ডার্ক ম্যাটারের বাংলা হিসেবে গুপ্ত পদার্থ ব্যবহার করলাম। এটি অদৃশ্য পদার্থ বা অদৃশ্য বস্তু নামেও পরিচিত। মহাবিশ্বের শতকরা প্রায় ২০ ভাগ ভরের জন্য দায়ী এই গুপ্ত পদার্থ। (মহাবিশ্বের শতকরা মাত্র ৫ ভাগ ভর আমরা সনাক্ত করতে পারি। ২০ ভাগ গুপ্ত পদার্থ আর ৭৫ ভাগ গুপ্ত শক্তি। গুপ্ত শক্তি নিয়ে এখানে কিছু বলব না।) অথচ নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে, এটিকে দেখা যাওয়া দূরের কথা চিহ্নিতও করা যায় না। একেবারেই গুপ্ত। অনেক বিজ্ঞানী বলছেন এটি এমন কোন কণা দিয়ে গঠিত যা সম্বন্ধে আমাদের কোন ধারণাই নেই। অতএব আমাদের পরিচিত কণাগুলোর থেকে একেবারে আলাদা। অনেকে আবার তাত্ত্বিক পর্যায়ে থাকা কিছু কণাকে গুপ্ত পদার্থ হিসেবে চিহ্নিত করছেন। অনেকে আবার বলছেন, গুপ্ত পদার্থ হল আমাদের সীমাবদ্ধতা। আমাদের মহাকর্ষ তত্ত্বের গোড়ড়াতেই গলদ আছে। এই গলদ থেকেই উত্থান ঘটেছে সীমাবদ্ধতার।
এরকম বেশ কিছু সমস্যার কারণে এখনও রহস্যময় রয়ে গেছে গুপ্ত পদার্থ। সেই ১৯৩৩ সালে ফ্রিৎস জুইকি এ ধরণের পদার্থের অস্তিত্বের কথা বলেছিলেন। তারও আগে আইনস্টাইন কর্তৃক প্রদত্ত আপেক্ষিকতাভিত্তিক মহাকর্ষের সমীকরণে এর অস্তিত্ব লুক্কায়িত ছিল। বিষয়টি পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সত্তরের দশকে। জ্যোতির্বিজ্ঞানী ভেরা রুবিন চূড়ান্ত সমাধানটি বের করেন। এজন্য তাকে অনেকেই গুপ্ত পদার্থের আবিষ্কারক হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ভেরা রুবিন আবিষ্কারটি করেছিলেন এভাবে।
নিউটনীয় বলবিজ্ঞান অনুযায়ী ছায়াপথের জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বস্তুগুলোর গতির ব্যাখ্যা হল: ছায়াপথ কেন্দ্র থেকে বস্তুটির দূরত্ব যত বাড়বে তার ঘূর্ণন বেগও তত বেশী হবে। এ হিসেবে ছায়াপথের প্রান্তসীমায় অবস্থিত বস্তুগুলোর বেগ অনেক বেশী হওয়ার কথা, কেন্দ্রের গুলোর তুলনায়। কিন্তু ভেরা রুবিন প্রান্তসীমার অনেকগুলো বস্তু পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পান, সেগুলোর গতিবেগ কেন্দ্রের কাছাকাছি অবস্থিত বস্তুগুলোর বেগের সমান। অর্থাৎ ছায়াপথের সর্বত্র জ্যোতিষ্কসমূহের বেগ সমান। একে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা আবিষ্কার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
জ্যোতিষ্কগুলো কেন সমবেগ বজায় রাখে? এর কারণ একটিই হতে পারে, ছায়াপথের ভর যদি আরও অনেক বেশী হয় এবং এই ভর যদি সর্বত্র সমানভাবে বণ্টিত থাকে। এখান থেকেই গুপ্ত পদার্থের ধারণার উৎপত্তি। এটা বোঝা গেল যে, ছায়াপথের দৃশ্যমান অংশটুকুর ভর খুবই কম। মূল ভর গুপ্ত অবস্থায় আছে। ব্যাপারটাকে বলা যায়, একটা বিশাল গুপ্ত পদার্থের গোলকের মধ্যে ছায়াপথটি অবস্থান করছে। এই গোলকটিকে গুপ্ত পদার্থের বর্ণবলয় (halo) বলে।
স্থূল উদাহরণ দেয়া যায় এভাবে। রাতের বেলা ক্রিসমাস ট্রিতে আলো জ্বালানোর পর বেশ খানিকটা দূর থেকে দেখলে মনে হবে আলোকময় বিন্দুগুলোই শূন্যের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু কাহিনী সেটা নয়, এই আলোকজ্জ্বল বিন্দুগুলো একটি কাঠামোর উপর অবস্থান করছে যেটি আমরা দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি না। তাহলে আলোকজ্জ্বল বিন্দুগুলোই আমাদের দৃশ্যমান ছায়াপথ, আর কাঠামোটা হল গুপ্ত পদার্থের বর্ণবলয়।
