ঘোরাঘুরি ব্লগ: উত্তর মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জ/ সমুদ্র যেখানে মা (একাদশ অংশ)

জ্বিনের বাদশা এর ছবি
লিখেছেন জ্বিনের বাদশা (তারিখ: বুধ, ১৬/০৪/২০০৮ - ৭:২৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

[এই পর্বে যে চরিত্রটির আবির্ভাব হবে, মানে আমাদের ট্যুর গাইড, ইন্টারনেটে তার ভুলে যাওয়া নাম খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে গিয়ে এক ভয়াবহ তথ্য জেনে ফেললাম। মনে হলো, লোকটার নাম খুঁজতে না গেলেই ভালো হতো। হাসিখুশী, দিলখোলা টাইপের লোকটা সারাজীবন আমাদের কাছে সেভাবেই থেকে যেত!]
*****************************************

১৪.
সকাল ন'টার এ্যাপয়েন্টমেন্ট, ট্যুর কোম্পানীর লোক এসে নিয়ে যাবে আমাদের "সাইপান হিস্ট্রি এ্যান্ড জাঙ্গল ট্যুর"-এ ঘুরে দেখাতে । দাঁতভাঙা নাম সন্দেহ নেই, কাজে কিরকম হয় সেটাই দেখার বিষয়। সাড়ে তিন ঘন্টার ট্যুর, দুজনের জন্য ৭৫ ডলার। বেশী বললে বেশী, রিজনাবল ভাবলে রিজনাবল, কি হবে বেড়াতে এসে অত হিসেব করে -- এরকম একটা মনোভাব নিয়েই বুকিং দিয়ে ফেলেছিলাম। সকালে উঠে জানালার পর্দা সরাতেই দেখি বাইরের অবস্থা আগের দিনের একশ আশি ডিগ্রী উল্টো, মানে রোদ চকচকে আকাশ; দেখে মনে হলো আলবাৎ ঠিক করছি বুকিং দিয়ে। এবারও যথারীতি কটায় কাঁটায় ন'টার সময় হোটেলের লবিতে হাজির আমরা। আমার গিন্নী ব্লগ পড়েননা, পড়লে নিশ্চয়ই খুব খুশী হতো যদি পরের বাক্যটা পড়ত। আমার একটা স্টেরিওটাইপ ধারনা হয়ে গিয়েছিলো যে মেয়েরা সময় অন্ততঃ একটা কাজ করতে পারেনা, বাসা থেকে বের হওয়া। সাজগোজ করতে গিয়ে দেরী করবেই। আমার সেই ধারনা পুরোপুরিই ও ভেঙে দিয়েছে। সত্যি বলতে, এখন মাঝে মাঝে আমার নিজেরই দেরী হয় -- এমন অবস্থা! (আল্লাহ, এই লেখাটা কোনভাবে যাতে বউয়ের চোখে পড়ে)

লবিতে এসে বসতে না বসতেই দেখি হোটেলের সামনে এসে হাজির এক বিশাল ল্যান্ডক্রুজার। ড্রাইভারের সীট থেকে নামল জাপানীজ গাইড। কালার করা চুল, ভীষন স্টাইলিশ সানগ্লাস চোখে, দেখতে বেশ দিলখোলা ধরনের লোক। লবীতে শুধু আমরাই বসে ছিলাম, লোকটা এগিয়ে এসে পরিচয় দিলো। নাম ভুলে গেছি। যথারীতি আমি জাপানীজ জানি শুনে দাঁত বের করে একটা হাসি দেখিয়ে দিলো, কিন্তু গিন্নীর জাপানী ভাষার অবস্থা তখনও দুবছরের বাচ্চাদের 'আব্বু' , 'আম্মু', 'খাই', 'ঘুমাই' এর মাঝে সীমাবদ্ধ। ব্যাপারটা জেনে সে উদার হাসি হেসে নিজের থেকেই বলল, "আমি মূলত ইংরেজীতেই বলব, তবে কোনকিছুর ইংরেজী না মনে পড়লে তখন জাপানীতে বলব, হা হা হা।" আমরাও হাসিতে যোগ দিই। তবে সেটা যতটা না তার হিউমারের কারনে, তার চেয়ে বেশী "এমন ড্যাশিং টাইপের লোকের মুখ থেকে এরকম বোকাবোকা কথা বের হবার" কারণে। বিরাট কনট্রাস্ট! চক্ষু-কর্ণে বিবাদের সৃষ্টি হলে হাসি আসতে পারে, ধারণা ছিলনা। আরেকটা মজার ব্যাপার ছিলো -- শুরুতে গাইড তার মুখের সামনে একটা হেডফোনের মাইকে কথা বলছিল; জাপানীদের হাজারো ফরমালিটিবলে কথা, হেডফোন দিয়ে অবশ্য কান যে ঢেকে ফেলেনি, সেটাই রক্ষে। পরে অবশ্য সে নিজেই ব্যাখ্যা করেছিল ব্যাপারটা -- সাধারণত অন্যান্যদিন অনেক বেশী প্যাসেঞ্জার থাকে, গাড়ীর পেছনের সারিতেও লোক বসে, তখন সবাই যাতে শুনতে পায় সেজন্যই এই ব্যবস্থা। বলতে বলতে নিজেই হেডফোন খুলে রাখে, খানিকটা রিলাক্সড হয়। লোকটাকে বেশ দিলখোলা, আলাপচারী মনে হলো; ভাবলাম, ট্রিপটা চমৎকার হবে।

