ইমার্জেন্সী ড্রিল

জ্বিনের বাদশা এর ছবি
লিখেছেন জ্বিনের বাদশা (তারিখ: শুক্র, ১৪/০৯/২০০৭ - ৯:৫৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সকালে অফিসে এসেই মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল, আজ ইমার্জেন্সী ড্রিল হবে।

পুরো ব্যাপারটাই একটা অভিনয়ের মতো, কতগুলো সিচুয়েশন কল্পনা করে সেই সিচুয়েশনগুলোতে কি করতে হবে তার একটা প্র্যাকটিস করা আর কি! রোজা-রমজানের দিনে সকালে ঢুলতে ঢুলতে অফিসে এসে এসব অভিনয়-টভিনয় কার ভাল লাগে!

পুরো ব্যাপারটা এরকম;
দশটার সময় ঘোষনা দেয়া হবে যে ম্যাগনিচিউড ৭/৮ এর কাছাকাছি একটা ভুমিকম্প হয়েছে, সুতরাং সবাই সতর্ক হয়ে যাও। তারপর আগুন লাগবে কোন একটা জায়গায়, আগুন নেভানো হবে, এবং অফিসের সবাই মিলে লাইন ধরে পার্কিংয়ে চলে যাবে। এভাবে ভুমিকম্প বা আগুন লাগলে সবাইকে সরানো হবে।

এই হলো মোটামুটি সিনারিও। সেটা অফিসের বস্-দের একজন মেইলে জানালেন, সকালে মেইলটা পরেই মেজাজ বিগড়ে গেল। আরে বাবা! এরকম 'মক্' করে কি কিছু হয়? যখন আগুন লাগবে তখন কি আর এরকম অভিনয় করে কাজ হবে? তখন তো সবাই যে যার মতো দৌড়ে পালাবে, চাচা আপন প্রাণ বাঁচা। এরমধ্যে আমার দায়িত্ব হলো আগুন নেভানোর, সেজন্য নাকি আমাকে শুনতে হবে কোথায় আগুন লেগেছে সেটা, তারপর কলিগদেরকে বলতে হবে কোথায় কোথায় আগুন নেভানোর ডাব্বাগুলো আছে, চারপাঁচজন সেই অগ্নিনির্বাপকযন্ত্র পর্যন্ত দৌড়ে গিয়ে সেটাকে বহন করে নিয়ে আসার ভান করবে; তারপর আমরা তিন চারজন যে যে জায়গায় আগুন লেগেছে সেখানে প্রাথমিক ও সাময়িকভাবে আগুন নেভানোর জন্য স্প্রে করব, মোটামুটি একমিনিট।
এই হলো আমার কর্তব্য -- আরে বাবা, কোন মানে হয় এসবের। স্প্রে করাইতে হলে সত্যি সত্যি করাও, একটু সাদা পাউডার ছিটাই এখানে ওখানে; না, খালি অভীনয় করতে হবে!

বুক ফাটে তো মুখ ফোটেনা আমার, কাজেই মনের ভেতরেই গজগজ শুরু করলাম।

ঠিক দশটায় সিলিংয়ের স্পিকারে ঘোষনা এলো
'ম্যাগনিচিউড ৭.৫ এর একটা ভুমিকম্প হয়েছে শিনাগাওয়া এলাকায়, সবাই ডেস্কের নীচে ঢুকে নিরাপদ অবস্থান গ্রহন করুন।'
'ম্যাগনিচিউড ৭.৫ এর একটা ভুমিকম্প হয়েছে শিনাগাওয়া এলাকায়, সবাই ডেস্কের নীচে ঢুকে নিরাপদ অবস্থান গ্রহন করুন।'

দেখলাম টপটপ করে কলিগরা সব ডেস্কের নিচে ঢুকে যাচ্ছে, আমিও ঢুকলাম। পাশের কিউবকলের কলিগ তখন ফোনে কার সাথে কথা বলছিল, কোনভাবে কথা শেষ করে ডেস্কের নীচে ঢুকতে ঢুকতে বলল, 'রিয়াল ভুমিকম্প হইলে তো আজকে গেছিলাম!'

