নাদেরালির স্বাস্থ্যটি বড়ই মজবুত। মেদ আর পেশির এমন সুচারু সহাবস্থান সচরাচর চোখে পড়ে না। ঢোলা সাদা প্যান্টের ওপর ফুলছাপা শার্ট চাপাইয়া কলার উঁচু করিয়া নতুন জুতা মসমসাইয়া সে যখন শহরের পথে হাঁটিতে বাহির হয়, তখন ষোড়শী, অষ্টাদশী হইতে শুরু করিয়া সপ্তচল্লিশা, পঞ্চান্নবর্তিনীরা পর্যন্ত চোখ ঘুরাইয়া ফিরিয়া ফিরিয়া চাহে। ইস্কুলগামী বালক-বালিকা যেইরূপ পণ্ডিতমশাইয়ের আশু কানমলার কথা স্মরণ করিয়া ইষ্টনাম জপিতে জপিতেও পথিমধ্যে আইসক্রিমের দোকান পড়িলে ঘাড় ঘুরাইয়া কয়েকবার না দেখিয়া পারে না, উহাদের অবস্থাও তদ্রুপ।
এই তো সেইদিন মাজুখালা তাহার জেষ্ঠ্য পুত্রধনের সদ্য পরিণীতা বধূকে লইয়া বাড়ি ফিরিতেছিলেন। দিনটা তাহার ভারী চমৎকার কাটিয়া ছিল। প্রাণসখী জয়নাবের বাড়িতে সারা বিকাল বসিয়া পান চিবাইয়া সারা শহরের মাগীদিগের নিন্দা করিয়া নতুন বৌটাকে দিয়া পা টিপাইয়া নসু মিয়ার বাঁশঝাড়ের গোড়ায় পানের পিচকিরি ফেলিয়া আঁচলের চাবি দুলাইয়া ফিরিবার পথে তাহার আর সুখের সীমা ছিল না। আসিবার পথে নাদেরালিকে দলবল সমেত দেখিয়াই তিনি অতি দ্রুত বুকের ওপর হইতে আঁচলখানা সযত্নে বেশ খানিক সরাইয়া দিলেন, চুলের একটা গোছা সামনে টানিয়া আনিয়া জিলিপির মতো প্যাঁচাইয়া তুলিলেন, তারপর বউকে ঝাড় মারিয়া কহিলেন, ঘোমটা টানিয়া চল মাগি, শাড়িকাপড়ের ঠিকঠিকানা নাই!
তারপর নাদেরালির দিকে চাহিয়া মদির কটাক্ষ হানিলেন। নাদেরালি সেয়ানা মানুষ, সেও কটাক্ষের উত্তরে একখানা চিকন হাসি হাসিল। সে চলিয়া যাইবার পর মাজুখালার সম্বিত ফিরিতেই দেখেন নতুন বধূ তাহার ঘোমটাখানি ফেলিয়া দিয়া সঘন সতৃষ্ণ চোখে নাদেনারালির অপসৃয়মান ছায়ার দিকে চাহিয়া রহিয়াছে। দেখিয়া তাহার পদনখের ডগা হইতে মস্তকের কেশাগ্র পর্যন্ত জ্বলিয়া উঠিল! বলিলেন, আবাগির বেটি, লাজলজ্জা নাই তোর? ভিনপুরুষ দেখিয়া ল্যা ল্যা করিয়া জিভের পানি ফেলিতেছিস?
লজ্জাকাতর নববধূর এইবার অন্যরূপ দেখা গেল, ঘাড় ঘুরাইয়া ঝাঁজাইয়া বলিল, তো আপনি কী করিতেছিলেন?
মাজুখালা চোখ কপালে তুলিয়া বলিলেন, ও মাগো, এ যে সাক্ষাৎ রাক্ষুসী! দুইদিন যাইতে না যাইতেই বুলি ফুটিতেছে!
বধূ কহিল, আপনি যাহা করিতেছিলেন আমিও তাহাই করিতেছিলাম। আমার দোষ হইলে আপনারও দোষ হইয়াছে!
