চোখটিপের আর পলক পড়ার মাঝে কি পার্থক্য? যেকাউকে প্রশ্নটা করলেই ত্বরিৎ জবাব চলে আসবে, 'চোখটিপ একচোখে দেয়।' এখন যদি ত্যানা প্যাঁচাই, যদি বলে, 'কারও যদি শুধু একচোখেই পলক পড়ে, তাহলে?' ... সমস্যা নেই, উত্তর আছে ...'সময়ের দৈর্ঘ্য' ... চোখের পলক নিমিষেই পড়ে ... চোখটিপ বা উইংক দিতে হয় একটু সময় নিয়ে।
মনে করার চেষ্টা করুন প্রথম কবে উইংক করেছিলেন, কেমন ছিল সে ঘটনাটা? মনে করতে করতে আপাতত চোখটিপকে বিদায় দিই।
এর কাছাকাছি ব্যাপারগুলো নিয়ে একটু পড়াশোনা করি, শেষে আবার চোখটিপের কথায় ফিরে আসব।
***************************************
এডিসনকে নিয়ে একটা মুভি হয়েছিল, যেখানে দেখাননো হয় যে এডিসন তাঁর তৈরী 'কাইনেটোস্কোপ' বা সহজে বললে ভিডিও ক্যামেরা প্রথম ব্যবহার করতে যাচ্ছেন, ক্যামেরার সামনে একব্যাক্তি বসে আছেন (অনেক আগে দেখেছি কে, কেন বসেছিলেন কিছুই মনে নেই), এডিসন যেই ক্যামেরা অন করলেন, অমনি লোকটা দিল এক 'হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ--চ্চো!!'
জানিনা সত্যি কিনা, সত্যি হলে মানুষের তোলা প্রথম মোশন পিকচারটা হবে হাঁচি দেয়ার
আসলে তা না, তার অনেক আগেই মাইব্রিজ নামক আরেক নাইনটিন্থ সেঞ্চুরী গীক (বাংলায় কি আঁতেল বলা যায়, একটু ভিন্ন) বের করে ফেলেছিলেন বিদঘুটে নামের "জু ...স্কোপ' (নামটা মনে নেই)। তো এই মাইব্রিজ মহোদয়ই খেয়াল করেছেন যে স্থিরছবির একটা সিরিজকে খুবদ্রুত শাটার ফেলে প্রদর্শন করলে সেটা চলমান একটা দৃশ্য হয়ে যায়। সেই থেকে মুভির শুরু, আজ মুভি দেখে মানুষ হাসে, কাঁদে, ভালবাসে, প্রত্যয়ী হয়, আরো কতকিছু। ধন্যবাদ সেইসব গীকদের।
তো, মুভির ব্যাপারে আরেকটা মজার ব্যাপার হলো, এর ভুলগুলো। একই সিকোয়েন্সের সবগুলো দৃশ্য সবসময় একটানে নেয়া হয়না, তো যখন পুরোনো দৃশ্য আবার নেয়া হয়, মুভি এ্যাসিস্ট্যান্টরা যারপরনাই ব্যাস্তব থাকেন যাতে অবিকল আগের সেটটি তৈরী হয়, কিন্তু মানুষ বলে কথা, ভুল থাকবেই। মজার ব্যাপার হলো সবাই সেই ভুলগুলোকে ফ্রেন্ডলি/স্পোর্টিলি নেয়, টিকেটের দাম ফেরত দিতে হবে বলে রাস্তায় বেরোয়না। হলিউডের মুভিগুলোতে এরকম সিকোয়েন্সের ভুলের স্ক্রীনশটওয়ালা ই-মেইলগুলো কমবেশী সবাই পেয়েছেন, মাঝখানে এত বেশী আসত একটু বিরক্ত ছিলাম, ভাবতাম আসলেই দর্শকদের রাস্তায় নামা উচিত, এত এত ভুল করবে আর গাদাগাদা পয়স হাতিয়ে নেবে সেটাতো হয়না, হলোই বা পুঁজিবাদী সমাজ। কিন্তু মানুষ রাস্তায় নামেনা, কারণ যখন সে মুভি উপভোগ করে তখন এই সামান্য ভুলগুলো পুরোপুরি তার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়, কোন