এরপর গুপ্ত পদার্থের পক্ষে আরও অনেক কিছু আবিষ্কৃত হয়েছে এবং এদের অস্তিত্ব বিষয়ে সব বিজ্ঞানীই এখন নিঃশংসয়। কিন্তু হাতেনাতে কেউই ধরতে পারেনি পদার্থটিকে। কারণ এগুলো এমন পদার্থ যারা আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কোন কণা বা পদার্থের সাথেই ক্রিয়া করে না। বিজ্ঞানীদের ধারণা সত্য হলে, বুঝতে হবে আমাদের ছায়াপথটিকে মুড়িয়ে রেখেছে গুপ্ত পদার্থ। এ থেকে কোন নিস্তার নেই। সর্বত্র এর অস্তিত্ব আছে। হয়তো প্রতি সেকেন্ডে আমাদের শরীর বা আমাদের সমগ্র পৃথিবী ভেদ করে গুপ্ত পদার্থের লক্ষ লক্ষ কণা চলে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি না। এই যে সর্বত্র বিরাজ করার বিষয়টি এর উপর ভিত্তি করেই সনাক্ত করার পদ্ধতি বের করা হয়েছে।
বর্তমানে গুপ্ত পদার্থ সনাক্তকরণের সবচেয়ে শক্তিশালী গবেষণাগার যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটায় অবস্থিত "সুডান আন্ডারগ্রাউন্ড ল্যাবরেটরি"। একসময় এটি ছিল মিনেসোটার সবচেয়ে প্রাচীন ও সমৃদ্ধ লৌহ খনি। সমুদ্রতল থেকে প্রায় ৭১৩ মিটার নিচে অবস্থিত এই খনিকে এখন গুপ্ত পদার্থ সনাক্তকরণের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। মাটির এতো নিচে করার কারণ, একমাত্র গুপ্ত পদার্থ ছাড়া অন্য কোন সংকেত বা কণা যেন সেখানে পৌঁছুতে না পারে। এদের অনুসন্ধানের নাম "ক্রায়োজেনিক ডার্ক ম্যাটার সার্চ"। ক্রায়োজেনিক বলার কারণ সনাক্তকরণটি অতি নিম্ন তাপমাত্রায় করা হচ্ছে। এমন একটি টিউব তৈরী করা হয়েছে যার ভেতরে তাপমাত্রা মাত্র কয়েক ডিগ্রি কেলভিন। টিউবের ভেতরে জার্মেনিয়াম কেলাস দিয়ে তৈরী অতি সূক্ষ্ণ ও সংবেদী সনাক্তকারক স্থাপন করা হয়েছে। জার্মেনিয়ামের আন্তঃআণবিক দূরত্ব এতো কমিয়ে আনা হয়েছে যে মাঝ দিয়ে কোন কণা অতিক্রম করলেই মিথস্ক্রিয় ঘটবে। ফলশ্রুতিতে কেলাসের তাপমাত্রা বেড়ে যাবে।
এভাবেই গত দুই বছর ধরে ওৎ পেতে আছেন বিজ্ঞানীরা। এখন পর্যন্ত কোন সফলতা আসেনি। গোপন থাকতে সম্পূর্ণ সফল হয়েছে গুপ্ত পদার্থ।
সম্প্রতি এই গবেষণাগার উঠিয়ে দিয়ে কানাডায় আরও ব্যাপভাবে কাজ শুরু করার কথা হচ্ছে। অচিরেই গুপ্ত পদার্থ সনাক্ত করার জন্য বিস্ময়কর এক গবেষণাগার পেতে যাচ্ছি আমরা। বেশী দিন পালিয়ে বেড়াতে পারবে না এই গুপ্ত পদার্থ।
কিন্তু গত ৭ই এপ্রিল আরেকটি খবর বেড়িয়েছে যা গুপ্ত পদার্থ বিজ্ঞানীদের কিছুটা হলেও হতাশ করতে পারে। সেটা হল সব ছায়াপথের মধ্যকার সমগতিকে গুপ্ত পদার্থ দিয়ে ব্যাখ্যা করার দরকার নেই। অনেকদিন আগেই ছায়াপথের গতি ব্যাখ্যা করার জন্য নিউটনীয় বলবিজ্ঞানের একটি পরিশীলিত রূপ প্রকাশিত হয়েছিল। একে "সংশোধিত নিউটনীয় বলবিজ্ঞান" (Modified Newtonian Dynamics - MOND) বলে। তারা বলছেন মন্ডের মাধ্যমে বামন ছায়াপথের মধ্যকার জ্যোতিষ্কগুলোর সমগতিকে ব্যাখ্যা করা যায়। তারপরও গুপ্ত পদার্থের অস্তিত্বের প্রয়োজন হবে। কারণ সব ছায়াপথই তো বামন নয়।
আধুনিক জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ এই গুপ্ত পদার্থ। তাল মেলাতে হলে আপডেট থাকুন সবাই।
*****
কিছু প্রয়োজনীয় প্রবন্ধ:
# মহাবিশ্বের গুপ্ত পদার্থ - ভেরা রুবিন (বঙ্গানুবাদ)
# গুপ্ত পদার্থের বদলে মন্ড দিয়ে বামন ছায়াপথের গতির ব্যাখ্যা - সাইন্সডেইলি
মন্তব্য
ইন্টারেস্টিং!