মাজুখালা আপন কপালে চাপড় মারিয়া বধূ লইয়া বাড়ি ফিরিলেন।
যে নাদেরালিকে লইয়া নারীকূলের এমত আস্ফালন, তাহার এই মজবুত স্বাস্থ্য আর রূপের চ্ছটা না ছড়াইবার কোনো কারণই নাই। দুধে-ডিমে-তেলে-জলে থাকিলে কাহার না চেহারায় জ্যোতি ফুটে? দেখিতে দেখিতে এই সেদিনের নাবালকটি চল্লিশ বছরের স্বাস্থ্যবান যুবায় পরিণত হইল, তাহার দিকে চাহিয়া কাহারো যেন বিস্ময় মানে না। তবে বিস্ময়ের কারণ তাহার স্বাস্থ্য নহে, রূপও নহে। তাহার অর্থবিত্ত বা ক্ষমতাও নহে। বা তাহার গোঁফের আড়ালে চিকন রহস্যময় হাসিটিও নহে।
বিস্ময়ের কারণ তাহার ভাগ্যের পরিবর্তন।
দেখিলে কে বিশ্বাস করিবে এই যুবাটিই তাহার বাল্যকালে দুধের বদলে লাথি, ভাতের বদলে কিল, রুটির বদলে কানমলা খাইতে খাইতে বড় হইয়াছে! বাজারে মাল বহিয়া, কাগজ টুকাইয়া, হোটেলে থালাবাসন ধুইয়া একটু একটু করিয়া আগাইতে আগাইতে কোন উপায়ে সে অচানক এতদূর আগাইয়া বসিল, ইহা শুধু তাহার শহরেই নহে, আশপাশে আরো বহু শহরের মানুষেরই বিস্ময় ও গুরুতর ঈর্ষার বিষয়। দিবারাত্র তাহারা সৎপুত্রের প্রতি বিমাতার ন্যায় তাকাইয়া ক্ষণে ক্ষণে বিড়বিড় করিয়া অভিশাপ দেয়।
লোকের আর দোষ কী? এরূপ উন্নতি দেখিলে কাহার না হিংসা হয়? ঘটনা খুলিয়া বলিতেছি।
নাদেরালির ইতিহাসটি বৈচিত্র্যপূর্ণ। জন্মের সময় নাদেরালির মাতা মারা গিয়াছিল বলিয়া সে শুনিয়াছে। শুনিয়াছে তাহার পিতার নিকটেই। তাহার মাতা দীর্ঘাঙ্গিনী ও সুশ্রী ছিলেন। নাদেরালির পিতাদেবও পরকালে যাত্রা করেন যখন তাহার বয়স পাঁচ কি ছয়। পিতার কথা তাহার আবছা মনে পড়ে। তিনিও দীর্ঘকায় পুরুষ, দরাজকণ্ঠ। পিতা ও মাতার মিলিত স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্যই সে পাইয়াছে।
পরম পরিতাপের বিষয় এক দুর্ভাগা রাতের অন্ধকারে কাহারা যেন নাদেরালির পিতাকে হত্যা করিল। তিনি এলাকার সজ্জন ব্যক্তিদের মুরুব্বি বিশেষ ছিলেন। গুণ্ডাপাণ্ডারা তাহাকে ভয় এবং অপছন্দ দুইটাই করিত। তাহার সূত্রেই উহাদের আয়-উপার্জন-প্রতিপত্তিতে গুরুতর টান পড়িয়াছিল। রাতের অন্ধকারে তেমনই কোনো কাপুরুষের দল সম্ভবত কুকর্মটি সমাধা করে।
সেকথাও আবছা আবছা মনে পড়ে নাদেরালির। বাজারের সম্মুখে সাদা কাপড়ে ঢাকিয়া পিতার মৃতদেহ নিয়া সে বসিয়া রহিয়াছে, তাহার চারপাশে লোকজন ব্যস্ত হইয়া হাঁটিয়া যাইতেছে, কাহারই কোনো ভ্রূক্ষেপ নাই। কেহ কেহ আসিয়া এক ঝলক দেখিতেছে, তাহার পরেই আতঙ্কিত মুখে পলায়ন করিতেছে, যেন মৃতের মুখ দর্শনেও তাহাদের জীবন বিপন্ন হইয়া উঠিতে পারে। কেহ একবারের তরে জিজ্ঞাসা করিল না--কী হইয়াছে, কেহ বলিল না--খোকা তোমার কি ক্ষুধা পাইয়াছে? কেহ ভুলেও মন্তব্য করিল না--দাফনকাফন তো কিছু করিতে হয়!
সন্ধ্যার দিকে নাদেরালি তাহার পিতার মৃতদেহ ফেলিয়া পলায়ন করিল। পাঁচ বৎসরের বালকের পক্ষে ইহাই স্বাভাবিক। তাহার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে ক্ষুধা আর ভয় ছাড়া কোনো চিন্তাই কাজ করিতেছিল না। সেই মৃতদেহের ভাগ্যে ইহার পর কী ঘটিয়াছে কেহই বলিতে পারে না।
যাহাই হউক, এরপর নাদেরালি কাউন্ট অব মন্টিক্রিস্টোর ন্যায় আবার ফিরিয়া আসিল। তবে মন্টিক্রিস্টোর ন্যায় অচানক নহে, সে এই শহরের পাশাপাশি আশপাশের আরো দু-চারটা শহরে গায়ে খাটা কাজ করিতেছিল, তেমন করিয়া কারো চোখে পড়ে নাই। একটু একটু করিয়া যখন সে ক্ষুদ্র হইতে মাঝারি, মাঝারি হইতে বৃহৎ ব্যবসায়ে টপাটপ উঠিয়া আসিল, তখন সকলেই চোখ কপালে তুলিয়া বলিল, আরে এ আমাদিগের নাদেরালি নহে? হাঁ, সেই তো! কী করিয়া হইল?
কী করিয়া হইল ভাবিতে ভাবিতেই দেখা গেল কী করিয়া যেন আরো অনেক কিছু ক্রমাগত হইয়া যাইতেছে!
এখন নাদেরালির অর্থ আর রূপের জৌলুস দেখিয়া সকলেই খাবি খায়। সকলের চক্ষুকে পীড়া দিতেই সে যেন আরো বেশি করিয়া সাজিয়াগুজিয়া কতিপয় মোসাহেব আর চাটুকার সাথে করিয়া ঘুরিয়া বেড়ায়। তাহার ধানকল আছে, সারা শহরের চাল সেই যোগায়। বড় বড় পুকুরে মাছের খামার আছে, সারা শহরের মৎস্যচাহিদার মূল নিমিত্ত সে। বড় বড় দোকান করিয়া ব্যবসা খুলিয়া বসিয়াছে, তাহাকে ছাড়া শহর অচল। হালে কাপড়কল খুলিয়া বসিয়া নিজ শহর তো বটেই কাছের দূরের বহু শহরেই তাহার কাপড় বিক্রি করিতেছে। উন্নতিটা কোনোরূপেই ঠেকাইয়া রাখা যাইতেছে না। ইহা দেখিলে হিংসা হয় না কাহার?