সমস্যাই হয়না। কেন হয়না, কারণ মুভি খুব ফাস্ট, এত অল্পসময়ে এসব সুক্ষ্ণভুল ধরা মানুষের পক্ষে সম্ভব না। সত্যি বলতে কি, মুভিতে তো আরও বড় সমস্যাই আছে। মুভি হলো একগাদা স্থিরচি্ত্রকে পরপর দেখানো, খুব দ্রুত। এরকম একগাদা স্থিরচিত্রকে পরপর দেখানো হলে আমাদের কাছে সেটা কন্টিনিউয়াস মনে হয়, কারণ স্থিরচিত্রগুলোর মাঝের অল্পসময়ের গ্যাপটা আমরা ধরতে পারিনা।
অনেকদিন পর্যন্ত এব্যাপারে অনেকেরই ধারনা ছিল (আমার ধারনা এখনও পারসেপশন মেজরের অনেক গবেষক একই ধারনা পোষন করেন) ভুল, অধিকাংশ গবেষকরাই সহজতম ব্যাখ্যাটা বেছে নিয়েছিলেন, বলেছেন, মানুষের মুভি বা টিভির সামনে বসে অর্থাৎ দ্বিমাত্রিক স্ক্রিনে দেখা জগতের পারসেপশন (পারসেপশন হলো সেই মেকানিজম যেটা দিয়ে চোখে ঢোকা দৃশ্য, কানে শোনা শব্দ কে আমরা ইন্টারপ্রিট করে ব্রেইনে পাঠাই), আর রিয়াল লাইফে ত্রিমাত্রিক জগতের পারসেপশন, এই দুটো পারসেপশনের মেকানিজম এক না। সেজন্যই, স্থিরচিত্রগুলোর মাঝের গ্যাপা আমরা লক্ষ্য করিনা, কিন্তু রিয়াল লাইফে আমরা কন্টিনিউয়াস সিন দেখি।
একটু দাঁড়ান!
রিয়াল লাইফে কি আমরা আসলেই কন্টিনিউয়াস সীন দেখি?
এই নিয়ে পরীক্ষা করেছেন কেন্ট স্টেটের লেভিন আর হার্ভার্ডের গবেষক সিমন।
তাঁরা মজার একটি পরীক্ষা করেছেন, যেখানে একগ্রুপ দর্শকদের একটি দৃশ্য দেখানো হয় যেটায়, একজন অভিনেত্রী ফোনরিং শুনে উঠে আসেন, রিসিভার তোলেন আর ফোনে কথা বলা শুরু করেন। দৃশ্যটি যখন ধারন করা হয়, তখন অভিনেত্রীর কথাবলার মাঝপথে একবার 'কাট' করে, তাঁর জায়গায় অন্য একজন অভিনেত্রী অন্য একটি পোশাক পরে ফোনে কথা বলা শুরু করেন।
মুভিটা দেখানোর পর দর্শকদের বলা হয় তারা কোন 'অদ্ভুত' কিছু দেখেছেন কিনা। ৬৬% বলেন, দেখেননি।
আরেকগ্রুপকে আগেই অদ্ভুত কিছু আছে কিনা জিজ্ঞেস করে মুভি দেখতে বলা হলো, তারপর দেখা গেল প্রায় সবাই বুঝতে পারছে কোথায় কি ঝামেলা।
এতো গেল সেলুলয়েডের পর্দায় আমাদের ঝামেলার কথা, এখন রিয়াল লাইফে আসলে কি হয় সেটাও দেখা দরকার। সেজন্যও লেভিন আর সিমন একটা মজার পরীক্ষা করেছেন, তবে সত্যি বলতে কি, পরীক্ষাটা আমার পছন্দ হয়নি। তাও শেয়ার করি; এই পরীক্ষায় ফুটপাতের উপর একজন অভিনেতা র্যান্ডমলি একজন পথচারীকে ধরে 'অমুক জায়গায় কিভাবে যাব?' জিজ্ঞেস করবে, কথাবলতে বলতে ফুটপাতে হাঁটবে। তখন তাদের পাশদিয়ে আরও দুজন অভিনেতা ভারী কিছু নিয়ে ক্রস করে যাবে, ঠিক যে মুহুর্তে তারা পরস্পরকে ক্রস করবে, সেমুহুর্তে কথা বলতে থাকা অভিনেতা আর ভারী জিনিস বয়ে যাওয়া একজন অভিনেতা দ্রুত নিজেদের মাঝে জায়গা বদল করে নেবে। অর্থাৎ, পথচারীর সাথে প্রথমে যে কথা বলছিল, আর পরে জায়গা বদলের যে কথা বলছে, তারা ভিন্ন লোক। ৫০% এর মতো পথচারী ব্যাপারটা টেরই পায়নি। মানে রিয়াল লাইফেও আমরা কন্টিনিউয়াসলি দেখিনা।
