বৃষ্টি নেমেছে চারদিক ছাপিয়ে।
কানে তালা লেগে যায় ঝমঝম শব্দে। কাছেই কাদের যেন একটা বাড়ি আছে টিনের চালের।
বড় ভালো লাগল এমন একটা বাড়ি কাছেই ছিল দেখে। মন থেকে আশীর্বাদ করলাম সেই বাড়ির মানুষদের... তোমরা না থাকলে কোথায় পেতাম পুরনো দিনের এত আপন এক আওয়াজ?
মেঘের ছায়ায় কাকের গলার মতো নীলচে কালো রঙে ছেয়ে আছে চারদিক। মাটিভেজা সোঁদা গন্ধে ভরে গেছে চারপাশ। সেই আশ্চর্য পবিত্র ঘ্রাণ প্রাণভরে টানছে আমার ফুসফুস। হিম বাতাসে কাঁটা দিয়ে উঠেছে আমার শরীর। আহ কী প্রশান্তি!
কতদিনের ক্লান্তি আর যত না পাওয়ার ব্যর্থতা যেন ধুয়েমুছে গেল একসাথে।
যত ধুলো, যত কালো ধোঁয়া, যত তামাক পোড়া বাতাস জমে ছিল বুকের ভেতর, বা তার চাইতে আরো বেশি কিছু... হেরে যাওয়ার আর মাথা নিচু করে প্রতিদিনের ক্লান্ত জীবনে ঝাঁপ দেয়ার যত গ্লানি, যত বিষণ্ণ বাষ্প... সব যেন উড়ে মিশে গেল হাওয়ায়!
কী শান্তি! কী অদ্ভুত শান্তি!
চোখ বুঁজে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি জানালার গ্রিল ধরে। আমার মুখে ছিটকে এসে লাগছে বৃষ্টির ঝাপটা।
বৃষ্টির এই ঘ্রাণের ভেতরেও আরো কী যেন একটা মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছি আমি। কিসের গন্ধ তা, কোথাকার, কবেকার যেন... বড় চেনা, বড় আপন, বড় ভালোবাসার...
কোনো ফুলের কি? জানি না, কিন্তু বুঁজে থাকা চোখেই আমার মনে হল, ফুলে নয়, মাটিতে নয়, এই পৃথিবীর কোনো অদ্ভুত বাতাসে নয়, এই গন্ধ ভেসে আসছে কোনো এক নদীর ওপার থেকে, যে নদী কোনোদিন দেখা হয় নি আমার... আশ্চর্য সেই পারে শুধুই স্বপ্নের বাতাসে খেলা করে ফেরে শৈশবের ধুলো...
চোখ খুললাম আমি। জানালা দিয়ে নিচে তাকাতেই দেখি, বাড়ির আঙিনায় পানি জমেছে। আর তাতে কাগজের নৌকা ভাসিয়ে দিচ্ছে বাচ্চা একটি মেয়ে। ফ্রক পরা, মাথার পেছনে ছোট্ট দুটো বেণী। নৌকা ভাসাতে ভাসাতেই মেয়েটি তাকাল ওপরের দিকে। হাসল আমার দিকে তাকিয়ে, তারপর হাত নাড়িয়ে চেঁচিয়ে ডাকল আমাকে... আয় রে... তাড়াতাড়ি নিচে আয়... আরো অনেক নৌকা ভাসাব...
আমি হাসলাম। বড় সুখের হাসি, বড় তৃপ্তি মিশে আছে সেই হাসিতে।
জানতাম আমি। জানতাম পৃথিবীর দরজা খুলে যাবে এভাবেই।
সেই দরজা খোলার সোনার চাবিটি তো সবসময় থাকত আমার সাথেই... তারপর বড় হতে হতে একদিন কোনসময় যেন হারিয়েও ফেললাম... তাকিয়ে দেখারও সময় পেলাম না... এত ব্যস্ত, এত হাস্যকর ব্যস্ত ছিলাম কত তুচ্ছ জিনিস নিয়ে...
আমার পিঠোপিঠি বড় বোনটির সঙ্গে কথা হয় না কতদিন! কাজের চাপে, সংসারের জটিলতায়, কত সামান্য কারণে আমরা একজন আরেকজনের কাছ থেকে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছি... দূর থেকে দূরে...
কিন্তু আজ, এখন সে ঐ তো দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। সেই ছোটবেলার মতোই। ঐ যে হাতে নৌকা তার। ভাসিয়ে দিচ্ছে বর্ষার জমে ওঠা বুনো জলে... আর ডাকছে আমাকে... আয় রে আয়... আরো অনেক নৌকা... আমরা ভাসাব... তুই আর আমি মিলে... অনেক মজা হবে... আয় রে... আর কত দূরে থাকবি... আয় রে নিচে নেমে আয়... এত ওপরে বসে আছিস কেন... নেমে আয়...
বৃষ্টির মিষ্টি জলের ঝাপটায় ধুয়ে যাচ্ছে আমার চোখের নোনা জল... আমি অস্ফূটে বললাম, আসছি আমি... আসছি...
মন্তব্য
আহ্, দেশের সেই ঝম্ঝম্ বৃষ্টি !
আপনি, যদিও সব্যসাচী লিখিয়ে, তবু দয়া করে একটু হাসিখুশীতেই যদি আটকে থাকতেন! কারণ, এরকম লেখা পড়লে প্রভাবিত না হয়ে তো উপায় নেই? আর এইসব কষ্ট কষ্ট সুখ দুঃখগুলো তারপর বড্ডই বিরক্ত করে ......
দেশের বৃষ্টি মানেই কেমন প্রশান্তি আর এখানে-আস্ত যন্ত্রনা...
তবু প্রশান্তিময় বৃষ্টিতে আর ভেজা হয়না ।
-------------------------------------
বালক জেনেছে কতোটা পথ গেলে ফেরার পথ নেই,
-ছিলো না কোন কালে;
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
বুঁজে থাকা চোখেই আমার মনে হল, ফুলে নয়, মাটিতে নয়, এই পৃথিবীর কোনো অদ্ভুত বাতাসে নয়, এই গন্ধ ভেসে আসছে কোনো এক নদীর ওপার থেকে, যে নদী কোনোদিন দেখা হয় নি আমার... আশ্চর্য সেই পারে শুধুই স্বপ্নের বাতাসে খেলা করে ফেরে শৈশবের ধুলো...
... ...
---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
নতুন মন্তব্য করুন