ইহাদিগের মধ্যেই যাহারা বুদ্ধিমান, তাহারা হিংসা প্রকাশ না করিয়া দুই হাতে উত্তমরূপে সরিষার তৈল মাখিয়া সজোরে ঘষিতে ঘষিতে নাদেরালির আশপাশে জড়ো হইয়াছে। তাহারা শুধুই তাহার প্রিয়ভাজন হইতে চাহে। সেই প্রিয়ভাজন হইতে চাহিবার ঢঙগুলাও হাস্যকর।
--নাদের ভাই, শফিপুরের কলিমুদ্দিকে কিছু না কহিলে যে আর চলিতেছে না!
--কেন রে, কী করিয়াছে সে?
--তাহাকে শয়তানে ধরিয়াছে। আপনার নামে যা নয় তাই বলিয়া বেড়াইতেছে। আপনি একদা মিসকিন ছিলেন, আপনার বংশপরিচয় নাই! শুনিলে মস্তকে রক্ত চড়িয়া যায়!
নাদেরালি মৃদু হাসিয়া বলে, তাহা মন্দ বলিয়াছে কী? ঘটনা তো মিথ্যা নহে!
--ছি ছি! ইহা আপনি কী বলিতেছেন নাদের ভাই? আপনি ভালোমানুষ বলিয়া এইরূপ বলিয়া থাকেন! যাহাই হউক, ইহার প্রতিকার আমাকেই করিতে হইবে! উহার মস্তক হইতে দুই এক মুষ্ট কেশ যদি উৎপাটন না করিয়াছি...
নাদেরালি শুধু মুচকি মুচকি হাসে। চামচা বাহিনী তাহাকে প্রদক্ষিণ করিয়া অল্পবিস্তর দক্ষিণা যে পায় না তাহা নহে, কিন্তু যে বিশাল দাঁও মারার আশায় তারা আসিয়াছিল, তেমন কোনো প্রাপ্তি কাহারও ঘটিয়া উঠে নাই।
চামচা বাহিনী ব্যর্থ হইবার পরে আসিল কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাগণ। কন্যাদায়গ্রস্ত বলিলে ভুল বলা হইবে, যাহাদের কন্যা এখনো বালিকা হইতে কন্যা হইয়া উঠিবার সুযোগ পায় নাই, তাহারা পর্যন্ত আসিয়া তাহাদের বাড়ন্ত কন্যাশিশুগুলিকে নানাভাবে নাদেরালির নিকট প্রদর্শনপূর্বক স্কন্ধে চাপাইবার চেষ্টা করিতে লাগিল। চিত্তে একবার ফাটল ধরাইতে পারিলেই হইল, কোটিপতির শ্বশুর হওয়া ঠেকাইবে কোন নটবর?
কিন্তু নাদেরালি প্রস্তরের ন্যায় অনড়। কিছুতেই তাহার ভ্রূক্ষেপ নাই।
এক কন্যার পিতা শেষে ক্ষেপিয়া গিয়া বলিল, বলি ভদ্দরলোকের পো, গঞ্জে তো আমরাও গিয়াছি, কিন্তু গঞ্জটা তো আর সমুদয় জীবন নহে! ঘরও একখানা চাই! বাজারের নটীমাগী আর ঘরের বউ কি এক হইল?
নাদেরালি হাসিয়া বলিল, তাহা আমি কী করিয়া বলিব? আমি তো কখনো গঞ্জেও যাই নাই, বিবাহও করি নাই! নটী কী জিনিস আর ঘরের বউ কী কোনো ধারণাই নাই! আপনি জ্ঞানী মানুষ, দুই পথেই হাঁটিয়াছেন। তুলনামূলক একখানা অভিসন্দর্ভ যদি লিখিয়া পাঠ করিয়া শুনাইতেন তো কিছু শিখিতে পারিতাম!
কন্যার পিতা লুঙ্গির খুঁটে ঘাম মুছিতে মুছিতে সরিয়া পড়িল!
কন্যার পিতাগণের পরে আসিল কন্যারা স্বয়ং। এই দলে লম্বা-বেঁটে-মাঝারি-মোটা-চিকন-বালিকা-শ্যালিকা-বিধবা-সধবা-বুড়ি-ছুঁড়ি সকলই আছে। এই প্রথম নাদেরালির কঠিন আত্মবিশ্বাসে কিছুটা হইলেও চিড় ধরিল। যখন সে দেখিল নানা পদের মলি-পলিদিগের পাশাপাশি পাশের শহর হইতে কোলের বাচ্চাটিকে দুগ্ধপান করাইতে করাইতে জয়গুন বিবিও আসিয়াছে এবং পাশের বাড়ি হইতে জোয়ান মর্দের ন্যায় গুম্ফের অধিকারিণী জোবেদা খালা রোজ ইষ্টকখণ্ডে মুড়িয়া প্রেমপত্র নিক্ষেপ করিতেছেন, তখন উপায়ান্তর না দেখিয়া নাদেরালি মাসাধিককালের জন্য গা-ঢাকা দিয়াছিল। ইহার পরেও নানারূপ নাটক ঘটিয়াছে এবং এখনো ঘটিতেছে। কেহই হাল ছাড়ে নাই।
সর্বশেষ যে উৎপীড়নের মুখে নাদেরালি পড়িল, তাহার কথাই এইবারে বলিতেছি।
ছয়-সাত দিবস পূর্বে নাদেরালি বাজারের রাস্তা দিয়া ফিরিতেছিল। অদূরে হোটেলের বাহিরে পাতা বেঞ্চিতে লোকজন বসিয়া ছিল, নাদেরালি নিকটবর্তী হইতেই তাহাদেরই ভিতর হইতে একজন "বাজান" বলিয়া ডাক দিয়া দৌড়াইয়া আসিল!
