ছেলেবেলায় গ্রামে বেড়াতে যাওয়াটা ছিলো আমাদের জন্য দ্বিগুণ আনন্দের! কারণ পথে নানাবাড়ি থামা হতো দু’দিন। নানাবাড়ি মফস্বল শহর। প্রধান সড়কের শহুরে বাউন্ডারি পেরোলেই বাড়িটি। একে ঘিরে ক্ষেত, পুকুরঘাট আর সর্পিল রাস্তা। সেই মেটে রাস্তার মাঝ বরাবর ঘাস ক্ষয়ে গিয়ে তৈরী হওয়া সিঁথি পথ ধরে অনেকদূর দৌড়ালে চলে যাওয়া যায় একদম শেষ প্রান্তে, আবার লোকালয়ে।
সারাদিন উঠান আর ক্ষেতের প্রান্ত ধরে ছোটাছুটি। কখনও পুকুরে ভেলা বানিয়ে খেলা। আর বাকি সময়টা বয়োজ্যেষ্ঠদের বিরক্ত করে করে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়তাম, তখন এক দৌড়ে চলে যেতাম মেঠো পথের শেষ প্রান্তের বাড়িটায়। হাঁপাতে হাঁপাতে কড়া নাড়তাম কাঠের দরজায়। দরজা খুলে দিতেন শান্ত চেহারার অল্প বরস্ক একজন, যাকে দেখতে অবিকল প্রতিমার মতন লাগতো। গোলগাল মিষ্টি মুখ। মাথায় কোঁকড়ানো ঘন চুলে বিনুনি। আমাদের দেখেই উজ্জ্বল হয়ে উঠতো তার মুখ। বলতাম “পানি খেতে পারি?” হাসি মুখে ঘরে বসতে দিতেন তিনি। আমরা অবশ্য সারাবাড়ি টই টই করে দেখতে থাকতাম। প্রধান আকর্ষণ থাকতো ছোট্ট একটা ঘরের দিকে, পূজার ঘর। সে ঘরের তিনদিক লাল রঙ, এক দিকে দেবমূর্তি। নীচে জলন্ত প্রদীপসারি। সেখানে মিতা’দির দাদী বসে বসে ঘন্টায় মৃদু আওয়াজ তুলে পূজা করতেন। আমরা পর্দার আড়াল থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম।
ও হ্যা, সেই গোলগাল সুন্দর মুখের দিদিটির নাম ছিলো মিতা। ভারী মিষ্টি ধূপ মেশানো একটা গন্ধ থাকতো তার চারিপাশ।
পরিচয়ের পর থেকেই কারণে অকারণে যেতাম মিতা’দির বাসায়। আমাদের কারেন্ট চলে গেলেই দৌড়ে চলে গিয়েছি ওবাড়িতে টিভি দেখার জন্যে। কখনও একটু জি্রাতে অথবা পানি খেতে। কখনও প্রসাদের লোভে। এত মিষ্টি করে কথা বলতেন যে খেলা শেষে শুধু মিতা’দি কে এক নজর দেখবো বলে দৌড়ে যেয়ে কড়া নাড়তাম সে বাড়ি। এরপর এমন হলো যে, দোর খুলে কিছু বলবার অবকাশ না দিয়ে দিদি বলে ফেলতেন, “জল চাই তো?”। তারপর এক ঢোক পানি গিলেই শুরু হয়ে যেতো হাত নাড়িয়ে রাজ্যের কাহিনী বকে যাওয়া, আর মিতা’দির স্মিত মুখে সেসব শুনে যাওয়া। পাশে বসিয়ে চুলে বিলি কেটে কেটে কত গল্প যে বলতেন তিনি! চোখ বন্ধ করে শুনতাম। ধূপ ধূপ গন্ধে ঘুম চলে আসতো।
এরপর যতবার বাড়ি গিয়েছি, প্রতিবার মিতা’দিদিদের বাসায় যেতাম।
মাঝে দু’তিনবছর বাড়ি যাওয়া হলো না। এরপর যখন গেলাম, শৈশব ছেড়ে তখন আমরা প্রায় কৈশোরে। মামা খালারা যাদের সাথে খেলেছি এক সময়, সকলেরই বিয়ে হয়ে গেছে ততদিনে। বিকেলগুলো সেরকম লাগেনা আর। মাঠে ঘাটে খেলাধুলাও আর করা হয়ে ওঠে না। তবু মিতা’দিকে ভুলিনি তখনও। খাওয়ার পর্ব সেরে, পরদিন দুপুরে পরচিত পথ ধরে হেঁটে গেলাম সেই বাড়িটায়।
খানিক ইতস্তত করে কড়া নাড়ার পর দরজা খুললেন এক ভদ্রলোক। আমি আর ভাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। তবে কি মিতা’দিদিরা এখান ছেড়ে চলে গেলেন! ভদ্রলোক কাকে চাই জানতে চাইলে বললাম, “এটা কি মিতা’দিদিদের বাসা?” বলতেই পেছন থেকে উঁকি দিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন দিদি। কিন্তু তাকে কেমন অপরিচিত দেখাতে লাগলো। পরনে লাল পেরে শাড়ি। দু’হাতে শাখা আর চুড়ি। চুলগুলো আগের মতই কোঁকড়ানো দীঘল, ঝুলছে। কেবল কপালের মাঝ বরাবর টকটকে লাল সিঁদুর। মিতা’দিদি হেসে বললেন “কেমন আছো তোমরা? এতদিন পরে এলে নানাবাড়ি বেড়াতে?” আরো দু-চার কথা বলতে লাগলেন তিনি।