আগেই বলেছি, আকাশ ভীষন পরিস্কার, তাপমাত্রাও বেশ সহনীয়। আমরা ঠিক করলাম জানালার কাঁচ খোলা রেখে পথের ভিডিও/ছবি তুলব। মিয়াবিবিতে নেমে পড়লাম ডিজিটাল অপটিকাইজেশনে (এই শব্দ এই মাত্র বানালাম, ইংরেজী ভাষার পন্ডিতেরা ক্ষেপবেননা প্লিজ)। কথাপ্রসঙ্গে গাইড বলল, "তোমরা কোন চিন্তা করবেনা, যত ইচ্ছে ছবি আর ভিডিও তোলো। পরবর্তী তিনঘন্টা তোমাদের জন্য আমি বুকড। আর বিশেষ বিশেষ স্থানগুলোতে তোমাদের টু-শটও তুলে দেব।"
টু-শটের প্রসঙ্গটা যখন চলে এলো, তখন বলেই ফেলি নিজের উর্বর মস্তিষ্কের এক অনুর্বর চিন্তার কথা। বিয়ের পরই বিষয়টা বিশেষভাবে টের পেলাম। বউ নিয়ে যেখানেই বেড়াতে যাচ্ছি, সেখানেই শখ হয় দুজন একসাথে ছবি তুলি। কিন্তু, কে তুলে দেবে? আমি নিজে জাপানী হয়ে গেছি কিনা জানিনা, তবে চিনিনা জানিনা এমন একজন লোককে হঠাৎ ডেকে ছবি তুলতে বলায় বেশ বাঁধে। সাইপান গিয়েও সমস্যাটা প্রবলভাবে অনুভব করলাম। সেজন্যই ভাবছি, বিভিন্ন দেশের অন্ততঃ রিজোর্ট বা অন্যান্য এ্যামিউজমেন্ট পার্ক টাইপের স্থানগুলোতে যেখানে প্রচুর পর্যটকের আনাগোনা সেখানে ছবি তুলে দেবার চাকরি কয়েকজনকে দিয়ে দিলে কেমন হয়? এরা নির্দিষ্ট রঙের পোষাক পরে ঘুরতে থাকবে, যে কেউ এসে ছবি তুলে দিতে বললে তুলে দেবে। তবে আমার সব চিন্তাই ঐ ভাবনা পর্যন্তই গিয়ে আটকে থাকে -- টানতে পারিনা। পাঠকেরা কেউ যদি টেনে নিয়ে যান, কৃতজ্ঞতা স্বীকার করলেই হবে।

কথাপ্রসঙ্গে গাইড জানালো, আগের তুলনায় সাইপানে ট্যুরিস্টের সংখ্যা নাকি অর্ধেকেরও কম হয়ে গেছে। ৯৫/৯৬ এর দিকে সাইপান বুম হয়েছিলো জাপানে, হাজার হাজার পর্যটক আসত। এখন অনেক কমে গেছে। সবাই ইন্দোনেশিয়া (বালি), মালয়শিয়া (লাংকাওয়ি, পিনাং), মালদ্বীপ, দুবাই -- এসব জায়গায় ছোটে।
আগেই বলেছি, এতদিন আমরা শুধু সাইপানের পশ্চিম ঊপকূলে ঘুরেছি। ভেটেরান কোম্পানীর লোকেরা সেটা ভলোই জানে, ট্যুরিস্টরা সাইপান এসে পশ্চিম অংশটা দেখেই চলে যায়। সেজন্যই তাদের এই ট্যুরটা হলো মূলত পূর্বসাইপান ঘুরে দেখানে, যেখানে প্রচুর ছোট ছোট পাহাড়, ছোটখাট একটা জঙ্গল আর চামোরো বসতি আছে।

চামোরো বসতি

"চামোরো" নামটার মধ্যে একটা পলিনেশিয়ান এথনিক আবহ আছে, চামোরো বসতি শুনেই আমি ভেবে বসি নিশ্চয়ই নানারকম গাছের পাতা দিয়ে বানানো এক্সোটিক কিছু হবে। অথচ, পথে গাইড যখন একটা বাড়ির দিকে হাত দেখিয়ে বলল, ঐ যে দেখো চামোরোদের ঘর, আমি হতাশ! এতো আমাদের রায়পুরের একটা গেরস্থ বাড়ী। বড়সড় চারচালা একটা দালানঘর, বাড়ীর সামনেই উঠোন, বারান্দাটাও আমাদের দেশের মতো, মানে পুরো উদোম, শুধু উপরটা একটু ঢালু হয়ে আসা টিনের চালে ঢাকা। পার্থক্যটা শুধু উঠোনের গাড়ী, আর ঘরের পাশে রাখা এসি'র এক্সস্টারে।

বাড়ীর আশপাশের গাছ

বাড়ীর আশপাশের গাছগুলোও আমাদের দেশের মতো, বড় বড় কাঁঠালপাতার মতো দেখতে, ঢেউয়া পাতা বলে আমাদের ওখানে। আর আছে অসংখ্যা নারকেল গাছ, কিছু বড় বড় ফুলের গাছ। ফুল আমি ভালো চিনিনা, কি কি ফুল গাছ ছিল সেটা বলতে পারবোনা, তবে এটুকু বলতে পারি যে এসব ফুল আমি দেশে অনেক দেখেছি। তবে সবচেয়ে অবাক হয়েছি কচুগাছ দেখে, মায়ের হাতের কচুশাকের ভর্তা আমার খাওয়া সেরা খাবার -- হঠাৎ যেন খিদেমতো অনুভব করি।

কচুগাছ

আমরা গেলাম পাহাড়ের উপরে এক পুরোনো পরিত্যক্ত তিনতলা সরু লম্বাটে এক বিল্ডিংয়ের সামনে; মিনারের মতো দেখতে একটা ছোট বিল্ডিং। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই বিল্ডিংটা ছিল জাপানীদের ওয়াচটাওয়ার। গাড়ী থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে খেয়াল করলাম, মাটির রাস্তায় দুপাশের গাছের ছায়া পড়ে প্রাণজুড়োনো এক ছায়ারঙ তৈরী করেছে। আমি হারিয়ে যাই সেই শৈশবে -- যখন একা একা বেরিয়ে যেতাম নানীবাড়ি থেকে, মাটির সোঁদাগন্ধ নিতে নিতে আপনমনে হেঁটে হেঁটে অনেকদূরে চলে যেতাম। এখনও লিখতে বসে আবারও মন চাচ্ছে চলে যাই, দূর্বার এক আকর্ষণে টানছে। বুকের ভেতরটা ফাঁকা বোধ করছি, যেন নতুন করে প্রেমে পড়েছি। টাওয়ারের প্যাঁচানো সরু সিঁড়ি বেয়ে উঠতে দেখি প্রচুর ভাঙা বোতলের টুকরো, বুঝে ফেললাম যে এই দ্বীপেও বখাটে ছেলেপেলে আছে। ওরা রাতে এই নির্জন পরিত্যক্ত বাড়ীতে ধুন্দুমার ফুর্তি করে।

