বিশ্ব ঐতিহ্যে জ্যোতির্বিজ্ঞান: রাধাগোবিন্দ চন্দ্র

শিক্ষানবিস এর ছবি
লিখেছেন শিক্ষানবিস (তারিখ: রবি, ১৩/০৪/২০০৮ - ৯:৩৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মানব সমাজের চালিকাশক্তি বারংবার পরিবর্তিত হয়েছে। কখনও ধর্ম আধিপত্য বিস্তার করেছে, কখনও করেছে দর্শন, কখনও বা আবার সনাতন প্রথায় চলেছে সব কিছু। বর্তমান যুগকে বলা হয় বিজ্ঞানের যুগ। এটা বলার কারণ হতে পারে, বর্তমান সমাজের চালিকাশক্তি হল বিজ্ঞান। কিন্তু, আমাদের ভেবে দেখা প্রয়োজন আসলেই সমাজের সর্বস্তরে বিজ্ঞানের প্রভাব বিস্তৃত হয়েছে কি-না। এক উপায়ে এটা বোঝা যেতে পারে।
একসময় মানুষ মনে করতো, তাদের বসতিটাই সবকিছু, এর বাইরে কিছু নেই। ধীরে ধীরে নতুন নতুন ভূমি আবিষ্কার করতে থাকে তারা। তারপরও বাঁধা হয়ে দাড়ায় সমুদ্র। তখন ভেবে নেয় সমুদ্রই বোধ হয় সবকিছুর শেষ। কিন্তু মানুষ থেমে থাকেনি। সমুদ্র জয়ের নেশায় জলচর যান তৈরী করেছে। পাল তোলা নৌকায় সমগ্র পৃথিবী দাপিয়ে বেড়িয়েছে। এভাবেই একসময় আমরা জানতে পেরেছি পৃথিবীটা কত বড় এবং সেই পৃথিবীতে আমাদের অবস্থান কোথায়।

এ ধরণের ভৌগলিক আবিষ্কারের পাশাপাশি আরেকটি বিষয় নিয়ে মানুষ সবসময়ই গভীরভাবে চিন্তা করতো। তা হল আকাশ। এই আকাশ নিয়ে মানুষের জল্পনা-কল্পনার কোন সীমা পরিসীমা নির্ধারণ করা যায় না। পৌরাণিক কাহিনীতে আকাশ ছাড়া যেন কিছুই নেই। একসময় আকাশ ছিল ঈশ্বরের স্থান। মানুষ তাই এমনও বিশ্বাস করতো, আকাশের অদ্ভূত বস্তুগুলো দ্বারা ঈশ্বর মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করেন। এভাবে জ্যোতিষ শাস্ত্রের সৃষ্টি হয়।
কিন্তু, সভ্যতার ধারা সবসময় সত্য জ্ঞানের দিকে ধাবিত হয়। তাই বিজ্ঞানের মাধ্যমে চূড়ান্ত সত্যকে খুঁজে নিয়েছে মানুষ। মানুষকে আকাশ নিয়ে আর কল্পনা করতে হয়নি। সত্য জ্ঞানের আলোকে জ্যোতির্বিজ্ঞানের জন্ম হয়েছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভিত স্থাপিত হয়েছে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। পর্যবেক্ষণমূলক জ্যোতির্বিজ্ঞানকে আধুনিক বিজ্ঞানের জনক বলা যেতে পারে। কারণ গ্যালিলিও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ধর্মের শৃঙ্খল ভেঙে বিজ্ঞানের জয়যাত্রা শুরু হয়।