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
ক্রিসমাস ট্রির উদাহরণ টা আসলেই অনেক মজার।আগেও বোধহয় কোথাও পড়েছিলাম।
---------------------------
থাকে শুধু অন্ধকার,মুখোমুখি বসিবার...
---------------------------------
বাঁইচ্যা আছি
হিস্টরি চ্যানেলের প্রামাণ্য সিরিজ "দ্য ইউনিভার্স" এর একটা পর্ব ছিল "ডার্ক ম্যাটার" নামে। আমি ঐখান থেকেই ক্রিসমাস ট্রি'র স্থূল উদাহরণটা নিয়েছি। সেখানে একেবারে ক্রিসমাস ট্রি দেখিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
সুন্দর ছিল বিশেষ করে ক্রিসমাস ট্রিতে আলো জ্বালানোর ব্যাপারটা অনেক মজার ছিল।
-নিরিবিলি
আমি আরো কিছু মতামত পড়েছি এ নিয়ে। যেমন, সবাই বলছে খুব বড় এবং অনেক পদার্থের মধ্যে মহাকর্ষ ঠিক নিউটন বর্ণিত উপায়ে কাজ করে না। গ্র্যাভিটন কণা (মহাকর্ষের জন্য দায়ী কাল্পনিক কণা) সম্পর্কে বিশদ না জানা পর্যন্ত তো মহাকর্ষ সম্পর্কে ঠিক বা ভুল এ ধারণায় পৌঁছন সম্ভবই নয়। মহাকর্ষ যে এখনো হাইপোথিসিস স্তরেই রয়ে গেছে ...
---------------------------------
হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
আসলেই হাইপোথিসিস। তার উপর অসম্পূর্ণ। কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান আর সাধারণ আপেক্ষিকতার সমন্বয় না হলে সম্পূর্ণ করাও সম্ভব না। কোয়ান্টাম তত্ত্বেই গ্র্যাভিটন নামক তাত্ত্বিক কণার কথা বলা হয়। দুটিকে একসাথে করে কোয়ান্টাম মহাকর্ষ আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে।
অনেকে দাবী করেন "কোয়ান্টাম মহাকর্ষ" নাকি আবিষ্কৃত হয়ে গেছে। যেমন ধর্মতাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী (থিওফিজিসিস্ট) ফ্র্যাংক টিপলার এমনটি দাবী করেছেন। আসলে এখনও এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার সময় আসেনি।
তাই মনে হয়, গুপ্ত পদার্থ আবিষ্কার কোয়ান্টাম মহাকর্ষ বিষয়ক গবেষণায়ও বিশেষ উপকারে আসবে।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
আপনাকে এই জাতীয় লেখার জন্য সাধুবাদ জানাই। খুব একটা উপকারী কাজ করছেন সবার জন্যে।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
উপকারে আসছে জেনে খুব ভাল লাগলো। ধন্যবাদ আপনাকে।
এই ফাঁকে বলে দেই,
আপনার গল্পগুলো কিন্তু আমার চরম লাগে।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
আমারো কিন্তু কমেন্ট লেখার মত কিছু পাই না ...
---------------------------------
হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
দারুন!!
---------------------------------
এভাবেই কেটে যাক কিছু সময়, যাক না!
নতুন মন্তব্য করুন