পরিত্যক্ত তিনতলা

টাওয়ারের উপরের তলায় বারান্দায় এসে আবারও দেখলাম পশ্চিমদিকের সাগরটাকে, অদ্ভুত সুন্দর। এই প্রথম সাগরের বুকে প্রবালপ্রাচীরটাকে (কোরাল রীফ) পুরোপুরি দেখতে পেলাম। পুরো পশ্চিম উপকূলে সাইপান দ্বীপের দৈর্ঘ্যবরাবর উত্তর-দক্ষিণে চলে গেছে প্রাচীরটি। সাইপান উপকূল থেকে হয়ত এক কিলোমিটারও হবেনা দূরত্ব। প্রাচীর থেকে উপকূল পর্যন্ত পানি তাই অগভীর, ল্যাগুন তৈরী করেছে। এই অগভীরতার কারণেই সৈকত এত সুন্দর দেখতে, স্বচ্ছকাঁচের মতো, আবার অদ্ভুত ওশানব্লু রং ধারণ করেছে। নীচের প্রবালপ্রাচীর ছবিতে যে সাদারঙের ফেনার মতো লম্বা অংশটি দেখা যাচ্ছে সমুদ্রে, ওটাই প্রবালপ্রাচীর। সেখান থেকে উপকূল পর্যন্ত অসম্ভব সুন্দর রঙের অগভীর ল্যাগুন। গাইড লোকটা প্রাচীরের দিকে হাত উঁচিয়ে প্রণামের মতো করল, বলল, "এই প্রাচীরই বাঁচিয়ে রেখেছে সাইপানকে। না হলে কবে ৎসুনামী বা জলোছ্বাস এসে ভাসিয়ে নিয়ে যেত দ্বীপটাকে!!" মনে মনে ভাবলাম, হয়ত চামোরোদের আদিপুরুষেরা, যারা এই দ্বীপে বসতি গেড়েছিলো, তাদের সমসাময়িক অন্য চামোরোরা প্রশান্ত মহাসাগরের এরকম অনেক দ্বীপেই বসতি গেড়েছিলো; হয়ত ৎসুনামী বা ঝড় নিয়ে গেছে তাদেরকে অনেক আগেই, সাইপানকে ঘিরে থাকা ফিলিপিন সাগরের এই প্রবালপ্রাচীর মায়ের মতো আগলে রেখেছে দ্বীপটাকে, দ্বীপের মানুষগুলোকে। এই প্রবালপ্রাচীর কি তবে সমুদ্রমায়ের বাহু? সাগরজলের আঁচলের আশ্রয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে অসংখ্য আদমসন্তানকে? আমি প্রাচীরটাকে দেখি আর আপাতঃদৃষ্টিতে অকারণ কৃতজ্ঞবোধ করি।

প্রবালপ্রাচীর

আমাদের এই জাঙ্গল ট্যুরের আয়োজনটা ছিলো খুব গোছানো। প্রথমেই গাইড জেনে নিয়েছিলো আমরা কোথায় কোথায় যাইনি। আমি কোথায় কোথায় গিয়েছি সেটা বললাম, বাকীটা সে নিজেই হিসেব করে নিয়েছিলো। প্রথমেই আমাদের বলে নিয়েছিলো যে আমাদের আজ শুধু পূর্বসাইপান দেখানো হবে, কাজেই উত্তরের ঐতিহাসিক বানজাই ক্লিফ দেখা হবেনা। খানিকটা দমে গেলেও, আবার ভাবলাম অমন অভিশপ্ত স্থানে না হয় নাই গেলাম। এই সেই বানজাই ক্লিফ, যেখান থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অন্ততঃ আট হাজার জাপানী নারী আর শিশু পাহাড় থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেছে।

আট হাজার নারী আর শিশু!! এক সকালে!!! তখন দ্বীপের দখল আমেরিকান বাহিনীর হাতে চলে গেছে, সাইপান দ্বীপের জাপানী বাহিনীর প্রধান সাইতোও "হারাকিরি" করে আত্মহত্যা করে ফেলেছে। পুরো দ্বীপে আমেরিকান সৈন্যরা অবশিষ্ট জাপানী সৈন্যদের খুঁজে বেড়াচ্ছিল। আমেরিকান বাহিনীর বর্ণনামতে,

"যুদ্ধে পরাজিত জাপানী বাহিনীর সৈন্যরা যে ক'জন বাকী ছিল তারা দ্বীপের জাপানী অধিবাসীদের মাঝে আতংকের সৃষ্টি করে এই প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে যে আমেরিকান বাহিনী এসে মেয়েদের গণহারে ধর্ষন করবে, বাচ্চাদের কষ্ট দিয়ে মারবে। অপমান যাতে সহ্য করতে না হয়, তাই এই প্রোপাগান্ডার স্বীকার জাপানী অধিবাসীরা তখন দলবেঁধে বানজাই ক্লিফে গিয়ে সাগরে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করে।"

একটা প্রোপাগান্ডা থেকে আটহাজার মানুষের একটা দল লাইন ধরে পাহাড়ের চুড়ায় উঠে, তারপর সবাই নিজনিজ সিদ্ধান্তে বাচ্চাকাচ্চাসহ লাফ-ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করবে?
আমার বিশ্বাস হয়নি, আই কান্ট সিম্পলি বাই দিস শিট!!
শুধুমাত্র অস্ত্রবাজিতে বিশ্বের মোড়ল বলেই এরকম আরো কতশত অসত্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে আমেরিকান কসাইবাহিনীর যুদ্ধাপরাধ, সে সত্যটা একদিন বেরিয়ে আসবে -- এই আশাটুকুই করা ছাড়াও অবশ্য বেশী কিছু করার নেই।