লোকটি পক্ককেশ, মুখে বলিরেখা বিদ্যমান কিন্তু চোখ দুখানিতে চাতুর্য ঝকঝক করিতেছে। লোকটি নাদেরালির হাত জড়াইয়া ধরিয়া সকলের সম্মুখেই হাউমাউ করিয়া কাঁদিয়া উঠিল। নাদেরালি নানান পদের নাটকের সহিত পরিচিত, তাহারপরেও সে খানিক বিব্রত বোধ করিল।
পাশ হইতে শামসু শেখ বিরক্ত গলায় কহিল, চাচা মিয়া, কী হইয়াছে? এইরূপ অচানক চিৎকার করিয়া সকলের প্লীহা চমকাইয়া দিবার হেতু কী?
বৃদ্ধ লোকটি আরো সজোরে হাউমাউ করিয়া কাঁদিয়া উঠিল।
নাদেরালি বলিল, চাচা, কী হইয়াছে খুলিয়া বলুন, শুনিয়া আমরাও খানিক ক্রন্দন করি!
বৃদ্ধ কান্না থামাইয়া চক্ষুস্থির করিয়া চাহিয়া রহিল। বলিল, বাজান, তুই আমাকে চাচা কহিলি?
শামসু শেখ এবারে গলা চড়াইয়া বলিল, কী মুশকিল! চাচা না বলিয়া কি জ্যাঠামশাই বলিবে নাকি? এ কেমন কথার ধারা?
বৃদ্ধ কোনো উত্তর না দিয়া কাঁদিতে কাঁদিতেই নাদেরালির চোখ-মুখ-কপালে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল। যেন বহুকাল পরে হারাধন তাহার দশটির ভিতরে একখানি ছেলেকে ফেরত পাইয়াছে!
নাদেরালি গম্ভীর হইয়া বলিল, ঘটনা কী খুলিয়া বলুন।
বৃদ্ধ বলিল, বাজান, সেকথা শুনিলে তুমি চমকাইয়া যাইবে। আর তাহা ছাড়াও এই আলাপ বোধকরি সকলের সম্মুখে করিবার নহে। তোমার বাড়িতে বসিয়া বলিলে সবচাইতে উপযুক্ত হইত।
নাদেরালি বলিল, বাহিরের বিষয় বাড়ি বহিয়া নিয়া যাইব না, কী বলিবেন এইখানেই বলুন। সকলের সম্মুখে বলিতে সমস্যা থাকিলে আশপাশে কোনো নিরালা স্থানে যাইতে পারেন!
বৃদ্ধ এইদিক ঐদিক চাহিয়া তারপর বলিল, ঐ তো ঐ দূরের বৃক্ষছায়ে দাঁড়াইয়া কথা বলা যাইতে পারে!
শামসু শেখ মুখ বাঁকাইয়া রহিল। অন্যান্য চামচাদিগেরও মুখভরা বিরক্তি। নাদেরালি বৃদ্ধকে নিয়া বৃক্ষের নিচে গিয়া দাঁড়াইল।
বৃদ্ধ চোখের পানি নাকের পানি এক করিয়া গড়গড়াইয়া একের পর এক কথা বলিয়া গেল। নাদেরালি মুখ শক্ত করিয়া তাহার কথা শুনিতে লাগিল। তাহার মুখের রঙ একের পর এক পরিবর্তিত হইতে লাগিল।
বৃদ্ধ বলিল, বাজান, আমি তোমার পিতা হই!
নাদেরালি--কীরূপে?
বৃদ্ধ--পিতা যা করিয়া পিতা হয়!
নাদেরালি--আমার তো পিতা ছিল, আপনি আসিলেন কোথা হইতে?
বৃদ্ধ--উক্ত পিতা তোমার সত্যিকার পিতা নহে। কেবলমাত্র তোমার মাতার স্বামী! তোমাকে লালন করিয়াছিলেন মাত্র। তোমার পিতা আমি স্বয়ং!
নাদেরালি--ঘটনাটি খুলিয়া বলিবেন কী?
বৃদ্ধ--শোনো তবে। এত বৎসর পূর্বের ঘটনা, তাহার পরও সমস্ত কিছুই চোখের সামনে জ্বলজ্বল করিতেছে! তোমার মাতা তখন কিশোরী, এই শহর হইতে দক্ষিণে গোটা দশেক শহর পার হইলে বসন্তপুর, তুমি তাহার নাম তো অবশ্যই শুনিয়াছ। সেইখানে প্রতি বছর জমিদারেরা ঘোড়দৌড়ের আয়োজন করিতেন। আর সেই ঘোড়দৌড়কে কেন্দ্র করিয়া বিশাল মেলা বসিত। সেই মেলায় তোমার মাতাদেবীর সহিত আমার সাক্ষাত ঘটে। সে অপরূপা ছিল, আমি তাহাকে সেই মেলায় একবার দেখিয়াই প্রেমে নিমজ্জিত হইলাম। নানারূপে তাহার সহিত দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করিলাম, আমার চেষ্টা তাহার চোখে পড়িল।
তোমাকে কী বলিব, আজ আমি বৃদ্ধ হইয়া সেই চেহারা আর নাই, কিন্তু সেইকালে তরুণীমহলে আমাকে লইয়া বিশেষ টানাহ্যাঁচড়া চলিত!