বুঝতে পারলাম এই কবছরের মাঝে মিতা’দিদির বিয়ে হয়ে গেছে। উনার বাবা গত হয়েছেন। আর পাশের ভদ্রলোক উনার স্বামী। জানিনা কিসের অভিমানে অথবা কিসের আকস্মিকতায় আমরা এই প্রথমবার মিতা’দির বাড়ির ভেতরে না ঢুকেই দৌড়ে ফিরে এলাম। ফিরে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম। আমার সেই ছোট্ট মনটা মানতে পারছিলো না যে মিতা’দিদি অন্য কারো হয়ে যাবেন কখনও। কিংবা সেই বাড়িতে যখন তখন আমাদের আর অধিকার থাকবেনা। পরে মা বুঝিয়ে দেবার পর একটু লজ্জা লাগছিলো, কেন এইভাবে দৌড়ে চলে এলাম ভেবে।
পরে অবশ্য দেখা করেছি মিতা’দিদির সাথে আরও। হেসেছি, তাকিয়ে থেকেছি। আর আড়ালে ভেংচি কেটেছি তার স্বামীকে। দেখা করেছি ঈদে, পূজা-পার্বণে। তবু আগের মতন ঘন ঘন যাওয়া আর হয়নি অকারণে, শুধু শুধু। আর এখন তো নয়-ই। কেবল পূজা এলে কিংবা হঠাৎ সিঁদুর কাপালে কাউকে দেখলেই মিতা’দির মুখটা ভেসে ওঠে আবার।
মন্তব্য
পছন্দের জিনিসে আর কেউ ভাগ বসিয়েছে এটা সহ্য করা সবসময়ই কঠিন।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
সেই সুদুরের সীমানাটা যদি উল্টে দেখা যেত!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
সেটাই। ছোটবেলায় তো আরও নয়
দারুণ লাগল, এক্কেবারে তোমার সিচুয়ান শ্রিম্পের মত
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
ধন্যবাদ
আবেগটা বুঝতে পারছি, কিন্তু মিতাদিদির স্বামীর কি দোষ...? হয়তো আদর দ্বিগুন হতো!!!
********************************************************
আমার লেখায় বানান এবং বিরাম চিহ্নের সন্নিবেশনের ভুল থাকলে দয়া করে ধরিয়ে দিন।
********************************************************
আমার লেখায় বানান এবং বিরাম চিহ্নের সন্নিবেশনের ভুল থাকলে দয়া করে ধরিয়ে দিন।
হতো হয়তো। কিন্তু ঐ সময় মনে হতো কেন মিতা'দি-কেই পেলেন উনি!
ধন্যবাদ আপু।
আমিও বেজায় হিংসুটে, প্রিয় কিছু ভাগ করে নেয়া ধাতে নেই!!
মায়াকাড়া লেখায়
[ইয়ে আপুনি,
ও হ্যা > ও হ্যাঁ, লাল পেরে> লাল পেড়ে শাড়ি,
জলন্ত> জ্বলন্ত, পরচিত> পরিচিত]
--------------------------------------------------
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
সংশোধন করে দেয়া আর পড়ার জন্য ধন্যবাদ তিথী
অনেকদিন পর মৃত্তিকার লেখা পেয়ে ভালো লাগলো।
শৈশবের আবেগ, অভিমান এগুলো এমনই। যুক্তি দিয়ে মেলানো যায় না।
----------------------------------------------------------
ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী, একা একা করি খেলা ...
ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী, একা একা করি খেলা ...
ধন্যবাদ আপু
- আরে, ভুলেই তো গিয়েছিলাম আপনার নামেও যে একজন সচল আছেন আমাদের মাঝে! নামের প্রতি সুবিচার করে তিনি লিখেনও মাটির মতোই নরম করে, বোধগম্য করে।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
অনেক ধন্যবাদ ধূগো'দা।
মনে পড়ে যায় আমার কঅসর হারানো সেই সউসবের দিন গুলি
স্মৃতিকথা পড়লে মন চট করে স্মৃতির উঠোনে একটা ঢু দিয়ে আসে।
লেখার জন্য অভিনন্দন আর পুরোনো দিনে ঘুরে আসার মশলা জোগানোর জন্য ধন্যবাদ।
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
ধন্যবাদ মর্ম
হুম...ছোটবেলার প্রিয় মানুষদের সাথে আবার মোলাকাত খুব সুখের বিষয়।
আপনার মত আমারও একজন দিদি ছিলেন। অনেকদিন যোগাযোগ নেই। জানিনা কেমন আছেন, কী করছেন। দেখি এবার দেশে গেলে খুঁজে বের করার চেষ্টা করব।
লেখা খুব ভাল লেগেছে।
ধন্যবাদ বাউলিয়ানা।
খুঁজে বের করে দেখা করুন। দেখবেন নিজের ছেলেবেলায় ঘুরছেন সেটুকু সময়
ভালো লাগলো।
ছোটবেলায় আমারও দিদি ছিলো একজন। গত প্রায় ৩/৪ বছর যাবৎ যোগাযোগ নেই। উনারা ৮ বোন ছিলেন, নেত্রকোনায় থাকতেন।
...........................