আধুনিক বিজ্ঞানের সকল শাখাই মহাকাশ বিজ্ঞানে গিয়ে নতুন মাত্রা পায়। এজন্য পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত, জীববিজ্ঞান, ভূগোল, ভূতত্ত্ব, জীবাশ্মবিজ্ঞান সবকিছুরই মহাকাশ পর্যায়ে পৃথক শাখা রয়েছে। যেমন, জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান, জ্যোতির্জীববিজ্ঞান ইত্যাদি। এটা স্বাভাবিক। আমাদের বিজ্ঞানের সবকিছু একসময় পৃথিবীর ভিত্তিতে আবর্তিত হয়েছে। কিন্তু এখন আমরা বুঝতে পারছি মহাবিশ্বের সুবিশাল পরিসরে আমাদের অবস্থান কোথায় এবং কত ঠুনকো আমাদের অস্তিত্ব।
কিন্তু সমাজের সবাই এখনও মহাবিশ্বের প্রেক্ষিতে চিন্তা করতে পারেন না। প্রায় সবাই ভাবতে পারেন, সমগ্র বিশ্বে আমাদের দেশের অমুক জেলায় আমার অবস্থান। কিন্তু সমগ্র মহাবিশ্বের অমুক ছায়াপথের অমুক তারা জগতের অমুক গ্রহে আমাদের অবস্থান, এটা কিন্তু অদিকাংশ মানুষই ভাবতে পারেন না। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান সবাইকে সেই পর্যায়ে নিয়ে যেতে চায়। সবাই যেন মহাবিশ্বের সাপেক্ষে নিজেদের অবস্থান বুঝতে শিখে। এতে আবার এক ঢিলে দুই পাখি মারা হয়। কারণ কাউকে স্পষ্টভাবে এই ধারণা দিতে হলে বিজ্ঞানের সব শাখার সাধারণ জ্ঞান নিয়ে আলোচনা করতে হয়।
তাই বর্তমানে বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ নির্মাণের চাবিকাঠি হল আন্তর্জাতিকতা ছাড়িয়ে মহাজাগতিকতার প্রসার ঘটানো। জাতীয়তাবাদ এখনও প্রবল আমাদের মধ্যে। কিন্তু বিশ্বায়নের মাধ্যমে আন্তর্জাতিকতাবাদ প্রসার পাচ্ছে। কিন্তু বিজ্ঞানের চাহিদা আরও বেশী, মহাজাগতিকতাবাদের প্রসার।

ইউনেস্কো ২০০৯ সালকে "আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান বর্ষ" ঘোষণা করেছে। ২০০৭ সালের ২০শে ডিসেম্বর জাতিসংঘের ৬২তম সাধারণ সভায় এই ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এই বর্ষ পালনের উদ্দেশ্য, মানুষ যেন মহাবিশ্বে তাদের অবস্থান পুনরায় আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়। এবারের আবিষ্কার হবে সজ্ঞানে, কল্পনার বশে নয়। এটা ইউনেস্কোর একটি বৃহত্তর উদ্যোগের অংশ। বৃহত্তর উদ্যোগটি হল, বিজ্ঞানের সাথে সংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়া বাড়ানো এবং সংস্কৃতিতে বিজ্ঞানের অবদান তুলে ধরা।
বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সংস্কৃতির বিকাশ ওতোপ্রতভাবে জড়িয়ে ছিল। এ কারণে বিশ্ব ঐতিহ্যে বিজ্ঞানের অবস্থান একটি বিশাল অংশ জুড়ে। বিজ্ঞানের মধ্যে আবার জ্যোতির্বিজ্ঞানের সম্পত্তিগুলো বেশী প্রভাব রেখেছে। বিভিন্ন সময়ে স্থাপিত মানমন্দিরগুলো বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই জ্যোতির্বিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট স্থাপনার সংখ্যা অনেক। কিন্তু, এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য নির্দিষ্ট কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

২০০৯ সাল আসার আগেই তাই ইউনেস্কো আরেকটি বিষয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে: জ্যোতির্বিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান চিহ্নিত করা। ইউনেস্কো থেকে "জ্যোতির্বিজ্ঞান ও বিশ্ব ঐতিহ্য" নামে একটি কর্মপরিকল্পনা পেশ করা হয়েছে। এই পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, বিশ্বের সকল দেশের জ্যোতির্বিজ্ঞান স্থপানাগুলো চিহ্নিত করা হবে, সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে এবং উন্নয়নের জন্য কাজ করা হবে। জ্যোতির্বিজ্ঞান স্থাপনাগুলোতে একই সাথে তদানীন্তন স্থাপত্য ও শিল্পের ছাপ পাওয়া যায়। এ হিসেবে ঐতিহ্য সংরক্ষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠবে এই বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলো।

ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটি ১৯৯৪ সালে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের যে তালিকা প্রকাশ করেছে তাতে বিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট স্থানের সংখ্যা বেশ কম। সেগুলোর মধ্যে আবার জ্যোতির্বিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট স্থাপনার পৃথক উল্লেখ ছিল না। কিন্তু, আদ্যিকাল থেকে এখন পর্যন্ত আমাদের পূর্বপুরুষ এবং আমরা এই স্থাপনাগুলোতে বসেই অপার বিস্ময়ে আকাশ দেখে আসছি। আকাশ দেখে এবং এর রহস্য উদ্‌ঘাটন করেই আমরা সভ্য হয়েছি। তাই জ্যোতির্বিজ্ঞান স্থাপনাগুলোর গুরুত্ব পৃথকভাবে তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছে ইউনেস্কো। এখনও পরিকল্পনার পর্যায়ে আছে এটি। তালিকা তৈরীর কাজ শুরু হয়নি।

২০০৯ সালকে সামনে রেখে বাংলাদেশের শৌখিন ও পেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানীরাও বিভিন্ন কর্মকাণ্ড শুরু করেছেন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে "বিশ্ব জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ঐতিহ্যবাহী স্থান" হিসেবে একটি মনোনয়ন দেয়া। এক্ষেত্রে অনেকটাই বিস্মৃত একটি নাম উঠে এসেছে। তিনি হলেন রাধাগোবিন্দ চন্দ্র। বাংলাদেশে পর্যবেক্ষণমূলক জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার অগ্রদূত তিনি। অবশ্য দেশ বিভাগের পর ষাটের দশকে তিনি বাংলাদেশ ছেড়ে কলকাতায় চলে যান।
১৮৭৮ সালের ১৬ই জুলাই যশোরের বাগচর গ্রামে জন্ম তার। ১৯৭৫ সালের ৩রা এপ্রিল বারাসাতের দুর্গাপল্লীতে মৃত্যুবরণ করেন। যশোরের বাগচরে তার বাড়িটি এখনও রয়েছে।

৩রা এপ্রিল রাধাগোবিন্দের ৩৩তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি আকটি আলোচনা সভার আয়োজন করে। দেশের বরেণ্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এতে অংশ নিয়েছেন। আলোচনার শেষে সর্বসম্মতিক্রমে যশোরে রাধাগোবিন্দের বাড়িকে বিশ্ব জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে প্রস্তাব করা হয়। আশা করা হচ্ছে, ইউনেস্কোতে এই স্থানের নাম পাঠানো হবে।
কিন্তু আন্তর্জালে রাধাগোবিন্দ নিয়ে খুব বেশী কিছু লেখা হয়নি। বাংলা উইকিপিডিয়াতে গত বছর একটি নিবন্ধ শুরু করা হয়েছিল। এটাই সবচেয়ে সমৃদ্ধ প্রবন্ধ হিসেবে রয়েছে। ইংরেজি উইকিপিডিয়াতে তার নিবন্ধটি সমৃদ্ধ করে তোলার কাজ শুরু হয়েছে। বিশ্ব ঐতিহ্যে জ্যোতির্বিজ্ঞানের অবদানের সাথে রাধাগোবিন্দের স্মৃতি জড়িয়ে থাকুক এটাই সবার কামনা।

