাজির !!
....................................................................................
অতঃপর ফুটে যাবার ঠিক আগে হীরক খন্ডটা বুঝলো, সে আসলে ছিল একটা মামুলি বুদবুদ!
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
"... কিংবা ... সংলাপে পরিপূর্ণ একটি শ্র“তিনাটক"
Felt just like that. sorry Mridul vai, Bangla's not working...
ভাল লাগলো খুবই। তবে বেশি বেশি ভালমানুষি দেখাবেন না আর। এই আপনাদের মত ভদ্রলোকের জন্যই আমার মত প্রাণিকে একলা থাকতে হয়!!
"ক্যাটেগরী: গল্প | অপ্রকাশিত গল্প " দেখে ধারণা করা যায় এটা মৃদুল ভাইয়ের লেখা অপ্রকাশিত গল্প । তবে বস আপনার চমতকার সব লেখা আমার মতো সাধারণ পাঠকের প্রত্যাশা অনেক অনেক উপরে নিয়ে গেছে বলেই হয়তো এই লেখাটা তেমন ভালো লাগেনি। আপনার অনেকগুলো দুর্দান্ত গল্প পড়ে যে জিনিসটা খেয়াল করেছি তা হলো হঠাত্ পাঠককে চমকে দেয়া । কিন্তু কেন জানি এই গল্পটা অনেক বেশী সরলই মনে হয়েছে । এটা নিতান্তই আমার মতামত । সব লেখাই যে একই হতে হবে তাও কিন্তু না । নিম্ন গ্রেডের পাঠক হওয়ার পরও আপনার লেখার দুর্ধর্ষ শক্তি সম্পর্কে জানি বলেই এই মন্তব্য করার দু:সাহস দেখালাম ।
শুভ কামনা আপনার জন্য ।
একটা সুন্দর শান্ত গল্প। ভালো লাগলো।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
উদ্ধৃতি
এই পৃথিবীর সব পুরুষই মাংসাশী নয়,...
এই প্রসঙ্গে একটি সহজ মন্তব্য- তাইলে ক্যামনে কি? সেই পুরুষরে কি কয়?
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
বস এদিক দিয়ে হাঁটাহাঁটি করছে, তাও একটু একটু করে পড়ে ফেললাম লুকিয়ে লুকিয়ে। সুন্দর গল্প। ধন্যবাদ।
কি সুন্দর মিষ্টি একটা গল্প !
মন ভালো হয়ে গেলো।
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
অসাধারণ!!! ৫ তারা
শুধু টিনএজ না কোনও মেয়েই কি অবহেলা সহ্য করতে পারে??
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে
দারুণ গল্প। এই প্রথম আপনার একটা গদ্য পড়লাম। সময় পাই কম। গল্পটা জমিয়েছেন বেশ।
জিজ্ঞাসু
অসাধারণ! গল্পটা যতটা না লম্বা, তারচেয়ে কয়েকগুণ বেশি সুন্দর খুব ভাল লাগল।
আমি কিন্তু আকতার ভাইয়ের সাথে একমত...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
আমিও আকতার ভাই এবং নজরুল ভাইয়ের সঙ্গে একমত। গল্পটা বহু আগে লেখা, যখন একটু সেকটু লেখালেখি শুরু করেছি, তখনকার গল্প। আনাড়িপনা তখনো আমাকে ছেড়ে যায় নি। এই গল্পটা সেই সময়কার লেখা। গল্পটার প্রতি আমার কোনো মায় নেই, কিন্তু সেই সময়কার অর্বাচীন আমির প্রতি আমার একটু মায়া আছে। বেচারা! লেখক হবার কী স্বপ্নই না দেখত! সেই সময়টাকে ধরে রাখতে চেয়েছি! তাই গল্পটাকে তুলে দিয়েছি ঠিক যেরকম ছিল, সেরকমই। এই ধরনের প্লট নিয়ে এখন আর লিখিই না!
আর... এটা একটা টেস্টও বলতে পারেন, দেখলাম, মৃদুলের লেখা আসলেই সবাই মনোযোগ দিয়ে পড়ে, নাকি ভালোবাসা থেকেই পাঁচতারা দিয়ে দেয়... হা হা হা! আমি সফল!
সবাই ভালোবাসা থেকেই পড়ে, কিন্তু লেখার মান নামলে সচেতন করে দেয়, এই ফলাফলটাই বুঝতে পারলাম! অনেক ধন্যবাদ! এখন থেকে আরো মনোযোগী হয়ে লেখার চেষ্টা করব!
---------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়!
--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'
নতুন মন্তব্য করুন