৫.
৩৭, ওয়াজী লেনের জীর্ণ-শীর্ণ একটি তিন তলা বাড়ী, চার ইউনিটের ছোট ছোট খুপরীর মতো ঘর প্রত্যেক তলায়। বাইরের দেয়ালের যেটুকু অংশে শ্যাওলা বা জংলা পাতা জন্মায়নি, সেটুকু অংশের পুরো পলেস্তরা খসে গেছে, এমনও হতে পারে আসলে পুরো বাড়িটিরই পলেস্তরা খসে গেছে অথবা কখনও সেটা ছিলোইনা, তবে সেটা নিয়ে ভাববার বা চিন্তিত হবার অবকাশ হাসনাইন বা রাজুর এ মুহূর্তে নেই। এই বাড়ীরই তিনতলার দক্ষিণ-পূর্বকোণের ঘরটিতে থাকে গল্পের বর্তমান আসামী, তথাকথিত ডিটেকটিভ তোজাম্মেল। বাড়ীতে দারোয়ান নেই, বাড়ীর সামনেই লাল লাল ইটবিছানো ভাঙা রাস্তার একপাশে বসে গুল্লি খেলছে কতগুলো বাচ্চা, ন'দশের বেশী বয়েস হবেনা কোনটিরই।
আজ সকাল থেকে বারবার আসা পুলিশের লোকদের অবশ্য এই গলিতে ঢুকতেই কষ্ট হয়েছিলো খুব, মূলতঃ পাবলিকের ভীড়ের কারণে; "পুলিশ এসেছে" এই তথ্যটি এদের মাঝে আলোর বেগের চেয়েও বেশী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিলো বারবার, এবং হাসনাইনের কলিগদের ভাষ্যমতে তারচেয়েও বেশী বেগে যেন লোকজন সবাই দলবেঁধে এসে গলির মুখে হাজির হয়ে উপচে পড়ছিলো। এসব তথ্য হাতে নিয়েই ওয়াজী লেনের বাসাটির সামনে এসে দাঁড়ায় হাসনাইন আর রাজু, তবে জনগণের অপ্রয়োজনীয় মনোযোগের হাত থেকে তারা বেঁচে যায় শুধুমাত্র ডিবির লোক হবার কারণে; সিভিল ড্রেসের পুলিশে পাবলিকের তেমন রুচি নেই, বুঝতে পারে দু'জনই, তবে এনিয়ে তারা হতাশ না আনন্দিত সেটা বোঝা যায়না।
গুল্লি খেলতে থাকা বাচ্চাগুলোকে জিজ্ঞেস করে জানা যায় যে এবাড়ীর মালিক এখানে থাকেনা বহুদিন, সবাই ভাড়াটিয়া। বাড়ীর চারপাশে ঘোরাঘুরি করে, এদিক সেদিক, উপর নিচে তাকিয়ে হাসনাইনের এও মনে হলো যে বাড়ীটির সবগুলো ফ্ল্যাটে হয়তো মানুষ থাকেওনা; বেশ কয়েকটি ঘরের জানালায় পর্দা নেই, ভেতর থেকে ছাদ দেয়াল দেখা যায়, নোংরা যদিও। তাছাড়া আশপাশটা কেমন নীরব শুনশান, বাড়ীর চারপাশে গজিয়ে ওঠা জংলা পরিবেশের কোনরকম যত্ন নেয়া হয়নি অনেকদিন, বোঝা যায়। একতলার একটি ফ্ল্যাটের জানালায় দেখা যায় কালোপর্দার এপাশে বেশ কয়েকটি নানান ধরনের সাহেবী টুপি ঝোলানো, একপাশে একটি ছড়ি; কমেন ভুতুড়ে, রহস্যময় একটা আবহ।
তিনতলার দক্ষিণ-পূর্বকোণের তোজাম্মেলের ফ্ল্যাটের জানালায়ও পর্দা একটা ঝুলতে দেখা যায়, এবং একতলা থেকে দেখেও মোটামুটি আন্দাজ করা যাচ্ছে যে কেনার পর আর কখনই ধোয়া হয়নি ওটাকে। সেদিকে তাকিয়ে থেকে ডানহাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে বাঁহাতের নখে মৃদু আঘাত করতে করতে হাসনাইন জিজ্ঞেস করে, 'আচ্ছা রাজু, হোয়াট ওয়াজ সো রং?'
