প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. ম তামিম গতকাল রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে অনুষ্ঠিত সেমিনারে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির আগাম সংবাদ পরিবেশন করেছেন। তার এ আগাম সংবাদের দু’টি অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য আঁচ করা যায়। এক: গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি বিষয়ে জনমনে একটি মানসিক প্রস্তৃতির ক্ষেত্র তৈরি করা। দুই: মূল্যবৃদ্ধি বিষয়ে সম্ভাব্য জনপ্রতিক্রিয়াও যাচাই করা। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জনপ্রতিক্রিয়াটাকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে আমলে না নেয়ার প্রবণতাটাই প্রবল এবং প্রতিষ্ঠিত। আগাম মানসিক প্রস্তুতির ক্ষেত্র সৃষ্টির প্রয়াস হিসেবে জনাব তামিম গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির কার্যকারণটাও ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন, এ মূহূর্তে বিশ্ববাজারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি না করা হলে বাংলাদেশের গ্যাস খাত নিকট ভবিষ্যতে গভীর সংকটে নিমজ্জিত হবে। সুতরাং এ সম্ভাব্য সংকট উত্তরণের সতর্কতা হিসেবে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করা জরুরি।
বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ: ঘটক ও অনুঘটকের ভূমিকায়
আপাত: দৃষ্টিতে মনে হতে পারে দেশ প্রেমের গভীর সমূদ্র থেকে উৎসারিত একটি অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজন থেকে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি সরকারকে ভাবিত করেছে। কিন্ত নিকট ও দূর ইতিহাসের প্রায় সকল উদাহরণ বলে যে, তেল-গ্যাস এর দাম বৃদ্ধির পেছনে সব সময় কলকাঠি নেড়েছে উন্নয়নের কর্পোরেট পরামর্শক বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং এডিবির মতো সংস্থাগুলো। সাহায্য-সন্ত্রাসের নামে নানা শর্ত-উপশর্ত দিয়ে এ কাজগুলো তারা হরহামেশা করেছে এবং করছে। সুতরাং এটিও বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ এর সাহায্য-সন্ত্রাসেরই ধারাবাহিকতা এটি অনুমান করার যথেষ্ঠ কারণ রয়েছে। প্রধান উপদ্ষ্টোর মাননীয় বিশেষ সহাকারী এমন এক সময় গ্যাসের দাম বাড়াবার আগাম সংবাদ দিলেন, যার ঠিক দু’একদিন আগে খবর বেরিয়েছে যে বিশ্বব্যাংক এবার বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় ঋণ সাহায্যের থলে নিয়ে বসে আছে। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের পরামর্শে প্রণীত পিআরএসপি-১ এর মেয়াদ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। সরকার এখন পিআরএসপি-২ ওপর কাজ করছে। কিছু দিনের মধ্যে চুড়ান্ত করা হবে। এ কাছাকাছি ঘটনাগুলোর সাথে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি সংক্রান্ত ঘোষণার সহসমম্পর্ক আঁচ করবার জন্য খুব বেশি ভাবনার প্রয়োজন পড়ে না।
দাম বৃদ্ধির রাজনৈতিক গাণিতিক প্রক্রিয়া
গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সব সময় একটি রাজনৈতিক গাণিতিক ফর্মূলা ব্যবহার করা হয়। এ ফর্মূলাটি ব্যবহার করা হয় দৃশ্যমান প্রভাবটাকে খাট করে দেখাবার জন্য। এ গাণিতিক ফর্মূলায় গ্যাস পরিমাপের ইউনিট প্রতি বৃদ্ধিটা খুব বেশি বড় মনে হয় না। ফলে সেটিই প্রচার করা হয়। যে মূল্যটা বৃদ্ধি করা হয় তা ইউনিট হিসেবে দেখাবার কারণে জনমনে কখনও এ বৃদ্ধির সম্ভাব্য অভিঘাত উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এবং মূল্যস্ফীতিতে কী পড়ে বা পড়তে পারে তা নিয়ে জরুরি ভাবনাটা তৈরি হয় না, বরং মূল্যবৃদ্ধির দৃশ্যমান অভিঘাতটা সহনীয় মনে হয়।
গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সম্ভাব্য অভিঘাত: সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এসএমই খাত
