২০০১ সালের অক্টোবরের ৮ তারিখ -- ইউএনএইচসিআরের এক বন্ধুর ফরোয়ার্ড করা একটি ইমেইল পেলাম। জানতে পেলাম, কাবুলে ইউএনএইচসিআরের জাপানীজ যে টিমটি ছিলো, তার প্রধান মিস চিবা পদত্যাগ করেছেন। ফরোয়ার্ড করা মেইলটি ছিলো মিস চিবার লেখা মেইল।
তার আগেই ছয় তারিখ থেকেই তালিবান নিধনের নামে আফগানিস্তানের আকাশ বাতাসে ছুটে বেড়াচ্ছে অসংখ্যা মৃত্যদূত -- ক্লাস্টার বোমা। মিস চিবার মেইলে জানতে পারলাম কিভাবে আকাশের দিকে চোখ মেলে মৃত্যুর অপেক্ষায় আছে শরণার্থী ক্যাম্পের মানুষগুলো, যাদের কেউই জানেনা তাদেরকে কেন মরতে হবে।
ইমেইলটি পড়ার আগে আমার ধারনাই ছিলোনা একটা জায়গায় যখন যুদ্ধ শুরু হয়, তখন সেখানকার সাধারণ নাগরিকেরা কতটা অসহায় হয়ে পড়ে। আমার মনে পড়ে যায় মায়ের বলা একাত্তরের কথা, তাঁরা শংকিত থাকতেন এই ভেবে যে যেকোন সময় শুনতে পাবেন "পাঞ্জাবীরা বাজারে এসে পড়েছে!" খবরের কাগজে বা সিনেমায় যখন দেখেছিলাম ফিলিস্তিনের শিশুরা, দারফুরের হাড়সর্ব্স্ব মানুষেরা অথবা রুয়ান্ডার হতভাগাদের দল -- আমার মিস চিবার সেই ইমেইলের আর্তনাদের একটা লাইন মনে পড়ে যায় -- "অজানা কারনে আমাদের কেন মরতে হবে? কেন?"
সেইসব মানুষদের সবাইকে উৎসর্গ করে এই কবিতা।
/_/_/_/_/_/_/_/_/_/_/_/_/_/_/_/_/_/_/_/_/_/_/_/_/_/_/
[sb]অভয়ারণ্যে অশ্লীল কনসার্ট[/sb]
আমাদের এই ছোট্ট শহর, ছিলো শুধুই এক অভয়ারণ্য।
এখানে বিকেলের মজা রোদ্দুরের পর,
হালকা বৃষ্টির রিমঝিম হতো, তারপর,
দামাল ছেলের দল দলবেঁধে নেমে যেতো পথে, মাঠে
হৈ হৈ রৈ রৈ, হৈ হৈ রৈ রৈ,
ফুটবল, দাঁড়িয়াবান্ধা, পিস্তল পিস্তল খেলা, আরো কত কি!
আকাশ বাতাস জুড়ে প্রাণের মেলা বসেছে -- মনে হতো, আহা!
আমাদের মেয়েরাও বের হতো,
বান্ধবীরা ঘুরতো একসাথে, খোশগল্প, হাসাহাসি, ঠাট্টা মস্করা।
অথবা জানালায় বয়ে যাওয়া, মৃদু বাতাসের ফাঁকে,
অবাক নয়নে থাকতো তাকিয়ে।
স্বপ্নে ভরা, অদ্ভুত সুন্দর সেই, ঝকঝকে কিশোরীনয়ন।
বাবা-চাচারা হাটবাজারের চায়ের দোকানে বসে,
উন্মাতাল করে তুলতো চারপাশ, আকাশ পাতাল, দুনিয়াদারী।
কত আলোচনা! কত বিশ্লেষণ! হুমকি, ধামকি, হাহাকার!!