নড়েচড়ে ওঠে রাজু, বলে, 'স্যার, খুব ক্ষীণ একটা সন্দেহ, তাও মনে হচ্ছে তোজাম্মেল খুনী নাও হতে পারে। প্রথমত দেখুন, তোজাম্মেলের পেটে কোন আঘাত বা কোমরে কোন ব্যথা নেই যেটা ডাক্তার বললেন, আর দ্বিতীয়ত সে সবসময়ই একদম তালগাছের মতো সোজা হয়ে হাঁটে, হাজতে আজ আমি কয়েকবারই খুব খেয়াল করে পর্যবেক্ষণ করেছি।'
হঠাৎ সতর্ক হয়ে যাবার দৃষ্টি হাসনাইনের, রাজুর দিকে তাকিয়ে বলে, 'বলতে চাচ্ছো যে, সিসিটিভিতে দেখা আসামী যেভাবে ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটছিলো তাতে অবশ্যই তার পেটের কাছে কোথাও আঘাত থাকার কথা?'
'জ্বি স্যার, হয় আঘাত বা কোন সমস্যা থাকবে, না হয় তার স্বাভাবিক হাঁটার ঢংটাই হবে ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটা। কিন্তু এর কোনটিই তোজাম্মেলের বেলায় মিলছেনা।'
'হুমম, তোমার পয়েন্টটা ফেলে দেবার মতো না। কিন্তু এমন কি হতে পারেনা যে রেডড্রাগনে তোজাম্মেল ইচ্ছে করেই ওভাবে হেঁটেছে।'
'স্যার, আমি সেখানে পিয়ানো বাজাচ্ছিলাম, কালো চশমার আড়ালে খুব ভালো করেই হ্যাটপরা লোকটির হেঁটে যাওয়া লক্ষ্য করেছি, চোখে পড়ার মতো হাঁটার ঢং। আমার মোটেও মনে হয়নি যে অভিনয় করে হাঁটছে, যদিও এটাকে কোন প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরা সম্ভব না। তাছাড়া ভাবুন স্যার, যে লোক নিজের ট্রেডমার্ক হ্যাট, জুতো, ওভারকোট সব পরে একেবারে নিজেকে মেলে ধরতে এসেছিলো, আর এমনকি আঙুলের ছাপও রেখে গেছে বিষের গ্লাসে, সে শুধু বেছে বেছে নিজের হাঁটার ঢং বদলাবে কি কারণে?'
'হ্যাঁ, তোমার কথাটা ঠিকই আছে,তবে দেখো ভায়া, সব সমস্যাই বা সন্দেহইতো ঐ ফিঙ্গারপ্রিন্টে এসে আটকে যাচ্ছে! এভাবে খাপেখাপ ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিলে গেছে, এখন আমাদের কিন্তু তোজাম্মেলের অপরাধী না হবার সম্ভাবনার চেয়ে অপরাধী হবার সম্ভাবনা যে অনেক বেশী সেটা ধরে নিয়ে সাপোর্টিং তথ্য-প্রমান খোঁজার চেষ্টা করতে হবে।' খানিকটা দম নিয়ে আবার বলা শুরু করে হাসনাইন, 'আর তাছাড়া পুলিশের ডেটাবেসে আমরা খুঁজে দেখেছি, তোজাম্মেলের ফিঙ্গারপ্রিন্টের সাথে মোটামুটি মিল আছে এমন আর কেউ আছে কিনা যাকে সন্দেহের তালিকায় রাখা যায়। একজনও পাওয়া যায়নি!'
"হুমম স্যার, সেটাও কথা। তবে স্যার, ফিঙ্গারপ্রিন্ট কিন্তু এখন নকল করে বানানো যায়। ন্যাশনাল ট্রেজার মুভিটাতে দেখেছিলেন, মনে আছে?'