যে কোন দেশের অর্থনীতির একটি মৌল খাত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প। আমাদের মতো দেশের জন্যতো অবশ্যই। বিগত দু’দশকে এ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশটাও খুব খারাপ না। একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী এ খাতে নিয়োজিত রয়েছে। এবং এ বিকাশমান খাতের জন্য আমাদের আমদানী ব্যয় অনেক নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অন্যতম খাত লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং সহ অনেকগুলো খাত তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়ার জন্য গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং গ্যাসের দাম বাড়ার সাথে সাথে তাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। এ উৎপাদন ব্যায় বাড়ার অর্থ হচ্ছে উৎপাদিত পণ্যের দামও বেড়ে যাওয়া। যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হচ্ছে আরেক ধাপ মূল্যস্ফীতি। কিন্তু কথা হচ্ছে এ মূল্যস্ফীতির সাথে তাল মেলাবার মতো ভোক্তা ক্রয় ক্ষমতা বাড়বে কি না? অবশ্যই না। ভোক্তার যদি ক্রয় ক্ষমতা না বাড়ে তাহলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সামগ্রিক উৎপাদন ও বিকাশ প্রক্রিয়ায় মন্দাভাব তৈরি হতে বাধ্য। আর এ মন্দাভাবের হাত ধরে অপক্ষেকৃত দুর্বল পুঁজির ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ঝরে পড়বে। পরিণামে তৈরি হবে বেকারত্ব, কেননা আমাদের শ্রম শক্তির একটি বিপুল অংশ নিয়োজিত রয়েছে এ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে। একই ভাবে এ প্রভাবটা বৃহৎ শিল্পেও পড়বে। পড়তে বাধ্য।
অভিঘাতের জেন্ডার মাত্রিকতা
গত দু’ দশকে যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত বিকশিত হয়েছে তাতে উল্লেখ যোগ্য না হলেও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসবে নারীদের অংশগ্রহণ ক্রমশ বাড়ছে। এখন এ ক্ষেত্রে প্রায় ১০% উদোক্তা নারী। আরও আশার সংবাদ হচ্ছে গতানুগতিক ধারার বাটিক-বুটিক থেকে নারী উদ্যোক্তারা আস্তে আস্তে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং এর মতো শিল্প উদ্যোগের সাথেও যুক্ত হচ্ছে। রাষ্ট্রের শিল্প নীতিমালা, আর্থিক খাতের নেতিবাচক আচরণ এবং সহায়ক নীতিমালার অনুপুস্থিতিতেও নারী উদ্যোক্তারা তাদের সৃজনশীল সম্ভাবনা ইতোমধ্যে রেখেছেন। তথাপি নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে এখনও ঝরে পড়ার হার বেশি এবং তার বিশেষ সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতও রয়েছে। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে অপেক্ষাকৃত দুর্বল (আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণে) নারী উদ্যোক্তাদের ঝরে পড়ার হার আরও বাড়াবে। তাদের টিকে থাকার সংগ্রামটাকে আরও কঠিন করে তুলবে। কারণ উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির সাথে তাদের অনেকেরই তাল মেলানে সম্ভব হবে না।
গ্যাসের দাম বৃদ্ধি: উৎপাদক থেকে ফেলিওয়ালায় রূপান্তরের প্রক্রিয়া
বিশ্বব্যাংক, আইএমফ, এডিবির মতো উন্নয়নের কর্পোরেট সংস্থাগুলো যে আমাদের শিল্পায়ন চায় না, এবং এ না চাওয়াটা তারা নানা উন্নয়ন পরামর্শের মাধ্যমে মৃতসঞ্জীবনী হিসেবে আমাদের পান করায় এটি নতুন করে বলার কিছু নেই। কিন্তু এর সর্বশেষ ফলাফল হচ্ছে আমরা উৎপাদক থেকে ক্রমশ: ফেরিওয়ালায় রূপান্তরিত হবো। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে আমদানী নির্ভর ফেরিওয়ালা অর্থনীতিটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। সে প্রক্রিয়াটা আরও একধাপ শক্তিশালী হবে এই যা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো বন্ধ হয়ে গেলে সে পন্যগুলোও আমাদের অন্য দেশ থেকে আনতে হবে। আমাদের নিজস্ব উৎপাদন কমে যাবে। শুধু ফেরিওয়ালা হিসেবে আমরা সেগুরো ভোগ করবো। ভোগ করতে বাধ্য হবো। একটি উৎপাদমূলক অর্থনীতিকে এ ভাবে ফেরিওয়ালা হিসেবে রূপান্তরের এ আয়োজনটা বন্ধ করা না গেলে আরও দু:সংবাদ অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন