অধ্যায় ১
এ বিষয়ে চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিভঙ্গি
এক তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী (এরভিন শ্র্যোডিঙার নিজেই) প্রায় চার'শ শ্রোতার উদ্দেশ্যে ধারাবাহিকভাবে কিছু বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেই বক্তৃতার কথাগুলো নিয়েই বইটি প্রকাশ করা হয়েছে। বক্তৃতাগুলোকে জনপ্রিয় বিজ্ঞানের পর্যায়ে ফেলা যায় না, আবার জটিল বৈজ্ঞানিক সমীকরণের কাতারেও ফেলা যায় না। আগেই শ্রোতাদের বলে দেয়া হয়েছিল, পদার্থবিজ্ঞানীদের সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র তথা সমীকরণের ব্যবহার খুব একটা না থাকলেও এই বক্তৃতামালাকে জনপ্রিয় বিজ্ঞান হিসেবে আখ্যায়িত করা যাবে না। দর্শক-শ্রোতার সংখ্যা প্রতিটি বক্তৃতায়ই আশানুরূপ ছিল। সমীকরণ ব্যবহার করা হয়নি বলে আবার এটা ভাবা যাবে না, বিষয়টা এতোই সোজা যে কোন সমীকরণই লাগে না। বরং বিষয়টাই এমন যে গণিত তার পুরোটা ব্যাখ্যা করতে পারে না। আরেকটি বিষয় বক্তৃতাগুলোর জনপ্রিয়তা কিছুটা হলেও বাড়িয়ে দিয়েছে। বিষয়টি হল: বক্তা প্রথম থেকেই পদার্থবিজ্ঞানী এবং জীববিজ্ঞানী সবার কাছে এমন একটি মৌলিক ধারণা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন যা পদার্থবিজ্ঞান এবং জীববিজ্ঞানের মধ্যেই দোদুল্যমান। অনেকগুলো বিষয় নিয়ে আলোচনা করলেও এই বক্তৃতার মূল উদ্দেশ্য ছিল কেবল একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর বিষয়ে সবাইকে জ্ঞাত করা। চলার পথে যেন পিছলে যেতে না হয়, সেজন্য প্রথমেই আমাদের পরিকল্পনা সম্বন্ধে সাধারণ কিছু কথা বলে নেয়া উচিত।
অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হল: একটি জীবিত সত্তার স্থানিক সীমার স্থান-কালের মধ্যে সংঘটিত ঘটনাগুলোকে পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়ন দিয়ে কিভাবে ব্যাখ্যা করা যায়?
এই ছোট্ট বইটি এই প্রশ্নের যে উত্তর প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করবে তার সারকথা হল: বর্তমানে এই ঘটনাগুলোকে পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়ন দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না, তাই বলে এটা মনে করার কোন কারণ নেই যে, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের মাধ্যমে ঘটনাগুলোকে ব্যাখ্যা করা যায় না।
পরিসাংখ্যিক পদার্থবিজ্ঞান (ভৌত গঠনসমূহের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য)
অতীতে যা আমরা অর্জন করতে পারিনি ভবিষ্যতে তা অর্জনের স্পৃহাকে জাগিয়ে তোলাই যদি উদ্দেশ্য হয়, তাহলে আমার উপর্যুক্ত মন্তব্যটিকে বেশ নগণ্য মনে হতে পারে। কিন্তু বর্তমান বিজ্ঞানের এই ব্যর্থতাকে যখন সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয় তখনই বোঝা যায়, এই আশাবাদী মন্তব্যটি কত ইতিবাচক। গত ত্রিশ-চল্লিশ বছরে জীববিজ্ঞানী বিশেষত জিনতত্ত্ববিদদের নিরলস প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিতে আজ আমরা জীবদেহের প্রকৃত গাঠনিক পদার্থ সম্বন্ধে জানত পেরেছি। সেই সাথে একটি জীবিত সত্তার স্থানিক সীমার স্থান-কালে সংঘটিত ঘটনাগুলোকে পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন দিয়ে কেন ব্যাখ্যা করা যায় না তাও জানতে পেরেছি। পদার্থবিজ্ঞানী ও রসায়নবিদরা এতোদিন পরমাণুর যে ধরণের সজ্জা নিয়ে তাত্ত্বিক পর্যায়ে গবেষণা করেছেন তা এক ধরণের, আর জীবদেহের প্রধান অঙ্গসমূহে পরমাণুর সজ্জা এবং এসব সজ্জার মিথস্ক্রিয়ার বিষয়টি একেবারে ভিন্ন ধরণের। যে পার্থক্যটিকে এতো প্রকটভাবে উপস্থাপন করলাম তা-ই আবার কারো কাছে সামান্য মনে হতে পারে, যদি তিনি পদার্থবিজ্ঞানী না হন এবং পরিসংখ্যান সম্বন্ধে ধারণা রাখেন। কারণ তিনি জেনে থাকবেন, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের সূত্রগুলো আদতেই পরিসংখ্যান ভিত্তিক।
আমরা তথা পদার্থবিজ্ঞানী ও রসায়নবিদরা নিজেদের গবেষণাগারে এতোদিন যে ধরণের গবেষণা করে এসেছি তা থেকে জীবদেহের প্রধান অঙ্গগুলোর গঠন এতো পৃথক কেন, এই সমস্যাটির সাথে পরিসংখ্যানের নিবিঢ় সম্পর্ক রয়েছে। আসলেই তো, যে ব্যবস্থার জন্য আমরা সূত্রগুলো আবিষ্কার করেছি সেগুলোই একেবারে ভিন্ন একটি ব্যবস্থায় একই রকম ফলাফল প্রদর্শন করবে, এমনটি ভাবা ঠিক নয়। তার পরও সমস্যা রয়েছে। এতোক্ষণ আমি দুই ভিন্ন ব্যবস্থার "পরিসাংখ্যিক গঠনে" যে পার্থক্যের কথা বিমূর্তভাবে বলে গেলাম তা পদার্থবিজ্ঞানী নন এমন কারো পক্ষেই সহজে বুঝে নেয়া সম্ভব নয়।
একটা সহজ উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি পরিষ্কার করে বলছি। এখানে কেবল স্থূল অর্থে উদাহরণ টানছি, বিস্তারিত পরবর্তীতে আসবে। একটি জীবিত কোষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল ক্রোমোজোম তন্তু। এই ক্রোমোজোম তন্তুকে "অনাবর্তী কেলাস" (Aperiodic crystal) (১) বলা যেতে পারে, অন্তত এমনটি বললেই তাকে মানায়। পদার্থবিজ্ঞানে এতোদিন আমরা কেবল পর্যাবৃত্ত কেলাস নিয়েই গবেষণা করে আসছি। একজন নিবেদিত পদার্থবিজ্ঞানীর কাছে এই বস্তুগুলো খুবই জটিল এবং চমৎকার। এগুলো বিশ্বজগতের অন্যতম বিস্ময়কর এবং জটিল ভৌত গঠনের সৃষ্টি করে। আর এগুলোর মাধ্যমেই নিষ্প্রাণ এই প্রকৃতি তার জটিল প্রাণের ধাঁধাময় বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। অথচ অনাবর্তী কেলাসের তুলনায় পর্যাবৃত্ত কেলাসকে সরল এবং খুব সাধারণই বলতে হবে। এই দুই কেলাসের মধ্যের পার্থক্যটিকে একটি সাধারণ ওয়ালপেপার এবং রাফায়েলের ট্যাপেস্ট্রির মত যুগান্তকারী শিল্পের পার্থক্যের মাধ্যমে তুলে ধরা যায়। সাধারণ ওয়ালপেপারে একই ধরণের গড়ন একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর ব্যবহৃত হতে থাকে। কিন্তু রাফায়েলের ট্যাপেস্ট্রির মত জটিল এমব্রয়ডারিতে এরকম নিরস উনরাবৃত্তির অবকাশ নেই, বরং এর প্রতিটি অংশ স্বকীয় এবং অর্থবহ। পদার্থবিজ্ঞানীদের গবেষণায় কিন্তু পর্যাবৃত্ত কেলাসের গঠনই সবচেয়ে জটিল। কিন্তু জৈব রসায়নের কথা তুললে সে জটিলতা কিছুই না। জটিল থেকে জটিলতর জৈব অণু নিয়ে গবেষণা করতে থাকায় বর্তমানে জৈব রসায়ন অনাবর্তী কেলাসের ধর্ম বোঝার খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। আর আমার মতে এই অনাবর্তী কেলাসই হল জীবনের বাহক। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, আমি এই ভেবে খানিকটা বিস্মিত হই যে, এই বিষয়ে জৈব রসায়নবিদরা যেখানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন এবং জীবন সমস্যার প্রায় সমাধান করে ফেলেছেন সেখানে পদার্থবিজ্ঞানীদের এ বিষয়ে কোন অবদান নেই বললেই চলে।
*****
অনুবাদকের কথা
(১) ক্রোমোসোমের মধ্যে এমন কি থাকে যা জীবনের জটিল তথ্য প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে নিয়ে যায়? এই প্রশ্নের কোন নির্দিষ্ট উত্তর তখন কারও জানা ছিল না। তাই শ্র্যোডিঙার পদার্থবিজ্ঞানের সাধারণ কেলাসের বাইরে অনাবর্তী কেলাস তথা অ্যাপিরিয়ডিক ক্রিস্টাল নামে একটি অণুর ভবিষ্যৎবাণী করেন। একেই বলেন জীবনের বাহক। এই ভবিষ্যৎবাণীর প্রায় ১০ বছর পর ডিএনএ অণু আবিষ্কৃত হয়। শ্র্যোডিঙারের অনাবর্তী কেলাস নয়, প্রকৃতপক্ষে ডিএনএ হল জীবনের বাহক। কিন্তু, শ্র্যোডিঙারের এই কেলাসকে একটি সফল ভবিষ্যৎবাণী বলা হয়। তিনিই প্রথম ডিএনএ ধরণের কিছুর ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন।
চলবে .....
*****
<< আগের পর্ব
মন্তব্য
ভাষা শক্ত হলে আপনি ব্র্যাকেটে ইংরেজী দিয়ে দেন না কেন? আমারো আজকাল আর ইংরেজী দেওয়া হচ্ছে না। "অনাবর্তী কেলাস"- এর ইংরেজী কি?
---------------------------------
হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
ব্র্যাকেটে ইংরেজি দিয়ে দিয়েছি। আর "অনুবাদকের কথা" নামে একটা আলাদা অনুচ্ছেদ যোগ করেছি। শ্র্যোডিঙারের যে কথাগুলো বর্তমানে আর খাটে না সেগুলোর সাম্প্রতিক মতবাদ এবং কোন কিছু বিস্তারিত বলার জন্যই এই অনুচ্ছেদ ব্যবহৃত হবে।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
বাঃ, অনুবাদকের কথা ব্যাপারটা বেশ সুন্দর ...
---------------------------------
হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
এই বিষয়ে জৈব রসায়নবিদরা যেখানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন এবং জীবন সমস্যার প্রায় সমাধান করে ফেলেছেন সেখানে পদার্থবিজ্ঞানীদের এ বিষয়ে কোন অবদান নেই বললেই চলে।
পুরোদমে মানতে পারছি না।
অনাবর্তী কেলাস"- বা ক্রোমোজোম তন্তুকে শুধু ক্রোমোজোম বা ডিএনএ বলা যায়?
তবে আমার কাছে "জটিল বিষয়টি" শুখপাঠ্য লেগেছে।
বাকী পর্বের অপেক্ষায়...
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
আসলে এই বক্তৃতাটি ১৯৪৩ সালে দেয়া। সেটার অনুবাদ করছি। বর্তমানে এ বিষয়ে পদার্থবিজ্ঞানীদেরও অনেক অবদান রয়েছে। কিন্তু সেই সময় তেমন কোন অবদান ছিল না। সুতরাং প্রেক্ষিত বিচারে একে সঠিক বলা যায়।
অনাবর্তী কেলাসের বিষয়টিও একই। শ্র্যোডিঙার ভেবেছিলেন, এই কেলাসই জীবনের সব তথ্য বহন করে। আর পরবর্তীতে আমরা জেনেছি ক্রোমোসোম তন্তু নয়, ডিএনএ ই সব তথ্যের প্রকৃত বাহক। এই বিচারেই হয়ত অনাবর্তী কেলাসকে ডিএনএ এর ভবিষ্যৎবাণী বলা যায়।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
মুহাম্মদ তুমি এগিয়ে চল...
---------------------------------
এভাবেই কেটে যাক কিছু সময়, যাক না!
আমরা আছি তোমার সাথে (সাইড ভোকাল এর কামটা সারলাম আর কি)
---------------------------
দুঃখ সুখের স্পর্শ নীরে
সাঁতরে বেড়াই;
নিঃসংগ এক,নিঃসংগ মেঘ।
---------------------------------
বাঁইচ্যা আছি
পুরাটা অনুবাদ হয়ে গেলে- একসাথে পড়ব। তাড়াতাড়ি শেষ করেন
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
পুরা অনুবাদ হলে একসাথে পড়তেই বেশী ভাল লাগার কথা। কিন্তু সমস্যা হল এতো বড় লেখা, আদৌ শেষ করতে পারবো কি-না কে জানে। দোয়া কইরেন।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
ইনশাআল্লাহ
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
নতুন মন্তব্য করুন