মিনিটখানেক পর ঘোষনা দেয়া হলো যে ভুমিকম্প থেমেছে, সবাই নিজনিজ অফিসে কোথাও আগুন লেগেছে কিনা চেক করুন। উল্লেখ্য, কান টানলে মাথা আসার মতোই ভুমিকম্পের পর আগুন লাগে, এবং ভুমিকম্পের চেয়ে ক্ষতিটা মূলতঃ হয় আগুনের কারনেই।

ঠিক তখনই আমরা পাঁচ জন অফিসরুমের বিভিন্ন জোনে সিলিংয়ে ইনবিল্ট অবস্থায় রাখা স্মোক সেন্সরের দিকে ছুটে গেলাম, পুরোটাই অভিনয়। একজন দৌড়ে এসে বলল টিভিব্লকের ওখানে সেন্সর সিগন্যাল দিচ্ছে, (সাধারণত কান ঝাঁঝালো শব্দ করে) এসব সেন্সর।

সাথে সাথে কন্টাক্টের চার্জে যে ছিল সে কোম্পানীর মেইন অফিসের ডিজাস্টার কন্ট্রোল সেকশনে ফোন করল, যে সিগন্যাল আবিস্কার করল সে লোকাল ফায়ারব্রিগেডে ফোন করল (এটা মক্, সত্যি সত্যি ফোন করলে ফায়ার ব্রিগেড প্যাঁপোঁপ্যাঁপোঁ করতে করতে ছুটে আসত অফিসে, কেলেংকারী হয়ে যেত)।

আমাদের সেকশনের ডিজাস্টার কন্ট্রোল ইন চার্জ ঘোষনা দিলেন যেহেতু আগুন লেগেছে, সবার বের হয়ে যাওয়াই বেটার।

সাথেসাথেই ইভ্যাকুয়েশন প্রসেস ইন চার্জ আর তার সহকারীরা ছুটে গেল চেক করতে যে, যে যে রুটে আমরা সবাই অফিস থেকে বের হবো, সেই রুটটায় আগুন লেগেছে বা কিছু ধসে পড়েছে কিনা।

একই সাথে আমারও পালা, আগুনের সাময়িক নির্বাপন, সবাইকে বললাম অফিসরুমের দুই দরজার পাশে ভেতরে, আর বিল্ডিংয়ের মেইন এন্ট্রান্সের দরজার পাশের বক্সে ফায়ার এক্সটিংগুইসার আছে, তবে যেহেতু এক জায়গায় আগুন লেগেছে একটাতেই হবে। বলে আমি নিজেই হাতের কাছে যে দরজাটা সেটার পাশ থেকে যন্ত্রটা নিয়ে ছুটে গেলাম টিভি ব্লকের দিকে, আগুন নেভানোর অভিনয় করলাম।

এরমধ্যে অফিস মেম্বাররা সবাই একে একে ইভ্যাকুয়েশন ইন চার্জের ইন্স্ট্রাকশন ফলো করে বের হয়ে গেল মেইন এন্ট্রান্সের কাছে, তারপর আমরা যারা ইন চার্জ তারা কেউ ভেতরে বাকী নেই এটা চেক করে বের হয়ে গেলাম।

মেইন এন্ট্রান্সের সেখান থেকে তারপর সবাই পার্কিংয়ে গেলে আবার নাম ডেকে চেক করা হলো সবাই ঠিক আছে কিনা।

পুরো ব্যাপারটি ঘটাতে আমাদের সময় লাগল দশ মিনিটেরও কম, এবং এই প্রথম মাথা পুরো ক্লিয়ার হয়ে গেল যে আগুন-ফাগুন লাগলে কি কি করতে হবে।