নাদেরালি বলিল, অপ্রয়োজনীয় কথা বলিয়া সময় নষ্ট করিতেছেন। ইহার পরে কী ঘটিল তাহাই বলুন!
বৃদ্ধ দাড়ি খুঁটিতে খুঁটিতে বলিল, অতীতের কথা বলিতে গেলে কে না খেই হারাইয়া ফেলে? যাহাই হউক, তোমার মাতাদেবীর সাথে তাহার পিতাও বর্তমান ছিল। তাহারা সেই মেলায় আসিয়াছিল তাহাদের বাড়ির টাটকা সব্জি বেচিতে। বহু শহর আর গ্রাম হইতেই সেইরূপ লোকজন আসিত! তো আমি একটু ঘুরিয়া ফিরিয়া বারংবার তাহাদের সেই ছোট্ট দোকানের সামনে ফিরিয়া আসি। তোমার মাতা আমার দিকে তাহার মনোহর চোখ দুখানি তুলিয়া তাকায়। কিন্তু তাহার পিতা জমিদারের রাগী গ্রেহাউন্ডের ন্যায় মুখ বানাইয়া বসিয়াছিল, আমাকে বার বার ঘুরিতে ফিরিতে দেখিয়া খ্যাঁক করিয়া উঠিয়া বলিল, কী রে ছোঁড়া, তোর মতলবখানা কী বলিবি নাকি? চুরির কোনোরূপ বুদ্ধি আঁটিয়াছিস তো তোকে কিলাইয়া ভূত বানাইব!
আমি বলিলাম, মহাশয়, দেখিয়া বারংবার বিস্ময় জাগিতেছে, তাই ফিরিয়া ফিরিয়া আসিতেছি! আপনার সব্জিগুলা কতই না টাটকা, কিন্তু এখনো পর্যন্ত আশানুরূপ বিক্রি দেখিতেছি না, অথচ মেলার সামনের দিকে লোকজন বাসি সব্জি বিক্রি করিয়া ধামা ভর্তি করিয়া টাকা লইয়া হাসিতে হাসিতে বাড়ি যাইতেছে! দেখিতেছি, আর ভাবিতেছি, ইহা কী করিয়া সম্ভব?
পিতাদেব কাশিয়া গলাটা মার্জিত করিয়া কহিল, ঘটনা সত্যি নাকি হে বুরবক? নাকি বিশেষ কোনো উদ্দেশে ভিন্ন গল্প ফাঁদিতেছ?
বলিলাম, আপনারা অধুনাকালের তরুণকূলকে অযথাই তিরস্কার করিয়া থাকেন! আমাকে দেখিয়া ভদ্রঘরের সন্তান বলিয়া মনে হয় কিনা? আমি আপনার সব্জির বস্তা ঘাড়ে করিয়া পলায়ন করিব নাকি?
তখন তোমার মাতা তাহাকে বলিল, পিতাদেব, তুমি বরঞ্চ মেলার সম্মুখভাগ হইতে ঘুরিয়া আস। পরখ করিয়া আস উহার কথা সত্য না মিথ্যা। সত্য হইলে আমরা জায়গা বদল করিয়া সামনের দিকেই যাইব!
পিতা বলিল, তোকে একলা ফেলিয়া যাইব? বিদেশ বিভুঁইয়ে এই অচেনা স্থলে?
তোমার মাতা বলিলেন, পিতা, আমি কি আর সেইরূপ ক্ষুদ্রটি আছি? তুমি ঘুরিয়া দেখিয়া আস। আর ঐ ভদ্রলোকটিকে নাহয় খানিক দাঁড়াইতে বলিয়া যাও। দেখিয়া তো উহাকে ভদ্র পরিবারের সন্তান বলিয়াই মনে হয়! আমি একাই থাকিতে পারিতাম, তোমার কিঞ্চিৎ ভরসা উৎপাদনের নিমিত্ত উহাকে থাকিতে বলিতে পার!
তখন তোমার মাতার সেই বুদ্ধিহীন পিতা আমাকে দোকানের সামনে দাঁড়াইতে বলিয়া মেলার সম্মুখভাগের বিক্রয় ব্যবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করিতে গেল! আর আমি তোমার মাতাদেবীর পার্শ্বে বসিয়া তাহার রূপসুধা উপভোগ করিতে লাগিলাম। তোমার মাতা হাসিয়া কহিল, তুমি এইরূপ পাগল কেন? তখন হইতে ঘুরিয়া বেড়াইতেছ--আমার রূপে পাগল হইয়াছ?
বলিলাম, হাঁ, কিন্তু তোমার চণ্ডালের ন্যায় পিতাকে দেখিয়া নিকটে ঘেঁষিতে পারিতেছিলাম না!
তোমার মাতা হাসিয়া বলিল, তাই তো উহাকে আমি বুঝাইয়া অন্য স্থানে পাঠাইলাম!
নানান গল্প করিতে করিতে তোমার মাতার সহিত আমার ভাব হইল। বন্ধুত্ব হইল। সেইখানে বসিয়াই আমরা কহিলাম, আমরা কেহ কাহাকেও ভুলিব না! তাহার পর সেই রাত্রেই...
নাদেরালি এক মনে শুনিয়া যাইতেছিল, বলিল, কী?