এই পরীক্ষাটা আমার এজন্য পছন্দ হয়নি যে হয়ত পথচারী অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল, পথে হাঁটতে হাঁটতে আমরা যখন কথা বলি তখন আমরা সবসময় একে অন্যের দিকে তাকিয়ে কথা বলিনা।
তবে রিয়াল লাইফে যে আমরা আসলেই কন্টিনিউয়াসলি দেখিন, তার আরো সহজ প্রমাণ আছে ...আমাদের চোখের পলক পড়ে আবার চোখ খোলার মাঝে যে সময়টুকু পাই, তা হলো ৮০ মিলিসেকন্ড। এই ৮০ মিলিসেকেন্ড আমাদের চোখে আলো ঢোকেনা, অর্থাৎ রিয়াল লাইফে যদি আমরা কন্টিনিউয়াসলি দেখতাম তাহলে কিছুক্ষণ পরপর আমরা কালো (!) একটা ক্যানভাস দেখতে পেতাম।
এই যে গ্যাপ বা ইনকনসিস্টেন্সী, এটা কেন আমরা ধরতে পারছিনা? সেটা আরেক কাহিনী, আরেকদিন বলব, শুধু এটুকু বলে রাখা যায়, আমাদের নিউরাল সিস্টেম একটা ট্রিক মাস্টার!
আমাদের চোখ-নাক-কান-ত্বক-জিহবার মাধ্যমে যে পরিবেশগত ইনপুটগুলো আমাদের শরীরে ঢোকে, সেগুলোকে নিউরাল সিস্টেম আবার প্রসেস করে, প্রসেসের পর তার অর্থটা আমরা বুঝি। এই প্রসেসিংয়ের সময়ই সে যাবতীয় যাদুকরী কাজগুলো করে, সব প্রত্যঙ্গ গুলোর মাধ্যমে ঢোকা ইনপুটগুলোর মধ্যে একটা সমন্বয় ঘটায়। সেটা নিয়ে গবেষনা চলছে দিনরাত, মজার একটা ব্যাপার বেরিয়ে আসছে, সেটা হলে মানুষের ব্রেইন টাইমকে কিভাবে নিচ্ছে।
সে নিয়ে আবার আলোচনা করা যাবে পরে, আজ শুরু করলাম চোখটিপি দিয়ে, সেটা দিয়েই শেষ করি।
অনেকেই উঠতি বয়েসে চোখটিপি প্র্যাকটিস করেন, এটা সত্যি যে ভাল উইংকারদের আলাদা একটা কদর আছে, বন্ধুদের মাঝেও, মিষ্টি-দুষ্টু মেয়েদের মাঝেও। তো পরামর্শ বা উপদেশ যাই বলুন, সেটা হলো, উইংক প্র্যাকটিস করতে করতে এমন করে ফেলবেননা যেন তা ৮০ মিলিসেকেন্ডের কম সময়েই সেরে ফেলেন! তাহলে নিজেই তালগোল পাকিয়ে ফেলবেন উইংক আর চোখের পলক নিয়ে। উইংক দেয়ার জায়গায় চোখের পলক ফেলে, চোখের পলক ফেলার জায়গায় উইংক করে বিপদে পড়তে পারেন ।
এসব ছাইপাশ কথার চেয়ে যারা পরের পর্ব নিয়ে এখনই আগ্রহ প্রকাশ করছেন, তাদের একটা প্রশ্ন করে রাখি আগাম।
ছোটবেলায় নিশ্চয়ই দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন, অলিম্পিকেও হয়ত দেখেন। আলোর গতি শব্দের চেয়ে বেশি, তার পরেও দৌড় প্রতিযোগিতায় ডেস্টিনেশনের কাছে উজ্জল বাতির ফ্ল্যাশ ব্যবহার না করে, প্রতিযোগীদের পেছনে বিপজ্জনক বন্দুকের গুলী ব্যবহার করা হয় কেন?