'জানি সেটা রাজু, তবে তোমার কি ধারনা সেই প্রযুক্তি এরই মধ্যে বাংলাদেশে চলে এসেছে? আর তাছাড়া তোমার কথা সত্য হলে সেটার মানে দাঁড়াচ্ছে যে তোজাম্মেলকে কেউ ফাঁসিয়ে দিতে চেয়েছে।' যুক্তির ক্রমাগত প্রবাহে হাসনাইন খানিকটা উত্তেজিত, বলে যায়,'অথচ দেখো, তোজাম্মেল এমন কোন শত্রুর নামও বলতে পারছেনা যে কিনা তাকে ফাঁসাতে পারে। বরং যতটুকু খোঁজ নিয়ে দেখেছি তাতে তোজাম্মেলের গোয়েন্দা ক্যারিয়ারের বারোটা বাজিয়েছে খন্দকার সাহেবের এ্যাপয়েন্ট করা লোকটা, নাম কি যেনো, ওহ, মোজাম্মেল, রাইট? লোকটাকে দেখে আসলেও বুদ্ধিমান মনে হয়। তবে সেক্ষেত্রে, ফাঁসালে তো বরং তোজাম্মেলেরই প্রতিশোধ নেবার লক্ষ্যে মোজাম্মেলকে ফাঁসানোর চেষ্টা করার কথা!" একটানে বলে যায় হাসনাইন, একটু থেমে তারপর কিছুটা নমনীয় গলায় বলে, "তাও তোমার সন্দেহের কারণে এখন তল্লাশীর সময় দেখবো তোমার সন্দেহের পক্ষে কিছু পাওয়া যায় কিনা।"
রাজু আর কিছু বলতে পারেনা, শুধু মনের ভেতরে জন্ম নেয়া সামান্য খটকাটাকে বয়ে নিয়েই হাসনাইনের সাথে এগিয়ে যায় সিঁড়ি বেয়ে। ওয়ালী বক্সের স্ত্রী সিনথিয়া বক্স হত্যার রহস্য উদঘাটনের জন্য রাজুকে স্পেশাল এ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে রেডড্রাগনে পাঠানো হয়, অন্ধ পিয়ানিস্ট সেজে সে একসপ্তাহ ধরে রেড ড্রাগনের কাস্টমারদের গতিবিধি লক্ষ্য করেছিলো। অথচ তার চোখের ওপরই এরকম একটা ঘটনা ঘটে গেলো, সে টেরও পেলোনা, যেজন্য এক ধরনের অপরাধবোধ তার মধ্যে কাজ করে যাচ্ছিলো গতকাল থেকেই। 'সেজন্য কি হাসনাইন ভাই আমার কথাবার্তাকে তেমন পাত্তা দিচ্ছেনা?' ভাবতে ভাবটে এ সন্দেহটাকেও সে ঠিক বাতিল করে দিতে পারেনা; এনিয়ে কিছুটা মনোক্ষুন্নও সে বটে এমুহূর্তে, তাও কর্তব্যের খাতিরে হাসনাইনকে অনুসরন করা আর সহযোগিতা করা ছাড়া অন্যকোন পথ থাকেনা তার।
'স্যার, কোন কারণে আপনার কি মনে হয় এটা সাইকো কিলিং হতে পারে?' রাজু জিজ্ঞেস করে।
'আরে নাহ! যেখানে দু'বারই ফিমেইল ভিকটিম, সেখানে সাইকো কিলিংয়ে কোন শারীরিক নির্যাতন থাকবেনা সেটা হয়না। আর সাইকো কিলিংয়ে সাধারনত খুনীরা কিছু সাইন ব্যবহার করে, মেসেজ রেখে যায়। যেটা অনেকটা পুলিশের বা ডিবির প্রতি চ্যালেঞ্জের মতো। এখানে তো তেমন কিছু নেইই, বরং তোজাম্মেল তো একদম সেধে সেধেই আমাদের হাতে ফিঙ্গারপ্রিন্ট তুলে দিয়ে রেখেছে। সাইকো কিলাররা অনেক ঘাঘু।'
'তা, ঠিক।'
'আমার ধারনা তোজাম্মেল হিটম্যান হয়ে কাজ করেছে। অনেকদিন ধরেই তার আয় রোজগার প্রায় নেই বললেই চলে, সে নিজেও স্বীকার করেছে সেটা। চলো দেখা যাক, ফ্ল্যাট তল্লাশি করে কিছু পাওয়া যায় কিনা।' বলতে বলতে কর্তব্যরত পুলিশের গার্ডকে আই.ডি দেখিয়ে ভেতরে ঢুকে যায় দু'জন।