বৃদ্ধ ধূর্ত হাসি দিয়া বলিল, সেই রাত্রেই মেলার ভেতরে সার্কাস দেখাইতেছিল। তোমার মাতার বৃদ্ধ পিতা সার্কাস দেখিতে দেখিতে মাটিতে পাতা মাদুরে দিব্যি নাক ডাকাইয়া নিদ্রাভিভূত হইল, তখন তোমার মাতা উঠিয়া আসিয়া আমার হাত ধরিল। আমরা মেলার পার্শ্ববর্তী এক স্থানে খড়ের গাদার আড়ালে গিয়া বসিলাম। সেইখানে আমাদের ভালোবাসা হইল!
নাদেরালি--ভালোবাসা হইল মানে?
বৃদ্ধ--মানে তুমি আমার শরীর হইতে তোমার মাতার শরীরে গমন করিলে আর কি!
নাদেরালি--অ! তো তাহার পর হইল কী?
বৃদ্ধ--তাহার পরদিন তোমার মাতা ঠিকানা লিখিয়া দিয়া বিদায় হইল। আমি পরিবার হইতে প্রস্তাব লইয়া উপস্থিত হইব, এইরূপ কথা হইল। তাহার কিছুদিন পর সেই শহরে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, উহারা ভিটাবাড়ি বিক্রয় করিয়া বিদায় হইয়াছে। কোথায় গিয়াছে কেহ সঠিকরূপে বলিতে পারে না। আন্দাজে, অনুমানে গিয়া তাহাদের নতুন ঠিকানায় ধুন্দুলপুর শহরে উপস্থিত হইলাম। শুনিলাম, উহারা ধুন্দুলপুর হইতেও নিবাস তুলিয়া অন্যত্র গমন করিয়াছে! সেইদিন হইতে নানাভাবে অনুসন্ধান করিতে করিতে যখন খোঁজ পাইলাম, তখন শুনিলাম সে মৃত, বিবাহ করিয়াছিল এবং বিবাহের অব্যবহিত পরেই পুত্রের জন্ম দিয়াছে। বুঝিলাম, পুত্রটি আমারই। কিন্তু তাহার সন্ধান কেহই দিতে পারিল না। তোমার পালক পিতাও নিহত। বহুদিন পর খোঁজ পাইলাম, তুমিই সেই পুত্র!
বৃদ্ধ চক্ষের উপরিভাগে গলার গামছাখানি দিয়া মুছিতে লাগিল। চক্ষুদ্বয় সিক্ত না শুষ্ক তাহা অবশ্য বুঝা যাইতেছিল না।
নাদেরালি বলিল, আপনার আগে জিয়া সর্দারও অনেকটা এইরূপ কথা বলিয়ছিল!
বৃদ্ধ ভ্রুঁ কুঁচকাইয়া বলিল, কোন জিয়া সর্দার?
--ধুন্দুলপুর শহরের জিয়া সর্দার। তাহার গল্পও প্রায় একই রকমের। আমার নিকটে সেও দাবি করিয়াছিল, আমি তাহারই সন্তান। আমার মাতার সহিত তাহার ভালোবাসা হইয়াছিল। আমার মাতা তাহাকে ফেলিয়া আমি যাহাকে পিতা বলিয়া জানিতাম তাহাকে বিবাহ করে। বিবাহের পরে আমার জন্ম হইলেও আসলে তাহার ঔরসে আমার জন্ম!
বৃদ্ধ চোখ কুঁচকাইয়া বলিল, তাহা কী করিয়া হয়? ধুন্দুলপুর শহরে তোমার মাতা আসিয়াছিল সেই বসন্তপুরে আমার সহিত ভালোবাসা হইবার পরেই তো! ধুন্দুলপুর আসিয়া আরো দু-চারজনের সাথে কিছু ঘটিলেও প্রথম ব্যক্তি আমিই। না হে বাপু, আমার ঔরসেই তোমার জন্ম ঘটিয়াছে!
নাদেরালি কহিল, আপনি নিশ্চিত তো?
বৃদ্ধ চোখ পাকাইয়া কহিল, একশ ভাগ!
নাদেরালি দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ঠিক আছে, তাহা হইলে বাড়িতে চলুন। পিতার উপযুক্ত সমাদরই পাইবেন!
বৃদ্ধ খুশি হইয়া নাদেরালিকে জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, বাজান আমার! ঠিক আছে চল, এইবেলা বাড়ি যাই। পিতাপুত্র মিলিয়া থাকিব!
নাদেরালি কহিল, হাঁ আব্বাহুজুর, চলুন!
পাশে হাঁটিতে হাঁটিতে বৃদ্ধ বলিল, ভালো কথা, সেই জিয়া সর্দারের খবর কী? যে তোমার পিতা হইতে চাহিয়াছিল?
নাদেরালি বলিল, তাহার পরিণতি বড়ই করুণ। তাহাকে উপযুক্ত সমাদর করিয়া বাড়িতে আনিতে চাহিয়াছিলাম। কিন্তু তাহার পূর্বেই শুনিলাম, রাত্রির অন্ধকারে কাহারা যেন তাহাকে আচ্ছামতন রামদা দিয়া কুপাইয়া গিয়াছে! শরীরের বড় বেশি একটা বাকি ছিল না!
বৃদ্ধ বলিল, হাঁ মিথ্যা বলিলে ঐরূপ শাস্তিই কপালে ঘটিয়া থাকে!