Every Picture Tells a Story
ভালো লাগলো জেনে খুশি হলাম মুস্তাফিজ ভাই।
ইশ্, এত সহজ অথব কী মায়া দিয়েই না লিখলে তুমি! এত ছুঁয়ে গেলো! আমারও এরকম আছে স্মৃতি। তাঁদের কথা বাদ, এক নানাভাইকে নিয়েই যা করতাম - প্রতিদিন আসতেন, তাও দরজা বন্ধ করে প্রমিস না করা পর্যন্ত না খোলা, ছাতা বা ব্যাগ লুকোনো ইত্যাদি ইত্যাদি! আসলেই।
স্কুলের দিদিদের কথা মনে আছে? আমাদের প্রত্যেককে চেনা, প্রত্যেকের নাম জানা দিদিদের? কী আপন ছিলেন সবাই! এবার যখন ফেরত যাবো, স্কুলে যাব একবার।
ভাল থেকো।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
আমি দেখতে চাই না বন্ধু তুমি
কতখানি হিন্দু আর কতখানি মুসলমান
আমি দেখতে চাই তুমি কতখানি মানুষ।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
আমি দেখতে চাই না বন্ধু তুমি
কতখানি হিন্দু আর কতখানি মুসলমান
আমি দেখতে চাই তুমি কতখানি মানুষ।
ধন্যবাদ আপু!
দাদা, দিদিদের কথা মনে আছে এখনও। শেষ যেবার গিয়েছিলাম, আমাকে চিনতে পেরেছিলো দিদিরা সহ ক্যান্টিনের দাদাও! হেভি মজা লেগেছিলো তখন!
ভালো থাকুন আপু।
খুব মিষ্টি লেগেছে লেখাটি।
আসলেই বাচ্চারা সহজে ভাগ দিতে চায় না, সেটা চকলেট হোক আর মানুষই হোক
চলুক স্মৃতিচারণ ।
+++++++++++++++++++++++++++++++++++++
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না?
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
অনেক ধন্যবাদ তাসনীম ভাই।
হুম, এরকম হয়
মায়া মায়া লেখা। ধন্যবাদ লেখা দেবার জন্য
ধন্যবাদ আনন্দী
আপনার লেখাটা পড়ে কেন যেন একটা গল্পের কথা মনে পড়লো খুব। বুদ্ধদেব বসুর 'প্রেমে পড়ার গল্প'...
এতো মায়া...
অনেক ভালো লাগলো লেখাটা...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
গল্পের নাম শুনেই তো পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে! খুঁজতে হবে তাহলে।
অনেক ধন্যবাদ নজরুল ভাই
কি অদ্ভুত সারল্যমাখা লেখা!
রাখেন ইহা উপরে (না বুঝলে জিগাইয়েন )
---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে
---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে
ধন্যবাদ রেনেট ভায়া
১০ মিনিট চিন্তা কইরা এখন বুঝলাম।
বেশ মায়াবী লেখা আপু
সত্যি! আমিতো এখনো কেন যেন পছন্দের কাউকে ভাগ করতে পারিনা।
পছন্দের মানুষগুলোর সংখ্যাও খুব কম বলেই হয়তো
------------------------------------
জানতে হলে পথেই এসো, গৃহী হয়ে কে কবে কি পেয়েছে বলো....
-----------------------------------------------------------------------------------------------------
" ছেলেবেলা থেকেই আমি নিজেকে শুধু নষ্ট হতে দিয়েছি, ভেসে যেতে দিয়েছি, উড়িয়ে-পুড়িয়ে দিতে চেয়েছি নিজেকে। দ্বিধা আর শঙ্কা, এই নিয়েই আমি এক বিতিকিচ্ছিরি
ধনেপাতা মউ
কি সুন্দর মায়াকারা স্মৃতিচারণ। আমাদের পাড়াতে এক আন্টি ছিলেন যার কাছে আমরা সব গিন্ডিপিন্ডিরা দল বেঁধে যেতাম পানি খেতে, তার কথা মনে পরে গেল। হয়তবা আমরা ছোয়াছুয়ি খেলছি, তিনি বারান্দাতে কাপড় মেলতে আসতেন, আর সবাই লাফাতে লাফাতে তার চারপাশে জড় হতাম। কোথায় যে হারিয়ে গেলেন!
নতুন মন্তব্য করুন