মায়েরা ব্যস্ত সন্ধ্যার নাশতায়,
নানান হেঁশেলের ধারে নানান অদ্ভুত ঘ্রাণ।
সবই ছিলো আমাদের, সবই ছিলো,
ছিলো সে এক অভয়ারণ্য।
আমরা আমাদের বাবা-মা, ভাই, বোন,
ছেলেদের আর মেয়েদের নিয়ে, ভালোই ছিলাম,
বেশ ভালোই ছিলাম সেই অভয়ারণ্যে।
আমাদের অর্থ ছিলোনা, সম্পদ ছিলোনা,
অথবা বাহাদূরীও ছিলোনা, মানি।
তাও,
আমাদের নিজহাতে আঁকা বৃত্তের মাঝে,
দারিদ্র্যের কুয়াশায় ঘেরা এই শহরের আঁচলে ঢাকা পড়ে,
আমরা ভালোই ছিলাম, সুখেই ছিলাম।
হঠাৎ একদিন কুয়াশার আঁচল খসে পড়ে,
আমাদের ছোট্ট শহরটির সম্ভ্ডমহানির আয়োজন শুরু হয় যেন,
একদিন খবর আসে, আমরা শুনতে পাই,
"ওরা আমাদের আক্রমণ করবে" -- ওরা কারা?
আমরা জানিনা, আমরা চিনিওনা।
তাও শুনি,
আকাশ থেকে আসবে উড়ে, পড়বে পাতাল ফুঁড়ে,
বিশাল বিশাল ধাতব দানবের দল।
দাউ দাউ করে জ্বলবে আগুন, সে আগুনে রোদ পোহানো যাবেনা।
সে আগুনে মৃত্যু হবে,
আর,
আর সেই মৃত্যুতে নাকি একদল মহামনাবের দল,
চিরতরে "নিরাপদ" হয়ে যাবে।
আহা! নিরাপদে চা-কফি-বিস্কুট-আপেল-কমলা-নাশপাতি খাবে।
বড় বড় মানুষেরা সব, নিরাপদ হয়ে যাবে।
আমাদের বলা হলো,
আমাদের ছেলেদের আর খেলতে হবেনা,
দুচারটা হাত-পা উড়ে গেলেই চলবে।
আমাদের মেয়েদের আর তাকিয়ে থাকার দরকার নেই,
কারণ কিছু চোখ অন্ধ হতে হবে ক্লাস্টার বোমায়।
আমাদের মায়েদের উনুনে হাঁড়ি না বসালেও চলবে,
হেঁশেল থেকে বারুদের গন্ধ বেরুলেই চলবে।
আর আমাদের বাবাদের,
কি হলে চলবে, সেটা না জানলেও আমাদের চলবে।
আমাদের জীবন থেকে খেলাধুলা, প্রেম,
আহার, নিদ্রা,আলোচনা, সমালোচনা, আর ভালোবাসা --
সব চলে যেতে হবে,
সব দূর হয়ে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে!
আমরা এখন একে অন্যেকে জড়িয়ে ধরে কাঁপতে থাকি
(যদিও তেমন শীত নেই আশপাশে)।
আমরা অপেক্ষায় থাকি,
কখন আসবে উড়ে, আকাশ-পাতাল ফুঁড়ে,
সেইসব মহান ধাতব দানবের দল,
ফুটো করে দেবে শহরের বিনীত আঁচল।
কেউ যদি যায় বেঁচে, সেটা হবে নাকি তার, "ভীষন উপরি পাওয়া।"
আমরা এখন তাই, প্রতিটি দিনের প্রতিটি সময়,
আমাদের এই নিরাপদ অভয়ারণ্যে,
মৃত্যুর অপেক্ষায় আকাশপানে চেয়ে থাকি,
অপেক্ষায় থাকি, কখন শুরু হবে মৃত্যুর কনসার্ট।
/_/_/_/_/_/_/_/_/_/_/_/_/_/_/_/_/_/_/_/_/_/_/_/_/_/_/
ফুটনোট: মিস চিবার ইমেইলের বাংলা অনুবাদের অনুমতি চেয়েছিলাম আমি, বাংলাদেশের সংবাদপত্রে দেবো বলে। ইউ এন এইচ সিআর থেকে নিষেধ করা হয়েছিলো। ঐ চুদির পুতেরা আবার গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলে!!!!
মন্তব্য
হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া কবিতা।
এখনও পৃথিবীতে কিছু বিবেকবান মানুষ রয়েছে যাদের কেনা সম্ভব নয়। মিস চিবার ইমেইলটি পড়ার অপেক্ষায় রইলাম। সচল ইমার্জেন্সী গ্রুপে কি দেয়া যায়?
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
ধন্যবাদ রেজওয়ান ভাই
মেইলটা আমাকে খুঁজতে হবে ... সাত বছর আগের মেইল তো .... খুঁজে পেলে অবশ্যই তুলে দেবো
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
হায়!
কেবলই মন খারাপ হয়ে যায়.............
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
নতুন মন্তব্য করুন