তোজাম্মেলের ফ্ল্যাটটি পুলিশ সীল করে রেখেছে আগের রাত থেকেই, সেখানে এখনও দু'চারজন পুলিশের গার্ড দায়িত্বে আছেন। প্রতিদিন তিন শিফটে কয়েকজন করে থাকছেন, পুলিশের তল্লাশী শেষ হওয়া পর্যন্ত বেচারাদের এভাবে পালা করে পাহারা দিয়ে যেতে হবে। গতরাতে আর আজ সকালে দুটো ভিন্ন দল দু'দফা তল্লাশী চালিয়েছে, তবে এখনও হত্যাকান্ড দুটোর সাথে সম্পর্কযুক্ত কোন আলামত তারা উদ্ধার করতে পারেননি। বেশ কিছু গোয়েন্দাগল্প, রহস্য উপন্যাস, সাইকো কিলিংয়ের বই অবশ্য পাওয়া গেছে; ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের দুই জুনিয়র অফিসারকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বইগুলো পড়ে কোন ক্লু বের করার, তবে এখনও সেগুলোর সাথে রেডড্রাগন ডাবল মার্ডার ঘটনার কোন সাদৃশ্য বা অন্তর্নিহিত সম্পর্ক থাকার আভাস মেলেনি।
(চলবে)
*********************************************
সুহান রিজওয়ানের লেখা গল্প 'ডিটেকটিভ'র প্লটটির উপর ভিত্তি করে লেখার একটা প্রচেষ্টা ।
বরাবরের মতো এ গল্পটিতেও নানান বিদেশী গল্পের ছায়া পাওয়া যাবে, কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে নিচ্ছি।
নজরুল ভাইর পরামর্শমতো ছোট ছোট করে পরপর পোস্ট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, প্রতিদিন দু'বেলা দুটো করে পোস্ট ছাড়বো ভাবছি; এতে কোন সমস্যা থাকলে মডুভায়ারা নির্দ্বিধায় জানাবেন প্লিজ।
মন্তব্য
চলুক...
আগ্রহ নিয়েই পড়ছি। গোয়েন্দাগল্প পড়তে মজা পাই।
এই পর্বে এসে ছোট্ট একটা কথা বলি... পর্বজুড়ে যে রাজু-হাসনাইন কথোপকথন, সেটার জন্য লোকেশন বাছাইটা পছন্দ হয় নাই। সম্ভাব্য খুনির বাড়ির সামনের প্রকাশ্যে খাড়ায়ে এতো কথা না বলে এই কথাগুলো তো তারা তাদের অফিসে বসেই সেরে ফেলার কথা।
আর একটা কথা... ধারাবাহিক গোয়েন্দা গল্পে ক্লিফ হ্যাঙ্গার একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার... পর্বের শেষ জায়গায় এসে লেখকের উপর চরম মেজাজ খারাপ হওন উচিত যে এরকম টানটান উত্তেজনায় রেখে চা খেতে গেলো কেন ব্যাটা? গত পর্বের ক্লিফ হ্যাঙ্গারটা (বাংলা কী?) দারুণ হইছিলো। আজকেরটা ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে গেছে। হইতে পারতো তল্লাশী চালাতে গিয়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কিছু পাওনের সম্ভাবনা...
যাহোক... এগুলা হুদাই কথা... গল্প মজা লাগতেছে। জানতে চাই খুনী কে? (এই নামে কাজীদার একটা বই ছিলো... আহারে, এখনো চোখে লেগে আছে)
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
ধন্যবাদ বস্, গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা জায়গা পয়েন্ট আউট করছেন।
তবে ক্লিফ হ্যাঙ্গার ছুইটা গেছে আপনার কথামতো অর্ধেক কইরা দিতে গিয়া কইলাম
ধন্যবাদ আবারও
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
দুই পর্ব একলগে দিলেও ক্ষতি আসিলো না। তবে এইবার যেটা বলার ছিলো- সেইটা নজরুল ভাই পয়েন্ট আউট করেই দিসেন- লিফ হ্যাঙ্গার রাখার বিষয়টা...।
এখন ৬ পড়তে যাইতেসি...
---------------------------------------------------------------------------
মধ্যরাতের কী-বোর্ড চালক
নতুন মন্তব্য করুন