সকালের রাগটা মাটি হয়ে গেল, বুঝলাম, আপাতঃদৃষ্টিতে হাস্যকর ধরনের অভিনয় করলেও, কোন জিনিসটা কোথায় আছে, কোন কোন কাজগুলো কে কে করবে, সবকিছুর একটা সুন্দর রিভাইজ হয়ে গেল। মাত্র দশমিনিটে। দিনে দশমিনিটের বেশী সময় মেইল বা ব্রাউজিংয়ে নষ্ট করি। (এখন অবশ্য লাঞ্চ আওয়ারে লিখছি, সাধারনত লাঞ্চ আওয়ারে পোস্ট লিখি (চামহাসি))

মাসে এরকম দশ মিনিট ব্যয় করলে প্রাণ বাঁচে। যদিও আমাদের অফিসে এটা হয় বছরে একবার।

বাংলাদেশের অফিসগুলোতে অফিস বিল্ডিংয়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে এরকম ম্যানুয়াল বানানো উচিত, আর অবশ্যই দুই বা তিনমাসে একবার প্র্যাকটিস। আগুন লাগলে সাধারণত কি করব দিশেহারা হয়েই স্টাম্পিড ঘটে।
সবাই যদি জানে কি কি করতে হবে এবং সেটার প্র্যাকটিস থাকে তবে বিশৃঙ্খলা এড়ানো যায়।

আমি এখন সিরিয়াসলি একটা জেনারেল ম্যানুয়াল বানানোর কথা ভাবছি। এই লাইনের কেউ থাকলে আওয়াজ দিয়েন।

***************************************
আমাদের এই এলাকায় (শিনাগাওয়া@টোকিও) সনির অফিস বিল্ডিং আছে মোট ১২ টি, আজ প্রত্যেক বিল্ডিংয়েই এই 'ইমার্জেন্সী ড্রিল' হয়েছে।

পার্কিংয়ে যখন অফিসের সবাই জড়ো হলাম তখন একজন সবার নাম ডেকে নিশ্চিত করল যে সবাই নিরাপদে বাইরে আসতে পেরেছে। আমরা যখন আবার অফিস বিল্ডিংয়ের দিকে রওয়ানা দিলাম তখনই শুনলাম প্যাঁপোঁপ্যাঁপুঁ প্যাঁপোঁপ্যাঁপুঁ
বাজিয়ে অন্ততঃ পাঁচটা ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ী কাছাকাছি আসছে।

আমি কনফার্ম, অন্য কোন বিল্ডিংয়ের কোন এক আবুল অভিনয় করতে গিয়ে আসলেই লোকাল ফায়ারব্রিগেডে ফোন করে ফেলেছে।


মন্তব্য

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

হা হা হা! হাসি
মজা পাইলাম।
ভ্রাত: পরে ঐ 'আবুল'টার খবর পাইছিলেন?

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

নাহ্, ভ্রাতঃ
তবে আমরা একটু টেনশনে আছি, সত্যি সত্যি কোন আবুল এইটা করলে আজকে নিউজে চইলা যাবে ,,, রীতিমতো কেলেংকারি মন খারাপ
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

দ্রোহী এর ছবি

দারুন অভিজ্ঞতা ভাই!! জটিল মজারতো! পড়েই মনে পড়ে গেল, ছোটবেলায় আমি রান্নাবাটি খেলতাম। ছ্যাক ছ্যাক করে ডালে বাগার দিতাম! সেই ডাল খেয়ে দেখতাম।
হাসি


কি মাঝি? ডরাইলা?

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

হুমম
আমি খেলতাম ক্রিকেট
শূন্যে বল ছুড়তাম, শূন্যেই ব্যাট ঘুরিয়ে ছক্কা ,, বাংলাদেশ জিতত প্রত্যেক ম্যাচেই ,,, বিশাল ব্যবধানে, রকিবুল নাইলে নেহাল সেঙ্চুরী করত হাসি

আহা, সেই দিনগুলা
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

ফায়ার ড্রিল গুলো খুবই জরুরী। এখানে আসার পর পর আগুন নয় পানির স্রোতে সব ভাসাভাসি অবস্থা হয়েছিল। তখনও ট্রেনিং নেয়া হয়নি। সবার দেখাদেখি বাইরে এসেছিলাম। পরে ট্রেনিং নেয়ার পর দেখলাম সব যন্ত্রপাতি চোখের সামনে থাকে তবু আগে চোখে পড়ে না।