যাই হোক, বানজাই ক্লিফের প্রসংগ থেকে আবার ফিরে যাই ভ্রমনের মেন্যুতে। গাইড আমাদের যে মেন্যু দিলো, তাতে প্রথমে আমাদের নিয়ে যাবে সাইপানের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ "মাউন্ট তাপোচো"তে। সেখান থেকে নিয়ে যাবে প্রশান্ত মহাসাগর খুব ভালোভাবে দেখা যায় এমন একটি পাহাড়ের চুড়ায়; এখানেই নাকি সাইপানের সত্যিকারের "অভিশপ্ত দ্বীপ"টা আছে, যাওয়া যায়না, শুধু দেখা যায়। তারপর একটি বিশেষ সাইপানী চার্চ, প্রশান্ত মহাসাগরের একমাত্র সৈকত, কিছু গ্রামে গিয়ে স্থানীয় লোকজনের জীবনযাপন দেখা, লোকাল সুপার মার্কেটে টুকটাক কেনাকাটা করা, গলফ কোর্স ঘুরে দেখা, সাইপানের জঙ্গল ভ্রমন আর সবশেষে কিছু ঐতিহাসিক নিদর্শন (২য় বিশ্বযুদ্ধের) দেখা -- এগুলো একটার পর একটা আসবে। ফুলকোর্স জাঙ্গল এ্যান্ড হিস্ট্রি ট্যুর দেখে আশ্বস্ত হই, অন্ততঃ খেয়ে পেট ভরেনি একথা কেউ বলতে পারবেনা। গাড়ী রওয়ানা দেয় মাউন্ট তাপোচোর দিকে।

এ পর্যন্ত সাইপানের যত রাস্তা দেখেছি, সেগুলোর সবগুলোই পাকারাস্তা। সাধারণ নুড়ি, পিচ আর এ্যাসফল্টের রাস্তা। কিন্তু যখন গাড়ী ধীরে ধীরে পাহাড়ী পাথুরে রাস্তার দিকে যেতে লাগলো, টের পেলাম এবড়োথেবড়ো রাস্তা কতপ্রকার! তারওপর পাহাড়ী রাস্তা কাটাও হয়েছে কোনভাবে চলার জন্য, বাঁক বলুন আর ব্যাংক বলুন কোনটারই হিসেব ঠিক নেই। আমাদের ল্যান্ডকক্রুজার বলেই রক্ষে। আমাদের আগে ও পিছনে কিছু গাড়ী দেখা গেলো, সবগুলোই ফোরহুইল ড্রাইভ। যাওয়ার পথে পাহাড়ী রাস্তা শুরু হবার আগে দেখতে পেলাম সাইপানের "গুলশান", বেশ অভিজাত সব বাড়ী তৈরী হয়ে আছে পাহাড়ের পাদদেশে। গাইড বলল, এসব ঘরগুলোতে সাইপান সরকারের আমলারা থাকেন। একটা বাড়ী দেখিয়ে বলল "দাম কত হতে পারে আন্দাজ করো।" আমি আদার ব্যাপারী, জাহাজের তো আর খোঁজ রাখিনা। বললাম, "এক লাখ ডলার।" গাইড ব্যাটা বুঝল, ভুল জায়গায় নক করেছে সে। কতক্ষণ পর মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল, "আড়াই লাখ ডলার"। আমার চোখ কপালে উঠার সুযোগ না দিয়েই বলল, "জাপান হলে মিনিমাম বিশ লাখ ডলার হতো।" আমি আর বেশী বিস্মিত হলামনা, দু হলেই যে চমকায়, বিশে তার কি বা আসে যায়।

অভিজাত বাড়ী

কথাপ্রসঙ্গে যেটা জানলাম, সাইপানের আমলাতন্ত্রের আমলাবাজির কথা। আগে থেকেই কিছুটা জানতাম, গাইডের কথায় বোঝা গেল যে যা শুনেছি কমবেশী ঠিকই। বেশ দূর্ণীতিগ্রস্ত সাইপানের আমলাতন্ত্র। আমেরিকা শুধুমাত্র এশিয়ার খুব কাছাকাছি নিজেদের একটা স্টেশন হিসেবে দ্বীপটাকে ধরে রেখেছে, বিনিময়ে ছাড় দিচ্ছে অনেককিছুর। যেমন, ফুডস্ট্যাম্প -- যেটার কথা আগেই বলেছি। প্রত্যেক আদিবাসী চামোরো দেড়শ ডলারের ফুডস্ট্যাম্প পায় প্রতিমাসে। তেলের দামও পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় সস্তা, মানে আমেরিকায় যেদামে বিক্রী হয় এখানেও সেদামে। তারওপর, সাইপানের প্রধান রপ্তানীশিল্প, গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রী, সেটাও পাচ্ছে সস্তা শ্রমের সুবিধা, কিন্তু একই সাথে ব্যবহার করতে পারছে "মেড ইন ইউএস" তকমা -- যেজন্য খোদ মেইনল্যান্ডের আমেরিকান ব্যবসায়ীরা ক্ষিপ্ত সাইপানের ওপর। ইন্টারনেটে একটা সাইট আছে, "সাইপান সাক্স!!" নামে -- বেশ মজার মজার রাগ ঝাড়া আছে সেখানে। আরো আনন্দ আছে সাইপানের চামোরোদের জন্য, যদিও এতে তাদের আগ্রহ খুব একটা নেই বলেই মনে হলো। সেটা হলো, আমেরিকায় পড়াশোনা। এক্ষেত্রেও সাইপান অধিবাসীরা আমেরিকান সিটিজেনের সুবিধা পেয়ে থাকে। দ্বীপের ভালো ছাত্ররা সবাই হাওয়াই ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যায়।

পাহাড়ী পথে

তবে, সাইপান অধিবাসী বিদেশীদের ক্ষোভটা অন্য জায়গায়, সেটা হলো, সরাকারীভাবে জমিপ্রদান নিয়ে চামোরোদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের নিয়ম। নিয়মটা হলো, একজন চামোরো ছেলে আর একজন চামোরো মেয়ে যদি বিয়ে করে, তাহলে তারা সরকার থেকে ফ্রি একটুকরো জমি পাবে। জাতিগত বিশুদ্ধতা বজায় রাখার প্রচেষ্টা, কেন কে জানে? তবে গাইডের কথায় তার আক্ষেপটা টের পাই হাড়ে হাড়ে, সে বলছিলো, "আমিও চামোরোদের মতো ট্যাক্স দিই সব করি, কিন্তু কোন সুবিধা নাই! " বেশ কয়েকবারই বেচারা বলল যে ইলেকট্রিসিটি আর গ্যাসের দাম এই দেশে খুব বেশী, আয়ের একটা বড় অংশই সেই খাতে চলে যায়।