হাঁটিতে হাঁটিতে তাহারা শামসু শেখ ও অন্যান্য সহচরবৃন্দের নিকট আসিয়া দাঁড়াইল। দীর্ঘ আলাপ শেষে তাহাদের ফিরিতে দেখিয়া সকলেই চোখেমুখে জিজ্ঞাসা ফুটাইয়া দাঁড়াইয়া ছিল। নাদেরালি সেদিকে দৃকপাত না করিয়া বৃদ্ধের দিকে ফিরিয়া সুকোমল কণ্ঠে বলিল, গোস্তাকি মাপ করিবেন আব্বাহুজুর! আপনার নামখানাই জিজ্ঞাসা করা হয় নাই এখন পর্যন্ত!
বৃদ্ধ উজ্জ্বল চোখে খলবলাইয়া উঠিয়া বলিল, নাম? হে হে, আমার নাম তারিকালি!
সুবিশাল সুশোভন বাড়ি। শহরে এইরূপ বাড়ি সহসা চোখে পড়ে না। দামি ইঁটের তৈয়ারি দেয়াল। সামনে বড় করিয়া লেখা "আব্বামহল"।
এই বাড়িতেই বর্তমানে তারিকালির বসবাস। নাদেরালি তাহার পিতৃদেবের আদরযত্নের চূড়ান্ত করিয়াছে। বিশাল বাড়িতে আটখানা চাকর-নফর সর্বক্ষণ খাটিতেছে। খানাখাদ্য, বিলাস-ব্যসনের কিছুই বাদ নাই। তারিকালি এই বৃদ্ধ বয়সে আসিয়া অশেষ সুখে কালাতিপাত করিতেছে।
তাহার শয়ন কক্ষটিও দেখিবার মতো। বিশাল ঘরের মাঝখানে দুগ্ধফেননিভ বিশাল শয্যা, অনায়াসে দশটি মানুষ সেইখানে শয়ন করিতে পারে। সেই শয্যায় শরীরটি এলাইয়া দেয়ামাত্র চক্ষে সুখের নিদ্রা নামিয়া আসে।
আগে নাদেরালির ভাগ্য নিয়া সকলের চক্ষু টাটাইত, আজিকাল তারিকালির ভাগ্য দেখিয়া সকলের হৃদযন্ত্র যেন কুঁকড়াইয়া ওঠে। গ্রামের বৃদ্ধরা বলাবলি করে, বাপু হে, জওয়ান বয়সে তো কম আমোদ করি নাই, কিন্তু কাহারো সহিত একবার মাত্র শয্যাগ্রহণ করিয়াই যে কেহ এইরূপে ভাগ্যদেবীর আশীর্বাদ লাভ করিতে পারে, তাহা কে জানিত? উহার কপালে সোনা গিল্টি করিয়া বাঁধানো!
এত কিছুর মধ্যে তারিকালির শুধু একটিই দুশ্চিন্তা। একখানা পুত্রবধূ যদি আসিয়া ঘর দখল করিয়া নর্তন কুর্দন আরম্ভ করে, তাহা হইলে এই প্রশান্তির আর কিছুই বাকি থাকিবে না! ইহা লইয়া সে নাদেরালির সম্মুখে বেশ কয়বার প্রসঙ্গ উত্থাপন করিয়া খানিকটা আশ্বস্ত হইয়াছে। নাদেরালির বয়স চল্লিশের অধিক হইলেও বিবাহের বদলে সে ব্যবসা ও অর্থবৃদ্ধি করিতেই অধিক ব্যস্ত। বিবাহে তাহার মনোযোগ নাই।
সেইদিন রাত্রি গভীর হইয়াছে। উত্তমরূপে নানাবিধ সুখাদ্যে উদর পরিপূর্ণ করিয়া মিষ্টি পান মুখে দিয়া তারিকালি সবেমাত্র আসিয়া শয্যাগ্রহণ করিয়াছে এবং চোখে মিষ্ট একখানা ঘুমের আবেশ লাগিয়া আসিয়াছে, এমন সময় সশব্দে শয়নকক্ষের দরজা বন্ধ হইল।
তারিকালি ঘোর ভাঙ্গিয়া চোখ মেলিয়া কহিল, কে?
অন্ধকার হইতে নাদেরালির কণ্ঠ ভাসিয়া আসিল, আব্বাহুজুর, আমি!
--কখন আসিয়াছ বাজান?
অন্ধকার হইতে নাদেরালির কণ্ঠ ভাসিয়া আসিল, সদ্যই আসিয়াছি। আপনার রাত্রির আহার উত্তমরূপে হইয়াছে তো?
তারিকালি মধুর হাসি হাসিয়া বলিলেন, তাহা হইয়াছে বৈকি!
অন্ধকারের ভেতর হইতে শয্যাকক্ষের একের পর এক জানালা বন্ধ হইবার আওয়াজ হইতে লাগিল!
তারিকালি বলিল, বাজান, জানালা কয়খানা বন্ধ করিতেছ যে?
নাদেরালি জানালা বন্ধ করিতে করিতে বলিল, হাঁ, যেন ভিতরের শব্দ বাহিরে না যায়!
তারিকালি একগাল হাসিয়া কহিল, কেন, খুব গোপন কথা বলিবে বুঝি?
নাদেরালি বলিল, হাঁ ভীষণ গোপন...