তাছাড়া ইভাকুয়্যেশন প্লানও কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

হুমম, মুর্শেদ, আজকে টের পেলাম কতটা জরুরী
কমসেকম, আগুন লাগলে দিশেহারা হবনা, বা সেই মুহূর্তে কোন প্ল্যান করতে হবেনা

বাংলাদেশে গার্মেন্টসগুলোতে ড্রিলিং শুরু করতে পারে
নাকি অলরেডী করা হচ্ছে? তাহলে তো খুবই ভালো

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

তারেক এর ছবি

উঁচু বিল্ডিং এ সবাইরে প্যারাসুট দিলেই হয়, আগুন লাগলেই জানালা দিয়া ঝাঁপ... তারপর যা থাকে কপালে দেঁতো হাসি
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

প্যারাসুটে প্যারাসুটে আকাশপথে জ্যাম চোখ টিপি
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

শামীম এর ছবি

ইন্টারন্যাশনাল ডরমিটরির ৮তলায় থাকতাম। ড্রিলের সময় মূল এলিভেটর/সিড়ি বাদ দিয়ে বিল্ডিং-এর বাইরে আলগা ভাবে লাগানো প্যাচানো টাইপের লোহার সিড়ি দিয়ে নেমে আসাটা শীতকালের ড্রীলে সত্যই খুব বিরক্তিকর ছিল।

ইভাকুয়েশনের পরে বিরাট ক্রেনওয়ালা ট্রাক থেকে ৮তলার বারান্দা থেকে একজনকে নামিয়ে আনছে দৃশ্যটা বেশ উপভোগ্য। তাই পাশের রূমের আহত কে ফায়ার বিগ্রেডের লোকজন যেভাবে ক্রেন লাগিয়ে উদ্ধারের মহড়া দিত সেটা দেখতে বেশ লাগতো।

আর পার্কিং লটে একটা বাক্সে আগুন লাগিয়ে সেটাকে এক্সটিংগুইশার দিয়ে নিভানো (৪/৫ জন সুযোগ পেত)... বেশ পিকনিক পিকনিক ভাব ...

বিরক্তিকর হলেও, সত্যি সত্যি কখনো বিপদে পড়লে এই ড্রিলটা খুবই কার্যকরী ভাবে কাজে লাগতো ... এই ব্যাপারে একমত।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

ওরেব্বাবা ,,, শামীম ভাই, আপনাদেরটা তো অনেক রিয়ালিস্টিক
আমাদেরও ইন্টারন্যাশনাল ডর্মে একবার হেলিকপ্টার পর্যন্ত উড়াইয়া ড্রিল করাইছে (এইসব খাতে ফান্ডের সীমা নাই) ,,, আমি যাইনাই ,,,বারান্দায় বসে সিগারেট টানতে টানতে হেলিকপ্টারের কার্যকলাপ দেখছি ,,,
আজকে প্রথম অংশ নিলাম ,,, ভাল লাগল ,,, প্রয়োজনীয়তাটা বুঝলাম হাসি
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

আরিফ জেবতিক এর ছবি

ড্রিলটা খুব প্রয়োজনীয়।
তবে ফায়ার এক্সটিংগুইশার বা অন্যান্য যন্ত্রপাতির ব্যবহার করেই সেটা করা উচিত,অভিনয় করে নয়।
নয়তো সময় কালে দেখা যাবে সবই হইছে কিন্তু "আবুল" জানে না এক্সটিংগুইশার কেমনে চালু করতে হয়।

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

হা হা হা ,,, আসলেই ,,,ঐ যন্ত্র ব্যবহার করাও এক দিগদারী ব্যাপার
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

এইসব ড্রিলের দিনে বাড়তি ধূমপান-বিরতি পাওয়া যায়। পরপর দুই-তিন-চারটা। হাসি

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।