তাই বলে যে লোকাল চামোরোরা খুব সুখে আছে তাও না। এরা আসলেই অলস, তার চেয়েও বড় কথা আমোদপ্রিয়। তাই দেড়শ ডলারের ফুডস্টাম্পের সাথে আরো কিছু জোড়াতালি আয় করে মাস কাটিয়ে দিতে পারলেই বাঁচে -- এমনই তাদের জীবনযাপন। চামোরোরা মাছ ধরা খুব পছন্দ করে, সমুদ্র সৈকতে গিয়ে পা বিছিয়ে বড়শী পেতে বসে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা, সাথে চলতে থাকে ঝাল আচার আর বীয়ার। জাপানী গাইড বলল, "চামোরোরা বারবিকিউয়ের গুরু, পৃথিবীর বেস্ট। গ্রীলড মাংসে বাটা মরিচ আর ভিনেগার মাখিয়ে খায়, এমন খাবার আর হয়না! সাথে বীয়ার হলে তো কথাই নেই।" বোঝা যায়, কি মজায় নিজের দেশ ছেড়ে ভদ্রলোক এখানে পড়ে আছেন। কথাপ্রসঙ্গে জানা যায়, পেঁপের আচারও সাইপানিজদের খুব পছন্দ। এদেশে পেঁপে অত বড় হয়না, ছোটছোট কষালো পেঁপেকে তাই বাটা মরিচ আর ভিনেগারের সাথে কচলে আচার করে খায়, উলসসস। লোকটা যখন খাবারের বর্ণনা দিচ্ছিল, তখন তার বর্ণনা থেকেই বোঝা যাচ্ছিল ব্যাটা আজ বিকেলেই বাসায় ফিরে এই খাবারগুলো খাওয়ার ব্যবস্থা করবে! তবে আমরা যেটা আবিস্কার করলাম, সেটা হলো সাইপানীরা মসলা বলতে দুটো জিনিসকেই বোঝে -- বাটা মরিচ আর ভিনেগার। তবে যেকথাটা না বললে অবিচার হয়ে যায়, সেটা হলো আমরা খুব ভাগ্যবান যে গাইড লোকটা খুব উঁচুমানের প্রফেশনাল ছিল। লোকটি একটি মুহূর্তের জন্যও ট্যুরটাকে বোরিং মনে হতে দেয়নি। যখন দেখার মতো জিনিস ছিলো, তখন সেগুলোর বর্ণনা দিয়েছে; যখন ছিলনা, পাহাড়ী বা জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে গাড়ীর একঘেয়ে ঝাঁকুনীর মধ্যে দিয়ে চলেছি, তখন সাইপানের দৈনন্দিন জীবন আর ইতিহাস নিয়ে মজার মজার তথ্য দিয়েছে।

(এই লেখাটি আর এক লাইনেই শেষ হয়ে যেত। এর পরের লাইনটি ছিল, "ঠিক করে রেখেছি এরপর যতবার সাইপান যাবো, গাইড লোকটাকে ফোন দিয়ে বলব "আসো, আমাদের অমুক জায়গায় নিয়ে যাও"। দুঃখের বিষয় হলো, লাইনটি রাখতে পারলামনা, অর্থাৎ এক্সাপঞ্জ করতে হলো।)

*****************************************
*******************************************

এই লেখাটি যখন লিখতে বসলাম, তখন আমি গাইড লোকটার নাম ভুলে বসে আছি। লিখতে লিখতে মনে হলো, নাহ্, লোকটার নামটা ঠিকভাবে না জেনে লেখাটা শেষ করা উচিত হবেনা। এত চমৎকার একটা ট্যুর যে আমাদের উপহার দিয়েছে, তার নামটা অন্ততঃ এই লেখায় আসা উচিত। তার নাম কাতাওকা, নাকি কাওয়াকিতা নাকি অন্যকিছু -- আমি ভীষন কনফিউজড। কি আর করা, গুগল সার্চ দিলাম, কী ওয়ার্ড -- পাউপাউ ট্যুর, সাইপান, স্টাফ। পাউপাউ ট্যুরের হোমপেজ পেলাম, কিন্তু দেখি কোন জাপানী লোকের নাম নেই!! তখন নেটে আরো খুঁজতে গিয়েই ভয়াবহ খবরটার মুখোমুখি হতে হলো। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল, বারবার মনে হচ্ছিল, "আসলেই!! বাইরে থেকে দেখে মানুষকে কতটা চেনা যায়?"

লোকটার নাম খুঁজে পেয়েছিলাম, মানে ইন্টারনেটে দেখে মনে পড়েছিলো। মিঃ কিতাওকা জুন। তার সম্পর্কে ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০০৮এর (আমাদের ট্রিপের মাত্র সাত সপ্তাহ পরে) মারিয়ানা নিউজে একটি খবর বেরিয়েছে। খবরটা হলো,

জুন কিতাওকাকে সাইপান পুলিশ ধর্ষনের দায়ে গ্রেফতার করেছে!!

পুরো খবরটা কয়েকবার মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। ঐ ফেব্রুয়ারীর ২৮ তারিখেই সে দুজন জাপানীজ মহিলাকে নিয়ে ট্যুরে বেরিয়েছিলো। গল্প করতে করতে খাতির হয়ে যায়, দুই কাস্টমারসহ কিতাওকা যায় এক রেস্টুরেন্টে খেতে। প্রচুর পরিমাণে এ্যালকোহল টেনে দুজন মহিলারই ভালো হ্যাংওভার হয়ে যায়, কিতাওকা তাদের হোটেলে ড্রপ করতে আসে, রূম পর্যন্ত নিয়ে যায়। সেখান থেকেই যা হবার তা হয়। একজন মহিলা ধর্ষনের ভিকটিম হয়, সেদিনই সে পুলিশে জানায়। এদিকে কিতাওকা দাবী করছে যে সে ধর্ষন করেনি, জোরাজুরি করেনি, মহিলার সাথে মহিলার অনুমতিক্রমেই শুয়েছে। কিতাওকাও ক্ষতিপূরণ মামলা করেছে, তবে "৬০ হাজার ডলার বিনিময়ের জামিন" না নিতে পারায় সে এখনও চৌদ্দশিকেতেই আছে।