মন্তব্য
মজাই লাগল। মানুষের মাথায় যে কত বুদ্ধি!!!
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
সাইকোলজীর ব্যাপারগুলা আসলেই জটিল ,,
এখন আফসোস হচ্ছে কেন এই মেজর নিলামনা !!
ধন্যবাদ, মুর্শেদ
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
শিরোনাম বোধ হয় 'সায়েন্সব্লগ - ০২' হবে!
পড়ে কমেন্ট করবো।
ওহ, ধন্যবাদ শিমুল ,,, ২ হবে
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
হুমমমমমম..
আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
এই এক্সপেরিমেন্টের ওপর ডিসকভারিতে একটা ফীচার দেখেছিলাম, চমৎকার।
ধাঁধার উত্তর সম্ভবত এমন, উজ্জ্বল আলোর ফ্ল্যাশ ও ৮০ মিলিসেকেন্ডের জন্য কেউ একজন মিস করে যেতে পারেন, আর সাধারণত উজ্জ্বল আলো চোখে বেশিক্ষণের জন্য পড়লে মানুষের রিফ্লেক্স অ্যাকশন ধীর হয়ে পড়ে। বন্দুকের গুলির ক্ষেত্রে কান বোঁজার ফাঁকে শব্দ মিস করার ভয় নেই, আর শব্দের পর দৌড় দেয়া অভ্যেস করা সহজ।
চলুক। ভালো লাগছে।
হাঁটুপানির জলদস্যু
চলুক চলুক ... ব্লাইন্ড স্পট ব্যাপারটাও এরকমই। আমাদের দৃশ্যমান অংশের একটা জায়গা আমরা আসলে দেখতে পাইনা। সেটা মস্তিষ্ক fill করে দেয়। এই ব্যাপারটাও মজার। কি কি fill করতে পারে আর কি কি পারে না তা নিয়েও সুন্দর কিছু পরীক্ষা আছে।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
এখন তো চোখের পলক ফেলতেও ভয় লাগছে। যদি উইংক হয়ে যায়!
আরেকটা মজার কথা মনে এলো। আমার পুত্র সেদিন আমাকে জিজ্ঞেস করলো, If you had just one eye, would you be blinking or winking?
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
হা হা হা ,,, জুবায়ের ভাই, আপনার ছেলে কিন্তু কোটি টাকা দামের দার্শনিক প্রশ্ন করেছে ,,,
কেউ একচোখা আচরণ করলে প্রশ্নটা করলে নিশ্চিত ভড়কে যাবে
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
হিমু, ধন্যবাদ ডিসকভারির ফিচারের প্রসঙ্গটা আনার জন্য।
রিফ্লেক্সটা খুব বড় ফ্যাক্টর, আমাদের অডিটরি রিফ্লেক্স ভিজুয়ালের চেয়ে ফাস্ট। সেজন্য বন্দুকের গুলি ব্যবহার হয়।
ফ্ল্যাশের সমস্যাটাও একটা পয়েন্ট।
দিগন্ত, ধন্যবাদ।
ব্লাইন্ড স্পট নিয়ে লিখে ফেলুন একটা লেখা। অপেক্ষায় আছি পড়ার জন্য।
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
নতুন মন্তব্য করুন