মফস্বলের পোলাপান আমরা। কম্পিউটার নাই ফুটবল খেলি সত্যিকার মাঠে। ইন্টারনেট নাই, ব্লগ লিখতে পারি না।
কিন্তু যার মাঠে ফুটবল খেলি, সেই রহমান চাচা বড় চামার। বিনা কারণে দোতলার বারান্দায় এসে খ্যাচখ্যাচ করে। "ঐ পোলাপান, ল্যাখাপড়া নাই তোমাগো? দিনরাত খালি বল পিটাও? বাপমায় জানে যে ল্যাখাপড়া ফালায়া বল পিটাও? খাড়াও, দিতাছি বিচার!"
এইসব খ্যাচখ্যাচ আমরা আমল দেই না, কিন্তু মাঝে মাঝেই আমাদের বল বাজেয়াপ্ত করে রাখে লোকটা। ফুটবল খেললে মাঝে মাঝে তো ওর বাড়িতে বল পড়বেই, বলেন, যদি মাঠের পাশেই বাড়ি বানিয়ে রাখে?
সবই সহ্য করে যাই আমরা। আমাদের পাড়ায় এই একটাই মাঠ। আর কোথায় যাবো বলেন?
কিন্তু একদিন আমাদের খেলায় দেখা দেয় বিশাল গোলযোগ। বড়লোকের ছেলে টাটা ভাই একদিন আমাদের ফুটবল খেলার মাঝখানেই এসে তিনটা তিনটা ছয়টা স্ট্যাম্প গাড়েন। সাথে একগাদা ভিনপাড়ার পোলাপান।
"আমরা এখানে ক্রিকেট খেলতে চাই।" টাটা ভাই মিষ্টি হেসে বলেন।
আমরা মুখ গোমড়া করে বলি, "আমরা এইখানে ফুটবল খেলি তো!"
টাটা ভাই আরো মিষ্টি হাসেন। "পারলে খ্যালো, বাধা নাই!"
আমাদের তর্কের মধ্যে রহমান চাচা বেরিয়ে আসেন বাড়ি ছেড়ে। "বাবা টাটা! ক্যামন আছো বাপধন? দ্যাশে আসলা কবে?"
টাটা ভাই ব্যাট ফেলে কদমবুসি করেন। "চাচাজি! এই তো কয়েকদিন আগে।"
রহমান চাচা খুঁটিয়ে স্ট্যাম্পগুলি দেখেন, তারপর ব্যাটগুলি দেখেন, তারপরে নিজের বাড়ির জানালার কাঁচগুলি দেখেন ভবিষ্যৎ ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করার জন্য। আর তখনই দ্যাখেন যে তার সুন্দরী মেয়ে পুতুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে গা মোচড়াচ্ছে আর টাটা ভাইয়ের দিকে কটাক্ষপাত করে যাচ্ছে। তিনি দুয়ে দুয়ে চার মিলান।
"ক্রিকেট খেলবা বাবা টাটা?" মধুর গলায় বলেন তিনি।
"ইচ্ছা তো ছিলো আঙ্কেল। কিন্তু .. ..।" মলিন গলায় বলেন টাটা ভাই।
"কিন্তু কিসের বাবা কিন্তু কিসের? বড় মানুষের বড় পোলা তুমি, তুমি এই মাঠে খেলবা এইটা তো আমার সৌভাগ্য। এই গুড়াগাড়া পোলাপান কোন ঝামেলা করলে আমারে বলবা, বাইরাইয়া এগুলির হাড্ডি ভাঙ্গুম!" রহমান চাচা কটমটিয়ে তাকিয়ে আমাদের ছাই করেন।
টাটা ভাই দিলখোলা হাসেন। "আরে না না। ওরা তো এ পাড়ারই সন্তান। ওদের সাথেই ক্রিকেট খেলবো আমি। ওরা বল করবে, আমি ছক্কা মারবো। ওরা ব্যাট করবে, আমি এক বলে তিন স্ট্যাম্প গুঁড়া করবো। ওরা না থাকলে খেলে মজা কী বলেন?" টাটা ভাই স্নিগ্ধ হাসেন আমাদের দিকে চেয়ে।
আমরা ঢোঁক গিলি।
রহমান চাচা গ্যালগ্যাল করে হাসতে হাসতে একবার পুতুলের দিকে তাকিয়ে কী যেন বলতে যান, কিন্তু তার আগেই টাটা ভাই গম্ভীর হয়ে যান। "কিন্তু চাচা, আপনি যদি চান আমরা এখানে খেলি, বিশেষ করে আমি এখানে খেলি তা-ই যদি চান আপনি," একবার পুতুলের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে জিভ বার করে ঠোঁট চাটেন টাটা ভাই, "তাহলে আমাদের কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে। বুঝতেই পারছেন, আড়াই হাজার টাকার খেলাধূলার সরঞ্জাম এখানে এনে খেলবো, কিছু শর্ত তো আপনাকে মানতে হবে।"
রহমান চাচা হাত কচলাতে কচলাতে বলেন, "কী শর্ত বলো বাবা বলো।"
টাটা ভাই গলা খাঁকরে বলেন, "খেলতে খেলতে তো আমাদের পিপাসা লাগবে। পানি খেতে হবে। ঘাম বের হবে, হাতমুখ ধোয়া গোসলের জন্য পানি লাগবে। আরো বিশদিন দেশে আছি আমি, এই বিশদিন আমাকে মাঙনা পানি দিতে হবে।"
রহমান সাহেব একটু কাঁচুমাচু হন। ওনার বাসায় পানি চাইলে উনি পানি দ্যান না, বলেন ওনার দোকান থেকে পেপসি কিনে খেতে। আমরা মাঝে মাঝে তা-ই করি, কী করবো, তেষ্টা।
টাটা ভাই ভুরু নাচান। "কী চাচা, রাজি?"
রহমান চাচা বিগলিত হেসে বলেন, "রাজি না মানে? তোমাকে আমি গ্যালন গ্যালন পানি দিবো। নতুন একটা পুকুর কাটাচ্ছি ঐ পাশে, তোমাদের জন্যই তো। আর খাওয়ার পানির কথা ভাইবো না বাবা, ঐ যে আমার নারিকেল গাছ. তোমাদের ডাব পাইড়া খাওয়াবো। এই পোলাপানগুলি খুব ভালো যাব পাড়তে পারে, তুমি খালি কষ্ট কইরা আওয়াজ দিবা, ওরা পটাপট পাইড়া আনবে। আর যদি সব পানি শেষও হয়ে যায়, আমি পাশের বাড়ির মনার মার কাছ থেকে পানি কিনে এনে খাওয়াবো তোমাকে। তবু খ্যালো বাবা।"
আমরা একবার হাঁকরে পুতুলের দিকে তাকাই, একবার তাকাই রহমান চাচার দিকে, তারপর তাকাই টাটা ভাইয়ের দিকে। টাটা ভাই হাসেন। আমাদের কলিজা শুকিয়ে আসে।
মন্তব্য
হাহাহা... দারুণ সব গল্প আপনার... এত চমতকার পলিটিক্যাল রূপগল্প অনেক অনেকদিন পড়িনাই...
আহা আহা, ২য় পর্বে কি টাটা ভাই আর পুতুলের গনতন্ত্র জনতন্ত্র জননতন্ত্র হইব নাকি???
খাসা!
নতুন মন্তব্য করুন