রাধাগোবিন্দ সমাজের একেবারে নিচু স্তরে বাস করে নিজ উদ্যোগে যে পরিমাণ পর্যবেক্ষণ করেছেন তা রীতিমত বিস্ময়কর। ১৯১৮ সালের ৭ই জুন তিনি আকাশে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র দেখতে পেলেন যা তার নক্ষত্রের মানচিত্রে ছিল না। তিনি তার এই পর্যবেক্ষণের কথা হাভার্ড মানমন্দিরে জানান এবং এভাবেই নোভা অ্যাকুইলা-৩ ১৯১৮ আবিস্কৃত হয়। পরে তাকে আমেরিকান এসোসিয়েসন অফ ভেরিয়েবল স্টার অবজারভার (American Association of Variable Star Observers - AAVSO) সম্মানসূচক সদস্যপদ প্রদান করে। ১৯১৯ থেকে ১৯৫৪ এর মধ্যে তিনি ৩৭২১৫টি পরিবর্তনশীল তারা পর্যবেক্ষণ করেন এবং এসব তথ্য আভসো (AAVSO) কে প্রদান করেন। তার এই কার্যক্রমের জন্য তিনি সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেবে ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত আভসোর এক তালিকায় স্থান করে নেন, যাতে আর মাত্র ২৫ জন জ্যোতির্বিজ্ঞানী রয়েছেন যারা ১০,০০০ এর বেশি পরিবর্তনশীল তারা পর্যবেক্ষণ করেছেন।

রাধাগোবিন্দের বাড়িই আমাদের ঐতিহ্য। কারণ এই বাড়ির ছাদে বসেই তিনি দুরবিনে চোখ লাগিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণ করতেন। অনেক স্থানেই বলা হয়, গ্যালিলিও প্রথম একটি সাধারণ দুরবিনের এক পাশে একটি অসাধারণ মস্তিষ্ক স্থাপন করেন। এভাবেই মহাজাগতিক রহস্যের দ্বার উন্মোচিত হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে রাধাগোবিন্দই প্রথম এ কাজটি করেছেন, একটি অতি সাধারণ দুরবিনের এক পাশে একটি অসাধারণ মস্তিষ্ক স্থাপন করেছেন। এভাবেই তিনি আমাদের ঐতিহ্যের অংশ হয়ে আছেন, বাংলাদেশের গ্যালিলিও হিসেবে। এই অনুসন্ধিৎসাই আমরা ঐতিহ্য হিসেবে বয়ে বেড়াবো।

*****
http://bn.wikipedia.org/wiki/রাধাগোবিন্দ_চন্দ্র


মন্তব্য

দিগন্ত এর ছবি

এখন দূরবীন অনেক শস্তায় পাওয়া যাচ্ছে। আমার কোলকাতার কিছু বন্ধু কিনেও ফেলেছে ... দারুন অভিজ্ঞতা। রাশিয়ান দূরবীনগুলো এমনিতে ভালই ... ছাদে বসে রাতে তারা দেখতে ব্যাপক লাগে ...


হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

পরিবর্তনশীল এর ছবি

ছোট্ট পরিসরে সমৃদ্ধ একখান লেখার জন্য আমার তরফ থেকে পাঁচ তারকা।

অন্য কথাঃ
আইনস্টাইন ভাই এতদিন বিশ্বরোডে কী করতাসেন? হো হো হো
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

শিক্ষানবিস এর ছবি

বিজ্ঞানী আইনস্টাইন জীবনে বিশ্বরোডে আসেন ই নাই। এতোদিন কি করবেন?

তবে গুগলে "আইনস্টাইন ভাই" লিখে সার্চ দিলে উইকিপিডিয়া থেকে একটি এবং বিজ্ঞানী ডট কম থেকে একটি রেজাল্ট আসে। যে পৃষ্ঠাদ্বয়ের লিংক আসে সে দুটির লেখক জনৈক অনধিকার চর্চাকারী উচ্চাভিলাষী শিক্ষানবিস।
বর্তমানে এই সচল শিক্ষানবিসের বায়ু পরিবর্তন আবশ্যক হইয়া উঠিয়াছে। তাই কিছুদিন বিশ্বরোডের বায়ু থেকে অক্সিজেন খাইতেছেন। দেঁতো হাসি

পরিবর্তনশীল এর ছবি

সপ্তাহে চাইরদিন বিশ্বরোডে থাকলে বায়ু পরিবর্তন হয় ক্যাম্নে?
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।