না রে স্বদেশ,
এখন থেকে তোর সাথে আর একটুও মিশব না...
খেলার মাঠে দেখা হলে মুখ ঘুরিয়ে নেব,
তুই কাঁধে হাত রাখলে ঝটকা মেরে সরিয়ে দেব সেই হাত...
তোর মতো বন্ধু একদম দরকার নেই আমার!
তোকে ছাড়াই তো আমি দিব্যি আছি!
দিন তো বেশ কেটে যাচ্ছে আমার
দুপুরের টেবিলে চারশো টাকা কেজি চিংড়ির মালাইকারি খেয়ে,
রাতের টিভিতে দুর্দান্ত অ্যাকশন মুভি আর
সকালের চায়ের কাপে পেপার ভর্তি অপরিচিত মানুষের দুর্গতিতে চোখ বুলিয়ে...
শুধু তোর... তোর চোখের দিকে তাকালেই আমার গলা শুকিয়ে আসে,
কতদিন না ঘুমানো ক্লান্তকালো তোর দুটো চোখ,
কত কী কথা আছে তাতে,
আমি জানি, বহুদিন হাঁড়ি চড়ে না তোদের বাড়িতে,
শেষ কবে পেট পুরে ভাত খেয়েছিস সেটা ইতিহাস,
আমি জানি, সবাইকে লুকিয়ে তুই স্টেশনে কুলিগিরি করিস,
লোকজন কম থাকলে হাত পেতে ভিক্ষে...
রেলের জানালা দিয়ে বাড়ানো পরিচ্ছন্ন হাত থেকে দু-টাকার নোট নিতে নিতে
তুই কৃতার্থ হেসে আচমকা আমার দিকে তাকিয়ে ধরা পড়ে চমকে উঠেছিলি...
এখনো ভয় পাস তুই? এখনো লজ্জা? হায় রে স্বদেশ...
সুতো ওঠা জামা আর ধুলোভরা পা নিয়ে তুই আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকিস
ঠিক যেন সার্কাসের ক্লাউন...
তোর হতক্লান্ত মুখে মামড়ি ফাটা ঠোঁটের হাসি দেখে আমার ঘেন্না আসা উচিত,
তবু তোকে দেখলেই বুক হুহু করা কান্না উঠে আসে আমার...
না রে স্বদেশ, তোর সাথে আমি আর একটুও মিশব না...
তোদের বাড়িতে যাওয়াই ভুল হয়েছিল আমার,
ভাঙা, বিবর্ণ, নোংরা এক বাড়ি... এখানে মানুষ থাকে?
জানি তোরা এককালে সম্পন্ন ছিলি, ছিল ধানের গোলা পুকুরে মাছ,
তোর দূর সম্পর্কের জ্যাঠা দুর্নীতি রায় আইনের মারপ্যাঁচে
সব চুরি করে নিয়ে তোদের নিঃস্ব করে গেছে...
তোর বাবা অভাবীনাথ তরফদার সেই আঘাতেই বুঝি আজও শয্যাশায়ী?
দেখেছিলাম তাকে তোদের ঘরে, তেলাপোকার কুৎসিত গন্ধ আর আলোহীন আসবাবহীন,
কঙ্কালসার মাকড়সা হাতে তোর বাবা আমার হাত আঁকড়ে ধরলেন...
বললেন, ভাত দে, ভাত দে আমার মুখে!
এই শরীরেই এত খিদে মানুষটার,
কুকুরের মতো সারাদিন নাকি চেঁচান, ভাত দে, ভাত দে আমার মুখে!
আর তোরা অপেক্ষায় আছিস কবে মানুষটার মৃত মুখে আগুন ঠেসে দিতে পারবি!
তোর মা, যাকে আমি ডাকি মুক্তিমাসিমা, তিনি আমাকে
রান্নাঘরে ডেকে কাঁসার থালে দুটো নাড়ু খেতে দিয়েছিলেন
কোনো এক অজ্ঞাত কৌটা থেকে, যেটা সবার নজর থেকে বাঁচিয়ে রাখা,
তোর ভাই জীবন উঠান থেকে সেই নাড়ুর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চাটছিল,
মুক্তিমাসিমার কোলে তোর দু-বছরের বোন স্বপ্নারাণীও জুলজুলে চোখে তাকাচ্ছিল সেদিকে...
তার ভেতরেই মাসিমা হাতপাখা দিয়ে বাতাস দিতে দিতে
আমাকে বললেন, খাও বাবা, বাড়ির অতিথি তুমি! কিছু মুখে না দিলে অলক্ষ্মী!
তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি চমকে উঠেছিলাম,
নিয়তির অদৃশ্য চাবুকে ফালা ফালা করে করে কাটা সেই মুখের ভেতরেই
সে কী সকরুণ এক হাসি!
তোদের বাড়িতে লক্ষ্মী বয়ে আনতে একটা নাড়ু আমি দাঁতে কেটেছিলাম...
কৌটার ভ্যাপসা গন্ধমাখা বাসী সেই নাড়ু খেতে খেতে শুনছিলাম
তোর ভাই আর বোনের বড় বড় শ্বাস টানার আওয়াজ!
স্বদেশ, নাড়ুটা ওরা খেলেই তো পারত!