মনে মনে শুধু এটাই বলতে পারি যে কিতাওকার দাবীটাই যাতে সত্য হয়, যাতে জানতে পারি অমন হাসিখুশী লোকটা আসলে এরকম জঘন্য কিছু করেনি। তবে এটাও ঠিক যে, কোনটা সত্য, সেটা কি মামলার রায়ে বোঝা যাবে? কাজেই কোনদিনই সত্যটা হয়ত আমরা জানতে পারবনা। হাসিখুশী, দিলখোলা, ভালোমানুষ বলে যে কিতাওকাকে চিনেছিলাম, তার সম্পর্কে একটা সন্দেহ মনের মাঝে থেকেই যাবে -- পরে কখনও সাইপান গেলে নিশ্চয়ই মনে হবে "কোনভাবেই যেন কিতাওকার সাথে দেখা না হয়।"


মন্তব্য

দিগন্ত এর ছবি

কাতাওকা সম্পর্কে এরকম জানিয়ে দিয়ে আপনি গল্পের শেষে মুডটাই মেরে দিলেন মন খারাপ ... অপ্রিয় সত্য না বললেই হত।

আর বানজাই ক্লিফের গল্পটা আমারো বিশ্বাস হয়নি, কিন্তু আমি অন্যরকম ভেবেছিলাম। আমার ধারণা, অনেকেই পালিয়ে গিয়েছিল আর গুটিকয়েক আত্মহত্যা করছিল। আমেরিকান সৈন্যরা অথবা জাপানী সৈন্যরা "সবাই আত্মহত্যা করেছে" ব্যাপারটা রটিয়েছিল। তবে সংখ্যাটা কোনোভাবেই আট হাজার বলে শুনিনি কখনও। উইকিতেও সংখ্যাটা কয়েকশো বলেই লেখা আছে। আর এগুলো চাপা থাকার তো কোনো কারণ জানি না, আজকে জাপানও এই কথা তুলতেই পারত .. কারোরই কোনো আসলে কোনো প্রমাণ হাতে নেই।

তবে বিশ্বাসের কারণে মৃত্যু আপনার কেন বিশ্বাস হচ্ছে না সেটা আমি জানি না। আমার মনে আছে আমেরিকায় অনেক লোক একসাথে আত্মহত্যা করেছিল কাছাকাছি একটা ধুমকেতুতে চড়ে স্বর্গে যাবে বলে। আরো আগে ১৯৭৮ এ গায়ানাতে ৯১৪ জন আমেরিকান একসাথে আত্মহত্যা করেছিল একই কারণে (আরো কিছু , আর এখানেও) । আর যুদ্ধের বাজারে কয়েকশো তো জলভাত ...


হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

হুমমম, বেশ দ্বিধাতেই ছিলাম লিখব কি লিখবনা ভেবে ,,,, পরে ভাবলাম, মনের মাঝে জমে থাকা কথাতো লেখার জন্যই ,,, আমি এখনও শকড!!!

মজার ব্যাপার কি দিগন্ত, যুদ্ধাপরাধ টাইপের ব্যাপারগুলোতে "কারোরই কোনো আসলে কোনো প্রমাণ হাতে নেই" টাইপের কথা প্রায়ই শোনা যায় .... আজকের জামাতওয়ালারাও দেখুন,এই টার্ম ব্যবহার করছে ... আমি মনে করি এত বড় একটা ঘটনা, অবশ্যই ঠিকভাবে তদন্ত করলে অনেক কইছু বেরিয়ে আসবে ,,,, "প্রমাণ নেই" বলে আসলে ফাইল চাপা দেয়া হয়, পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া হয় ,,, আমার কথা হলো, "প্রমাণ নেই তো কি হয়েছে? প্রমাণ বের করো" -- সাধারণ কমনসেন্স তো বলে প্রচলিত কাহিনীটা হবার না

৮ হাজার তথ্যটা আমি পেয়েছি সাইপানেরই আমেরিকাচালিত পিস-মেমোরিয়াল পার্কের যাদুঘরে ,,, ভিডিওতে ,,,জাপানী সৈন্যরা কখনও বলেনি আট হাজার লোক আত্মহত্যা করেছিলো ... এটা ছিল আমেরিকান প্রচার...তখনকার জাপানী সেনাবাহিনীর অবস্থা ছিল আজকের আলকায়েদার মতো ... নিষিদ্ধ!!! ....তাদের কোন কথাকে কেউ কেয়ার করেনি .... আর এত বিশাল মাসপোপুলেশনের কোথায় পালিয়ে যাবার প্রমাণও নেই ,,,, এরা আসলেই মারা গেছে

আর আপনি যে ধুমকেতু বিশ্বাসের উপমা টানলেন, সেটা এখানে খাটছেনা ,,, যুদ্ধে এভাবে আত্মহত্যা করে শুধু নির্যাতিত নারী, আর পরাজিত সেনাপ্রধান ,,, এই আট হাজার লোক কোন রকম ফ্যান্টাসী থেকে আত্মহত্যা করেনি যে তাদের মৃত্যুকে একটা কাল্টের কার্যকলাপের সাথে মিলিয়ে ফেলতে হবে .... যুদ্ধের বাজারে কয়েকশ জলভাত বলেছেন, তবে সেটা আত্মহত্যার জন্য না, বরং দখলদারদের দ্বারা হত্যার জন্য

আপনি কেন আমেরিকান বাহিনীকে ডিফেন্ড করছেন জানিনা ... কিন্তু এখানে কই এখটু ভাবলেই হয়না? .... সম্ভবতঃ দুই তিন সপ্তাহর টানা উত্তেজনাকর যুদ্ধের পর এক বাহিনী দ্বীপ দখল করেছে .... পরাজিত বাহিনীর সেনাপ্রধান আত্মহত্যা করেছে ,,,, পরাজিত সেনারাও জান নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে ,,, এমন সময় পরাজিত জনগোষ্ঠীর আট হাজার লোক এক সকালেই মরে গেল ,,, এখানে এই আট হাজার মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ কি হতে পারে? আত্মহত্যা?? আই কান্ট বাই দিস, স্যরি ...