তারিকালি অন্ধকারে টের পাইল নাদেরালি বিছানায় তাহার পাশে আসিয়া শুইয়াছে। তারিকালির কানের কাছে মুখ আনিয়া সে চাপা গলায় বলিল, আব্বাহুজুর, আপনাকে গোপন কথাটা এইবেলা বলিয়া ফেলি! বাল্যকাল হইতে নানাবিধ অসুস্থ পরিবেশের ভিতর দিয়া বড় হইয়াছি। অর্থেবিত্তে আজিকে বড় হইলেও নানা জায়গায় কাজকর্ম করিতে গিয়া জীবিকার দায়ে যেইসকল বাজে অভ্যাসের ভিতরে পড়িয়াছি, তাহার অনেকগুলা আজও ছাড়াইতে পারি নাই! হোটেলে বাজারে কাজ করিতে গিয়া অনেক পুরুষের লালসার শিকার হইতে হইতে নিজের ভিতর আপনা হইতেই পুরুষপ্রীতি জন্মাইয়াছে, নারীদিগকে ভুলিয়া গিয়াছি। তাই তো আজও বিবাহ করা হয় নাই। আগে নানা স্থানে গিয়া পুরুষসম্ভোগ করিতাম। এখন সমাজে সম্মান রহিয়াছে, তাই আর যত্রতত্র যাইতেও পারি না, বাড়িতেও কাহাকে পুষিতে পারি না। চাকরগুলাকে ব্যবহার করিতে গেলে উহারা কথা ছড়াইবে, তাই উহারাও বাদ। বাধ্য হইয়া নিজের এই বাসনাকে চাপিয়া রাখিতে হয়। কিন্তু এইভাবে কতদিন? এমন ক্ষণে আমার আপনার মতন শুভানুধ্যায়ীই দরকার, যিনি আমার বাসনাও মিটাইবেন আবার একখানা সামাজিক পরিচয়ের অবগুণ্ঠনে আমার চরিত্রও সবার চোখে রাখিবেন নিষ্কলুষ। অর্থাৎ সর্পও মরিবে, যষ্ঠিও ভাঙ্গিবে না! ...আপনি কোনো চিন্তা করিবেন না, অধিক যন্ত্রণা পাইবেন না, আপনি আমার আব্বাহুজুর, আপনাকে কি অধিক যাতনা দিতে পারি?
তারিকালি টের পাইল, তাহার দামি সূতি লুঙ্গিখানা কোন এক অদৃশ্য হস্তের টানে ধীরে ধীরে খুলিয়া আসিতেছে, সে বিষম খাইয়া হা হা করিয়া উঠিয়া বসিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু সবল একখানা হাত তাহাকে পুনর্বার শোয়াইয়া দিল।
এর মিনিটখানেক পরেই তারিকালির গগনবিদারী চিৎকার শয্যাকক্ষের বন্ধ দরজা জানালাগুলিতে আছড়াইয়া পড়িতে লাগিল। তাহার আর্তনাদ কেহই শুনিল না।
তারিকালি ঠাপ খাইয়া চেঁচাইয়া প্রমাণ করিল যে সে আগে কখনো ঠাপ খায় নাই। ঠাপ খাইলে কদাপিও ভুঁইফোড় বাপ হইবার মতো এই চাপ সে স্কন্ধে লইত না!
মন্তব্য
ধ্বংস!!!!!
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
ওরেএএএএএএএএএএএএএএএএএ
বিধ্বংসী
হা হা হা! অনেকেই মজা পেয়েছেন দেখি লেখাটা পড়ে। ধন্যবাদ সবাইকে। তারিকালিদের পরিণতি বোধহয় এমনি হওয়া উচিত, কী বলেন?
--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'
মাইরালাইছে রে , মাইরালাইছে
এইরূপ মায়াদয়াহীন লেখা লিখিলেন! ধুন্দুলপুরে আপনার খবর আছে।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
পুরাই ফুকুশিমা - পুরাই তেজষ্ক্রিয়!
হা হা হা ------ চরম!!!!
তবে দুয়েকটি শব্দের ব্যবহার চোখে লেগেছে - মাগী, ঠাপ ইত্যাদি। জানি না এগুলো সে সময়ের (ভাষা অনুযায়ী গল্পটা যে সময়ের বলে অনুমান করছি) বহুল প্রচলিত/উচ্চারিত শব্দ ছিলো কিনা, তবে এখন এগুলোকে কদর্য গালাগালি বলেই জানি!!
____________________________
আগেকার দিনে বয়স্ক মহিলাদেরকে "মাগী" বলেই সম্বোধন করা হত একটু ব্যাঙ্গার্থেও হয়ত। শরৎসাহিত্যে তো পাবেনই, সবচে ভালো পাবেন রাশিয়ান বইগুলোর অনুবাদে। বোকা বয়স্ক মহিলা অর্থে ব্যবহৃত হত!
আর "ঠাপ" অবশ্যই খারাপ শব্দ। শেষ লাইনে এই শব্দ ইচ্ছ করেই দিয়েছি। বাস্তবে ফিরিয়ে আনার জন্য। যে এটা শরৎসাহিত্য নয়, এটা এই সময়ের লেখা। আর তারিকালি প্রসঙ্গে এই শব্দই প্রযোজ্য আসলে। এই দুটো লাইন তুলে ধরার জন্যই আসলে পুরো গল্পটা লিখতে হয়েছে!
--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'
বাহ। দারুন একটি রচনা! অসাধারণ। সাধু ভাষার ব্যাবহারেও দারুন পারদর্শিতা আপনার। ভাল থাকবেন মৃদুল।
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
ধন্যবাদ আনিস ভাই। আপনি এখনো বাংলাদেশে? বইমেলা পর্যন্ত থাকবেন বুঝি? হিংসা... আমি তো আর এইবার বইমেলায় থাকতে পারছি না!
--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'
ইসরাত
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
বুলেট!
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
নতুন মন্তব্য করুন