আমি খাবার পরও তো কোনো লক্ষ্মী এল না তোদের বাড়িতে!
তোদের বাড়িতে আর যাব না স্বদেশ, মিশবও না তোর সাথে!
তোকে দেখলেই আমার সব কথা মনে পড়ে যায়...
তোকে দেখলেই আমার বুক ঠেলে আসে হুহু করা কান্না,
তোকে দেখলেই আমি আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারি না!
আর কাছে আসিস না স্বদেশ... কেন কুকুরের মতো পায়ে পায়ে ঘুরিস?
কেন নোংরা হাতে ছুঁতে চাস বার বার?
কী বললি? আমি তোর ভাইয়ের মতো?
থুথু দেই তোর মুখে! কিসের সাথে কিসের তুলনা!
তোর ভাই জীবন নাড়ুর লোভে ঠোঁট চাটতে চাটতে অনাহারে মরে শুকিয়ে আছে তোদের উঠানে,
তার ঠোঁটে বসে আছে একগাদা নীল নীল মাছি...
আর আমার ঠোঁটে প্রেমের কবিতা, মধুর সঙ্গীত, লাসভেগাসের পশ্চিমি গল্প...
দূর হ স্বদেশ হারামজাদা আমার চোখের সামনে থেকে!
মন্তব্য
মন্তব্য করার সাহস পাচ্ছি না
রাফি
আপনার হাতটা দিন মৃদুল, আমি একটু ধরে চুপ করে বসে থাকি..
---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
ঠিকাসে...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
অদ্ভুত লিখছেন বস ! মন্তব্য করার ভাষা খুঁজে পাইতেছিনা । আপনারে স্যালুট
কবিতার পাঠক বা বোদ্ধা বলতে যা বোঝায় তা আমি নই নিঃসন্দেহে। তবুও সাহস করে এটুকু অন্তত বলতে পারি, সচলায়তনে আজ অবধি যত কবিতা পড়েছি নিঃসন্দেহে তার মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ এটি। কবিতার ভাব এবং ভাষায় হৃদয়কে ছুঁয়ে গিয়েছে।
আপনাকে অভিনন্দন এত চমৎকার একটা লেখার জন্য।
অলমিতি বিস্তারেণ
অলমিতি বিস্তারেণ
কিছু বলার ভাষা নেই, সবই বলে দিয়েছেন
লাল সালাম মৃদুলদা
-----------------------------------------
রাজামশাই বলে উঠলেন, 'পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?'
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
সচলে আজ অনেক মনকে ভারাক্রান্ত করে দেয়া লেখা।
ভয় লাগে এইসব সত্যকে দেখতে খোলা চোখে।
তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
বেশ ভালো কবিতা। একটু আবেগী..
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
এরকম কিছু পড়ে মন্তব্য করার আসলে কিছু থাকে না। চুপচাপ বসে আবেগে কাঁপতে হয়।
মৃদুল ভাই আপনার এ লেখা কবিতা হিসেবে কতটা শুদ্ধ জানিনা। তবে এর অন্তর্নিহিত আবেগ প্রচন্ড নাড়া দিয়ে যায় সমস্ত অনুভবে।
------------------------------
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে !
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
ধন্যবাদ সবাইকে। কবিতাটা লিখেছি একটানে, বুকের ভেতর আগলভাঙ্গা কথাকে সামলাতে পারি নি। সাহিত্যমান এখানে কতটুকু আছে জানি না, শুধু জানি যেটা আছে, সেটা অক্ষম মানুষের দুঃখ।
আমার আবেগটুকু সবাইকে স্পর্শ করেছে দেখে ভালো লাগল!
---------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়!
--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'
ধুররর মৃদুল! এসব মন খারাপ টারাপ ভাল্লাগছে না একটুও!
এবার একটা মন ভালো করা কিছু লিখুন। স্বদেশ নিয়েই নাহয়?
মৃদুল এই লেখাটার জন্যে বলো তুমি কি চাও আমার কাছে?
যা চাইবা তা-ই পাইবা। সঙ্গে বোনাস-হাজির বিরিয়ানী টানা সাতদিন ফ্রি। যতো খাইতে পারো।
হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!
এমন দুর্দান্ত একটা কবিতা না লিখতে পারার কষ্ট আমাকে তাড়া করবে আজীবন । কারণ রিটন ভাই যদি আমাকে এরকম একটা সুযোগ দিত .. তাহলে আমি চাইতাম "ছোটদের কাগজ" আবার ফিরে আসুক !
চোখে পানি এসে গেল!
====================================
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
=====================================
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
.....
কি অসাধারণ লিখেছেন মৃদুল। সুমনের লাইনগুলো মনে পড়ে গেল...
এঁকোনা কখনো স্বদেশের মুখ, তোবড়ানো গাল ভেংগে যাওয়া বুক...
++++++++++++++
ভাষা হোক উন্মুক্ত
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
বাপরে, কী কবিতা! কী কবিতা!
অনেকদিন পর আবার চোখে পড়ল...
আবারো স্যালুট ঠুকলাম।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
অদ্ভুত সুন্দর। খুব ভালো লাগলো।
নতুন মন্তব্য করুন