জাপানী সামুরাইদের যুদ্ধে হেরে গেলে আত্মহত্যার যে মীথ প্রচলিত আছে, সেটার প্রলেপ দিয়েই এই মৃত্যুগুলোকে ধামাচাপা দেয়া হয়েছে বলে আমি মনে করি ...অন্ততঃ জাপানে এতদিন থেকে এটা বুঝতে পেরেছি যে সামুরাইরা এমনি এমনি পেট কাটতনা ,,, কেউই নিজের পেট কেটে মরতে চায়না ,,, তাদের উপর সমাজ থেকে চাপ আসত ,,, ভয়ানক চাপ ,,, দায়িত্বশীলতাজনিত চাপ ,,,সেই চাপে জাপানীরা এখনও আত্মহত্যা করে ,,,, কিন্তু সেটাকে আটহাজার লোকের লাইন ধরে পাহাড়ের চুড়ায় উঠে ঝাঁপ দিয়ে মরার ব্যাপারে ব্যাখ্যা হিসেবে দাঁড় করানোর অর্থ একটাই --- "যা হবার হয়ে গেছে, পাস্ট ইজ পাস্ট; ভুলে যাও।"

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

দিগন্ত এর ছবি

আপনি কেন আমেরিকান বাহিনীকে ডিফেন্ড করছেন জানিনা

দুঃখিত আমার মন্তব্য এরকম মানে নেবেননা। আমি গল্পটা অনেককাল আগে শুনেছিলাম। তখন আমার যা যা মনে হয়েছিল সেগুলোই বলেছি। কোনো সংশয়ই নেই যে আমেরিকান সৈন্যদলের গণহত্যা চাপা দেবার একটা প্রয়াস এটা হতেই পারে।

আবার কমেন্ট করব একটু পরেই ...


হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

দুঃখিত, আমি আসলে সেভাবে মিন করিনি ,,, রূঢ় শোনালে আসলেই ক্ষমা চাইছি
আমার মনে হয়েছে আপনি বলতে চেয়েছেন আত্মহত্যারও যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

দিগন্ত এর ছবি

কয়েক হাজার বাসিন্দার মধ্যে সংখ্যাটা কয়েক'শ হলে আত্মহত্যার একটা সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু আট হাজার হলে অসম্ভব ...


হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

দিগন্ত, গায়ানা'তে জিম জোন্স-এর সাথে যারা মারা গিয়েছিল, তারা কিন্তু সবাই স্বেচ্ছায় মরেনি। জোরাজুরি করা হয়েছিল কারো বেলায়। এই বিষয়ে শিব নাইপলের প্রামাণ্য গ্রন্থটি অবশ্যপাঠ্য। (ইনি নোবেলজয়ী ভি এস নাইপলের সহোদর, দুর্ভাগ্যক্রমে অল্প বয়সে মারা যান।)
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

দিগন্ত এর ছবি

আমি জানি সেটা, কিন্তু সেটা এখানেও হয়ে থাকতে পারে। সবাই স্বেচ্ছায় করেছে কিনা সেটা তো কেউ দেখে নি।


হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় এর ছবি

পড়ছি হাসি
................................................................................
objects in the rear view mirror may appear closer than they are ...

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

ধন্যবাদ
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ওসব কিচ্ছু না
আমেরিকানদের ভয়ে গিয়ে পাহাড়ে পালিয়েছিল দ্বীপের লোকজন
ভেবেছিল অতদূর পর্যন্ত আর ধাওয়া করে আসবে না

কিন্তু যখন সেখানেও মিলিটারি চলে এলো তখন এদিক সেদিক পালাতে গিয়ে মরল কিছু
আর বাকিদের পেছনে গুলি খরচ না করে মিলিটারিরাই মারল ওখান থেকে ঠেলে ঠেলে ফেলে। অথবা গুলি করে ফেলে দিলো ছুঁড়ে

কিন্তু মানুষকে এভাবে মারা তো যুদ্ধআইনে সম্মানজনক না
তাই দোষ পড়লো মৃত ব্যক্তিদের উপর আত্মহত্যার
আর সেই যুক্তিকে পাকাপোক্ত করল জাপানের হারিকিরির ইতিহাস

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

পিস মেমোরিয়াল মিউজিয়ামের ভিডিওটা দেখে আমার যে খটকাটা লেগেছিলো, সেটা পুরো দূর হয়ে যায় আপনার এই ব্যাখ্যায় ... ধন্যবাদ লীলেন ভাই

আমারও মনে হয়েছে শুধু গুজব থেকে তৈরী হুজুগ থেকে এরকম ম্যাসিভ সুইসাইড হওয়াটা "দুয়ে দুয়ে চার" করেনা .... দিগন্ত প্রসংগটা তুলে ভালো করেছেন .... অনেক ঘেঁটে একজন প্রত্যক্ষদর্শী জাপানী সৈন্যের (নাম তানাকা নোরিসুকে) লেখা বইয়ের কিছু অংশ পেয়েছি ... তার ভাষ্যমতে, নারকীয় উৎসব প্রত্যক্ষ করেই হতভাগা জাপানী বৃদ্ধ-নারী-শিশুরা ঝাঁপ দিয়েছিল বানজাই ক্লিফের চুড়া থেকে ... ঠিক করেছি একটা পোস্টই দিয়ে দেব

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

দিগন্ত এর ছবি

নারকীয় উৎসব প্রত্যক্ষ করেই হতভাগা জাপানী বৃদ্ধ-নারী-শিশুরা ঝাঁপ দিয়েছিল বানজাই ক্লিফের চুড়া থেকে

এটাই সবথেকে ঠিকঠাক। আমি জানি জাপানী সৈন্যদের মেরে আমেরিকানদের মধ্যে অঙ্গপ্রত্য্গ নিয়ে পুরষ্কার বিতরণ চলত। তবে যুদ্ধাপরাধের ব্যাপারে জাপানীরাও কম যায় নি। চিনে দেখেছি পরমাণু বোমা ফেলার দিন রীতিমত লোকজনে সেলিব্রেট করে ... এরা জাপানীদের এত অপছন্দ করে ...


হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

হুমমম, তখন ইউরোপে জাপানী সৈন্যদের মাথার খুলি কলমদানী হিসেবে ব্যবহার করেছেন এমন এলিট নারীও নাকি ছিলেন মন খারাপ

জাপানী নৃসংশতার বিষয়ে একদম একমত .... কোরিয়া-চীন আর পূর্ব এশিয়ায় জাপানীদের নৃসংশতা কল্পনাকে ছাড়িয়ে যাবার মতো ছিলো .... এখনও জাপানের বয়স্ক কোরিয়ানদের সাথে কথা বললে বোঝা যায়, কি কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছে তারা ... আমার মাঝেমাঝে এটা ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয় যে নেতাজীর ঘাড়ে চেপে জাপানীরা একবার ভারতবর্ষের কর্তৃত্ব নিয়ে ফেললে কি ঘটত!! ... জাপানীদের নেতাজী কি বুঝে এত বিশ্বাস করেছিলেন -- আমি বুঝিনা।

তবে ঘুরে ফিরে সেই একই .... ইতিহাস থেকে কেউ শেখেনা ... চীন এখন অত্যাচার চালাচ্ছে তিব্বত, উইঘুর, মংগোলিয়া সীমান্তে ...

সুযোগ পেলে কেউ কাউকে ছাড়েনা
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

অতিথি লেখক এর ছবি

ইতিহাসের ভয়াবহ বিষয় হল দুই বিপ্রতীপ সত্যের উপস্থিতি----যা- কিছুই সত্য হোক না কেন--কোন এক পক্ষের কারণে অন্য পক্ষকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছে----এ চরম নিষ্ঠুরতা---যা সমর্থন করা যায় না।

আর ‘কিতিওকা’---হয়তো ----হয়তো বা না-----প্রকৃতিতে দু'টোই সত্য। আমরা নিজেরাও কি তা-ই না? (হয়তো বা এরকম ভয়াবহ সত্য সবার মাঝে সমান নয়----তবুও----)

আর ভ্রমণ কাহিনীতে স্থানের বর্ননা আরও দৃশ্যগ্রাহ্য হলে ভাল হয়। আড্ডা আর ঘুরে বেড়ানো আমার সবচেয়ে প্রিয় দুই সাথী। তাই--------

ক্যামেলিয়া আলম

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

ধন্যবাদ ক্যামেলিয়া আলম
ঠিক ধরেছেন, লিখতে গিয়ে কিছুতেই স্থানে ফোকাস করতে পারিনা মানুষের দিকে চলে যায় ফোকাস মন খারাপ

ইতিহাসের ভয়াবহতার ব্যাপারটা ঘটে আসছে অনাদিকাল ... আমেরিকার জেনারেল কার্টিস লুমে বলত, "২য় বিশ্বযুদ্ধে হারলে আমি হতাম পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ওয়ার ক্রিমিনাল" ....
কিতাওকার ব্যাপারটা কতটা ফ্রাস্টেইটিং বোঝাতে পারবনা
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

বউ নিয়ে যেখানেই বেড়াতে যাচ্ছি, সেখানেই শখ হয় দুজন একসাথে ছবি তুলি। কিন্তু, কে তুলে দেবে?

আমেরিকায় কিন্তু অন্যরকম দেখি। ছেলে-বুড়ো নির্বিশেষে একদম অচেনা কেউ এসেও জিজ্ঞেস করে, তোমাদের ছবি তুলে দিই?

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

তাই?
এখানেও মাঝে মাঝে যে হয়না, তা না .... বুড়োবুড়িরা বেশী করে
আমরাও কোথাও গেলে যদি মনে হয় যে দুজনে ছবি তুলবো, তখন বুড়োবুড়ি কেউ আশেপাশে থাকলে নিজেরা নিজেরাই কষ্ট করে ছবি তোলার কসরৎ করছি ভাব দেখাই .... মাঝেমাঝে কাজে দেয় হাসি

সাইপানে অবশ্য একবারও কেউ অফার করেনি ... কারণ সম্ভবতঃ সবাই ট্যুরিস্ট বলে .... আমি যে এ্যালগরিদম ফলো চোখ টিপি করেছি --- কোথাও ছবি তুলতে মন চাইলে প্রথমে সেখানে কোন কাপলকে গিয়ে অফার করেছি "দাও, ছবি তুলে দিই", তখন ওরা ভদ্রতা করে আবার আমাদেরটা তুলে দিয়েছে ... বাঙালী বুদ্ধি চোখ টিপি

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

banzai এর ছবি

২,৫ লাখ ডলার, বাঞ্জাই ক্লিফ আর কিতাওকার নাম শুনে অনেক পুরণো ঘটনার কথা মনে পড়ে গেলো।
আপনার টুর গাইড জুন কিতাওকা - হি হ্যাজ অ্যা চেকারড পাস্ট। সম্ভবতঃ ১০/১১ বছর আগের ঘটনা, কিতাওকাকে গভীর রাতে দুই জাপানী কোম্পানীর স্টাফ বাঞ্জাই ক্লিফ-এ তুলে নিয়ে হুমকি দিয়েছিলো, হয় ২,৫ লাখ ডলার ছাড়ো, নাহয় ক্লিফ থেকে জাম্প করে আত্মহত্যা করো। বেসবল ব্যাট দিয়ে কিতাওকাকে আচ্ছামত ধোলাই দিয়েছিলো তারা। সম্ভবতঃ কিতাওকা তাদের কোম্পানীর কাছ থেকে কিছু টাকা পয়সা হাতিয়েছিলো।
সে যাত্রায় রাত ৩টার দিকে এক কোরিয়ান টুর গাইড এসে পড়ায় কিতাওকার জান রক্ষা হয়েছিলো।
বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছি, যারা কথাবার্তায় অতীব পটু তাদের কারোকারো থেকে একটু সাবধান থাকতে হয়। যারা একটু কম কথা বলে, তারা সাধারণতঃ ওভারস্মার্ট লোকদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে সৎ হয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।